এলোমেলো বেড়ানোর গল্প (ধারাবাহিক, তৃতীয় পর্ব)
অমিতাভ রায়, ১৯৭৯ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আগের দু’টি পর্ব পড়তে হলে, লিংক
*****
কুলধারা
কুলধারা। সে আবার কোথায়? দেখ কাণ্ড! সেই কবে থেকে সোনার কেল্লা উপন্যাস/সিনেমায় মজে থাকার পরে এমন প্রশ্ন করলে দুঃখ হয়। ওই এক সোনার কেল্লার দৌলতে জয়সলমিরের লোকজন একটু-আধটু বাংলা শিখেছেন, দোকানে দোকানে টাঙানো রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ছবি। এমনকী স্থানীয় পুরসভাও নিজেদের পোশাকি নাম করে ফেলেছে স্বর্ণনগরী, আর এখন বলছেন কুলধারার নাম শোনেননি? সত্যিই বিচিত্র সমস্যা। জয়সলমির গিয়ে কেল্লা দেখে, কেনাকাটি সেরে বেলা গড়ালে নিশ্চয়ই চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাম স্যান্ড ডিউন্স দেখতে ছুটেছেন। ওখানে উটের পিঠে চেপে ছবি না তুললে তো জয়সলমির ভ্রমণই সার্থক হল না। এরপরেও কুলধারা কোথায় জানতে চাইলে সত্যি সত্যিই বড্ড লজ্জা লাগে। আরে বাবা, সাম স্যান্ড ডিউন্স যাওয়ার পথে বাঁ দিকে কুলধারা লেখাটা খেয়াল করেননি? যেখানে অনেকগুলো মরু পান্থনিবাসের ফলক লাগিয়ে বাঁ দিকে তির চিহ্নের নিশানা লাগানো আছে, সেই পথেই এগিয়ে চলুন। পথের দু’পাশে গজিয়ে ওঠা চার-পাঁচ তারার ছাপ মারা আট-দশটা হোটেল পেরিয়ে যেখানে গিয়ে রাস্তা মরুতে হারিয়ে যাবে, সেখানেই পেয়ে যাবেন হাল আমলের পাঁচিল ঘেরা এক ধ্বংসাবশেষ যার একমাত্র ফটকের উপর লেখা রয়েছে— কুলধারা।
নিজের জন্যে তো বটেই, কাঁধে ঝোলানো বা মুঠোয় ধরা ক্যামেরাটির জন্যেও টিকিট কেটে ভেতরে চলে আসুন। দেখুন ধ্বংসাবশেষ সাজিয়ে গুজিয়ে রাজস্থান সরকারের পর্যটন উন্নয়ন নিগম কেমন রোজগার করছে। প্রধান রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলে একটু পরেই পেয়ে যাবেন বাজার ও বাসগৃহের ধ্বংসস্তূপ। পাথরের তৈরি বাড়িগুলির দেওয়ালের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আন্দাজ করতে পারবেন, বাড়িগুলি মোটামুটি একই নকশায় নির্মিত হয়েছিল। মাঝখানে উঠোন রেখে চারপাশে গড়ে উঠেছিল ঘর-রান্নাঘর-স্নানাগার। প্রতিটি বাড়ির পিছন দিকে নিকাশি নালার অস্তিত্ব ছিল। এক লপ্তে বেশ কয়েকটি বাড়ির পরেই রাস্তা থাকায় বোঝা যায় যে, বেশ চিন্তা-ভাবনা করেই রীতিমতো নীল নকশা সামনে রেখে গড়া হয়েছিল এই পরিকল্পিত জনপদ। এখন কোনও বাড়িরই ছাদ নেই। সম্ভবত প্রবল মরুঝড়ে উড়ে গেছে অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে না পেরে ভেঙে গেছে। কয়েকটি বাড়ি নিশ্চয়ই দোতলা ছিল। ভাঙাচোরা পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে পারেন। কিন্তু দোতলার ওপরের ছাদ যথারীতি অনুপস্থিত। বাজারের ঘর হোক বা বসতবাড়ির ঘর প্রতিটি দেওয়ালেই কুলুঙ্গি খুঁজে পাবেন।
