শিউলাল
তাপস মৌলিক, ১৯৮৯ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
তখন আমার অফিসটা ছিল হাইকোর্টের কাছে একটা আদ্যিকালের বহুতল অফিসবাড়িতে, সেই যেটার একতলায় একবার ইলেকট্রিকের তারের জঙ্গলে শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লেগে গিয়েছিল। ইংরেজ আমলের দালান, কাঠের সিঁড়ি, মান্ধাতার আমলের একটা লিফট, তার ভেতরে টুল পেতে বসে থাকত লিফটম্যান। এক-একটা তলা এতই উঁচু উঁচু যে পাঁচতলায় আমাদের অফিসের ভেতরের অর্ধেক অংশ কাঠের মেঝে দিয়ে ভাগ করে একটা তলার মধ্যেই দুটো ফ্লোর বানিয়ে নেওয়া হয়েছিল, জায়গা বাড়ানোর জন্য।
শিউলাল ছিল সেই অফিসের একজন বেয়ারা। তার দেশ ছিল বিহারের দ্বারভাঙ্গায়। বয়স পঞ্চান্নও হতে পারে, সত্তরও হতে পারে, দেখে কিছু বোঝা যেত না। অফিসের রেকর্ডে এরা যে বয়স দেয় তাতে হামেশাই গোঁজামিল থাকে। এমনও শুনেছি, একই জায়গায় কাজ করে বাপ আর ছেলে, তাদের বয়সের তফাৎ মাত্র দশ! বয়স যাই হোক, অফিসের চার-পাঁচজন বেয়ারার মধ্যে শিউলালই ছিল সবচেয়ে সিনিয়র। বাকিরাও তার দেশেরই লোক, আত্মীয়-কুটুম্ব কিংবা গাঁয়ের চেনাজানা, শিউলালের সূত্রেই তারা একে একে এসে জুটেছিল। শুধু আমাদের অফিসে নয়, ওই অফিসবাড়ির আরও কয়েকটি অফিসে, এমনকি হাই কোর্ট পাড়ার অন্যান্য অফিসেও ছড়িয়ে ছিল শিউলালের গাঁয়ের লোকজন। মাঝে মাঝে সন্ধেবেলা, যখন অফিসপাড়ার ব্যস্ততা একটু কমত, তখন এদের একটা আড্ডা বসত আমাদের বিল্ডিং-এর একতলায়, গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ির সামনে প্রশস্ত জায়গাটায়। সুখদুঃখের কথা আদানপ্রদানের আসর আর-কি! প্রত্যেকেরই মাতৃভাষা মৈথিলি। মৈথিলি ভাষাটা এত মিষ্টি আর শ্রুতিমধুর যে এদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুনতে আমার বেশ লাগত।
শিউলালের কাজ ছিল সবার ফাইফরমাশ খাটা, অফিসের ভেতরেই একটা ছোট্ট ঘরে দফায় দফায় চা বানিয়ে বিস্কুট সহযোগে আমাদের এবং ভিজিটরদের পরিবেশন, সন্ধেবেলা সবার জন্য নিচ থেকে চপ-মুড়ি কিনে আনা – ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সিনিয়র হিসেবে তার একটা বাড়তি দায়িত্ব ছিল, সেটা হল সকালে সবার আগে এসে অফিসের কোলাপসিবল গেটের তালা খোলা এবং সন্ধেবেলা সবাই চলে গেলে ফের গেট বন্ধ করে তালা দেওয়া। সন্ধেবেলা এই গেট বন্ধ করা নিয়ে মাঝে মাঝেই একটু নাটক হত। আমাদের তিন-চারজনের আসল কাজকর্ম শুরুই হত বিকেল পাঁচটায় অফিস আওয়ার শেষ হয়ে