সাহিত্যিকা

প্রেম যারে কয় সকল জনে

প্রেম যারে কয় সকল জনে
@ প্রমিত বসু ২০০১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

14 February আবার প্রেমের দিবস। যথারীতি তাই বিশ্বচরাচর ভেসে যাচ্ছে প্রেমে আর প্রেমের দেখনদারিতে। চারপাশে আজকের দিনে প্রেমের এত রকম বৈচিত্র্য দেখে সত্যি বাক্যহারা হয়ে যেতে হয়। সিধে প্রেম, বাঁকা প্রেম, সোজা প্রেম, ন্যাকা প্রেম, গাঢ় প্রেম, ঢিলা প্রেম, আরও আরও না জানি কত রকমের প্রেম। কিন্তু এত সব দেখার পর বেশ বুঝতে পারি যে এই কাঠখোট্টা জীবনে প্রেম জিনিসটা যে কী তার তল আজও খুঁজে পেলাম না।

এক সময় শুনেছিলাম যে মানুষের জীবনে প্রেম মোটামুটি ভাবে দুরকম ভাবে আসে। আর সেই দুই ধরণের কথা নাকি আবার রবীন্দ্রনাথও বলে গেছেন। হয় প্রেম ব্যাপারটা ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দচরণে’ গোছের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় আবার কখনো এর ঠিক উল্টোটা হয়ে ‘এসেছে প্রেম এসেছে আজ কি মহাসমারোহে’ রকমের ব্যাপার স্যাপার হয়ে ওঠে। যদিও জিনিষটা এতটাই সোজা বাইনারি ভাবে হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু প্রেমের মধ্যে এই দুরকমের পরতই রয়েছে। হয়তবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেম শুরু হয় এই দুরকমের ক্যাটেগরির মাঝামাঝি কোনো একটা রকমফেরের মধ্যে দিয়ে, কিন্তু সেটা তো খালি গোড়ার কথা! আদি পর্বের পরের পর্বগুলো কী রকম চলে সেটাই তো বোঝা দায় হয়ে যায়।

কিছুদিন আগে এক জায়গায় দেখি একটা সংগ্রহীত লেখায় বলছে যে “কোনো কবি প্রেমে ব্যর্থ হয় বলেই সে কবিতা লেখে। প্রেমটা সফল হলে তাকে বাজারে গিয়ে নটেশাক দর করতে হতো”। এই রকম ব্যাপার দেখলে আরও ঘেঁটে যাই। তখন আমার একটা খুব সাধারণ প্রশ্ন থাকে, নটেশাক কিনলে প্রেমকে কেন হারিয়ে যেতে হবে? দুটোর মধ্যে সংঘাতটা কোথায়?

কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে সেটাই হয়ে থাকে। জীবনের মারপ্যাঁচে নটেশাকের কাছে প্রেমকে ওয়াকওভার দিতে হয়। সেই রকম পরিস্থিতিতে থাকা মানুষগুলো যখন ঘটা করে প্রেম দিবস পালন করে তখন মনে হয় তারা যেন রাশিচক্রের কোনো নক্ষত্র। দূর থেকে যখন যাদের দেখা হয় মনে হয় যে যুগলে মিলে কী চমৎকার জুড়ি। কিন্তু একটু কাছ থেকে তাদের জানলে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই সেই রাশিচক্রের সেই তারাগুলোর মতো, তারা না আছে এক রেখায় বা এক তলে, উল্টে নিজেদের মধ্যে দূরত্বটা যেন কয়েক আলোকবর্ষের।

