আমাদের তিরাশি ব্যাচের ৪০ তম বর্ষপূর্তি (১৯৮৩ – ২০২৩)
অক্ষয় দাস (বাণভট্ট), ১৯৮৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়রিং
অভিজিৎ ভৌমিক, ১৯৮৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়রিং
আমাদের তিরাশি ব্যাচের এবার ৪০ তম বর্ষপূর্তি ছিল। সেই উপলক্ষে মিলনমেলা ছিল ১০ই ডিসেম্বর, কলেজ ক্যাম্পাসে। সঙ্গে, স্মরণিকা “তীরে আসি” -২০২৩ প্রকাশিত হলো। স্মরণিকায় আমার এই লেখাটা স্থান পেয়েছে। সমস্ত ব্যাচের প্রাক্তণীদের মধ্যে লেখাটা ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে হলো।
=কিছু অসম্পৃক্ত দৃশ্যকল্প=
কোনো সংখ্যাকে শুন্য দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল দাঁড়ায় ইনফিনিটি। আমরা সবাই সেই শুন্যের দলে, যারা বি ই কলেজকে নিজেদের মত করে ভাগ করে নিতে চেয়েছি, ছুঁতে চেয়েছি কলেজের নীল আকাশ, সবুজ বাগান। সব কিছু দুহাত ভরে বিলিয়ে দিয়েও আমাদের কলেজ সেই অসীম। আমরা সেই টেণ্ডস টু জিরোর ভবিতব্যে বন্দী- নিয়ম মেনে লিমিটের অঙ্ক কষে চলেছি জন্ম থেকে মৃত্যু। ভাগফল, ভাগশেষ গুলিয়ে যাচ্ছে-
যার কোন জন্ম নেই
যার কোনো মৃত্যু নেই
সে এমনই এক উদ্ভাসিত
এলোমেলো এক ভালোবাসা
আকার বদলে বদলে
সুষম বর্গক্ষেত্র হয়ে গেল
এই তো সেদিন এক দুঃসহ আঠারো বছর বয়সে পৌছে গিয়েছিলাম ক্যাম্পাসের ফার্স্ট গেটে- বি ই কলেজের আকাশ দেখতে। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টিজল আমার চোখে, মুখে, মনে ঝিম ধরাচ্ছিল। ভেজা দেবদারু গাছের পাতা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ পেয়েছিলাম। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম ক্লক টাওয়ার। মুচকি হেসে বলেছিল – “হুঁহুঁ বাবা, ফাঁদে পড়ে গেছ। সারা জীবনের জন্য বন্দী করে নিলাম-
ভালোবাসা অর্ধজীবন মেপে মেপে
উড়ে উড়ে চললো
এক জ্যামিতিক অন্তহীনে
তিল তিল করে ক্ষয়
ভালোবাসার অর্ধজীবন
শুরু নেই
শেষ নেই
চিরকাল যেন এমনই ছিল
মাথার ওপর নীল আকাশ, ছেঁড়া সাদা মেঘ। ওই যে লোকটা শরতের রোদে মাথায় ছাতা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। নেতাজি ভবন থেকে সবুজ লর্ডসের পায়ে চলা পথ দিয়ে, কোনাকুনি, হলুদ রঙা হোস্টেল বাড়িগুলোর দিকে। পরণে খাটো ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি। উনি আমাদের ফোনদাদু, খবর পৌঁছে দিতে চলেছেন। কার বাড়ি থেকে ফোন এলো? কোথা থেকে? আলিপুরদুয়ার, নাকি মালদা থেকে? খবরটা কি ভালো না খারাপ? ফোনদাদু কর্তব্য পালন করতে চলেছেন। প্রিয় নাতিদের কাছে সুখ-দুঃখের বার্তা নিয়ে।
ফোনদাদুর আসল নাম কি ছিল? আমি জানি না। কেন জানি না? কেন কোনোদিন জিজ্ঞাসা করি নি? কেন…?