পর্যটক টানতে রাজস্থান পর্যটন উন্নয়ন নিগমের উদ্যোগে একটি বাড়িকে মেরামত করে অতীতের এক টুকরো নিদর্শন উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। অন্তত একটি মন্দিরকে সারিয়ে তোলায় বোঝা যায় যে কুলধারার মন্দিরগুলি আকার-আয়তনে খুব একটা বড়ো ছিল না। তবে দেওয়ালে পাথর কেটে নানারকমের আলঙ্কারিক কারুকার্য করা হয়েছিল। এই পর্যন্ত রাস্তা নতুন করে গড়ে তোলায় চলতে কোনও অসুবিধা নেই।
আরও এগনো যায়। কিন্তু পথ বড্ড বন্ধুর। দূর-দূরান্তে যত দূর চোখ যায় সেই একই দৃশ্য। তিরিশ-চল্লিশটা বিধ্বস্ত বাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। বয়ে যাচ্ছে দুরন্ত বাতাস। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাসই দুপুরের দিকে এখানে বয় মরুভূমির তপ্ত হাওয়া। শীতে তীব্রতা যেটুকু কমে গরমের দিনে তার দ্বিগুণ উত্তপ্ত হাওয়া ঘাটতি পুষিয়ে সমতা ফিরিয়ে আনে। আবার সন্ধ্যার পরে পৃথিবী ঠান্ডা হতে শুরু করলে গরমকালেও উষ্ণতা অনেক কমে আসে। আর তখনই নাকি শুরু হয় তেনাদের রাজত্ব। প্রবল বেগের হাওয়ার সঙ্গে নাকি ভেসে আসে মেয়েলি গলার ক্রন্দনধ্বনি।
মনুষ্য অবয়বের ছায়া দেখা গেছে বলে শোনা যায় না। তবে কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। এমনকী ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের স্থানীয় মানুষেরাও এই তথ্যকে মর্যাদা দেয়। সত্যি বলতে কী, ধ্বংসাবশেষ ধরে এক-দেড় কিলোমিটার এগিয়ে যাওয়ার পরে একেবারে খটখটে রোদ্দুর ছড়ানো ভরদুপুরে শান্ত ভাবে একটু কান পাতলে আপনিও অমন কিছু একটা শুনতে পারেন। চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে তীব্র বেগে বয়ে যাওয়া মরুবাতাস যেন এক ধরনের ফিসফিসানি বা আলতো কান্নার মতোই শব্দ সৃষ্টি করে। কানে শোনা শব্দ অচিরেই হৃদয়ে অনুভব করবেন। অবশ্যই সেই অনুভূতির সঙ্গে, বুক ঠুকে বলা যায়, কিঞ্চিৎ শীতল শিহরণ মিশে থাকে। তাহলে এটা কি সেই এতদিন ধরে শুনে আসা তেনাদের কণ্ঠস্বর?
এখানে নাকি দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই একদল পালিওয়াল ব্রাহ্মণ বসবাস করত। জপতপ-অধ্যয়ন ছাড়াও তাদের বাণিজ্যে মতি ছিল। মূলত বাণিজ্যের কারণেই তাদের এত সমৃদ্ধি। জয়সলমিরের রাজারাও নাকি এদের সমীহ করতেন এবং একটু দূরত্ব রক্ষা করতেন। উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত এটাই ছিল এখানকার পরিস্থিতি। লোককথায় বলা হয় যে এককালে নাকি এখানে একটা নদীর অস্তিত্ব ছিল। এবং স্থানীয় বাসিন্দারা জলপথেই বাণিজ্য করতেন। এমনটা হতেই পারে। পর্যাপ্ত জলের জোগান থাকায় সিন্ধু ও সরস্বতী নদীর অববাহিকায় সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল। আবার জলের অভাবেই একসময় এখানকার সমাজ-সভ্যতা অবলুপ্ত হয়। সেই জন্যেই কি কুলধারার চুরাশিটি সমৃদ্ধ জনপদ হারিয়ে গেছে?