যাবার পর। সারাদিন মিটিং, বসের ঘরে ডাক, ভিজিটর আপ্যায়ন, ফোন ধরা ইত্যাদিতে কখন যে সময় চলে যেত টেরই পেতাম না। পাঁচটার পর নিজের ডেস্কে ল্যাপটপের সামনে গ্যাঁট হয়ে বসতাম বাকি পড়ে থাকা কাজকর্ম সামলানোর জন্য। নিচ থেকে আমাদের জন্য মুড়ি-তেলেভাজা এনে সঙ্গে এক কাপ চা দিয়ে শিউলাল চলে যেত তার দেশোয়ালি আড্ডায়। এমনিতে সে ছিল খুবই ভদ্র এবং বিনয়ী স্বভাবের, কখনোই তাকে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। তবে সাড়ে ছ’টা নাগাদ আড্ডা থেকে ফেরার পরই শুরু হত তার ঘ্যানঘ্যানানি। ডেস্কের পাশে একটু দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে মাঝে মাঝেই করুণ গলায় ডাক ছাড়ত, “বা-বু-উ!” অর্থাৎ এবারে আপনার ল্যাপটপ বন্ধ করুন, বাড়ি যান, তাহলে আমিও গেট বন্ধ করে বাড়ি যেতে পারি আর-কি! আমাদের অবশ্য সাতটার আগে কোনোদিনই বেরোনো হত না, মাঝে মাঝে এমনকি রাত আটটাও বেজে যেত, সারা অফিসপাড়া নিঝুম হয়ে যেত। আর শিউলাল প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর সেই করুণ আবেদন করে চলত – “বা-বু-উ!” ওকে ব্যস্ত রাখার জন্য মাঝে মাঝে বলতাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এই হয়ে গেছে, জম্পেশ করে এক কাপ কফি করে আনো দেখি, কফি খেয়েই উঠব।” আশার আলো দেখতে পেয়ে দশ মিনিটের মধ্যে শিউলাল কফি নিয়ে হাজির, কিন্তু তারপর যখন সে দেখত বাবুরা এক কাপ কফি শেষ করতে আধঘন্টা লাগিয়ে দিচ্ছে, ল্যাপটপের ঝাঁপ বন্ধ করার কোনো লক্ষণই নেই, তখন ফের তার শব্দবাণ নিক্ষেপ চালু হত – “বা-বু-উ!” ধুত্তোর বলে বিরক্ত হয়ে একসময় উঠে পড়তে হত তাই। শিউলাল হাঁপ ছেড়ে বাঁচত।
শিউলালের এই ঘ্যানঘ্যানানির অবশ্য যথেষ্ট কারণ ছিল। চা-কফি-বিস্কুটের নিয়মিত সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে বিরক্ত হলেও তাকে বেশি চটাতাম না আমরা, বরং রসেবশে রাখার চেষ্টা করতাম। তার করুণ তাগাদার মাঝেই টুকটাক আলাপচারিতা চালিয়ে যেতাম, জানতে চাইতাম তার ঘরের কথা, দেশের কথা। ঘ্যানঘ্যান করতে করতেই সে সব বৃত্তান্ত শিউলাল জানিয়েছিল আমাদের। সে থাকত চিৎপুরের কোথাও পুরোনো এক বাড়ির একতলায়। মাঝখানে বাঁধানো চাতাল চারপাশে ঘর বাড়িটার পুরো একতলাটাই ভাড়া নিয়েছিল শিউলাল আর কলকাতায় থাকা তার আত্মীয়পরিজন, সংখ্যায় প্রায় পনেরো-ষোলোজন। তাদের মধ্যে পালা করে এক-দু’জন যেত দেশে, উপার্জিত টাকাপয়সা যার যার সংসারে পৌঁছে দেওয়া এবং খেতিবাড়ি দেখভাল করে আসার জন্য। বাকিরা থাকত সেই ভাড়া বাড়ির ছোটো ছোটো পাঁচ-ছ’টা ঘরে গাদাগাদি করে। অবশ্য ঘোর বর্ষার দিনগুলি ছাড়া ঘরগুলি ব্যবহৃত হত কেবল জিনিসপত্র এবং জামাকাপড় রাখার জন্য। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, খাটিয়া পেতে রাত্রের ঘুম এবং শীতকালে আগুন জ্বেলে চারপাশ ঘিরে আড্ডা – সবই চলত মাঝখানের চাতালে। সবার জন্য রাত্রের রান্না সেখানে একসঙ্গে হত, অফিসফেরত শিউলালকে বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে সে সবের তদারক করতে হত। তাই তার বাসায় ফেরার তাড়া স্বাভাবিক।
অনেক কথা জানা গেলেও শিউলালের একটা রহস্য ভেদ করতে আমাদের বেশ খানিক সময় লেগেছিল। হাইকোর্ট পাড়ার ওই অফিসে জয়েন করার কিছুদিনের মধ্যেই লক্ষ করেছিলাম, শিউলালের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটায় ব্যান্ডেজ জড়ানো। ভেবেছিলাম, হয়তো কেটেছড়ে গেছে, কিন্তু তিনমাস পরেও যখন সেই ব্যান্ডেজ যথাস্থানে বহাল দেখলাম, তখন কৌতূহল হল। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কী? কী হয়েছে তার আঙুলে? আমার মতো আরও অনেকেই তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করল। গুরুতর কোনো চোট কি? ডাক্তার দেখিয়েছে শিউলাল? স্পষ্ট কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছিল না শিউলালের কাছ থেকে, কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছিল সে। খুব চাপাচাপি করলে জবাব দিত, “নেহি সাব, অ্যায়সাই, থোড়া সা চোট হ্যায়।” চোট যদি ‘থোড়া সা’-ই হবে তবে সারছে না কেন? রহস্য!
এই সময় ঘটনাচক্রে একদিন আচমকা সেই রহস্যের পর্দা সরে গেল আমাদের চোখের সামনে থেকে। বাড়িতে ছুরি দিয়ে আম কাটতে গিয়ে আমার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটায় বেশ খানিকটা কেটে গেছিল একবার, রক্ত বেরিয়েছিল অনেক, সেলাই পড়েছিল তিনটে, অফিস কামাই হয়েছিল এক দিন। ব্যান্ডেজ বাঁধা আঙুল নিয়ে পরদিন অফিস গেছি, সকালের চা দিতে এসে শিউলাল দেখেই বলে, “বাবু, আপ তো পড়ে-লিখে আদমি হো, আপনে কিঁউ পট্টি লগায়া অঙ্গুঠা মে?”
যাব্বাবা! পড়াশুনো জানার সঙ্গে আঙুলে ব্যান্ডেজ বাঁধার কী সম্পর্ক? আমোদ পেয়ে বললাম শিউলালকে, “তুমনে কিঁউ লগায়া? তুম লগায়া, ইস লিয়ে ম্যায়নে ভি লগায়া।”
সে বলে, “ম্যায় তো আনপড় আদমি হুঁ বাবু। আপনে তো পড়না-লিখনা জানতে হ্যায়, আপ কিঁউ পট্টি লগাওগে? আপকা কৌন সা ডর হ্যায়?”
