সানতানা’র ডায়েরি থেকে (সরস্বতী ও ভ্যালেন্টাইন)
শান্তনু দে, ১৯৮৯, মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
সত্যি বলছি, কাল রাত্রে মা সরস্বতী স্বপ্নে এসেছিলেন। খুব বকাবকি করলেন।
“তুই যখন ছোট ছিলি, ভাবতাম তোর মাথায় একটু বুদ্ধি শুদ্ধি আছে ,পড়াশোনায় ভাল করে দি। তারপর ক্লাস এইটে পড়ার সময় গান শেখার চেষ্টা করে আমার মটকা এমন গরম করে দিলি যে আমি অভিশাপই দিয়ে দিলাম। পড়াশোনাটা তো আর করতে পারলি না। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, জয়েন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং কোনটাতেই সুবিধে হল না। তারপর চাকরি বাকরি তে ঢুকে দেখলাম তোর মতি ফিরেছে। প্রচুর ভাল ভাল বই পড়ছিস, এমনকি আমার যারা প্রিয় সন্তান… শ্যামল, অতীন, অমিয়ভূষণ, মতি, শক্তি, মণীন্দ্র সবার বইই পড়ছিস, ভাল ভাল গান শুনছিস। ভাবলাম এখন তোকে একটু আশীর্বাদ করি। কিন্তু ওমা, একি… এখন তো একদমই পড়াশোনা করিস না…খালি ফেসবুক , whatsapp, আর নেটফ্লিক্স…”
অনেক করে ক্ষমা চাইলাম…
দেবী একটু নরম হলেন মনে হলো। বললেন, “ঠিক আছে, তবে খবরদার গান গাওয়ার চেষ্টা করবি না।”
29 January 2023
*******
এ বছরের শুরুতেই সরস্বতী পুজো হয়ে গেল, আর তার দিন দুয়েক আগে ছিল ভ্যালেন্টাইন’স ডে। আজকাল শুনতে পাই (কোথায় আর শুনবো, এই ফেসবুকেই পড়ি)…সরস্বতী পুজোই নাকি বাঙালীর ভ্যালেন্টাইন’স ডে।
আমাদের সময় নাকি এই দিনই হলুদ পাঞ্জাবী পরা ছেলেরা, বাসন্তী (হলুদ আর কী) মেয়েদের প্রপোজ করতো, ফুল দিত, প্রেম পত্র দিত বা নিদেন পক্ষে ঝারি অন্তত মারতো। একদমই ভুলভাল ন্যারেটিভ। ক্লাস এইটে পড়তেই, আবার কারোর কারোর ক্লাস সিক্স থেকেই আমাদের সবার স্টেডি গার্লফ্রেন্ড ছিল…কারোর ক্রিস এভার্ট (স্টেফি গ্রাফ বা গাব্রিয়েলা সাবাতিনি তখনও মার্কেটে আসে নি, খুব সম্ভবতঃ তখনো ওরা নিজের নিজের বাড়িতে পুতুল খেলছে, টেনিস racket চোখেও দেখে নি), কারোর নাদিয়া কমেনেচি। আমার এক বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড ছিল টিনা মুনিম।
আমরা এদের জন্য খুবই সিরিয়াস নির্ভরযোগ্য প্রেমিক ছিলাম, কেউ এদের ব্যাপারে কিছু বললেই একদম ক্যালাকেলি লেগে যেত। তবে আমাদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর দিন পাঞ্জাবী পরার চল থাকলেও, হলুদ পাঞ্জাবী কাউকেই পরতে দেখি নি। মেয়েরাও শাড়ি পরলেও, হলুদ শাড়ি? মনে পড়ছে না।
আমাদের কাছে সরস্বতী পুজো ছিল একটা স্বাধীনতা দিবস টাইপের দিন। এই দিনই আমরা ক্লাস এইটে প্রথম সিগারেট খাই, বিয়ার ক্লাস নাইনে আর বাবার প্রসাদ? সেটা বোধ হয় ক্লাস ইলেভেনে। পাড়ার পড়াশোনায় সব থেকে ভালো যে ছেলে থাকতো (এখনকার ভাষায় শর্মাজী কা বেটা), এসব ব্যাপারে সাধারণত তারাই হতো পাইওনিয়ার। সিগারেট খাওয়ার গন্ধ বাড়ি থেকে লুকোতে আমরা পেয়ারা পাতা চিবোতাম, আরো সব কী কী যেন করতাম …কিন্তু ফিফটি পার্সেন্ট কেসেই ধরা পরে যেতাম। যাই হোক, এই দিনের একটা আডভ্যান্টেজ ছিল, ধরা পড়লেও পুজোআচ্চার দিনে রাম ক্যেলানি খাওয়ার চান্স কম থাকতো।