জনশ্রুতি অবিশ্যি অন্য কথা বলে। জয়সলমিরের মহামন্ত্রী সালিম সিংহ নাকি কুলধারার কোনও এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। এখানকার বাসিন্দারা সেই প্রস্তাবে সম্মতি না দিয়ে রাতারাতি নিজেদের যাবতীয় অস্থায়ী সম্পদ নিয়ে দেশান্তরী হয়ে যায়। ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় অবশ্যই ঘোষিত হয়েছিল সেই ভয়ঙ্কর অভিশাপ— এখানে বসবাসের অভিপ্রায়ে এলে মৃত্যু অবধারিত। ভাঙাচোরা অবস্থায় কুলধারা দীর্ঘকাল লোকের চোখের আড়ালেই পড়েছিল। নব্বইয়ের দশকে জনৈক সুমের রাম এবং তার বাবা কুলধারার একটি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে দু’জন বিদেশি তিনদিন এখানে খোঁড়াখুড়ি করে কিছু প্রাচীন সম্পদ উদ্ধার করেন। সুমের রাম এবং তার বাবা ঘটনাটির ওপর সতর্ক নজর রেখেছিলেন। বিদেশিরা উদ্ধার করা সম্পত্তি এখান থেকে সরানোর চেষ্টা করলে সুমের রাম এবং তার বাবার সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়। পুলিশের সহায়তায় সংঘর্ষের নিষ্পত্তি হয়। বিদেশিরা দীর্ঘকাল কারাগারে কাটিয়ে জামিনে মুক্তি পায়। সংগৃহীত সম্পদ অবিশ্যি জয়সলমির আদালতের তোষাখানায় গচ্ছিত আছে।
কুলধারাকে কেন্দ্র করে তিরিশ কিলোমিটারের ব্যাসার্ধের এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা চুরাশিটি জনপদের মধ্যে মাত্র দুটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে এবং তাদের যথাযথ সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। কুলধারা ছাড়াও দশ কিলোমিটার দূরের খাবা-য় গেলে দেখতে পাবেন দুশো বছরেরও আগে হারিয়ে যাওয়া জনপদের ভগ্ন স্মারক। বাদবাকি বিরাশিটি বোধ হয় মরুঝড়ের তীব্রতায় পরাজয় স্বীকার করে কালের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। সালিম সিংহের গল্প অবিশ্যি জয়সলমিরের কেল্লায় অবস্থিত ‘সালিম সিং কি হাভেলি’ দেখার সুবাদে আগেই শুনে নিয়েছেন। তবে যেটা শোনেননি তা হল— কুলধারার ধ্বংসাবশেষ পাহারা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন সুমের রাম। কুলধারায় পৌঁছে সুমের রামকে খুঁজে নিলে একই সঙ্গে ইতিহাস ও তেনাদের গল্প তো শুনতে পাবেনই— বাড়তি পাওনা হিসেবে পেয়ে যাবেন এক বিচিত্র অনুভূতি।
কুলধারা দর্শন সেরে বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে বাঁ পাশে তাকান। ক্যাকটাস পার্ক লেখা এই বাগিচায় প্রবেশের জন্য কোনও টাকা লাগে না। ভেতরে চলে আসুন। দেখুন ক্যাকটাসেরও কত রকমফের। এখানে কিন্তু চোখ ভরে কাঁটাবাহারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে গেলেও সবসময় সতর্ক থাকবেন। না, তেনাদের দাপট নয়— অসতর্ক হলেই কাঁটার খোঁচায় রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটতে পারে। ক্যাকটাস পার্কের পাশেই রয়েছে এক শীর্ণকায় জলধারা। এক ছুটে কুলধারার ফটকের ওপারে বসে থাকা সুমের রামকে প্রশ্ন করলে জেনে যাবেন যে, এককালে ওখানে ছিল কাক নদী। হঠাৎ করে মনে পড়ে যেতে পারে যে হরপ্পা সভ্যতায় হাক্রা নামের একটি নদী ছিল। সেই হাক্রা-ই কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাক-এ পরিণত হয়েছে? হবেও বা!