ডর? ভয়! কীসের ভয়ের কথা বলছে শিউলাল? রহস্য ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল। সকালে সবাই ব্যস্ত, তাই সময় হল না, পার পেয়ে গেল শিউলাল। সন্ধেবেলায় অনেকে মিলে চেপে ধরা হল তাকে। তিন-চার মাস ধরে সে যে আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে রেখেছে, সেটা কি তাহলে কোনো চোটের জন্য নয়? অন্য কোনো কারণ আছে? অবশেষে কথা বেরোল তার পেট থেকে। ফেঁসে গিয়ে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে আমতা আমতা করে বলতে শুরু করল শিউলাল, তার দেহাতি হিন্দিতে। যা জানা গেল তাতে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ।
তিরিশ বছর ধরে সে কলকাতায় রয়েছে, এই অফিসেই কাজ করছে বছর পঁচিশ। গাঁয়ের এক চাচার হাত ধরে যখন পা দিয়েছিল কলকাতায় তখন সে ছিল প্রায় নিঃস্ব। ধীরে ধীরে নিজের রোজগার জমিয়ে গাঁয়ে জমি কিনেছে, ঘর তুলেছে, বিয়ে করেছে। জমিজমাও কিছু কিনেছে তারপর, লোক লাগিয়ে চাষবাস শুরু করেছে তাতে। ছেলে-মেয়ে বড়ো হয়েছে, মেয়ে দুটির বিয়ে দিয়েছে। চার ছেলের দু’জন আছে গাঁয়ে, চাষ-আবাদ দেখাশোনা করে। বাকি দু’জন কলকাতাতেই থাকে। যে ভাড়া বাসায় সে থাকে এখানে, সেখানে তার সঙ্গে তার দুই ছেলে, এক জামাই ছাড়াও থাকে ক’জন ভাইপো ভাগনে এবং অন্যান্য নিকট আত্মীয়স্বজন। মুশকিল হয়েছে, সম্প্রতি ছেলে-জামাইরা তার সম্পত্তি তাদের মধ্যে ভাগ করে দেবার দাবি তুলেছে। জমিজমা, ঘরদোর ছাড়া টাকাও যা সে জমাতে পেরেছে এতদিনে, তাদের গাঁয়ের নিরিখে তা নেহাত কম নয়। কিন্তু, নিজের কষ্টার্জিত সম্পত্তি এখনই ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দেবার ইচ্ছে তার নেই। বুড়ো বয়সে কে দেখে না দেখে, সেই বুঝে দেওয়া যাবে ’খন। ছেলে-জামাইরা অবশ্য অপেক্ষা করতে রাজি নয়। বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেও বিফল হয়ে এখন নানান ফন্দিফিকির আঁটছে সম্পত্তি হস্তগত করার। শিউলাল লেখাপড়া জানে না, নিজের নাম সই করতে পারে না, টিপসই ভরসা। ভাড়া বাসায় রাত্রে বাইরে চাতালে খাটিয়া পেতে ঘুমোতে হয়, সেই সুযোগে কেউ যদি কোনো কাগজে তার টিপসই লাগিয়ে নেয়! বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে তাই সে ব্যান্ডেজ বেঁধে রেখেছে। গাঁয়ের বাড়িতেও বাইরে খাটিয়া পেতে শোয়াই দস্তুর। সেখানে নাকি তার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে একবার এরকম টিপসই নিয়ে নেবার চেষ্টা হয়েছিল। গাঁয়ের এক জ্ঞাতির উপদেশে তারপর থেকে সে এই ব্যবস্থা নিয়েছে তাই। চমকদার ব্যবস্থা, কোনো সন্দেহ নেই তাতে।
তবে শেষরক্ষা করতে নাকি পারেনি শিউলাল। বছর তিনেক হাইকোর্ট পাড়ার সে অফিসে কাজ করার পর আমি অন্য চাকরিতে যোগ দিই। তারও দু-তিন বছর পর হঠাৎই ওই সংস্থার এক পুরোনো সহকর্মীর সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় তার কাছে জানতে পারি, শিউলাল মারা গেছে। রিটায়ার করার আগে জমানো ছুটি নিয়ে গাঁয়ে গেছিল, সেখানেই মারা যায়। তার দেশের লোকেদের কাছে জানা যায়, রাত্রে অভ্যেসমতন বাইরে খাটিয়া পেতে ঘুমিয়েছিল সে, কে বা কারা তার বাঁ হাতের কবজি থেকে পাঞ্জাটা কেটে নিয়ে চলে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শিউলালের মৃত্যু হয়।
এরকম অনেক বাস্তব চরিত্র আমাদের অফিস জীবনে দেখা যায়। এঁরা মোটামুটি নিঃস্বার্থভাবে নিজের সেবা দিয়ে যায়।