ইস্টিশন
রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার, ১৯৭২ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
স্টেশনে অপেক্ষা। এই অপেক্ষাকে সময় আর সীমা দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে এর রূপ বিভিন্ন রকমের। অপেক্ষায় প্ল্যাটফর্মের ঘড়িটা খুব আস্তেই চলে। একটা মিনিটের ফোঁটা এক ঘন্টা ধরে পড়ে। কাঁটাটা ঘট করে লাফ মারে এক ঘর। কখনও আবার ওকে যেন ভূতে পায়, ঢক ঢক করে গিলে খায় সময়। দৌড়েও পারা যায় না।
ওখানে আর ওখানে নয়, সময় যেন আলাদা। বিপুল আত্মবিশ্বাসে অপেক্ষার সমটুকু যেন আমার নয়, অন্য কারো নিয়ন্ত্রণে। অপেক্ষা শেষে আবার আমার হবে।
একটা মস্ত টিনের শেডের তলায় শুয়ে ভারী ভারী কিছু কংক্রিটের চাতাল। ইতি উতি একা দাঁড়িয়ে থাকা জলের কল। দোকানে শুয়ে জাগা বা ঘুমন্ত, বসে বা ঘুমিয়ে কিছু মানুষজন নিয়ে স্টেশন চত্বর কখনই কারো স্থায়ী আশ্রয় হয়ে ওঠে না। অথচ দুপা এগিয়ে স্টেশন যেখানে ঢাল নেমে হারিয়ে যায় দূরের পথে, রেলের রূপোলী রংকরা ত্রিশুল বেড়ায় শুকোতে দেয়া ন্যাতা কানি, দুটো ইটের ওপর চাপানো অদ্ভুত আমিষ নিরামিষ মিশ্র গন্ধের ধোঁয়ায় আবছা কালো হাঁড়ির সামনে বসা আধান্যাংটো মায়ের বুকে সেঁটে থাকা শিশুটির নিশ্চিত আশ্রয় সেই স্টেশন। তুমি ঠিক কি স্টেশন? আশ্রয়ের অপেক্ষা না অপেক্ষার আশ্রয়?
যে সময়টা স্টেশন চত্বরে কাটে সেটা কারো নয়। শুধু অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকা ছাড়া অন্য আর কাজে আসে না। যে অপেক্ষায় বা যার অপেক্ষায় কারো নয়। স্টেশনের কথা মনে পড়লে অপেক্ষার স্মৃতি আসবেই। ট্রেন কিন্তু স্টেশনে আগে চলে আসে না, মানুষই আগে আসে অনেক “যদি” র কথা ভেবে। সময় তখন মুচকি হেসে বদলে নেয় নিজেকে। সেকেন্ড মিনিট হয়ে যায়, মিনিট ঘন্টা। আর “যদি” যদি না থাকে, হা হা হেসে সময় লাফিয়ে চলে। ঘামে জবজবে শরীরে হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাতে ধড়াস ধড়াস হৃদপিণ্ড ধরে হুইসিল দেয়া ট্রেনের সামনে এসে কেউ ঘড়ি দেখে না। সময়ের তখন মাথার ঠিক নেই যে, ঠিক সময়ে সে ঘন্টা বাজিয়ে দেয়!