*****
তানোট
সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ ছবির সুবাদে জয়সলমের মোটামুটি পরিচিত পর্যটন গন্তব্য। শহরের পুরসভা পর্যন্ত শহরের পোশাকি নামকরণ করেছে স্বর্ণনগর জয়সলমের। কেল্লা থেকে শুরু করে বাজার-দোকান সর্বত্র সত্যজিৎ রায়ের বন্দনা-প্রশস্তিতে মুখর। অবশ্যই ‘সোনার কেল্লা’ ছবি নিয়ে সকলেই সরব। তবে মিষ্টির দোকানিদের মতে ‘সোনার কেল্লা’ নির্মাণের অনেক আগেই জয়সলমেরে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম পদার্পণ আর এক ছবির সূত্রে। সেই ছবিও জগদ্বিখ্যাত। গুপী গাইন বাঘা বাইন। এবং জয়সলমেরে প্রায় প্রতিটি মিষ্টির দোকানে টাঙানো সত্যজিৎ রায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে দোকানি আপনাকে অবশ্যই জানিয়ে দেবেন যে তাঁর দোকান থেকেই সিনেমার জন্য যাবতীয় মিষ্টি সরবরাহ করা হয়েছিল।
সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই মনে হতে পারে, তখন কি আড়ে-বহরে শহরের এত সমৃদ্ধি ছিল? ছিল কি এত মিষ্টান্ন ভাণ্ডার? প্রশ্নটা মনের মধ্যেই রেখে দেওয়া ভালো। প্রকাশ করলে দোকানির সম্মানহানি হতে পারে। এবং একটা নিটোল গল্প শোনার সুযোগ হারাতে পারেন। বরং সত্যজিৎ রায়ের গল্প শুনতে শুনতে মনে মনে ভাবতে পারেন, সত্যি সত্যিই তো গুপী গাইন সিনেমার যুদ্ধের দৃশ্যে কত মিষ্টির প্রয়োজন হয়েছিল। আর সেই সঙ্গে দোকানিকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন যুদ্ধক্ষেত্রটা ঠিক কোথায় অবস্থিত। আশ্চর্যজনকভাবে সব দোকানিই একটা জায়গার কথাই বলবেন— তানোট যাওয়ার পথে রামগড়ের একটু আগে রাস্তার পাশের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে যুদ্ধের আয়োজন হয়েছিল।
সফরসূচিতে তানোট না থাকলে জুড়ে নিন। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ুন। ঠকবেন না। জয়সলমের থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরের পাকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা। ঘণ্টা আড়াইয়ের পথ। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গেলেই রাস্তার দু’পাশে চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। গাড়ির চালক ততক্ষণে সিনেমার যুদ্ধের ধারাবিবরণী দিতে শুরু করে দিয়েছেন। বলার ধরন এতটাই নিখুঁত, যে মনে হবে সেই ১৯৬৮-তে শুটিং চলাকালীন তিনি নিজেই ওখানে উপস্থিত ছিলেন। অথচ চালকের বয়স দেখে আন্দাজ করতে অসুবিধা হবে না যে গুপী গাইন ছবির শুটিংয়ের সময় চালকের জন্মই হয়নি। এমনকী তাঁর পিতারও জন্ম হয়েছিল কিনা সন্দেহ আছে। একেই বলে মৌখিক ইতিহাস (oral history) যা যুগের পর যুগ এক প্রজন্ম পেরিয়ে আর এক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।
যতক্ষণ না রাস্তার দু’পাশে ঝাঁকে ঝাঁকে উইন্ডমিলের দেখা পাওয়া যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই বকবকানি শুনে যেতেই হবে। একবারের জন্যেও ভাববেন না যে কোন কুক্ষণে এমন একজন চালকের গাড়িতে সফর শুরু হয়েছিল। জয়সলমেরের সব গাড়িচালকের এমনটাই দস্তুর। এবার আসা যাক উইন্ডমিলের বর্ণনায়। বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তরে সুদীর্ঘ স্তম্ভের উপর বনবন করে ঘুরছে দুটো পাখা। হাওয়ার গতি কমে গেলে পাখা আস্তে আস্তে ঘোরে। আবার হাওয়ার তীব্রতা বাড়লে বেড়ে যায় পাখার ঘূর্ণন। টিভি ইন্টারনেট সম্পৃক্ত সময়ে স্কুলপড়ুয়া শিশুও জানে উইন্ডমিলের প্রযুক্তিতে কোনও জটিলতা নেই। হাওয়ার চাপে পাখা