সাহিত্যিকা

বিক্কলেজের ভ্যালেন্টাইন ডে

বিক্কলেজের ভ্যালেন্টাইন ডে
অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

কৈশোর যৌবনে ভ্যালেন্টাইন ডে কথাটাই আমরা শুনি নি। যদি বিই কলেজে পড়াকালীন (১৯৭২-৭৭) জানতাম যে ভ্যালেন্টাইন ডে কি বস্তু, তাহলে আমাদের কি হতো? আর আমাদের কলেজের টেলিফোন দাদুরই বা কি অবস্থা হতো?

একটা ভূমিকা দিয়ে রাখি। পরবর্তী প্রজন্মের যারা টেলিফোন দাদুকে দেখো নি, তাঁদের জানাই যে ৭০ এর দশকে গোটা বিই কলেজের ১,২০০ ছাত্রছাত্রীর জন্য ছিলো একটিই মাত্র পাবলিক ফোন। আর আমাদের ফোনদাদু ছিলেন এক বহুল চর্চিত বর্ণময় চরিত্র, যিনি সারাদিন নাতনীদের ফোন রিসিভ করে ছেলেদের হস্টেলে হস্টেলে মেসেজ পৌঁছে দিতেন। সেই নাতনীরা ছিলো উনার এতটাই প্রিয় যে নাতনীদের ফোন এলে আমাদের দাদু সেই ফোন ছাড়তেই চাইতেন না।

গল্পের খাতিরে ধরে নি যে ভ্যালেন্টাইন ডে সেই সময়েও ছিলো। সেই পটভূমিকায় এই গল্প। সব চরিত্রই কাল্পনিক। দুর্ভাগ্যবশত যদি মিল দেখা যায়, সেটা নেহাতই কাকতালীয়।

*******

টেলিফোন দাদুর চিন্তার শেষ নেই। টাক মাথা চুলকেও আজকাল বুদ্ধি আর আসে না। আগে মাথায় যখন চুল ছিলো, তখন বুদ্ধির প্রয়োজন হলেই মাথা চুলকে নিতেন। সে অনেক অতীতের কথা। এখন বয়স হয়েছে। ক্যাম্পাসের ১,২০০ অবাধ্য ছেলেমেয়েকে এই বয়সে সামলানোর টেনশন এখন আর নিতে পারছেন না।

গতবারের ভ্যালেন্তিন দিবসের অভিজ্ঞতা মনে আছে। এবার সামনের সপ্তাহেই ভ্যালান্তিন দিবসে যে উৎপাতগুলো হবে, সেটা তিনি কিভাবে সামলাবেন?

অনেক ভাবনাচিন্তা করে দুর্গানাম জপ করতে করতে ফোনদাদু গেলেন প্রিন্সিপালের অফিসে। সেক্রেটারি হারানবাবু নিয়মমতনই জানতে চাইলেন, কি ব্যাপারে দেখা করতে চান?
“ভ্যালেন্তি দিবস। ও তুমি বুঝবে না।” হারানবাবু চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। একটা বিরাট বিষম খেলেন।
“ভ্যালেন্টাইন ডে? ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার কি করবেন?” হারানবাবু অবাক।
– সে অনেক লম্বা কথা, অনেক ঝামেলা আছে, তুমি সেসব বুঝবে না। আমি সেটা সোজা স্যারকেই বলবো।
হারানবাবু আর কথা বাড়ালেন না। ফোনদাদু প্রিন্সিপালের ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলেন যে সব চেনা লোকেরাই আছেন। দুর্গানাম জপ করে ঘরে ঢুকলেন।

“স্যার, একটা নিবেদন ছিলো। জানি না স্যার, কিভাবে আপনাকে বোঝাবো। বলছিলাম, সামনের সপ্তাহেই তো ভ্যালেন্তিন দিবস। তাই কিছু কথা ছিলো।“
শুধু প্রিন্সিপাল নয়, সেখানে উপস্থিত প্রফেসর তরুণ শীল, প্রফেসর নীলেশ চৌধুরী, উপেন মৌলিক, ভঞ্জ স্যার, আর অন্য যারা ছিলেন সকলেই অবাক। সত্তর বছর বয়সী টেলিফোন দাদু ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে অফিসিয়াল আলোচনা করতে এসেছেন কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে?
“স্যার, বলছিলাম, প্রতিবার ভীষণ গোলমাল হয়। এবারেও সকাল থেকেই বাইরের সারা দুনিয়ার মেয়েরা আমাকে ফোন করবে। আর এছাড়াও…”
প্রিন্সিপাল স্যার দেরী না করে ওখানেই দাদুকে থামিয়ে দিলেন।
– আপনি তো নাতনীদের সাথে রোজই ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেন। আপনার এবিষয়ে প্রচুর সুনামও আছে। এ তো নতুন কিছু নয়।
– না স্যার, ঐদিন অনেক অনেক ফোন আসবে। আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার।
– ফোন এলে আসবে। রোজ একশ’টা ফোন আসে, সেদিন দুশ’টা ফোন আসবে। আপনি রোজ যেভাবে আপনার নাতনীদের সাথে কথা বলেন সেভাবেই সেদিনও কথা বলবেন। এখানে সমস্যা কোথায়?
না, প্রিন্সিপাল স্যার ফোনদাদুর সমস্যা বুঝতেই চাইছেন না।

দাদু চলে গেলে প্রথমেই মুখ খুললেন প্রফেসর তরুণ শীল। “ওফ, গতবারের ভ্যালেন্টাইন ডে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিলো। সকালে উঠেই দেখি আমার কোয়ার্টারের বাইরের সিঁড়িতে সব লাল লাল গোলাপ ফুলের এত্ত পাহাড়। ঠিক যেন কবরখানা। ছেলের দল সব রেখে গেছে। একবার পরিস্কার করি, জঞ্জাল ফেলার জায়গায় ফুলগুলো ফেলে আসি, তো কিছুক্ষণ পরেই দেখি আবার সেই ফুলের পাহাড়। পরে শুনলাম, ঐ জঞ্জাল থেকেই ছেলেরা সেই একই ফুল আবার তুলে নিয়ে এসে আমার বাড়ির সিঁড়িতে রেখে যায়। বোঝো এবার! আমার দুই মেয়ে তো রেগে ফায়ার।”

প্রফেসর চৌধুরীর অভিজ্ঞতা অন্যরকম। “আপনি থাকেন মধুসূদনের বাড়িতে, সেই এক কোনায়। আর আমার কোয়ার্টার রাস্তার উপরেই, একতলায়। গতবার ছেলেরা বাড়ির সামনে সক্কালবেলায় নাচতে নাচতে কীর্তন গেয়েছিলো ইয়ে জিন্দেগী উসি কি হ্যায়, প্যার কিসি সে হো গয়া।  কি সাহস!!”
প্রিন্সিপাল রসিক লোক, “আরে? এটা আমার বিয়ের সময়ের বিখ্যাত গান। আর তুমিও তো তখন কচি বয়সের ছিলে, ঝর্ণা সিনেমায় গিয়ে এই সিনেমাটা অনেকবার দেখেছিলে, সেরকমই তো জানি।“
– হোক সেই সময়ের গান। তাই বলে সক্কাল সক্কাল বাড়ির সামনে কেত্তন গাইবে?

ভঞ্জ স্যারেরও অভিযোগ আছে। “আপনাদের বছরে শুধু একদিন। আমার মেয়ে ম্যাক আর রিচার্ড হলের ছেলেদের থেকে নিয়মিত চিঠি পায়। সোহম নামের একটা ছেলে কবিতা লিখে পাঠায়। হিমাই নামের বদ ছেলেটা হস্টেলের সামনে মোটর বাইক চালায়।“

এবার উপেনবাবু মুখ খুললেন। “আমারও একই সমস্যা।“
– তোমার? তোমার মেয়ের তো স্কুলে যাওয়ারই বয়স হয় নি।
– আমার ক্ষেত্রে মেয়ে নয় স্যার, আমার ভাইঝি’কে গান গেয়ে শোনায়। সেকেন্ড গেট দিয়ে আসতে যেতে “নিম্মি কেমন আছো?” বলে হাঁক মারে। এঁরা কি বয়সের ধার ধারে? নইলে দান্তেবাবুর এই সাত আট বছরের মেয়ে যখন স্কুলে যায়, তখন সাহেবপাড়ার সব ছেলেরা লাইন দিয়ে কেন দাঁড়িয়ে থাকে?
অমলবাবুও জানালেন মেয়ে ঐদিন ঘর থেকে বেরোতেই পারে না।
প্রিন্সিপাল স্যার এতসব জানতেন না। সকলের কথা শুনে বুঝলেন যে, এই ভ্যালেন্টাইন দিনে ছেলেদের মধ্যে উন্মাদনাটা একটু বেশিমাত্রায়ই থাকে।

বাড়িতেও ফোনদাদুর স্ত্রী খেয়াল করেছেন, স্বামী কেমন যেন চিন্তিত, কিছু একটা সমস্যা নিশ্চয় আছে, কিন্তু দাদু কিছুই খুলে বলছেন না। অবশেষে দিদিমার “আমার মাথা খাও” বারবার শুনতে শুনতে বলেই দিলেন নিজের সমস্যার কথা। দিদিমা ভ্যালেন্তি দিবস ব্যাপারটা জানতেন না। সব শুনে উল্টো দশ কথা শুনিয়ে দিলেন। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতি বছর এত বড় একটা পূণ্যতিথি আসে। ঐ দুধের শিশুর ছেলেমেয়েরাও কত নিষ্ঠাভরে সেই তিথি পালন করে অথচ দাদু জীবনে একদিনের জন্যও সেটা পালন করলেন না? দিদিমা ওয়ার্নিং দিয়ে দিলেন, এই বছর তুমি যদি ভ্যালেন্তি দিন পালন না করো, তো তোমার একদিন আর আমারও একদিন হয়ে যাবে।

নির্দিষ্ট দিনে দিদিমা বলে দিয়েছেন, আজকে ভ্যালেন্তি দিন, মনে থাকে যেন। দাদু অন্যদিন ফোনবুথে আটটা নাগাদ চলে আসেন, আজ অনেক সকালে সাতটার আগেই পৌঁছে গিয়ে দেখেন ইতিমধ্যেই লম্বা লাইন পড়ে গেছে। দূর থেকেই বুঝলেন কিছু একটা ঝামেলা চলছে। আজ এসব যে হবে সেটা তিনি আগেই আন্দাজ করেছিলেন।

ব্যাপারটা জটিল। মাঝরাতে কিছু ছেলে ইট পেতে লাইন রেখে গিয়েছিলো, সেই ইটগুলো উধাও। কিছু ছেলে রাত থাকতেই লাইন দিয়েছিলো, কিন্তু ভোরবেলা বেগ আসাতে হস্টেলে গিয়েছিলো, পেট হাল্কা করতে। ইটের লাইন সামলে রাখার জন্য যাদেরকে বলে গিয়েছিলো, তাঁদেরও বেগ আসে, আর তাঁরাও সব নিজেদের পেট হাল্কা করতে হস্টেলে চলে যায়। এরপর ছেলেরা ফিরে এসে দেখে সব গোলমাল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে লাইনে বিরাট বিশৃংখলা, আর ঝামেলা।

একটি মেয়ে এসেছে, দাদু এঁকে তো কলেজে ছোট্টবেলা থেকেই দেখছেন। ক্যাম্পাসেরই কোন স্টাফের মেয়ে নয় তো? নিশ্চয় বাড়ি থেকে ফোন করতে অসুবিধে, তাই এখান থেকে ফোন করতে চায়। তাঁর দাবী, ছেলেদের লাইনে সে দাঁড়াবে না, সবার আগে সেই ফোন করবে। শুনেই ছেলেদের মধ্যে গুঞ্জন। লাইন ভেঙে সবার আগে ফোন করবে, সেটা সমস্যাই নয়। অভিযোগ অন্যরকম। বিই কলেজের হাজার খানেক ছেলের মাঝে কি একজনকেও পাওয়া গেলো না? বিই কলেজে জন্ম, বাবা বিই কলেজের প্রফেসর, মেয়ে নিজেও বিই কলেজেই পড়ে। ও কেন বাইরের ছেলের সাথে প্রেম করে? বিই কলেজে কি ছেলের আকাল পড়েছে?

মেয়েটি হিন্দী ইংরেজিতে মিনিটখানেক প্রেমালাপ করে চলে গেলো। দাদু যাবার সময় বললেন, “আবার এসো। যখনই সময় পাবে চলে এসো।“ সুযোগ পেলেই দাদু কলেজের নাতনীদের বলেন তাঁরা যখনই সময় পাবে, যেন এই ফোনদাদুর কাছে চলে আসে। কিন্তু দরকার ছাড়া কোন মেয়েই আসে না। এখানেই দাদুর দুঃখ।

তিলু চলে যেতেই দিনের প্রথম ফোনটা এলো, অপর প্রান্ত থেকে একটা মিষ্টি গলার আওয়াজ “দাদু, আমি খেয়ালী বলছি, এতবার তোমাকে ফোন করছি, সেই সকাল থেকে।“ রোজ এত এত ফোন আসে, কে যে খেয়ালী, দাদুর মনেই থাকে না। তবে এইসব মিষ্টি আওয়াজে দাদুর সব টেনশন দূর হয়ে যায়, দাদু এক অনাবিল রোমাঞ্চের আনন্দ অনুভব করেন।
“হ্যাঁ, মা, কেমন আছো?” দাদু তাঁর রোজকার নিজস্ব স্টাইলে আলাপ শুরু করে দিলেন।
– দাদু, আজ ভ্যালেন্টাইন ডে দাদু, আই লাভ ইউ দাদু, আই লাভ ইউ, লাভ ইউ।
দাদু রোজই অনেক অনেক ফোন রিসিভ করেন, কিন্তু আই লাভ ইউ? দাদু ঠিক শুনছেন তো? বিশ্বাস হয় না।
– দাদু, লামিকে, মানে ঐ শংখকে একটা খবর দিতে হবে, দাদু। আজ বিকেল চারটের সময় লামি যেন লাইটহাউস সিনেমার বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করে। খবরটা দিয়ে দিও প্লিজ।
দেখো কান্ড! গতকালই তিন তিনটে ফোন এসেছে এই লামির জন্যই। হ্যাঁ, স্পস্ট মনে আছে। একজন বলেছে, আজ দুপুরে হস্টেলে গিফট নিয়ে আসবে, একজন বলেছে লিপিতে দুপুরের শো’তে রাম তেরি গঙ্গা মইলির টিকিট কেটে রাখবে। আরেকজন কি যে বলেছিলো ঠিক মনে আসছে না, তবে সেও সিনেমার কথাই বলছিলো। আর এখন এক মেয়ে খেয়ালীও সেই সিনেমার কথাই বলছে। যাক গে, সে লামিই বুঝবে। দাদুর কাজ মেসেজ দেওয়া, দিয়ে দেবে।

ফোনে কথা শেষ হতেই আবার ফোন বেজে উঠলো। ছেলেরা নিয়ম করে দিয়েছে, যে ইনকামিং পরপর চলবে না। আউটগোইং চালু রাখতে হবে। লাইনে সবার আগে সমীর, ১৫ নম্বর হস্টেলের, ছেলেরা নাম দিয়েছে রমণীরঞ্জন, ছোট করে রমণী। মাঝরাতে এসে লাইন দিয়েছে, সকালে প্রচন্ড বেগ আসা সত্ত্বেও বেগ চেপে রেখে লাইনে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আর বেশিক্ষণ হয়তো চেপে রাখতে পারবে না।
– দাদু, আমি মালদা’র ঝামাগ্রামে ফোন করবো।
– মালদা, চামাগ্রাম, ঝামাগ্রাম। হবে না। হবে না। সে তো এসটিডি করতে হবে। এখানে এসব এসটিডি ফেসটিডি হয় না। অন্য কোথাও যাও।“
দাদু বেশ বিরক্ত। দিনের শুরুতেই তিলু আর এই খেয়ালী মেয়েটা বেশ ভালো মেজাজ এনে দিয়েছিলো, এই ঝামাগ্রামের ছেলেটা এসে সব বরবাদ করে দিলো।
– মালদা হবে না? তাহলে দাদু এই নম্বরটাই লাগিয়ে দিন।
– এটা কোথাকার?
– এটা এখানের, হাওড়ার, শালিমার, ঐ ফোরশোর রোডে।“
দাদু নম্বর লাগিয়ে দিলেন। ছেলেটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে প্রেমের কথা বলছে। লাইনে আরও অনেক ছেলে। দাদু তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, ফোন ছাড়তে হবে। ফোন শেষ করে রমণী আরও একটা কলকাতার নম্বর ধরিয়ে দিতেই এবার লাইনে দাঁড়ানো ছেলেরা হল্লা লাগিয়ে দিলো। একদল বলছে কেউ একটার বেশি ফোন করতে পারবে না। রমণী কাতর অনুরোধ জানলো, যে রাত থাকতেই সে লাইন দিয়েছে, এমনকি সকালে প্রচন্ড বেগ আসা সত্তেও সে লাইনে অবিচল ছিলো। দাদুকে অনুরোধ, আর শুধু একটাই ফোন সে করতে চায়। “দাদু, প্লিজ। আমি আর থাকতে পারছি না। এই ফোন করেই আমি পায়খানা করতে ছুটবো।“ দাদু দেখছেন, ছেলেটা বেগের চাপে ছটফট করছে, কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল।

