প্রবীর ঘোষ চলে গেলেন।
প্রমীত বসু, ২০০১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রবীর ঘোষ চলে গেলেন।
উনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না। অথচ নিজের অজান্তেই আমাকে এত ঋণী করে দিয়েছিলেন যা এক জীবনে মেটানো অসম্ভব।
সেই কিশোর বয়সে দেখি একজন মানুষ জনে জনে প্রশ্ন করছেন তাদের জীবনে দেখা অলৌকিক ঘটনা সম্বন্ধে, অতি বিনয়ের সাথেই প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছেন যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেই ভেলকি তিনি নিজে তা দেখিয়ে প্রমাণ করবেন অলৌকিক বলে কিছু হয় না। বুক চিতিয়ে সব বাবাজিদের উদ্দেশ্যে ৫০,০০০ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করছেন (সেই নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়) যদি কেউ তাকে অলৌকিক ঘটনায় সন্তুষ্ট করতে পারেন। এক এক করে প্রচলিত অলৌকিক ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি করছেন সকলের সামনে, বুঝিয়ে দিচ্ছেন অন্তর্নিহিত বিজ্ঞান। গ্রামে গঞ্জে ছুটে বেড়াচ্ছেন ভণ্ড বাবাজিদের চক্র ভাঙতে, সাধারণ মানুষকে অবহিত করছেন তাদের জালিয়াতি নিয়ে। সেই থেকে একটা ঘোর লেগে গেছিল মানুষটাকে দেখে।
কপিল দেব, আজাহার, শচিনের সাথে এই মানুষটাও বসে যান হিরোর আসনে। গরমের দুপুরে গোগ্রাসে গিলতে থাকি ওঁর লেখা বইগুলো। এমনও হয়েছে যে একটা সময় স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হব না, বরং প্রবীর ঘোষ হব। সময়ের সাথে, পরিস্হিতির চাপে সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলেও উনি রয়ে গেলেন সেই হিরোর আসনে। তাই উচ্ছ্বাসে ভেসে যাই যখন দেখি সুমন মুখোপাধ্যায় ‘হারবার্ট’এ একটা চরিত্র সৃষ্টি করেছেন অনেকটা প্রবীর ঘোষের আদলে। তাই প্রবীর ঘোষ থেকে যাবেন বাঙালি জীবনের একজন কাল্ট হয়ে। এমন একজন কাল্ট যাঁর কাজকে চট করে কেউ মেলাতে পারবেন না নিজের জীবনের সাথে, কাজের সাথে।
অথচ আজ এই জাতীয় ভণ্ডামির যুগে খুব বুঝতে পারি এখনও যে সংখ্যালঘু শ্রেণী তারকাটা রয়ে গেছে যারা ধর্মের নামে ধ্যাষ্টামোতে পায়ে পা দিয়ে চলে না, বরং এড়িয়ে যায়, প্রতিবাদ করে, খিস্তি দেয়, তাদের অনেকেরই মনে প্রভাব রেখেছেন প্রবীর ঘোষ। অনেকের মনে বিজ্ঞানমনস্কতার বা যুক্তিবাদী হওয়ার বীজ বুনেছেন, অনেক একলব্য তৈরী করেছেন নিজের অজান্তে। ওঁকে দেখে লাগে রহো মুন্নাভাইয়ের একটা সংলাপের কথা মনে পড়ে। গান্ধী নিয়ে পড়াশোনা করা মানুষ তো প্রচুর দেখা যায়, কিন্তু গান্ধীর দর্শনকে এতো সুন্দর করে জীবনে প্রয়োগ কজন করতে পারে। তেমনি বিজ্ঞানী তো প্রচুর আছে, তিনি তাদের মধ্যে অনেকেই আবার বারবেলায় বাড়ি থেকে বেরোয় না, জৈষ্ঠ্য মাসে লাউ খায় না, হাতে একগাদা তাবিজ আর মাদুলি পড়ে ঘুরে বেড়ায়।
প্রবীর ঘোষ বিজ্ঞান নিয়ে আজীবন গান্ধীগিরি করলেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন বিজ্ঞানী আর বিজ্ঞানমনষ্ক সবসময় এক হয় না। তাই শিক্ষক না হয়েও তিনি শিক্ষক, অনেককে ধর্মের অন্ধকূপটা সঠিক সময় চিনিয়ে দিয়ে রয়ে যাবেন তাদের গুরু হয়ে।
প্রণাম নেবেন প্রবীরবাবু।
What we want is to see the child in pursuit of knowledge, and not knowledge in pursuit of the child. – George Bernard Shaw
Add comment