অথচ এই রকম তো হওয়ার কথা নয়। আমার বোকাবুদ্ধিতে মনে হয় যে এদের অনেকেরই হয়ত কোনোদিন প্রেম ছিলই না, সম্পর্কের শুরুতে যেটা ছিল সেটা শুধু এক বাহ্যিক আকর্ষণ বা একধরণের মুগ্ধতা, সেটা থেকেই প্রেমের যাত্রারম্ভ। কিন্তু জীবন মানে তো একটা বহুমাত্রিক বা মাল্টি প্যারামিটার মডেল, যেটার মধ্যে ওই কিছু কিছু প্যারামিটার ওই আকর্ষণ, মুগ্ধতা বা ভালোলাগাটা বয়ে নিয়ে চলে। আর বাকি ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে যদি পরস্পরের ভালো লাগা না বা কোথাও কোথাও আকর্ষণের জায়গায় কোনো বিকর্ষণ থাকে তাহলে তো সেখানে প্রেমের জলাঞ্জলি হতে বাধ্য। যে মানুষটা দুরন্ত কবিতা লেখে সে যদি চূড়ান্ত মদ্যপ হয় বা সোভিনিস্ট প্রকৃতির হয়, তাহলে তার সঙ্গীর কাছে সে প্রেমের ধারাবাহিকতার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। অতটা কড়া মাপের উদাহরণ না নিয়েও যদি বলা যায়, তাহলে দেখব খুব সাধারণ জীবনেও একজন খুব গোছানো মানুষের চরম অগোছালো মানুষকে অসহ্য মনে হতে পারে, সে তাদের মধ্যে আরও অন্য ভালো লাগা যাই থাক না কেন, সেখানে আবার প্রেমের নকআউট হওয়া অবধারিত।

আবার এইরকম সম্পর্কের বাইরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুজন মানুষকে দেখে তাদের সম্পর্কের পারস্পরিক সমঝোতা কতটা প্রেমের আর কতটা অভ্যেসের সেটা বুঝতে পারা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই রকম ক্ষেত্রে তো মনে হয় প্রেমটা সব চেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর। একই সম্পর্কে দিনের পর দিন থাকলে কখনও কখনও পরস্পরের কিছু দৈনন্দিন অভ্যেস ভালো লাগতে শুরু করে বা জোর করে ভালো লাগাতে হয়। আটপৌরে জীবনে যখন পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়, তখন দুজনে একে অপরের ভালোমন্দেরও অংশীদার হয়ে ওঠে। একজন অসুস্থ হলে অন্যজন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, একজনের সাফল্যে অন্যজন গৌরবান্বিত হয়। কিন্তু সেটা কতটা একসাথে জীবনযাপনের অভ্যাসের দরুন আর কতটা প্রেমের টানে, সেটা বুঝতে পারা আমার কম্ম নয়।

কিন্তু মূল সমস্যাটা মনে হয় আরও গভীর। যেখানে সেই অর্থে পরস্পরের মধ্যে কোনো বিকর্ষণ নেই বা শুধুই অভ্যেসের বন্ধন নেই, সেখানেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই নটে শাকের বাণ্ডিলের গেরোয় প্রেম ‘দূরপথে দীপশিখা রক্তিম মরীচিকা’ হয়ে ওঠে। স্রোতস্বিনী অলকানন্দা যেন হয়ে ওঠে বারাণসীর প্রবাহবিহীন প্রবাহিনী।

যাইহোক এই ঘেঁটে যাওয়া থেকে একটু মুক্তি পেতে সেই মুশকিল আসানের শরণাপন্ন হলাম। ভাবলাম কিছু না কিছু তো পেয়েই যাবো, এই বিভ্রান্তি খানিকটা হলেও কাটবে। কিন্তু যার যা কপাল। আমার সঙ্গে সবসময় যা হয় এবারেও তাই হল। সমাধান খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই যেটা খুঁজে পাই সেটা সমাধান তো করেই না, বরং এই ভেবলে যাওয়া পরিস্হিতি আরও গণ্ডগোলের হয়ে ওঠে। চোখে পড়ল ‘লিপিকার’ ‘সতেরো বছর’ লেখাটাতে। আমার বিভ্রান্ত আত্মা বিভ্রান্ততর হল।

নীচে রইল ‘সতেরো বছর’।

*****

আমি তার সতেরো বছরের জানা।
কত আসাযাওয়া, কত দেখাদেখি, কত বলাবলি; তারই আশেপাশে কত স্বপ্ন, কত অনুমান, কত ইশারা; তারই সঙ্গে সঙ্গে কখনো বা ভোরের ভাঙা ঘুমে শুকতারার আলো, কখনো বা আষাঢ়ের ভরসন্ধ্যায় চামেলিফুলের গন্ধ, কখনো বা বসন্তের শেষ প্রহরে ক্লান্ত নহবতের পিলুবারোয়াঁ; সতেরো বছর ধরে এই-সব গাঁথা পড়েছিল তার মনে।

