তোমার মোহন রূপে
@ বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আহা সে এক দিন ছিল কত্তা।
ভাইফোঁটা দেওয়া শেষ হলেই হাওয়ায় ধারালো টান। সকালে ঘুম ভাঙতে চায় না, ভোরাই বাতাসে কুঁকড়ে গোল হয়ে, আপাদ মস্তক ঢেকে শুয়ে থাকি মটকা মেরে। মা’র শানানো গলা শোনা যায় “কিইইই? এবার কি পরীক্ষায় বসা হবে না? সাতটা বাজলো এখনো পড়ে পড়ে ঘুম!”
হাই তুলে অনিচ্ছায় চাদরের ওম থেকে উষ্ণ শরীরটা বের করি। মাটিতে পা পড়তেই ঠান্ডায় ছ্যাঁক করে ওঠে। চৌবাচ্চার কনকনে হিম জলে মুখ ধোওয়া, কি কষ্ট কি কষ্ট! গরম দুধের গ্লাস দু’হাতের বেড় দিয়ে ধরে তার ভাপ নেওয়া! আঃ সেই আরামদায়ক তপ্ত স্বাদ তালুর চামড়া ফুঁড়ে ছড়িয়ে যেত সারা শরীর, গরম দুধের স্রোত খাদ্যনালী বেয়ে বুক পেট পুড়িয়ে দিত – কী আরাম! বই হাতে ছাদের সিঁড়িতে রোদে পিঠ দিয়ে পড়তে বসি। ছুটি ফুরোলেই ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা। কত পড়া বাকি রে, শেষ করব কবে! আর সে সময় সন্ধে পেরিয়ে রাত নামলেই চোখে ঘুমের ঢুল। মা দাবাই দিত “চোখে সরষের তেল ঘষে নাও। ন’টাও বাজে নি এখনও। পড়ার বই নিয়ে বসলেই যত ঘুম পায়। গল্পের বই হাতে নিলে তো ঘুমোতে দেখি না।”
একসময় আমাকে রেহাই দিয়ে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে নটায় থামে। মা খেতে ডাকে, হেঁসেল তোলার তাড়া থাকে। খাওয়া শেষ হলেই ঘুম উধাও। ছাদে দাঁড়িয়ে দেখি মাথার ওপর কালপুরুষ, পায়ের তলায় লুব্ধক, তার প্রভুভক্ত কুকুর। আকাশের নীচে এবাড়ি ওবাড়ির ছাদে ছাদে আকাশপ্রদীপ, অন্ধকার অন্তরীক্ষে আলোর ভেলার মত ভেসে রয়েছে। কত্তা গো, এমন ঝকঝকে হিমঝরা আকাশ আর পৃথিবীর ছাদে চাঁদোয়া খাটায় না, এখন। সবাই বলত পূর্বপুরুষেরা নাকি কার্তিক মাসে ঐ আলোর নিশানা চিনে চিনে যার যার বসতবাড়িতে আপনজনেদের দেখে যান। এখন এমনটা বিশ্বাস করি না কত্তা, তখনও বোধহয় করতাম না। কিন্তু কার্তিকের কুয়াশা মাখা রাতে একলা ছাদে দাঁড়িয়ে অদেখা গুরুজনদের সঙ্গে আলাপচারিতা করতে পেলে এখন বড় ভাল লাগত! জীবন যখন ফ্লাডলাইটের আলোয় ভেসে যাওয়া মাঠের মত ধূ ধূ অবারিত নৈর্ব্যক্তিক সর্বজনীন তখন একটা দুটো রূপকথাকে বাঁচিয়ে রাখতে বড় লোভ হয় কত্তা। শুধু আকাশে প্রদীপ আর দেখতে পাই না ।
এমন চলতে চলতে একদিন দেখি ছুটি শেষ, কালই স্কুল খুলবে। দীর্ঘ একমাস পর প্রাণের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, ভাগ করে টিফিন খাওয়া, সুখ দুঃখের গল্প – কি মজা কি মজা। কি ভয় রে কি ভয় – খুলেই পরীক্ষা – সারা ছুটি কিছুই তো পড়লাম না! ভাবতে ভাবতেই দিনে দিনে শীতের কুয়াশা গাঢ় হয়। ভোরে উঠে ছাদের কোলে ভুটানি কম্বলের চাদরে গা ঢেকে পড়তে বসি।
কুয়াশা আবছা লেগে আছে আশেপাশের বাড়ির ছাদে, রেললাইনের ওপারে, সামনের শিমূলগাছটার ডগায়। খোলা ছাতে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ লাগে নাকে। মা চেঁচায় – “হিম পড়ছে, ভেতরে এসে পড়। পরীক্ষার আগে ঠান্ডা লেগে জ্বর বাঁধালে আমি কিন্তু দেখাবো মজা!“
বেলা গড়ালে গলি থেকে হাঁক আসে “জয়নগরের মোয়া, নলেন পয়লা গুড়” – মাথায় ডেকচি বসিয়ে ফেরিওয়ালা যায়। বাজারে বেরোনোর সময় বাবাকে মা বলে – কমলা লেবু উঠেছে কি না দেখো তো। কড়াইশুঁটি এনো।” জানি খাওয়ার সময় ফুলকপি সীম গাজর বীটের তরকারি থাকবে পাতে। বিকেলে মুড়ি মাখা খেলে তেলতেলে মিঠে কড়াইশুঁটি। নয়তো আছে পাটালির টুকরো দিয়ে দুধ রুটি ।
