সোয়েটার
আবীর ব্যানার্জী, প্রবীর ব্যানার্জী’র (১৯৭৭ মেটালার্জি) স্ত্রী
১
শীত আসবে আসবে সেই ভেবেই আমার মা অনেক আগেই উল কিনে ফেলতেন। বাবার এনে দেওয়া বিলিতি নিটিং এর বই দেখতে শুরু করে দিতেন। তাই শীত শুরু হওয়ার শুরুতেই বাবার গায়ে উঠে যেত নতুন হাফ সোয়েটার। ফুল সোয়েটার বানাতে সময় লাগত বলে সকলের জন্য হাফ- ই বানাতেন।
সময়ের সাথে সাথে আমিও মা হলাম। যত রকমের হাতের কাজ আছে তার মধ্যে উল বোনাকেই ভালোবেসে আয়ত্ত করলাম। চিরকালের ফাঁকিবাজ আমি, সে কে না জানে! সোজা – উল্টো – ঘর ফেলা – ঘর তোলা, এইই তো!
বিয়ের পরে ঘরকন্যা করে আমার তখন অঢেল সময়, কাজেই শুরু হোক উল বোনা। সবার আগে বাবার জন্যই একটা হয়ে যাক। প্রথমটা শেষ করে বুঝলাম মাপে ছোট। পরিয়ে দিলাম হাতের কাছের আমার মানুষ স্বামীটিকে। গলার শেপ নিপুণ হয়নি বটে, তবে আস্ত একখানা সোয়েটার তো হল! আনন্দ আবার আর ধরে না!
স্বামী বললেন, বানাতে থাকো, হাত জমতে যেকোন কাজেই সময় লাগে।
তিনি হলেন জ্ঞান দেওয়ার মাস্টার পিস।
ইতিমধ্যে মেয়ে এল, কাজ বাড়ল। তবু শীতকাল এলে উল বোনাটা বজায় রাখলাম। ছোট্ট মেয়ের জন্য ফটাফট সোয়েটার বানিয়ে ফেলতাম।
জীবনের ছবি সবসময় একরকম তো থাকে না। কাজেই আমারও নানা দিকে বাহিত জীবন আমার উল বোনার অভ্যাসকে কখন যে একপাশে সরিয়ে রাখল সেটা কখনও টেরই পেলাম না। প্রায় সাত বছর কেটে গেল। মেয়ের সাথে নিজেও বড় হলাম নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে। জটিল কুটিল সব সদস্যরাই জীবন জুড়ে বসতে চাইল। মস্তিষ্ক সচেতন হল আগের চেয়ে অনেক বেশি। মেয়ে মানুষ করা আর শ্বাশুড়ি ননদ নিয়ে সংসারটাই বেশি প্রাধান্য পেল উল বোনার চাইতে।
সাত বছর পরে ফিরে এলাম কলকাতায়। আবার বাবার সান্নিধ্য পেলাম। আর হঠাৎ একদিন বুঝতে পারলাম যে বাবা আমার বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন। বাবার জন্য কিছু করতে চাওয়া ব্যাকুল মন সোয়েটার বানানোর জন্য মেতে উঠল।
যেমন ভাবা তেমনকাজ। বাবার জন্য উল কাটায় ঘর তুললাম মায়ের পরামর্শ নিয়ে। তিন সপ্তাহে হাফ সোয়েটার রেডি! ছুটে গেলাম পরের দিন। রোদে বসে আমার ক্ষয়ে যাওয়া বাবা! সোয়েটারটা পরিয়ে দিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক টেনে সোয়েটারটা গায়ের সাথে ভালভাবে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
— বাহ্, এ তো একেবারে নিখুঁত হয়েছে! একটু দেরি হল শুধু।
— দেরি কোথায় বাবা? মাত্র তিন সপ্তাহ নিলাম তো! তোমার জন্য পুরো একশ কুড়ি ঘর নিতে হয়েছে জানো?
বাবা সেই হাসি হাসলেন, যে হাসি মেখে আমি বড় হয়েছি। যে হাসি মুখে বাবা শিখিয়েছিলেন, সবচেয়ে সুন্দর পোশাক হল মুখের হাসি।
পরের দিনই ভোর বেলায় খবর পেলাম বাবা হাসি মুখে মহা সিন্ধুর ওপারে যাত্রা করেছেন।।
ছোট থেকে দেখেছি, বাবা হাত দেখছেন, কুষ্ঠি বিচার করছেন। সেইজন্যই ……..বড় দেরি হয়ে গেল।।
২
বহুদিন ধরে আমার বন্ধু তৃপ্তি সোয়েটার বানাচ্ছিল ওর স্বামীর জন্য। শেষ আর হয় না। স্বভাবে একটু ঢিলে বলেই বোধয়। ওদিকে সমীরদা (বন্ধুর স্বামী) ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন থেকে থেকে
— কি হল? আর কতদিন লাগবে? শীত এসে এবার তো চলেও যাবে!
— যাবে তো যাবে। আমি অত তাড়াহুড়ো করতে পারিনা। এটা ছাড়া কি তোমার কোন সোয়েটার নেই?
— আহা! তা কেন থাকবে না! ওগুলোতে তো আর তোমার হাতের ভালবাসাটা নেই!
— ন্যাকামি হচ্ছে! তুমি যা গায়ে দাও সবটাই কি আমার হাতের বানানো?
এসব কথা আমার উপস্থিতিতে চলছে বলেই উঠে গেলাম চা করার বাহানায়। তিন কাপ চা নিয়ে হাসিমজায় কাটিয়ে দিলাম একটা সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত। সমীরদা আমাকে পৌঁছে দেবেন বলে যখন গাড়ি বের করতে গেলেন, তখন তৃপ্তিকে বললাম,
— সত্যি কিন্তু তুই বড্ড দেরি করছিস। এক কাজ কর, পেছন পার্টটা বরং আমি খানিকটা শুরু করে দি।
— নাআআ! সবটাই আমি বানাবো! তুই যা তো, তোকে অত ভাবতে হবে না।
তৃপ্তি ভাবে, বিবাহোত্তর প্রাপ্তি যেটা প্রায় সকলেই আশা করে, সে তো দিতে পারেনি সমীরকে। তাই বছরে একটা সোয়েটার বুনতে বুনতে নিজের সবটা ভালবাসা উজার করে দিতে চায়। হোক না দেরি !
শীত চলে যাওয়ার মুখে শেষ হল সমীরের সোয়েটার।
— দাও দাও, যে’কটা দিন পারি পরে ফেলি।
সমীরের তর সয়না আর।
— থাক, গরমে আর সোয়েটার পরতে হবে না। পরের বছর পোরো।
— আরে দাও না! একদিন অন্তত নতুন ভালবাসা জড়িয়ে থাকি!
তৃপ্তি কেঁদে ফেলে। সমীর তৃপ্তির চোখের জলের ফোঁটা আঙুলে নিয়ে বলে,
— গাছের ফুল ফোটে আবার ঝরে গিয়ে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তোমার মনের কষ্ট আর বুকের ভালবাসা দিয়ে তৈরি সোয়েটার কখনও ছেড়ে যাবে না। শীত এলেই জড়িয়ে নেব বারবার।
— আবার ন্যাকামী! পরের বছর আবার আরেকটা বানাবো তো!
দুজনেই হেসে ওঠে….
Khub Shundor Lekha