আমরা পাড়ার ছেলেপুলেরা চাঁদা তুলে পুজো করতাম। তখনকার দিনে চার আনা, আট আনা, এক টাকা। একবার এক কাকু দু’টাকা চাঁদা দিয়েছিল। পাড়ার ঠেকে আমরা দু দিন আলোচনা করেছিলাম এই নিয়ে। কেউ কেউ বললো উনি গ্রহান্তরের জীব। হতে পারে, না হওয়ার কিছু নেই। তবে আজকাল শুনি লোকে নাকি চাঁদা দেওয়ার আগে কুজ্ঝটিকা বানান জিজ্ঞেস করে। যে যাই বলুক, এ রকম বোকা বোকা অভিজ্ঞতা আমাদের কিন্তু কোনদিন হয় নি। তা সেই পাড়ার ছোটদের বারোয়ারি পুজোর টি আর পি ছিল খুবই কম। কেউ ঠাকুর দেখতে আসতো না, অঞ্জলি দিতেও না। আমরাই নিজের নিজের বাড়িতে একবার অঞ্জলি দিয়ে, তারপর পাড়ার পুজোয় গিয়ে আবার অঞ্জলি দিতাম। আর আমাদের “স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানগুলো” হতো সন্ধ্যেবেলায় প্যান্ডেলের আশেপাশের আলোআঁধারিতে।
16 February 2023
*******
লক্ষ্মী আর সরস্বতী দুই পিঠোপিঠি বোন। দুই বোনের মধ্যে সম্পর্ক যাকে বলে আদায় -কাঁচকলায়… সিবলিং রাইভ্যালরি আর কী। সরস্বতী একবার পাড়ায় রটিয়ে দিল, লক্ষ্মী নাকি ট্যারা। তাই নিয়ে পাড়ার সব লোক ওর পিছনে লাগে। লক্ষ্মী তো গোসাঘরে দরজা আটকে বসে থাকলো। মা দুর্গা অনেক কষ্টে ভুজুং ভাজুং দিয়ে ম্যানেজ করে দিলেন… “আজ থেকে যত মেয়ে ট্যারা হয়ে জন্মাবে, তাদের কাউকে ট্যারা বলা যাবে না…সবাইকে বলতে হবে লক্ষ্মী-ট্যারা। মানে একটু ট্যারা, যেটা সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
তারপর দুজনে একটু বড় হতেই বাহন সিলেকশনের দিন এলো। সরো তো শিবকে টুপি পরিয়ে বাহনদের মধ্যে যেটা রোলস রয়েস সেই রাজহংস বাগিয়ে বসলো। লক্ষ্মীর ভাগে জুটলো ন্যানো সদৃশ একটা প্যাঁচা। লক্ষী একটু প্রাচীনপন্থী … লাল বেনারসী শাড়ি, সারা গায়ে জবরজং সোনার গয়না। ওদিকে সরস্বতী হেভি স্টাইলিশ …সাদা শাড়ি সঙ্গে ম্যাচিং মুক্তোর গয়না (কুচযুগ শোভিত মুক্তা হারে)। এত কুল বলেই ওঁর পুজোর প্রসাদে কুল মাস্ট। লক্ষ্মী আগে একটু মাছ টাচ খেলেও ইদানিং স্ট্রিক্টলি ভেজ, ওই ভেগান না কী বলে আজকাল। ওদিকে সরস্বতী জোড়া ইলিশ থেকে মাটন বিরিয়ানির পথে।
যাক এখানেই থামি…না হলে আবার অভিশাপ-টাপ দিয়ে দিলে কেলো হয়ে যাবে।
5 February 2023
*******
বইমেলা চলছে।
আমার পাওয়া প্রথম বই …বোধ হয় চার বা পাঁচ বছরের জন্মদিনে, এক কাকীমার দেওয়া ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। গল্পগুলো সবকটাই আমার নিজের ঠাকুরমার কাছে শোনা। সেই গল্পগুলোই আবার পড়তে পেয়ে অদ্ভুত আনন্দ পেয়েছিলাম। বইটা মাথার কাছে রেখে ঘুমোতাম, এটুকু মনে আছে।