তবে অনেক আগে ফাঁকা স্টেশনে পৌঁছে গিয়ে অপেক্ষার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলে স্টেশন ভারি সুন্দর ছবি দেখায়। জমায়েতের সিংহভাগ নিয়ে ট্রেন চলে গেলে, বা হঠাত ভারি বর্ষায় জমা জলের মত জনতার ঢল নেমে গেলে, নাছোড় মাছির মত কিছু চোখ থেকেই যায়। দেহাতি মেয়েটি রেলের কলে স্নানের সুযোগ পায়। কিছু চোখ সুডৌল বুকের ভেজা আব্রু একটু সরে যাবার অপেক্ষায় থাকে। স্টেশন চত্বরে বড় হওয়া মেয়েটিকে স্টেশনই শিখিয়ে দিয়েছে ঐটুকু ছোটো কাপড়ে ওর ইচ্ছেমত আব্রু রাখতে বা না রাখতে। রোদে পিঠ পেতে ও প্রসাধন সেরে নেয়। কৃষ্ণচূড়া উত্তেজনায় লাল চোখে দেখে নেয়। ওর মা ছড়ানো সংসার ছায়ায় গুছিয়ে এনে খাবার বাড়ছে। একরাশ ধুলোর ঝড় তুলে কয়লার ইঞ্জিন ঝাঁপিয়ে এসে পড়ার আগেই খাওয়া সারতে হবে। শিশুটি হামাগুড়ি দিয়ে একদম প্ল্যাটফরমের ধারে চলে এলে শহুরে মায়ের বুক কাঁপে। সে নির্বিকার। স্টেশনের কাঁকড় ওর হাত হাঁটুকে শিখিয়েছে কোথায় থামতে হয়।
যন্ত্র আর মানুষের অদ্ভুত সখ্যের সাক্ষী এই কয়লার ইঞ্জিন। আকাশে এক রাশ কালো চুল উড়িয়ে রেল পটরিতে ঘটাঘট তাল তুলে তুমিল শীৎকারে দামাল ছুকরি যখন ঝাঁপিয়ে পড়ত স্টেশনের বুকে —– যাহ্ ইতিহাস। এ দৃশ্য আর দেখা যাবে না। এখনকার বিজলি ট্রেন জিনস পড়া তন্বী, আপন ফোনে বিভোর। পাশে দাঁড়িয়ে এসএমএস করে “তোমার পাশেই তো দাঁড়িয়ে, টের পাওনি”?
বাস স্টেশন, রেল স্টেশন আর হাওয়াই আড্ডা এঁরা সকলেই তুতো ভাই। বাস স্টেশন বেশী লেখাপড়া না করা গ্রাম্য ভাইটি। ছোট মেশিন এসে ছোট দূরে নিয়ে যাবে। হাওয়াই আড্ডা —- সেই বিমানবন্দর থেকে বিদেশে—- দূ উউর দেশে অনেক পড়তে যাওয়া ভাইটি। যে ধীরে ধীরে নিশ্চিতভাবে কেমন যেন বাঙালি থেকে অবাঙালি হয়ে যাচ্ছে। এখানে মস্ত যন্ত্রটির সাথে প্রায় দেখাই হয় না। বিদেশে ভাইটির মত। ভাই, কিন্তু হাওয়াই জাহাজ কেমন যেন নিজের নয়। সময় খরচ না করে চড়ে যাও। অজানার কিছুই জানা হলো না। আমার অজানা আরও যে অনেক কিছু আছে ওর।
অন্য ভাই রেল স্টেশন, একদম নিজের। বড় যন্ত্র, অনেক দূর নিয়ে যাবে, সঙ্গে একদম টাটকা বেঁচে থাকা। ভিড়-কথা-গান, ঝগড়া, খাওয়া, সুখদুঃখ —- একদম চলমান জীবন নাটক। ব্যাগের ওপর বসা মেয়েটির সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি –একদম শেষ পর্বের প্রেম নিবেদন। একটু দূরেই একটু ফাঁকা দেখে দুবার গামছা ঘুরিয়ে শুয়ে পড়া, যাচ্ছে-যাচ্ছেনা স্ত্রী পুরুষের পারিবারিক জটলা, উচ্ছল অথবা ছলছল চোখ, সামান্য বাসন থেকে ভাগ করে খাওয়া তিনজন —- অপেক্ষায়। অপেক্ষাতেই কেউ পায়চারী করছে এ মাথা ওমাথা। সময় চলছে আপনমনে। নাটকে সেকেন্ড কিন্তু মিনিট বেশে, মিনিট ঘন্টায়।