খাটের তলা থেকে সিন্দুকের মত বিশাল মায়ের বিয়ের ট্রাঙ্ক বেরোয়। ডালা খুলতেই ভক করে কর্পূরের গন্ধ। আমি পড়া ফেলে খুঁকে দেখি, কত ভুলে যাওয়া জিনিস বেরোচ্ছে একের পর এক, চিচিং ফাঁকের মত। লাল সালুতে মোড়া লেপ বেরোয়, মায়ের পুরোন রঙিন সিল্কের শাড়ি কেটে বানানো বালাপোষ, সবুজ রঙের খেস, – কোনটা ভোরের দিকে, কোনটা দুপুরে, কোনটা রাত গভীরে – ঠান্ডার তারতম্য বুঝে গায়ে জড়ানোর। বড়ছাদে রোদে দেওয়া হয় – মা বলে “রোদ খাওয়ানো।“ বেরোয় আমাদের ভুলে যাওয়া রংচটা সোয়েটার, গায়ের চাদর, মাফলার। নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার ইস্পেশাল শাল, কার্ডিগান। সবাই মিলে ছাদের ওপর শীতের মিঠে রোদ খায়। ছাদটা যেন রঙিন হয়ে ওঠে।
ইস্কুলে সকালের প্রার্থনা সভায় সংস্কৃত স্তোত্র আওড়াতে আওড়াতে সামনের সারিতে দাঁড়ানো মেয়েদের সোয়েটারের রোঁয়া ছিঁড়ে ছিঁড়ে রঙিন উলের বল বানাই – এটা আমাদের মজার খেলা – শীতকাল স্পেশাল। অনেকে আবার মজাটা ঠিক বোঝে না, রেগে যায়, নালিশ করে। সেলাই দিদিমণি জ্যোতিদি, যিনি আছেন নজরদারির দায়িত্বে – অপরাধী মেয়েদের মাথায় কাঁচির ডগার এক এক আলতো বাড়ি দেন। সেটাও একটা খেলা হয়ে ওঠে। গানের ক্লাসে গীতাদি বেছে বেছে শীতের গান শেখান – ঢিমে কাহারবা তালে “কে রয় ভুলে তোমার মোহন রূপে” বা দ্রুত দাদরা তালে “শীতের হাওয়ার লাগল নাচন”। অর্গান বেজে ওঠে ঝমঝম ঝমঝম।
পরীক্ষা শুরু হয়। শীতের কুয়াশায় চাপা আতংক। উত্তুরে হাওয়ায় টেনশনের তীব্রতা। ভীষণ আনন্দ ও গভীর দুঃখের সাইন কার্ভ কটা দিন । তারপর – ছুটি ছুটি – অনাবিল নিরংকুশ ছুটি। রেজাল্ট না বেরোলে পড়ার কোন কথা নেই। কয়েকটা পেপার গোলমেলে হয়েছে – মনটা খচখচ করে। মনকে বোঝাই – ওরে ব্যাটা গোমূর্খ, পরীক্ষায় লাড্ডু পেলে ঝাড় তো খেতেই হবে। সে যবে হবে তবে হবে। এখন যতদিন না রেজাল্ট বেরোয় হেসে খেলে নে। কান্নার সময় তো অনেক আছে, বরাদ্দ কান্না না কেঁদে যাবি কোথায়।!”
ভবি কিন্তু ভোলার নয়, সে হাসে, খেলে, সার্কাস দেখে, পিকনিক যায় কিন্তু রাত গভীর হলেই, অনিদ্র নয়নে ভাবতে বসে – তিন নম্বর অঙ্কটারতো উত্তর মেলে নি, দশ নম্বরটা তো শেষই হল না। পাশ মার্ক থাকবে তো! চন্তায় চিন্তায় চোখ জ্বালা করে, ভাবে রেজাল্টটা যদি কালই হাতে পাওয়া যেত, এই উদবেগ আর সহ্য হয় না।
তারপর তো অনেক শীত বসন্ত খেলে গেল আমার এই একান্ত নিজস্ব ত্রিপাদ ভূমির ওপর, ব্যস্ত ছিলাম চলা চলতিতে, গুণে গেঁথে রাখি নি আজ্ঞে। এবার শীতে হাতে আমার চৌপর সময়। ধূসর আকাশে চোখ জ্বালা ধোঁয়াশা, কালপুরুষকে তার অস্ত্র শস্ত্র, কোমরবন্ধনী ও প্রভুভক্ত লুব্ধক নিয়েও কেমন ফিকে লাগে, সেই স্বমহিমায় আর জ্বলতে দেখি না। যে দিকে তাকাই ড্রয়ারের মত খোপ খোপ ফ্ল্যাট, চেস্টের মত চৌকো চৌকো ইমারত। তিন বাই পাঁচ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ফালতু ছেঁড়া কথা ভাবি কত্তা আর মাথার মধ্যে ঝমঝম করে সেই স্কুলে শেখা গানের ্লাইন –
“শূণ্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা /তারি লাগি রইনু বসে সকলবেলা।
শীতের পরশ থেকে থেকে/যায় বুঝি ওই ডেকে ডেকে
সব খোয়াবার সময় আমার /হবে কখন কোন সকালে”
তা কত্তা, বলছিলাম কি – সে তো অনেক বছর হয়ে গেল, পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি।
রেজাল্টটা যে এখনও হাতে পেলাম না কত্তা। ক্লাসে ওঠার সময় চলে যাচ্ছে।
এট্টু দেখলে হত না!
@ বন্দনা মিত্র
Very nice and nostalgic. Liked reminiscing the smaller incidents with great depth connecting ordinary events to extraordinary feelings.
বেশ ভালো লেখা।
খুব ভালো মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা