গুরুজী স্মরণে
আবীর (শুভা) ব্যানার্জি, প্রবীর ব্যানার্জী’র (১৯৭৭ মেটালার্জি) স্ত্রী
“আমাকে দাদা বলবি, আমি মাষ্টারমশাই বা গুরুজী কথার ভার নিতে পারিনা, কারণ আমি বিশেষ কিছু জানি না, শুধু জানি গান ভিতর থেকে আসে আর সুর ঈশ্বর প্রদত্ত। ভালোবেসে গান গেয়ে যা”।
এই ছিল তাঁর প্রথম এবং শেষ পর্যন্ত উপদেশ। যাঁর আশ্রয়ে আমি মেয়ে বা মহিলা নয়, একজন মানুষ হতে শিখেছি। যাঁর সঙ্গ পেয়ে বুঝতে শিখেছি,
“কোথাও আলো সূর্য সমান
কোথা চির অমানিশা ”
বুঝতে শিখেছি,
“আমি তো হার মেনেই আছি
দেখি জয় করো কি করে ! ”
বুঝতে শিখেছি ,
” কি সুখে থেকে লোকে দুঃখ ভোলে কেউ বোঝেনা
দুচোখে সাগর আছে জল না ঢেলে কেউ বোঝেনা ”
বুঝতে শিখেছি, বুকের মাঝে বোবা হয়ে থাকে কথার পাহাড় প্রত্যেক মানুষেরই কম বেশি । ভাঙতে গেলে সমাজ ভেঙে পড়ে, তাই যতন করে লালন করা আর প্রতি ক্ষণে নিজেকে খুঁজে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টাকেই বলে জীবন যাপন।
বলছিলাম শ্রী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কথা। জটিলদা’র কথা। যিনি তাঁর স্বরলিপির বইতে প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
— বাবা ও মা, যাঁরা আমাকে পৃথিবীর আলো আঁধার দুই চিনিয়েছিলেন।
ভিন্ন অথচ সাধারণের মধ্যে মিশে থাকা এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।
“ভালো গান, অর্থাৎ ভালো লেখা এবং ভাল সুর উপহার দিয়েছেন বাঙালিকে” বলেছিলেন ওঁর গুরু শ্রী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া প্রায় সর্বত্র সমাদৃত জটিল’দা কে যখন আমি শিক্ষক হিসেবে পাই তখনও আমার ভাল গান বলতে ধারণা নজরুল আর ভজন; কারণ আকাশবাণীতে এই দুই রকমের গানের পরীক্ষাতেই আমি উত্তীর্ণ হয়েছিলাম ছোটবেলায়। রেডিওতে আধুনিক গান শোনার পারমিশন ছিলো না তখন। দশম শ্রেণীতে ওঠার পরে শুনেছি অনুরোধের আসর আর ছায়াছবির গান। বধূয়া আমার চোখে জল এনেছে, এ কোন সকাল, কেউ বলে ফাল্গুন, তোমার সঙ্গে দেখা না হলে, এসব গানের স্রষ্টাকে একেবারে হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলতে পারি এমন দূরত্বে কোনদিন বসতে পারবো এ ছিলো ভাবনার অতীত। কয়েকটা ক্লাস করেই বুঝেছি এতদিন মায়ের ইচ্ছায় গান শিখেছি, এবার শিখবো নিজের ইচ্ছায়। আমার প্রথম প্রেরণা, ভাল গায়িকা আর ভালো মানুষ হয়ে ওঠার।
আমি চিরকালই গানের ব্যাপারে একটু নার্ভাস প্রকৃতির ছিলাম, সবসময়ই মনে হতো ঠিকমতন পারবো তো? প্রথম গানে গলা টলা কেঁপে যেতই যেত। ক্লাসে যখন সবাইকে আলাদা আলাদা করে গান ধরতেন তখন আমি ল্যাজে গোবরে হয়ে যেতাম। দ্বিতীয়বার গাওয়ার সুযোগ তো পাওয়া যেত না। তাই বেশ সংকুচিত হয়েই থাকতাম। জটিল’দা একদিন ক্লাসের পর বসতে বললেন। আমি তো দুরু দুরু বুকে বসে ভাবছি বোধহয় বলবেন, তুই আর আসিস না। তার বদলে বলেছিলেন, “ভুল তো হয়না একটুও, শুধু ভয় পাস বলে গলাটা রাগ করে।“
বলেন, “কার ভয়? আমার না গানের ? তুই তো আমার থেকেও ভাল গাস! যেভাবে অনায়াসে ” মা ” বলে ডাকিস, সেইভাবেই অনায়াসে গান গাওয়ার অভ্যেস করতে হবে বুঝলি? গলায় মধু তোকে ঈশ্বরই দিয়ে পাঠিয়েছেন, এবার তাকে যত্ন করাই তোর কাজ।“
প্রণাম করে চলে এলাম।
মনে আছে পরের ক্লাসে গলা কাঁপেনি।
বাংলা গান কিভাবে গাইতে হয়, গানের কথা ঠিক কিভাবে উচ্চারণ করলে শব্দের নিজস্ব মহিমা গানে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, শিখেছিলাম ওঁনার কাছে। সূক্ষ কাজ এবং তালের বিনা কালয়াতির সাথে প্রয়োগও শিখেছি ওঁনার কাছে। জটিল’দা বলতেন, “গানে গায়ক কি কথা বলতে চাইছে সেটাই যদি না বুঝতে পারা যায় তাহলে গাওয়ার প্রয়োজন কি? অবশ্যই কিছু কিছু কৌশল শিখে নিতে হবে মনের মত গুরুর কাছে। শয়নে স্বপনে গান গাওয়ার ইচ্ছেকে লালন করতে নিয়মিত অভ্যাস প্রয়োজন বৈকি! এ তো এক সপ্তাহ তিন রাত্রের ব্যাপার নয়! অনেক দূরের পথ হাঁটলে তবেই অনেক দুর্লভ দৃশ্য চোখে পড়ে। যারা প্রতিভাবান তারা তুলনামূলক ভাবে জোরে হাঁটবে, এগিয়েই যাবে, এটাই স্বাভাবিক।“
এসব ছিল গানের ফাঁকে ফাঁকে কথার শিক্ষা।
বছর কয়েক আগে একজন যুবক আমার কাছে গান শিখতে এসে বলেছিল ,
“আমার শ্রীকান্ত আচার্য্য’র ‘বধূয়া আমার চোখে জল এনেছে’ গানটা শেখার খুব ইচ্ছে।“
শুনে আমার চোখে জল এসেছিল। এই প্রনম্য মানুষটিকে হয়ত আমাদের প্রজন্মের পরে আর কেউ মনে রাখবে না। তবু জোরগলায় বলতে পারি জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় একটি অধ্যায়, সংরক্ষণ যোগ্য।
চলনে বলনে জীবন ধারণে কোথাও বাহুল্য ছিলনা, মাষ্টারমশাই সুলভ আচরণ তো ছিলই না। দীর্ঘদিন জটিলদা’র সাহচর্যে থেকে শিখেছি, বহিরঙ্গ নয় অন্তরঙ্গে সবুজ হয়ে থাকতে পারলেই প্রকৃত অর্থে বেঁচে নেওয়া যায়।
– গান গাইবি মনের আনন্দে, কোন বাজিমাৎ করতে নয়। এই দুনিয়ায় যা কিছু ভাল তার প্রকাশ আপনিই হয়।
বলতেন আমার গুরুদেব শ্রী জটিলেশ্বর মুখোাধ্যায়।
আর, শিক্ষকের প্রতি সন্মান আর ভাললাগা দুটো মিলিয়ে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠলেই অচিরে ফল পাওয়া যায়।
বলতেন মা।
শিক্ষক স্মরণে এঁদের জানাই আমার শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
Add comment