ঘোরে। আর পাখার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত জেনারেটর শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। তারপর তারের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক শক্তি পৌঁছে যায় পূর্বনির্ধারিত ব্যবহার ব্যবস্থায়। জয়সলমের উইন্ডফার্মের প্রতিটি উইন্ডমিল থেকে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক শক্তি রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিবহন গ্রিডে সরাসরি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম কর্মক্ষম অনশোর (অর্থাৎ সমুদ্র সৈকতে নয়) উইন্ডফার্ম।
২০০১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষমতার উইন্ড টারবাইন জেনারেটর একের পর এক সংস্থাপন করতে করতে এখন সম্মিলিতভাবে এখানকার নিহিত উৎপাদন ক্ষমতা ১৩০০ মেগাওয়াট। প্রথমদিকের এক একটি উইন্ডমিলের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩৫০ কিলোওয়াট। আর একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সংস্থাপিত প্রতিটি উইন্ড টারবাইন জেনারেটরের উৎপাদন ক্ষমতা ২.১ মেগাওয়াট। হাতে সময় থাকলে আর মরুপ্রান্তরে ঝলসে ওঠা রোদের তাপ অসহনীয় মনে না হলে গুণে দেখতে পারেন কতগুলো উইন্ডমিল রয়েছে। তানোট যাওয়ার পথে জয়সলমের জেলার অমরসাগর-বাদাবাগ-তেজুভা-সোদামাদা মৌজা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই বিশাল উইন্ড ফার্ম। আর গুণে দেখার ইচ্ছে না থাকলে গাড়িতে বসে রাস্তার দু’পাশে তাকিয়ে থাকলেই বুঝতে পারবেন উইন্ডফার্মটি কত কিলোমিটার দীর্ঘ।
উইন্ডফার্মের একঘেয়েমি দেখতে দেখতে চোখ যখন শ্রান্ত হয়ে যাবে, ঠিক তখনই সড়কের বাঁ পাশে এসে যাবে রামগড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সংক্ষেপে RGTPP নামেই বেশি পরিচিত। এটি একটি গ্যাসভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। রামগড় গ্যাস-থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট। রাজস্থানের রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগমের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২৭০.৫ মেগাওয়াট। জেলাসদর জয়সলমের থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে গ্যাস সরবরাহের জন্য গ্যাস অথরিটি অফ্ ইন্ডিয়া লিমিটেড (GAIL)-এর একটি টার্মিনাল রয়েছে। এছাড়াও সরকারের অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন (ONGC), অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড (OIL) এবং বেসরকারি সংস্থা ফোকাস এনার্জি লিমিটেড (FEL) মূল টার্মিনালে গ্যাস সরবরাহ করে। ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য কর্মী মিলিয়ে কমবেশি শ’দুয়েক মানুষ এখানে কর্মরত। পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা তাঁদের আবাসন দেখে মনে হতেই পারে যে মরুপ্রান্তরে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে এক ছোট্ট শিল্পনগরী। টাটানগর বা দুর্গাপুরের আয়তনের তুলনায় নিতান্তই শহুরে-পাড়া। ১৯৯৪-এর ১৫ নভেম্বর এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করলেও প্রকল্প সংস্থাপনের জন্য তার বছর কয়েক আগেই কর্মসূত্রে এখানে বসবাস করতে থাকেন এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী।