স্টেশনের শব্দও বহুরূপী। লোকজন, মালপত্র যন্ত্র যন্ত্রী সব যেন শব্দের সমুদ্রে ডুবে আছে। মা ছেলেকে বলে দিচ্ছে এই কটা দিন কেমন করে সাবধানে কাটিয়ে দিতে হবে, প্রেমিকা প্রেমিককে বুঝে নিচ্ছে, ভিকিরি ঠগ আলোচনা করে নিচ্ছে সহজ শিকার কোথায়, ফলের ব্যাপারীর কেএএএএলা মুউউউসাম্বিইই সুর, বাপ মাকে ছেড়ে যাবার আগে নতুন বৌ এর হেঁচকি— সব আলাদা আলাদা বুদবুদ। ডুবে আছে শব্দের সমুদ্রে। সবার ওপরে মাইকে ঘোষণার ঢেউ। এই শব্দগুচ্ছের ওপারে যারা, তাঁরা জানেন কি করে সবাইকে শোনাতে হয় কথা। তবে সবার ওপরে আছে “চায় গরররম”।
এখানে কিন্তু সত্যি থেমে সময়। রেল লাইনের ফাঁকের ময়লাটুকু যে ঠিক কোন দশকের বলা যাবে না। অনন্তকাল আগে ছুঁড়ে ফেলা ভাঁড়টি ঠিক তেমনি কাত হয়ে দাঁড়িয়ে। ট্রেন আসা আর যাবার সময়টুকুই জেগে ওঠে সময়। নামার তাড়া, ওঠার তাড়া। ঠিক কতটুকু সময় আছে হিসেব করতে করতে জল খোঁজা। ট্রেন চলে যায়। থেমে যায় আবার সময়। আর কিছু ঘটবে না, কিছুই না।
এই কিছুই ঘটবে না নিশ্চয়তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে চমকে উঠত আগুনের ঝলক, বোমার হুঙ্কার, ছুরির ঝিলিক সত্তর দশকে। চকিতে সময় লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ত ইতিহাসের পাতায়। স্টেশন চত্বরে আধো আঁধারে ছিলনা প্রায় কেউ, আরও কেউ রইল না। প্ল্যাটফর্মে কালচে লালে পড়ে রইল প্রাণ। একটা পা একটু নড়ে স্থির হয়ে গেল।
থামল সময়।
ইস্টিশন –২
স্টেশনের কথা মনে পড়লে অপেক্ষার স্মৃতি আসবেই। ট্রেনের জন্য বা অন্য কারো জন্য। লম্বা ছুটি শেষে কাজে ফেরার ট্রেনের অপেক্ষার সময়, সময় যেন কয়েক কদম পেছনে পড়ে যায়। মা, বাবা, বা ঘরণী, কিম্বা আদরের মেয়েটি, বা বাগান, বাড়ি, জলকাজল চোখের কাছে সময় আর ইস্টিশন দুজনেই গোহারা হেরে যায়। আর একদম অচেনা ফেসবুক মোহিনী বা ছুটে যাওয়া স্কুল প্রেমিকার কলেজ শেষে বাক্স প্যাট্রা নিয়ে আসার অপেক্ষার স্মৃতিতে সময় কিন্তু টানটান। সময়ের আধার থেকে ছোট ছোট স্মৃতির বুদবুদ লহমায় ফেটে পড়ে একদম সামনে। আবার তুমুল ঠান্ডায় সেই অতীতের লোনাওয়ালা স্টেশনে একা। রাত একটা। প্লাটফর্মের প্রতিটি কোনায় কোনায় সময় ঢুকে পড়েছে হিমের কোট পড়ে। কিংবা গ্লাসগোর শহরতলির স্টেশনে ভোর বেলায় প্রথম ট্রেনের অপেক্ষা। সুদৃশ্য কাচের বাঁকা দেওয়াল আছে, অপেক্ষার আশ্রয়। সময়ের থেকে যেমন আড়াল করা যায় না নিজেকে, এই শুকনো ঠান্ডা হাওয়াও তেমনি। যেখানেই লুকোও না কেন, ঠিক খুঁজে নিয়ে ঠান্ডা হাতটা লাগিয়ে যাবে গালে।