আর, তারই সঙ্গে মিলিয়ে সে আমার নাম ধরে ডাকত। ঐ নামে যে মানুষ সাড়া দিত সে তো একা বিধাতার রচনা নয়। সে যে তারই সতেরো বছরের জানা দিয়ে গড়া; কখনো আদরে কখনো অনাদরে, কখনো কাজে কখনো অকাজে, কখনো সবার সামনে কখনো একলা আড়ালে, কেবল একটি লোকের মনে মনে জানা দিয়ে গড়া সেই মানুষ।
তার পরে আরও সতেরো বছর যায়। কিন্তু এর দিনগুলি, এর রাতগুলি, সেই নামের রাখিবন্ধনে আর তো এক হয়ে মেলে না, এরা ছড়িয়ে পড়ে।
তাই এরা রোজ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমরা থাকব কোথায়। আমাদের ডেকে নিয়ে ঘিরে রাখবে কে।’
আমি তার কোনো জবাব দিতে পারি নে, চুপ করে বসে থাকি আর ভাবি। আর, ওরা বাতাসে উড়ে চলে যায়। বলে, ‘আমরা খুঁজতে বেরোলেম।’
‘কাকে।’
কাকে সে এরা জানে না। তাই কখনো যায় এ দিকে, কখনো যায় ও দিকে; সন্ধ্যাবেলাকার খাপছাড়া মেঘের মতো অন্ধকারে পাড়ি দেয়, আর দেখতে পাই নে।

*****

লেখাটা পড়ে মনে পড়ল বহুদিন আগে দুরদর্শনে হওয়া ‘Mind your Language’ এর অনুকরণে হিন্দি সিরিয়াল ‘জবান সামহালকে’। যেখানে এক হিন্দি শিক্ষক (সম্ভবত পঙ্কজ কাপুর) সারা পৃথিবীর ভিনভাষীদের হিন্দি শেখানোর চেষ্টা করছে। সেখানে একদিন ক্লাসে কোনো এক সুত্রে ‘প্যার অন্ধা হ্যায়’ কথাটা উঠে এসেছে যেটার অর্থ উনি সবাইকে বুঝিয়ে ছাত্রদের দিয়ে একবার করে বলানোর চেষ্টা করছেন। আর এক বিদেশী ছাত্র যতবার বলতে যায়, আসল লব্জের জায়গায় তার মুখ থেকে বেরোয় ‘প্যার আন্ডা হ্যায়’।

আজ আমারও অবস্হা ওই ছাত্রের মতো। প্রেমের ধারাবাহিকতা বুঝতে গিয়ে এখন মনে হচ্ছে প্যার আন্ডা হ্যায়। তবে সেটা কিসের আন্ডা, মুরগী নাকি ঘোড়া নাকি ডাইনোসর নাকি অন্য কিছুর তা ভগার মা-ই জানে।

প্রেম হয়ত সত্যি খুব ব্যক্তিগত এবং কোনোভাবেই তার গতিবিধি কোনো বাঁধা ছকে ফেলা যায় না। হয়ত তার একটা কারণ আমরা কী চাই, কী ভালো লাগে, কীসে খুশি হই তা ছাই আমরা নিজেরাই বুঝি না। বুঝি না যে সময় নিজেই কান মূলে আমাদের চাওয়া পাওয়ার পরিবর্তন ঘটায় তিলে তিলে যার আঁচ আমরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে মালুম হয়ে ওঠে না। তাই প্রেম বেচারা ভীতু কিশোরীর মতো নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, কখনও বা চোরাগলি দিয়ে পালিয়ে নিজেকে নিষ্কৃতি দেয় আমাদের জীবন থেকে।

যাইহোক, অত ভাবলে চলবে ক্যামনে। আজ প্রেম দিবসে সবার জীবনে প্রেম থাকুক বছরভর, জীবনের চড়াইতে উৎরাইতে, হাসিতে কান্নাতে, আনন্দে অশ্রুতে শুধু এইটুকুনিই চাওয়া।

@ প্রমিত বসু

কৃতজ্ঞতা স্বীকার
#preronapublishers
#preronasdailydiaries
#preronarrojnamcha
#publisherstory #prerona #publishers
#book

Sahityika Admin

1 comment