বাইরে আবার হট্টগোল, অধিকাংশ ছেলেরাই বলছে অন্তত তিনটে ফোন যেন সকলকে করতে দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ চারটে পাঁচটা ফোনের অধিকারও দাবী করছে। সব শুনে দাদু নিয়ম করে দিলেন, কেউ দুটোর বেশি পরপর আউটগোইং ফোন করতে পারবে না। মাঝে দুটো ইনকামিং স্লট রাখতে হবে। দেখা গেল যে অনেকেই আছে যারা ফোন করবে না, শুধু ইনকামিং এর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। দাদু তাঁদের একটা আলাদা জোনে ভাগ করে দিলেন।

ইতিমধ্যে স্টুডেন্ট ক্যান্টিন থেকে চা, সিগারেট, শিঙ্গাড়া, লুচি তরকারীর স্টল এসে গেছে। যারা কার্ড বা চিঠি দিতে চায় তাঁদের জন্য জানা’দা সস্তা দামের গ্রীটিংস কার্ড, আর দশ পয়সার পোস্টেজ স্ট্যাম্প নিয়ে এসেছেন। ইউনিয়নের ছাত্রদরদী সেক্রেটারিই এসব ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।

সবে মিনিট পনেরো হয়েছে, এরই মধ্যে দাদুর পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। খেয়ালীর সাথে কথা বলে সুন্দর শুরু হয়েছিলো দিনটা। কিন্তু এই বদ ছেলের দল মেজাজটাই বিগড়ে দিলো। দাদু উঁকি মেরে বাইরের লাইন দেখলেন। আন্দাজ শ’খানেক ছেলে, ধীরে ধীরে আরও আসবে। মানে সারাটা দিনই বরবাদ।

এবার একটা ইনকামিং ফোন এলো। সুন্দর মিস্টি গলা। “দাদু, আমি নুপুর, কেমন আছো?”
এই “তুমি” সম্বোধন দাদুর খুব ভালো লাগে। যেন নিজের আপন লোক। আপনি আপনি বলে ডাকলে দাদুর মেয়েটাকে কেমন যেন দূরের লোক মনে হয়।
“ভালো আছি দাদু, তুমি কেমন আছো?”
বাইরে প্রতিবাদ, “দাদু, সময় কম, কথা কম। কাজের কথায় আসুন। শুধু মেসেজটা নিয়ে নিন।“
দাদুর ইচ্ছে ছিলো আরও কিছুক্ষন মেয়েটির সাথে কথা বলেন। বদ ছেলেদের জ্বালায় মেয়েটার সাথে দু’দন্ড কথা বলে যে আনন্দ পাবেন, সেই যো নেই।
– দাদু, তোমাদের বারো নম্বর হস্টেলে উত্তম থাকে, তবে তুমি ঐ নামে ওঁকে খুঁজে পাবে না। ভোগী বা নারদ নামেই ছেলেরা ওঁকে চেনে। আমাকে বলেছিলো, আজকের দিনের জন্য সুলা রাসা সিরাজ প্রেজেন্ট করতে। আমি বাজারে গিয়ে দেখি, ওটা একটা ওয়াইন, মানে মদ। আমি বুঝতে পারছি না দাদু, ও কি আমার থেকে মদের বোতল গিফট চেয়েছে? তুমি একটু ওকে বলবে? যেন আমায় ফোন করে? প্লিজ দাদু।
এই “প্লিজ” কথাটায় এত মধু ঝরে পড়ে যে দাদু আর না করতে পারেন না।
– শোনো মেয়ে। যদি মদ হয়, বিনা দ্বিধায় দিয়ে যাও। এখনের মডার্ন মেয়েরা বয়ফ্রেন্ডদের মদ, গাঁজা, চরস এসবই প্রেজেন্ট করে।
– ঠিক আছে দাদু, আমি এক বোতল রেড ওয়াইন নিয়ে আসছি।
– না গো না। এক বোতলে ওঁদের হবে না। কম করেও চার পাঁচ বোতল নিয়ে এসো। ওঁদের হস্টেলে আরও অনেক মদ খাওয়া ছেলে আছে, এক বোতলে ওঁদের হবে না।
লাইন ছেড়ে দিতেই খেয়াল হলো, এই যাঃ, ওঁকে তো বলা হলো না যে আমার সাথে এসে যেন দেখা করে!!

