সাহিত্যিকা

আমার মনের স্মৃতিপটে আবদ্ধ শিক্ষকদের কথা

আমার মনের স্মৃতিপটে আবদ্ধ শিক্ষকদের কথা
কল্যাণ কুমার মিত্র, ১৯৬৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

আমার বাবা পেশায় ডাক্তার ছিলেন, ডাক্তারী পাশ করার পর কয়েক বছর বাদে মুর্শিদাবাদে নশিপুরের রাজার ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেছিলেন। ওখানে একটাই ভালো স্কুল ছিল নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউশন। এই স্কুলে ক্লাস থ্রী থেকে পড়ানো শুরু হয়।

যখনকার কথা লিখছি তখন তখন পাঁচ বছর বয়স থেকে A B C D অ আ ক খ শেখানো হতো। আমরা দুই ভাই এক বোন। আর তখন আমার বয়স পাঁচ, দাদা আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড, ও তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। দাদা ছিলো অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, এনুয়াল পরীক্ষায় পর পর দু বছর ফার্স্ট হয়েছিলো।

অন্যদিকে পড়ায় আমার একদমই মন ছিল না। মা যখন হাজার চেস্টা করেও আমাকে এসব শেখাতে পারলো না, তখন মাস্টার হিসেবে নিযুক্ত হলো বিরিঞ্চি মাস্টার মশাই। প্রথম কয়েকদিন আমাকে ঠিক মতো পড়াতে খুব চেস্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই আমাকে কব্জা করতে পারলেন না। পড়া না পারলে কাণ মুলে দিতেন, চড় থাপ্পড় মারতেন। আর আমারও অদম্য জেদ, কিছুতেই আমি পডবো না।

অবশেষে একদিন উনি একটা চেলা কাঠ সঙ্গে করে আনলেন, পড়া না পারায় সেই চেলা কাঠ দিয়েই আমায় মারতে লাগলেন। আমার আর্তনাদ শুনে মা দৌড়ে এলো, আর অত্যন্ত তিরস্কার করে বিরিঞ্চি মাস্টারকে তাডিয়েই দিলো।

এবার মা আমাকে মন দিয়ে পড়াতে শুরু করলো। আমাকে মাঝে মাঝে ভয় দেখাতো, পড়া না করলে আবার সেই বিরিঞ্চি মাস্টারকে ডেকে আনা হবে। সেই ভয়েই আমি এবার মন দিয়ে পড়াশুনা করতে লাগলাম, আর নবাব বাহাদুর ইনস্টিটিউসানে ক্লাস থ্রী থেকে ফোরে ওঠার ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্টও হয়ে গেলাম। এখন মনে হয় বিরিঞ্চি মাস্টারের হাতে সেই মার না খেলে, বা মা সেই ভয় না দেখালে আমি হয়তো মন দিয়ে পড়াশুনাই করতাম না।

তারপরেই বাবা আমাদের নিয়ে কোলকাতায় চলে এলেন। তখন বছরের মাঝখানে কোনো ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া খুবই মুস্কিল। আমরা দুই ভাই এক অনামী স্কুল চক্রবেড়িয়া হাই স্কুলে গিয়ে ভর্তি হলাম। ক্লাস ফোর থেকে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়েছিলাম।

এই স্কুলের দু’জন শিক্ষকের কথা আজও মনে আছে। একজন দীনবন্ধু ব্যানার্জি স্যার, উনি সাধারণ জ্ঞান পড়াতেন, আর ক্লাসের পড়ানো শেষ করে উনি দরদ দিয়ে সেক্সপীয়ারের সব গল্প বলতেন, হ্যমলেট, ম্যকবেথ, মার্চেন্ট অফ ভেনিস ইত্যাদি, আমাদের মন ভরে যেতো। আরেকজন শিক্ষক ছিলেন সত্যব্রত চক্রবর্তী স্যার, উনি ক্লাস সিক্স আর সেভেনে ইতিহাস পড়াতেন, প্রথমে গল্প বলার মতো করে ইতিহাস পড়াতেন, তারপর ছেলেদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ঢুকে পড়তেন।

এরপরে ক্লাস এইটে আমি এডমিশন টেস্ট দিয়ে বালীগন্জ গভর্ণমেন্ট স্কুলে এসে ভর্তি হলাম। এই স্কুল থেকে প্রতি বছর ম্যট্রিকুলেসান অথবা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় দশজনের মধ্যে অন্তত একজন র‍্যাঙ্ক করতোই।