একটু বড় হতেই মনপ্রাণ জুড়ে থাকতো আনন্দমেলা, শুকতারা আর কিশোর ভারতী। কিশোর ভারতী-তে রুনু চরিত্র নিয়ে বাংলাদেশের পটভূমিকায় কিছু ধারাবাহিক উপন্যাস বেরিয়েছিল, সম্ভবত শ্যামাদাস দে’র লেখা। সেটাও খুব প্রিয় ছিল। বছর দুয়েক আগে পত্রভারতীর কলেজ স্ট্রিটের দোকানে গিয়ে খোঁজ করলাম। “ওসব আর পাওয়া যায় না “…মালিক বললেন। পরে অবশ্য, গত বছর রুনু সমগ্র বের হয়।
মাসিক আনন্দমেলা যখন প্রথম বেরোয়, আমি তখন ক্লাস থ্রি-তে। বলতে নেই, আমাদের জেনারেশনকে সবচেয়ে বড় উপহার আমাদের দিয়ে গেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী…আনন্দমেলা বের করে, আর টিনটিন আর টারজানের কমিকস ছাড়াও…শীর্ষেন্দু আর সুনীলকে দিয়ে শিশু / কিশোরসাহিত্য সাহিত্য লিখিয়ে। বই মানেই, জন্মদিনের উপহারে যেগুলো পেতাম তার বেশিরভাগই ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কু বা সত্যজিৎ রায়ের গল্প সংকলনগুলি…আর বইমেলা থেকে কেনা অন্যান্য বই-এর সাথে অদ্ভুত সুন্দর রাশিয়ান বইগুলি…সিভকা বুরকা, মাশা, বাবা ইয়াগা….
সেই সময় একটা বই পড়েছিলাম, একটা পেন্সিল আর স্প্যানারের বন্ধুত্বের গল্প। গল্পের অন্তর্নিহিত থিম তখন বুঝিনি। সেটা বোধ হয় লেখকের উদ্দেশ্যও ছিল না। টান টান জমাটি গল্প, অনুবাদ, আর অসম্ভব ভাল ভাল সব ছবি থাকতো বইগুলোতে। ক্লাস এইটে পড়তে, চেকভের ছোটগল্পের ইংরিজি অনুবাদ কিনেছিলাম। ক্লাস নাইনে পুশকিনের নাটকের ইয়া পেরেলম্যানের ফিজিক্স ফর এভরিওয়ান ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে, তখন ইংরিজিতে বই পড়তে একদমই সড়গড় ছিলাম না। মাধ্যমিকের পরের তিন মাস ছুটিতে, অনেক কষ্ট করে পড়েছিলাম। ভাগ্যিস পড়েছিলাম, না হলে বাংলা বই-এর বাইরেও যে এক অধরা, বিপুলা পৃথিবী রয়েছে, সেটা অধরাই থেকে যেত।
এখন সারা বছর ধরে বই কিনি কলেজ স্ট্রিটে, বা এয়ার পোর্টের বইয়ের দোকানে, বা অন্য শহরে গেলে সেখানকার বিখ্যাত দোকান (যেমন ব্যাঙ্গালোরে গেলে ব্লসমস …গত সপ্তাহে ব্লসমস এ ক্র্নিকলস অফ নার্নিয়া সাতটা ভলিউমের কালেকশন 1998 সি এস লিউইস এর বার্থ সেন্টেনারি এডিশন পেলাম। মোটা গ্লসি পেপারে ছাপা অরিজিনাল স্কেচ সহ মাত্র নশো টাকায়। বইটা সবার চোখের সামনে পড়ে ছিল, একদম মিন্ট কন্ডিশন। আমাজন বা বাংলা বই-এর অন লাইন দোকানগুলো থেকে, আপাতত কলেজের ভাই মলয় কুন্ডুর কাছ থেকে। মলয় বইগুলো প্রায় সন্তান স্নেহে প্যাক করে পাঠায়।
সব পড়তে পারি না। আশা রাখি,ভবিষ্যতে কোন এক সময় পড়ে নেব।
9 February 2023
দারুণ, এজ ইউজুয়াল
রম্যরচনা লেখা সহজ নয়।
লেখকের কলমের জোর আছে।
You are an excellent creative writer