সরস্বতী বিদ্যেবতী
রঞ্জন চক্রবর্তী, ১৯৮০ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রতি বছর সরস্বতী পুজোর আগে ক’বছর আগের ঘটনাটা বারবার মনে আসে।
*****
বছর দশেকের কিছু আগের কথা। আমেরিকার নিউ জার্সিতে সরস্বতী পুজোয় আমি আর আমার স্ত্রী শর্মি গেছি। আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু-কাম-ভায়রাভাই ধ্রুব আর শ্যালিকা ঊর্মির ছেলে অরিত্র(গাপ্পা) তখন নিউ জার্সির “রাটগার্স” ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে। ওকেও নিয়ে গেছি পুজোতে। ওদিকে আমার বন্ধু কমল ও তার স্ত্রী সুস্মিতাও এসেছে। কমবেশি মোট শ’দু তিনেক লোক হয়েছে। এখানে সাধারণত কোন স্কুল ভাড়া করে তার বড় হল-এ পুজো হয়। এক পাশে প্রতিমা থাকে। সকাল থেকে দুপুরে পুজো, অঞ্জলি এবং প্রসাদের ব্যবস্থা, মাঝে কয়েক ঘন্টার বিরতি আর তারপর সান্ধ্য অনুষ্ঠান। সরস্বতী পুজোর বাজেট কম, তাই জাঁকজমকও কম। বেশিরভাগ স্থানীয় শিল্পীরাই সান্ধ্য অনুষ্ঠানে নাটক, নাচ, গানে অংশগ্রহন করে থাকেন। তবে ঐ বিরতির সময়ে প্রোজেক্টার-স্ক্রীনের মাধ্যমে বেশ ভালো ভালো বাংলা সিনেমা দেখানো হয়। এখানে সিনেমা হলে তো বাংলা সিনেমা সচরাচর আসেনা এবং সেই কারণে দেখাও হয়না তাই ওটাই একটা বড় আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায় প্রতি বছর। সেই বছরেও তাই।
সকালে পুজো-শেষে অঞ্জলির পরে প্রসাদ খেয়ে সপরিবার, সবান্ধবে মঞ্চের সামনে এসে বসেছি। শুনলাম “কৈলাশে কেলেঙ্কারি” দেখানো হবে। আমরা বেশ গুছিয়ে সামনে থেকে কয়েক সারি ছেড়ে একটু পেছনের দিকে স্ক্রীনের মাঝ বরাবর পাশাপাশি চেয়ারে বসেছি আর গল্পগুজব করছি। ওদিকে প্রোজেক্টার, স্ক্রীন ইত্যাদির সেট-আপ চলছে। আশেপাশে বসে থাকা মানুষদের মধ্যে লক্ষ্য করলাম পুজোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবাই সাজগোজ করেছেন। তার মধ্যে এক সুন্দরী যুবতী আমাদের সামনের চেয়ারে বসে তার ছোট এবং ছটফটে বাচ্চাটিকে সামলাতে বেশ হিমসিম খাচ্ছেন। যাই হোক, সিনেমা কখন শুরু হয় সবাই যখন উন্মুখ হয়ে তার অপেক্ষায় বসে আছি, সেই সময়ে মাইকে ঘোষণা করা হল কোন এক মহিলা তার হাতের সোনার বালাটি হারিয়েছেন। কেউ খুঁজে পেলে যেন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়ে দেন।
কথাটা শুনে আমি আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম “ভীড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে কান থেকে দুল খুলে যেতে শুনেছি। কিন্তু হাত থেকে কব্জি গলিয়ে বালা পড়ে যায় কী করে? আর পড়ে গেলে যার বালা সে জানবেও না?! এই প্রথম শুনলাম কারুর এরকম হল।” কথাটা বোধহয় একটু জোরের সঙ্গেই বলে ফেলেছিলাম। সামনে বসা মহিলা, যিনি এতক্ষণ তার বাচ্চাকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন, আমাদের দিকে ঘুরে কাঁচুমাচু মুখ করে দুঃখের অনুভূতি নিয়ে বললেন “আসলে ঐ স্ক্রু ফিট করা বালা ছিল তো। কখন স্ক্রু খুলে গেছে বুঝতে পারিনি। হয়ত আগে থেকেই লুজ্ ছিল।”
আমি তো একেবারে থ!
ব্যাপারটা যে আমার সামনের মহিলারই হবে আর উনি যে আমার কথাটা শুনতেও পেয়ে যাবেন সেটা আমার মাথাতেই ছিলনা। অসম্ভব অপ্রস্তুতির মধ্যে আড়ষ্টভাব কাটিয়ে উঠতে শুধু মুখ ফুটে “ও আচ্ছা” কথাটুকুই বেরোল।
পাশের সীটে বসা শর্মি তো তখন আমার ধৃষ্টতা আর মূর্খামির জন্য চোখের দৃষ্টি দিয়েই ভষ্ম করে দেয় আর কি। শুধু ফিসফিস করে বলল “কোথায় যে কী বল না! তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না।” গাপ্পা অন্য পাশ থেকে মুচকি হেসে ঐরকম ফিসফিসিয়েই বলল “যা তা কেস একেবারে।” ওপাশে বসে থাকা বন্ধু কমল দেখলাম আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। ভাবলাম আমারই মাথার স্ক্রুটা হয়ত লুজ্, ঐ বালাটার নয়। মনে মনে সেদিন শুধু বলেছিলাম “মা সরস্বতী, মুখফোঁড় না হবার বিদ্যেটা যে কেন দিলেনা”।
নিজের রঙিন দিনের মিষ্টি মুহূর্তের কথা লেখক খুব সুন্দর লিখেছেন
এইজন্যই বলে দেওয়ালেরও কান আছে। সাবধানে চারিদিক দেখে নিয়ে তারপর কথা বলবেন
এইজন্যই বলে দেওয়ালেরও কান আছে।