ইস্টিশন–৩
বাস স্টেশন হলো বেশী লেখাপড়া না করা গ্রাম্য ভাইটি। গ্রাম্য আওয়াজ, হেটো দোকানপাট, হাটুরে লোকজন। গায়ে গায়ে সবাই, চেনা অচেনা নেই। সময় এখানে মাথা নীচু করে থাকে। কেউ সময় মাপে না মিনিটে। এক আধ ঘন্টার এদিক ওদিকে কারো হেলদোল নেই। দেখতে পাবে সময় এখানে বিড়ি ধরিয়ে হাটু মুড়ে বসে প’ড়ে চেয়ে দেখে ইতি উতি। সেকেন্ড, মিনিট ধোঁয়ার আলপনা আঁকে বাতাসে। ‘ছোট’ভাই বাস আসবে তার সময়মত। সময়কে সে সাজিয়ে নিয়েছে নিজের মত করে। খুব ভোরে ঘটি হাতে সে ছুটে যায় ড্রাইভারের বেশে। কিম্বা থপ থপে দিদিমা,বা অনেকক্ষণ বাদে সিগারেট ধরিয়ে চোখ বন্ধ করা সুখটাণে উলুঝুলু যুবকটি।
হাওয়াই আড্ডা —- সেই বিমানবন্দর থেকে বিদেশে—- দূ উউর দেশে অনেক পড়তে যাওয়া ভাইটি যেন। যে ধীরে ধীরে নিশ্চিতভাবে কেমন যেন বাঙালি থেকে অবাঙালি হয়ে যাচ্ছে। হুস হুস করে ভাঁড়ে চা খায় না এখানে ‘এক চামচ’ কাপুচিনো গলায় ঢেলে দিতে হয়। সময় এখানে স্যুট টাই পড়া, নীল সবুজ চৌকো ফোঁটায় চলে। কাঁটার ধার ধারে না। সময়ের ঘন্টা বাজে না ঢং ঢং। এখানে মস্ত যন্ত্রটির সাথে প্রায় দেখাই হয় না বিদেশে ভাইটির মত। ভাই, কেমন যেন আর আমার নিজের নয়। আমার অজানা আরও অনেক কিছু আছে ওর।
রেল স্টেশন, একদম নিজের। বড় যন্ত্র এসে অনেক দূরে নিয়ে যাবে, সঙ্গে থাকবে একদম টাটকা বেঁচে থাকা। ভিড়-কথা-গান, ঝগড়া, খাওয়া, সুখদুঃখ —- একদম চলমান জীবন নাটক। ব্যাগের ওপর বসা মেয়েটির সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি –একদম শেষ পর্বের প্রেম নিবেদন। একটু দূরেই একটু ফাঁকা দেখে দুবার গামছা ঘুরিয়ে শুয়ে পড়া, যাচ্ছে-যাচ্ছেনা স্ত্রী পুরুষের পারিবারিক জটলা, উচ্ছল অথবা ছলছল চোখ, সামান্য বাসন থেকে ভাগ করে খাওয়া তিনজন —- অপেক্ষায়। অপেক্ষাতেই কেউ পায়চারী করছে এ মাথা ওমাথা। সময় চলছে আপনমনে। এই নাটকে সেকেন্ড কিন্তু মিনিট বেশে আর মিনিট ঘন্টারূপী।
এই কিছুই ঘটবে না নিশ্চয়তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে চমকে উঠত আগুনের ঝলক, বোমার হুঙ্কার, ছুরির ঝিলিক। সত্তর দশকে। চকিতে সময় লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ত ইতিহাসের পাতায়। স্টেশন চত্বরে আধো আঁধারে ছিলনা প্রায় কেউ, আরও কেউ রইল না। প্ল্যাটফর্মে কালচে লালে পড়ে রইল প্রাণ। একটা পা একটু নড়ে স্থির হয়ে গেল।
থামল সময়
Beautiful narration.
আপনি তো সাধারণত ধারাবাহিক লেখেন। সেইদিক দিয়ে এটা আপনার একটা ব্যাতিক্রমী লেখা, এবং সবকিছু আপনি গভীরভাবে দেখেছেন এবং লিখেছেন