নব্বইয়ের দশকে উইন্ডফার্ম ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার আগে জয়সলমের থেকে শুরু হওয়া শতাধিক কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তায় ফৌজি যানবাহন ছাড়া অন্য গাড়িঘোড়া চলাচল করত কিনা সন্দেহ আছে। কাজেই হাল্লা আর শুন্ডির বিশাল সেনাবাহিনী মোতায়েনের উপযোগী এমন আদর্শ জায়গা আর কী হতে পারে! রামগড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়িয়ে আরও চল্লিশ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে দেখা যাবে তানোট মাতার আদি মন্দির। মানুষের বিশ্বাস মামাদিয়া চরণের (গধবী) কন্যা দেবী আওয়াদকে তানোট মাতা হিসেবে পূজা করা হয়। প্রাচীনতম চারণ সাহিত্য অনুসারে, তানোট মাতা হল দেবী হিংলাজ মাতার অবতার।
মন্দিরের এক পুরোহিতের বয়ানে জানতে পারবেন, যে বহুকাল আগে মামাদিয়া চরণ নামে একজন এখানে বসবাস করতেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। সন্তানলাভের আশায় তিনি সাত-আটবার পায়ে হেঁটে এখান থেকে অনেক দূরে এখনকার পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত হিংলাজ মাতার মন্দিরে গেছিলেন। তারপর কোনও এক রাতে, হিংলাজ মাতা স্বপ্নে মামাদিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী চাও– ছেলে না মেয়ে? চরণ বললেন, তুমিই আমার ঘরে জন্মগ্রহণ কর। হিংলাজ মাতার কৃপায় চরণের সাত কন্যা ও এক পুত্রের জন্ম হয়। এর মধ্যে একজন ছিলেন আওয়াদ মাতা, যিনি তানোট মাতা নামেই বেশি পরিচিত। লোকশ্রুতিকে বিশ্বাস করবেন কিনা সে আপনার বিষয়। তবে বহুকাল ধরেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই গল্প বর্ণিত হয়ে চলেছে।
ইতিহাসের নথি অনুসারে মন্দিরটি ৮২৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নির্মিত হয়েছিল। স্থানীয় ভাটি বংশের রাজপুত রাজা তনু রাও এখানে তানোট মাতার মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। সেই থেকে মন্দিরটিতে পূজার আয়োজনের ধারাবাহিকতায় কোনও ছেদ পড়েনি বলেই মানুষের বিশ্বাস। ইতিহাস ও লোকশ্রুতি নির্ভর তানোট মাতার মন্দিরে এইভাবেই চলে আসছিল নিয়মিত পূজা-অর্চনা। ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পর তানোট মাতার মন্দিরের আখ্যানে অকস্মাৎ যুক্ত হল এক নতুন অধ্যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৬৫-র যুদ্ধে, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিল। পাকিস্তানের হাতে ছিল আমেরিকার কাছ থেকে পাওয়া আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্র, যেগুলি আগের তুলনায় অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এবং পাকিস্তানের গোলাগুলির জবাব দেওয়ার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনী এই সুবিধা নিয়ে সীমান্তের সাদেওয়ালা পোস্টের কাছে হামলা চালানো শুরু করে। সাদেওয়ালায় যুদ্ধরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর জানা ছিল যে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। তবুও তারা জীবন বাজি রেখে স্বদেশভূমি রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। কিছুদিনের মধ্যেই তানোট মাতা মন্দিরের কাছেও গোলাগুলি শুরু হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গ্রেনেড এবং বোমাগুলির প্রতিটিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এবং একটিও বিস্ফোরিত হয়নি।
লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তিন হাজারেরও বেশি বোমা ফেললেও তানোট মাতার মন্দিরটি অক্ষত থেকে যায়। এমন নিখুঁত হিসেব কী করে পাওয়া গেছিল বলা মুশকিল। যাই হোক, স্থানীয় আখ্যান অনুসারে, গ্রেনেডগুলি হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় বা বিস্ফোরিত হয়নি। তার মধ্যে থেকে পাঁচটি নিয়ে এসে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আদি মন্দিরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১-এ আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। পূর্ব পাকিস্তানে বিধ্বস্ত পাকিস্তান হঠাৎ করেই ৩ ডিসেম্বর রাজস্থানের কাছে পশ্চিমদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দুটি ফ্রন্টে ব্যস্ত রাখার জন্য এই আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সাদেওয়ালা ততদিনে ভালোভাবে সুরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী লঙ্গেওয়ালা এলাকা বেছে নেয়। মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত লঙ্গেওয়ালা চৌকির পাহারায় সেই সময় উপস্থিত মাত্র ১২০ জন ফৌজিদের একটি কোম্পানি। ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান একটি পূর্ণ ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং ট্যাঙ্কের স্কোয়াড্রন নিয়ে লঙ্গেওয়ালা আক্রমণ করে। তবে পাকিস্তানের ট্যাঙ্কগুলি মরুভূমির বালির মধ্যে আটকে পড়ে। সেই সুযোগে ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের ধ্বংস করে দেয়। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের ইতিহাসে লঙ্গেওয়ালার লড়াই আজও স্মরণীয়। এবং এই যুদ্ধেও নাকি তানোট মাতার মন্দিরের দিকে ছোড়া বোমা এবং গ্রেনেডের একটিও বিস্ফোরিত হয়নি। ফলে ১৯৭১-এর যুদ্ধের পরে, তানোট মাতার খ্যাতি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
ভারত ১৯৬৫-এর যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করার পর, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) মন্দির চত্বরের কাছে একটি চৌকি স্থাপন করে এবং তানোট মাতার পূজার দায়িত্ব নেয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর, ভারতের আদি মন্দির থেকে সামান্য দূরে বিশাল এলাকা জুড়ে স্থাপিত হয় তানোট মাতার নতুন মন্দির। মন্দির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে বিএসএফ। মূল মন্দিরের পাশে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ চবুতরায় কালভৈরবের মূর্তি রয়েছে। ভালো করে ঘুরে দেখলে নজরে আসে একটি পিরের দরগা। স্থাপিত হয়েছে একটি মিউজিয়াম। এবং মিউজিয়ামের প্রধান দ্রষ্টব্য দুই যুদ্ধের অবিস্ফোরিত বোমা ও গ্রেনেড। এছাড়া ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয়ের স্মারক হিসেবে মন্দির প্রাঙ্গণের ভিতরে নির্মিত হয়েছে একটি বিজয় মিনার। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মহান বিজয়ের স্মরণে একটি বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়। আর এভাবেই লোকের মুখে মুখে রচিত হয় নতুন নতুন লোককথা। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে তানোট মাতার অলৌকিক ক্ষমতা। সময় যত এগিয়ে যায় ততই মাতৃমহিমার প্রচার প্রসারিত হয়। সকাল ছ’টায় মন্দিরের দরজা খোলার পর থেকে রাত আটটায় বন্ধ হওয়া পর্যন্ত দর্শনার্থীর খামতি নেই। ফলে জয়সলমেরের পর্যটক খুঁজে পেয়েছেন জন্য নতুন গন্তব্য— তানোট।
*****
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Tibettravel, Patrika, Jaisalmer Tourism
ইতিপূর্বে পত্রিকায় প্রকাশিত ://banglalive.com/
Add comment