জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক)
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকশন ইঞ্জিনিয়ারিং
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।
******
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মেঘনাদ সাহা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭০তম জন্মদিবস উপলক্ষে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম The Golden Book of Tagore (A Homage To Rabindranath Tagore)। পৃথিবীর তাবড় তাবড় সাহ্যিতিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, রাষ্ট্রনেতা, স্বাধীনতা সংগ্ৰামী ইত্যাদি বহু বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁদের শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখে পাঠান এই বইটির জন্য। এঁদের কয়েকজন যেমন : প্রফুলচন্দ্র রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, বিধুশেখর শাস্ত্রী, বিপিন চন্দ্র পাল, জওহরলাল নেহেরু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, আঁদ্রে জিদ, চার্লস ফ্রিয়র এন্ড্রুজ, হেরমান হেস, আলবার্ট আইনস্টাইন, বার্ট্রান্ড রাসেল, উইলিয়াম রোটেনস্টাইন, মাদলিন রোলাঁ, জগদীশচন্দ্র বোস, মেঘনাদ সাহা এবং আরও অনেকে। শুধু রবীন্দ্রনাথের প্রশংসায় নয়, তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের নানা দিক তুলে ধরেছেন এই বিখ্যাত ব্যক্তিরা।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অনেক বৈজ্ঞানিকের ঘনিষ্ঠ আলাপ ছিল, যেমন জগদীশচন্দ্র বোস (রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জগদীশচন্দ্র বোসের চিঠিপত্র দেখা যেতে পারে), প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, আলবার্ট আইনস্টাইন ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ বার বার বলেছেন উন্নত বিজ্ঞানের প্রয়োগ ও সাধনা না করলে আমাদের দেশের উন্নতি হবে না। আধুনিক কৃষিবিদ্যা শিক্ষার জন্য তিনি তাঁর পুত্র , জামাই ও বন্ধুপুত্রকে আমেরিকায় পাঠান। উন্নত মানের শস্য ফলন নিয়ে তিনি নিজেও বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর ভালোই দখল ছিল। ‘বিশ্বপরিচয়’ ও বিজ্ঞান বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধও তিনি লিখেছেন। উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে তাঁর রীতিমত চর্চা ছিল।
সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন : ” .. তিনি যখন বর্ষা, বসন্তের গান লিখেছেন তখন উদ্ভিদবিদ্যায় অজ্ঞ সাধারণ কবির মত একই ঋতুতে কদম্ব আম্রমঞ্জরী ফোটান না। বস্তুতঃ আমাদের দেশে যে শত শত দিশী বিদেশী ফুল ফোটে, কোন জায়গায় কি সার দিলে ভালো ফুল ফোটে, এসব খবরও রাখতেন।“ কিন্তু এইসব সত্ত্বেও মেঘনাদ সাহা, তাঁর লেখায়, রবীন্দ্রনাথের ওপর পরম শ্রদ্ধা রেখেও, একটি অনুযোগ করেছেন।
মেঘনাদ সাহার অনুযোগটি The Golden Book of Tagore – থেকে তুলে ধরলুম; অনুযোগটির আপনারা বিচার করবেন :
“… But we, scientific men, beg to bring one complaint against him. His great powers have not yet been used in the exposition of science – of the synoptic world-picture of to-day, of the beauties of the world explored by the physical, the biological and the anthropological sciences.
May we not hope that, like his illustrious predecessor Goethe, he will turn for a while to modern science, and give expression in his inimitable poetry to the Hope behind the invading despair and the Harmony behind the modern Babel of jarring voices.”