দাদু ভাবেন, কি যে দিনকাল এলো! গতকালই একটা স্কুলে পড়া মেয়ে সাত নম্বর হস্টেলের শৈবাল নামের একটা ছেলেকে একগাদা সিগারেট উপহার দিয়ে গেছে। ছেলেটা সিগারেট খায়, কিন্তু বাড়ি থেকে যে টাকা আনে, সেই বাজেটে কুলোয় না, তাই মেয়েটা ভালোবেসে নিয়মিত সিগারেট উপহার দেয়। দাদু ভেবে কুলকিনারা পান না। স্কুলে পড়া মেয়ে তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে ভ্যালেন্তি দিবসে সিগারেট, মদ উপহার দেয়?

এবার একটা ছেলের ফোন। দাদু বিরক্ত, ছেলেদের ফোন একদমই পছন্দ করেন না। “দাদু, আমি সুকান্ত বলছি।”
– হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি বলো, বাইরে লম্বা লাইন।
– কেমন আছেন দাদু?
– বাইরে লম্বা লাইন, তাড়াতাড়ি কাজের কথা বলো।
– দাদু, লেডিজ হস্টেলে অঞ্জনাকে একটা মেসেজ দিতে হবে।
দাদু রেগে যাচ্ছেন। কে এক মর্কট সুকান্ত, কাজের কথা না বলে অযথা সময় নষ্ট করছে।
– দাদু, অঞ্জনাকে বলবেন, আমি আজ সিউড়ি’তে আটকে গেছি, বিকেলে কলেজ যাচ্ছি। লেডিজ হস্টেলের নীচে অপেক্ষা করবো।
– ঠিক আছে, বলে দেবো।
– দাদু, প্লিজ ভুলে যাবেন না।
– কি মুস্কিল। আরে বলছি তো, বলে দেবো। ফোন ছাড়ো, বাইরে লম্বা লাইন।
– এই সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ। মানে এই পাঁচ দশ মিনিট দেরি হতে পারে।
– বলে দেবো, এবার ফোন ছাড়ো।
– ঠিক আছে দাদু, আপনি ভালো আছেন তো?
দাদু ফোনের লাইন কেটে দিলেন। সুকান্ত ছেলেটা দাদুর মেজাজটাই বিগড়ে দিলো।

আজকে দাদু সত্যিই ব্যাস্ত। লাইন দিয়ে এরকম দাঁড়ানো প্রতি বছরই একদিন হয়। এবার যেন আরও বেশি। তার উপর এবছর সিকিউরিটির লোকেরা সব অচেনা মেয়েদের দাদুর কাছেই পাঠিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে রকমারি সব গিফটও আসছে। কেউ আনছে ফুলের তোড়া, অনেকেই আনছে মদের বোতল। অনেকের গিফট প্যাকেটে মোড়া, বোঝা যায় না ভেতরে কি আছে। শুনেছেন গতবার ময়ূখ নামে এক ছেলেকে ওর পুরুলিয়া জেলা স্কুলের গার্লফ্রেন্ড নাকি গিফট প্যাকে গাঁজার সরঞ্জাম পাঠিয়েছিলো। মেয়েটি ময়ুখকে এত ভালোবাসে যে ময়ুখের কোন ইচ্ছাই সে অপূর্ণ রাখে না। দাদু ভাবেন আর অবাক হয়ে যান। আজকালের মেয়েরা ছেলেদের এতটাই ভালোবাসে যে মদের বোতল, গাঁজা এইসব উপহার দেওয়ার প্রথাও চালু করে দিয়েছে?