নতুন ক্লাসে আমরা যে স্যারকে ক্লাস টিচার হিসেবে পেলাম ওনার নাম প্রভাত চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। উনি ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সব ছাত্রকে বাগদেবীর বন্দনার স্ত্রোত্র বলতে অনুরোধ করতেন :
যা কুন্দেন্দু তুষারহার ধবলা
যা শুভ্রবস্ত্রাবৃতা
যা বীণাবরদন্ডমন্ডিত করা
যা শ্বেতপদ্মাশনা।
তারপর সস্নেহে ঘুরে ঘুরে সব ছাত্রদের কাছে আসা শেষ করে পড়াতে শুরু করতেন, আমার মন ভরে যেত।

আমরা জানতাম যে বোর্ডের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেতে হলে অঙ্ক আর এডিসানাল অঙ্কে ভালো নাম্বার মানে লেটার মার্ক পেতেই হবে। আমার মধ্যে এই উদগ্রতা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন অঙ্কের স্যার নবনীধর দাস। কি প্রচন্ড কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন দিতেন। আমরা সবাই জানি তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের আরোহনের প্রশ্ন, কিন্তু উনার বাঁদরটি বাঁশের অগ্রভাগে পৌঁছানোর পরেও একটা বিশেষ গতিতে নীচে নেমে এসেছিল, সেই উঠতে আর নামতে বাঁদরটির কত সময় লেগেছিলো? চৌবাচ্চার অঙ্কে একটা নল দিয়ে বিশেষ গতিতে জল ঢুকবে আর আরেকটা নল দিয়ে বিশেষ গতিতে জল বেরিয়ে যাবে, এইটাই ছাত্ররা জানতো কিন্তু নবনী স্যার দুটো পাইপ দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গতিতে জল ঢোকালেন ও দুটো পাইপ দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গতিতে জল বার করে দিলেন। এরকম ভয়ংকর সব অঙ্ক দিতেন। তবে এটাও সত্যি যে এইসব কঠিন কঠিন যত অঙ্কের মোকাবিলা করেই আমার মধ্যে অঙ্কের ভিত শক্ত হয়েছিল।

আর শিক্ষক হিসেবে যার কথা আজও ভুলি নি তিনি হলেন সংস্কৃত টিচার বাসন্তী মুখোপাধ্যায়। উনি সংস্কৃতে এম এ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে গোল্ড মেডালিস্ট হয়েছিলেন, কিন্তু ওনার কথা বলায় সমস্যা ছিলো, তাই উনি কলেজের প্রফেসারের চাকরীর চেস্টা করেন নি। আমি স্কুলে সংস্কৃত পরীক্ষায় খুব ভালো নাম্বার পেতাম। উনি আমায় বলেছিলেন যে সংস্কৃত পডাবার টোলে আমার চাকরী নিশ্চিত। আর বলেছিলেন স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর সংস্কৃতের প্রশ্নপত্র নিয়ে ওনার সঙ্গে আমি যেন দেখা করি। আমি সেই মতো পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর সংস্কৃতের প্রশ্নপত্র নিয়ে ওনার সঙ্গে দেখাও করলাম, উনি আমার সঠিক উত্তর লেখার তারিফ করছিলেন। হঠাৎ একটা ইংরেজী থেকে সংস্কৃততে অনুবাদ করার আমার উত্তর শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ইংরেজী বাক্যটা ছিল How beautiful is this night, আমি লিখেছিলাম কথম ইদম সুন্দরম রাত্রম। উনি আমায় বলেছিলেন “night হচ্ছে রাত্রি, শব্দটা স্ত্রী লিঙ্গ, উত্তর হবে “কথ ইয়সি সুন্দরী রাত্রি“, বুঝলাম চার নাম্বার কাটা গেল।

প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে আমার অভ্যাস হয়ে দাঁড়ালো কে কিসে হায়েস্ট নাম্বার পেয়েছে সেই খবর জানা। অঙ্ক ও এডিসানাল অঙ্কে লেটার পেলেও আহামরি নাম্বার পাইনি, সংস্কৃতে আমি পেয়েছিলাম ৮৯, খবর নিয়ে জানতে পারলাম উৎপল চ্যটার্জি সংস্কৃত পরীক্ষায় ৯২ নাম্বার পেয়েছে, সংস্কৃত অনুবাদ ভুল না করলে আমিই সেই মেডল পেতাম।

শিক্ষকদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিরিঞ্চি মাস্টার, সত্যব্রত স্যার, দীনবন্ধু স্যার, প্রভাত স্যার, বাসন্তী স্যার, নবনীধর স্যারেদের কথা মনে আসছে। ওনারা আমার পড়াশুনার ভিত এতটাই শক্ত করে দিয়েছিলেন যে আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি।

আমি আজ যেখানে, সেই ভিত ওনারাই তৈরি করে দিয়েছিলেন।

Sahityika Admin

Add comment