Meghnad Saha
(The University, Allahabad)
তবে একটা কথা বলা দরকার। গ্যয়টে (Johann Wolfgang von Goethe, 1749 – 1832) শুধু কবি, সাহিত্যিক বা নাট্যকার ছিলেন না; তিনি প্রকৃতি-প্রেমের দৃষ্টিতে জীববিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যার চর্চাও করেছেন। বিজ্ঞানের নানা বিষয় (Meteorology, Morphology, Anatomy, Optics ইত্যাদি) নিয়ে গবেষণাও করেছেন। এইসব বিষয়ে কয়েকটি বইও লিখেছিলেন: Theory of Light, Metamorphosis of Plants ইত্যাদি। তবে এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। গ্যয়টের বিজ্ঞান-সাধনার ফল ও বিজ্ঞানের জয়গান তাঁর কাব্যে কতটা প্রতিফলিত হয়েছিল তা আমার জানা নেই। আমার এই বিষয়ে বিদ্যে শূন্যের বেশ কিছুটা নিচে। তবে আমার মনে হয় মেঘনাদ সাহা মূল জার্মান থেকে গ্যয়টের এই সব বই পড়েছিলেন। মেঘনাদ সাহা জার্মান ভাষা ভালোই জানতেন। তার থেকেই বোধহয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গ্যয়টের একটা তুলনা টেনে তিনি অনুযোগটি করেছেন। একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখি, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, মূল জার্মানে গ্যয়টের ‘ফাউস্ট’ পড়তে চেষ্টা করেছিলেন।
*****
পুণ্যাহ-অনুষ্ঠান
যুবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন সবে মাত্র জমিদারী দেখাশোনার কাজ পেয়েছেন। তিনি প্রথমবার জমিদারীর সদর-পুণ্যাহ উপলক্ষে শিলাইদহে এসেছেন। এই পুণ্যাহ-অনুষ্ঠান সম্বন্ধে একটু আলোকপাত করা দরকার। সেকালে জমিদারীর সদর কাছারীর পুণ্যাহ-অনুষ্ঠান মহা সমারোহে সম্পন্ন হ’ত। এই উপলক্ষে কীর্ত্তন, কবির লড়াই, যাত্রাগান, লাঠিখেলা, কুস্তীর প্রতিযোগিতা, দীন-দরিদ্রদের খাওয়ানো, বস্ত্রদান, আমলা ও প্রজাদের প্রীতিভোজ ইত্যাদিতে তিন-চারদিন ধ’রে প্রচুর অর্থব্যয় ও সমারোহ হ’ত। জমিদারবাবু স্বয়ং পুণ্যাহ-সভায় বসতেন। সদর কাছারীর একতলার প্রকান্ড হলঘরটি ঐ উপলক্ষে সাজান হ’ত। সিংহ দরজায় নহবত বসত। রাজপুরোহিত জমিদারবাবুকে বরণ করে চন্দনের তিলক পরিয়ে দিতেন। তারপর জমিদারবাবু সমবেত আমলাবর্গ ও প্রজাদেরকে সম্বোধন ক’রে তাঁদের শুভকামনা করতেন। এরপরই মাতব্বর প্রজারা আর আমলারা হাঁটু গেড়ে বসে জমিদারকে নজরানা দিয়ে প্রথম কর প্রদান করতেন। জমিদারবাবু তাঁদের কপালে চন্দন আর গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিতেন। তারপরই বাকি প্রজা ও নায়েবরা তাঁদের নিজেদের কর প্রদান করতেন।
এই অনুষ্ঠনে একটি অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। পুণ্যাহ-সভায় প্রজাদের সম্ভ্রম ও জাতিবর্ণ হিসাবে বিভিন্ন রকমের আসনের বন্দোবস্ত থাকত। হিন্দুরা এক ধারে, তার মধ্যে ব্রাহ্মণেরা পৃথকভাবে, মুসলমানেরা অন্য ধারে, সম্ভ্রান্ত প্রজারা আর সদর ও মফস্বল কাছারীর কর্মচারীদেরও নিজ নিজ আধিপত্য ও পদমর্যাদা রক্ষা করে পৃথক আসনের ব্যবস্থা থাকত। শূদ্র, চাষী, সদগোপ, চাঁড়ালদের জন্য আলাদা আসন।
সেবার তরুণ জমিদার রবীন্দ্রনাথ প্রকান্ড পাল্কী থেকে নেমে বিরাট সমারোহ আর জয়ধ্বনির মধ্যে সুসজ্জিত পুণ্যাহ-সভায় প্রবেশ করে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ভেলভেট-মোড়া সিংহাসনের কাছেও গেলেন না। বিরাট হলঘরে তখন বহু লোকের সমাগম হয়েছে। সবাই তাঁর বসার অপেক্ষায়। কিন্তু কি আশ্চর্য, তরুণ জমিদার সভায় না বসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সভায় হৈ চৈ পড়ে গেল। আমলাবাবুরা ছোটাছুটি করছে, নিশ্চয় কোন ত্রুটি হয়েছে। সদর নায়েব (অর্থাৎ ম্যানেজারবাবু) করজোড়ে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর সিংহাসনে বসতে অনুরোধ করলেন। রবীন্দ্রনাথ এবার সভা থেকে মুখ ফিরিয়ে সদর নায়েব মশাইকে বলেলন, “নায়েব মশাই, ব্যাপার কি ? পুণ্যাহ-সভায় এমন হরেক রকম বসবার ব্যবস্থা কেন? মানুষের বসবার জন্য এত বিভিন্ন রকমের আয়োজন কেন ? নায়েব মশাই তো অবাক। তিনি বললেন এই প্রথাই তো চলে আসছে সেই কবে মহর্ষি বা প্রিন্সের [দ্বারকানাথ ঠাকুর ] আমল থেকে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে বলেলন, “এমন একটা শুভ উৎসবেও আমাদের মিলনের এত বাধা, এত ভেদবুদ্ধি থাকবে কেন? দেখুন আমার অনুরোধ, এই সব আসন উঠিয়ে দিন। আজকের দিনে এই উৎসবে আমরা একাসনে বসব। সেটাই হবে আজকের শুভ উৎসবের সার্থকতা।”
সদর নায়েব এই প্রাচীন প্রথা তুলতে একেবারেই নারাজ। এক যুবক জমিদারের ভাবাবেগ হিসাবে তিনি ব্যাপারটাকে নিলেন। শেষে রবীন্দ্রনাথ নায়েবকে বললেন এই আমার হুকুম। আপনি সব আসন উঠিয়ে দিন, সবার একাসন করে দিন। এদিকে পুণ্যাহের শুভক্ষণ পেরিয়ে যেতে বসেছে। সভায় তখন শোরগোল পড়ে গেছে। নায়েব এবং কিছু আমলা তখন এসে রবীন্দ্রনাথের কাছে ইস্তফা দিতে চাইলেন। তাঁরা এই প্রাচীন নিয়মের বিরুদ্ধে কখনই যেতে পারবেন না বলে জানালেন। রবীন্দ্রনাথ এবার সত্যিই বিপদে পড়লেন। কিন্তু তিনি ছেড়ে দেবার লোক নন। তিনি এইবার সভার দিকে ফিরে উচ্চকণ্ঠে চেঁচিয়ে সমস্ত আমলা ও প্রজাদের সম্বোধন করে বললেন – “আজ এমন একটা উৎসবের দিনেও কি আমরা একত্র মিলিত হবার সুযোগ হারাব? এটা যদি সত্যিই উৎসব-সভা হয়, তবে এখানে এসেও আমরা পরস্পরে ভেদ সৃষ্টি করে আমাদের মধুর সম্পর্কটা নষ্ট ক’রে দেব? না, তা হবে না। তোমরা আমার কথা শোন, সব চেয়ার সরিয়ে নাও। এস আমরা সবাই আজ একাসনে ব’সে আলাপ পরিচয় করি, – উৎসব করি। এস, সব সরিয়ে নাও।”
ভোজবাজীর মত কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রকান্ড হলঘরের চেয়ার, চৌকি সব অপসারিত হ’ল। সমস্ত হলঘরে প্রকান্ড ফরাস পাতা হ’ল, কেবল জমিদারবাবুর জন্য মধ্যস্থলে জরি ও ভেলভেটের কাজ করা একটা গালিচা ও তাকিয়া দেওয়া হ’ল। রবীন্দ্রনাথ সবার আগে গিয়ে বসলেন। তিনি উচ্চহাস্যে হলঘর মুখরিত ক’রে বললেন – “সদর নায়েব মশাইকে ডাক, তোমরা সবাই এস, সবাই এখানে বস। এস আমরা সবাই পুণ্যাহের উৎসব করি। পুণ্যাহের উৎসব সুসপন্ন হ’ল। প্রজারা সেদিন কাতারে কাতারে কাছারীতে ভেঙে পড়েছিল। সেদিন ছোট-বড় সমস্ত প্রজা রবীন্দ্রনাথের অপরূপ দেবমূর্তি দেখে আর তাঁর অমৃত-কণ্ঠের বাণী শুনে তৃপ্ত হয়ে বাড়ী ফিরে গেল।
সেইদিন থেকে পুণ্যাহ-সভায় তীব্র জাতিভেদের ব্যবস্থা উঠে গেল। সেইদিন থেকে পুণ্যাহ-সভায় প্রকান্ড ফরাস, আর জমিদারবাবুর বসবার জন্য গালিচা ও তাকিয়ার প্রবর্ত্তন হয়েছে।
*****
তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১. The Golden Book of Tagore (A Homage To Rabindranath Tagore), Edited by: Ramananda Chatterjee, Published by the Golden Book Committee, Calcutta – 1931.
২. সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী (দ্বিতীয় খন্ড) – রবির বিশ্বরূপ (অপ্রকাশিত রচনা), প্রকাশক : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স ।
৩. সহজ মানুষ রবীন্দ্রনাথ – শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারী। প্রকাশক : বৃন্দাবন ধর এন্ড সন্স, লিমিটেড
*মূল লেখাটিতে সামান্য কিছু কাটছাঁট মাত্র করে এখানে দিলুম। এই কাহিনীটি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ডক্টর মহেন্দ্রলাল সরকার মশাইকে বলেছিলেন। ১৩৪৮ সালের “প্রবর্ত্তকে” তাঁর লেখা এই কাহিনীটি আছে।
খুবই তথ্যপূর্ণ মনগ্রাহী লেখা
আমাদের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে খুবই তথ্যপূর্ণ একটি লেখা।