ফোনের আসর চলছে। ছেলেমেয়েরা আসছে, যাচ্ছে। একটি বেশ স্মার্ট, মডার্ণ মেয়ে এগিয়ে এসে দাদুকে বললো “হোয়ার ইজ শ্যাঙ্গুপ্তা হল, দাদু?”
ইংরেজি শুনে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও দাদু নিজেকে সামলে নিলেন। বুঝলেন বাইরের মেয়ে। দাদু খুশী, একের পর এক নাতনীরা আসছে। এঁদের অনেকের সাথেই আগে ফোনে অনেক কথা হয়েছে। সামনাসামনি এই প্রথম। দাদুর মন খুব প্রফুল্ল। খুবই মিঠে গলায় প্রশ্ন করলেন “কোন হল?
– শ্যাঙ্গুপ্তা হল
দাদু কিছুই বুঝলেন না। পাস থেকে একজন আওয়াজ দিলো, “দাদু সেনগুপ্ত হস্টেলের কথা বলছে।“
– তাই বলো, সেনগুপ্ত হল। কার জন্য এসেছো? তোমার চেনাজানা কেউ আছে ওখানে?
– ও, ইয়েস। আমি স্যুকান্ট কে মিট করতে চাই। কিছু গিফট এনেছি ফর হিম।
দাদুর কেমন যেন সন্দেহ হলো। “তুমি কি সিউড়ি শহরের সুকান্তের কথা বলছো?”
পিছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, সে এগিয়ে এলো। “এক্সকিউজ মি, তুমি সুকান্তকে চেনো?”
– অফ কোর্স চিনি। হিলেকটোনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইন্যাল ইয়ার, শ্যাঙ্গুপ্তে থাকে।
– না, তুমি চেনো না। ও সিউড়ি নয়, বালিগঞ্জে থাকে। আমি তো ওকে পনেরো নম্বর হস্টেলের দিন থেকে চিনি, আমি অনেকবার হস্টেলে ওঁর রুমে এসেছি।
– শো হোয়াট? ও পাশ করে গেলেই বলেছে আমাকে ডারজিলিন, ডীগা, সান্টীনিকেটন নিয়ে যাবে।
– দীঘা? শান্তিনিকেতন? ব্যাস? ও কিন্তু আমাকে বলেছে সিমলা, গোয়া নিয়ে যাবে। থ্রি নাইটস ফোর ডেজ প্রোগ্রাম।“
আশেপাশের জনতার মাঝে একটু মৃদু গুঞ্জন উঠলো। সুকান্তকে ওরা সবাই চেনে। ক্যালিবাজ ছেলে। তাই বলে এখন থেকেই থ্রি নাইটস ফোর ডেজ আউটডোর প্রোগ্রাম? সাধারণ ছেলেদের ক্যালি লাইটহাউস, মেট্রো, অলকা, মায়াপুরী, ভিক্টোরিয়া, ব্যাস ঐ পর্যন্তই। এর উপরের গ্রেডের ছেলেদের জন্য গার্ডেন বারের মদ, গাঁজা। কিন্তু সুকান্ত এখন কলেজে থাকতেই থ্রি নাইটস ফোর ডেজ প্রোগ্রাম সেট করছে।

দাদু ভাবছেন, এই সুকান্ত প্রায়ই ফোন করতে আসে। দিন দুয়েক আগেই ফোনে কাকে যেন বলছিলো মেয়েটি যেন পাসপোর্ট রেডি রাখে। ব্যাংকক নিয়ে যাবে। এখন অন্য দুটি মেয়ে বলছে দীঘা, সিমলা, গোয়া। আবার খানিক আগে ফোনে বলেছে সন্ধ্যাবেলায় অঞ্জনার সাথে দেখা করবে।
না, ফোনদাদুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

ইতিমধ্যে আরেকটা ইনকামিং ফোন। একটি মেয়ে করছে। “দাদু, ভালো আছো? আমি একটূ তাড়াতাড়িতে আছি। সেনগুপ্ত হলের সুকান্তকে একটা খবর দিতে হবে।“
– সুকান্ত, সেনগুপ্ত হলের? শোনো মেয়ে, তুমি কিন্তু পাঁচ নম্বরে আছো।
– পাঁচ নম্বর? মানে?
– মানে, তোমার পাসপোর্ট আছে?
– হ্যাঁ, আছে তো। সুকান্তই করিয়ে দিয়েছে। ও পাশ করলেই আমরা ইউরোপ বেড়াতে যাবো। সেরকমই আমাদের প্ল্যান আছে।“

না। দাদু আর নিতে পারছেন না। উনি জেনেছেন, এইসব কাজকম্মোকে আধুনিক বাঙ্লায় বলে মাল নামানো। যাই হোক, কে কোথায় কি মাল নামাচ্চে, দাদুর জানার কি দরকার? দাদুর কাজ খবর পৌঁছে দেওয়া, আজকে যে সব গিফট আসছে, সেগুলো পৌঁছে দেওয়া, তিনি শুধু তাই করবেন। আবার মাঝে মাঝেই হতাশায় ভুগছেন। উনি কেন কলেজজীবনে এরকম ভাগ্য নিয়ে জন্মান নি?

এভাবেই সারাটা দিন কেটে গেলো। কতজন যে আজ তিনটে, চারটে, পাঁচটা করে ফোন করেছে। আর কতজনের জন্য যে চারটে, পাঁচটা করে ইনকামিং ফোন এসেছে, তাঁর হিসাব করা মুস্কিল। তাঁর উপর পাহাড়প্রমাণ ফুল, আর কতরকমের যে গিফট। আরও জানলেন, এই যুগের ছেলেরা কিরকম সব মাল নামায়।

এবার ঘরে ফিরতে হবে। দাদু সমস্ত গিফট হস্টেলের ছেলেদের কাছে পাঠান নি, কিছু নিজের জন্য লুকিয়ে রেখে দিয়েছেন, যদিও জানেন না, প্যাকেটের ভেতর কি আছে। দিনের শেষে রিক্সা ডেকে ঐ লুকিয়ে রাখা গিফট নিয়ে বাড়ি চললেন।

ফুল আর গিফট প্যাক পেয়ে দিদিমা খুব খুশি। ফুলগুলো সাজিয়ে রেখে, এক এক করে প্যাক খুলছেন। বেশিরভাগই মদের বোতল, আর আছে সুগন্ধি পারফিউম, দামী পেন, এইসব। দামী পেন মনে হয় পড়াশুনায় ভালো ছেলেদের জন্য মেয়েরা পাঠিয়েছিলো।
– চলো গিন্নি, আজকের সন্ধ্যায় আমরা একসাথে ওয়াইন খাই। যাও, গেলাস নিয়ে এসো।
দিদিমা রান্নাঘর থেকে গেলাস নিয়ে এলেন।
– আরে, আরে স্টিলের গেলাস নয়। স্টিলের গেলাসে কেউ ওয়াইন খায় না। কাঁচের গেলাস নিয়ে এসো।
দুটি কাঁচের গেলাসে ওয়াইন খেতে খেতে দিদিমা দাদুর গলা জড়িয়ে সোহাগ করে বললেন “হ্যাঁ গো, এই ভ্যালেন্তি তিথিটা কি বছরে একবারই আসে? পুন্নিমে অমাবস্যার মতন প্রতি মাসে আসতে পারে না?”

Sahityika Admin

8 comments

  • সুন্দর মজার ও নস্টালজিক! ভালো লাগলো অসীম দেব এর রম্য রচনা!

    সুকৃৎ বসু
    ১৯৬৮-৭৩

  • খোরাক আর মজাদার।
    এরকম আরও অনেক চাই।

  • বিই কলেজের খোরাকি দিনগুলো মনে পড়ে গেলো, টেলিফোন দাদু, কি বর্ণময় চরিত্র ছিলেন!!

  • অসাধারণ লেখা, কিছু কিছু চরিত্র আমাদের চারপাশেই দেখা যায়

  • অসীম লেখাটা খুব উপভোগ করলাম। বিশেষ করে ফোনদাদুর অনেক ঘটনা পড়ে অনেক কথা মনে পড়ে গেল। তবে সবচেয়ে উপভোগ করলাম তোর ভ্যালেন্টাইন ” তিলুর” কথা পড়ে।ওকে গল্পটা পাঠালি? কলেজ জীবনের এইসব মনের কোণে লুকিয়ে থাকা ঘটনাগুলো লেখার মধ্যে ছবি হয়ে ফুটে উঠে অনেক আনন্দ দিল। এরকম আরো অনেক গল্প চাই।

  • টেলিফোন দাদু, আমাদের সময়ের ঐতিহাসিক চরিত্র। ছাত্রদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন, খুবই ভালো সম্পর্ক ছিলো সব ছাত্রের সাথে।

  • Hello Asim:

    I hope you are all doing well. Thanks for sending me the magazine regularly. I enjoy reading the articles, specially those related to the campus life. I was telling one of friends about the magazine and he is interested to get a copy whenever it is published. I have sent him the old ones. His name is Bidyut Niyogi (’68 ME) and lives in New Jersey. His e-mail address is bidyutniyogi@gmail.com. I would appreciate if you add his name in your distribution list. Thanks again and Wish you all a belated Happy New Year.

    Tarunda

  • আমি সাহিত্যিকার নিয়মিত পাঠক।
    প্রতিটি সংখ্যাই অতি সুন্দর।
    ইঞ্জিনিয়ারদের কলমেও যে শিল্প ফুটে ঊঠতে পারে, সাহিত্যিকা তারই উজ্জ্বল উদাহরণ