গঙ্গার দিক থেকে এক ঝলক উটকো হাওয়া। ফোন দাদু ছাতা সামলাচ্ছেন। দৈনন্দিন এক নিছক চলচ্ছবি, চিরন্তন হয়ে গেল।
একজন অবিভাজ্য মানুষ
পৃথিবী পৌঁছে দিলো প্রত্যেক ঘরে
ঝিমিয়ে থাকা দুঃখ
নিভিয়ে রাখা ইচ্ছে
টুকরো আত্মীয়তা
নিখুঁত ভাজ্য ভাজক
নিশ্চিহ্নতা বিছিয়ে দিলো
পৃথিবীর দিকে পাশ ফেরা লোকটা
শূন্যতর দিয়ে
ভাগ হয়ে গেল।।
তীরে-আসি। তীরে আসব কথা ছিল। রজত আর আমি ইনষ্টিটিউট হল থেকে ফার্স্ট গেটের দিকে হাঁটছিলাম। আমাদের ধীর পদক্ষেপ ধীরতর হচ্ছিল। আমরা কি সময়কে নিশ্চল করতে চাইছিলাম। কেউ কথা বলছিলাম না। রজত উদাস কোনো চিন্তায় ডুবে । হঠাৎ ওর মুখে অস্ফুট স্বগতোক্তি – ‘টাইম ডাজন্ট ওয়েট’…। এটাই ছিল কলেজের ১২৫তম বছরের ফোটোগ্রাফি কম্পিটিশনের বিষয়। দমবন্ধ নস্টালজিয়া। এক পলকে দুজনের চোখেই ভেসে উঠলো সেই পুরোনো আলো। সেইবার রজত, নির্ঝর, আদ্রা আর আমি সারা ক্যাম্পাস ঘুরে, সেই অপেক্ষার তোয়াক্কা না করা সময়কে বন্দী করে নিয়েছিলাম ক্যামেরায়। সময়কে কি সত্যিই বন্দী করা যায়? ‘সময় যেন মুঠোয় বালি, আঙুল-ফাঁকে ঠিক ঝরে যায়…’
সে সব অনেক পুরোনো দিন
এক সময় ভীষণ আনকোরা ছিলো
খুঁটিনাটি ঠিকঠিক মনে নেই আর
ধনুক থেকে ছিটকে যাওয়া দিন
হাওয়ায় বায়বীয় হওয়ার দিন
স্বপ্ন পেয়ে নস্যাৎ করার দিন
পঞ্চান্ন বাসে বিনা টিকিটের দিন
হলুদ প্যাকেট চারমিনারের দিন
হলুদ ফুলের সেই গাছটার কথা তেমন মনে নেই। মডেল স্কুলের কাছে কালভার্টের ধারেই তো ছিল সেই গাছটা। কি ফুলের গাছ যেন! আর সেই বুড়ো গাছটা। বয়স অনেক বেশী। মধুসূদন ভবনের চ্যাপেলের ঠিক সামনে, ওভালের প্যাভিলিয়নের পিছনে। আর ক্লকটাওয়ার ঝিলের ধার ধরে রয়েছে তাল গাছের মত দেখতে উর্ধমুখী গাছের সারি। গাছগুলোর নাম জানিনা, কি নাম গাছগুলোর! কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া তেমনিই আছে সব নিশ্চয়ই। সেই যে ফর্ম জমা দিতে গিয়ে ফার্স্টগেটের দিয়ে ঢুকে বেন্ডিং মোমেন্ট অবধি দেখেছিলাম দেবদারুর ছায়াবীথি । প্রথম বার দেখেই মনে হয়েছিল- এখানে পড়তেই হবে। টাওয়ার ঘড়ি কি পড়ে ফেলে কারো মন!
কালের ত্বন্বী তখন ভাতঘুম দিচ্ছেন
বিকেলে আরো আরো সুন্দরী হওয়ার লোভে-
চারমুখো ঘড়িটা এইফাঁকে
দু-সেকেন্ড স্লো হয়ে গেল, আলসেমিতে।
ঘুম সেরে উঠে,
সদ্য গোলাপী রঙিন ঘড়িঘর
শেষ মুহুর্তের প্রসাধন সেরে নিচ্ছিল,
ঝিলের আয়নায়-
ঘুরঘুর করা ফিচেল হাওয়াটা
ঘাই মেরে ঝিলের জল ছুঁয়ে
টাওয়ার সুন্দরীর তিরতিরে ছায়া
আরো ভেঙে দিলো
যেদিন প্রথম কলেজে গিয়েছলাম থাকব বলে- সময়টা ছিল ভারী অদ্ভুত। বিকেল আর সন্ধের মাঝামাঝি একটা সময়। চারিদিকে মায়াবী হলুদ আলো। একটু আগে ঝিরঝিরে বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি বাক্স-হোল্ডল নিয়ে একটা হলুদ হোস্টেল বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে। টানা বারান্দা। কারা যেন ডাকছে – আয় আয় আয়। একপাশে একটা ত্রিভঙ্গ-দর্শন কৃষ্ণচূড়া গাছ। মরসুমের শেষ কয়েক ফুল ফুটিয়ে একলা ক্লান্ত যেন।
পরের বছর এই গাছটাই লাল ফুলে ফুলে অপরূপা হয়ে উঠলো। সে এক দেখার মত ব্যাপার। এখনো তেমনটাই হয় নিশ্চয়ই।
হোস্টেলের জানালার ধারে লতিয়ে উঠেছিল মাধবীলতা। রাতের বেলায় মনমাতানো সুগন্ধ মাতিয়ে রাখত। একবার ফুল-ফোটা দেখতে গিয়ে প্রায় সারারাত লতানো গাছটার দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম। সেই প্রথম ফুল ফোটা দেখেছিলাম। সে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। “আমি ফুল দেখেছি, ফুল ফুটতে কখনো দেখিনি” – গানের এই লাইনের আক্ষরিক কাব্যিকতা আমার কাছে সেদিন থেকে হারিয়ে গেল। তবুও কেন যে হৃদয় চঞ্চল হলো কে যেন ডাকে বারে বারে…
শেষ বৃষ্টির উপত্যকায়
কোনো নিমগ্নতা নেই-
জল ঝাঁঝরি শুষে নিলো
সম্ভাব্য প্রথম প্লাবন।
মৃত্যু থেকে জীবন-
অনন্ত এক জাল-প্রণালী
অজাড্য এক গতিবেগ
মানুষ গহ্বর পেরিয়ে;
দুষণের মাপা অস্থিরতা
ভাগাভাগি করে নিলো।
সেবার আমাদের সার্ভে ক্যাম্প বীরভূমের সিউড়িতে। রাত নটা। সন্দীপন আর মানব উত্তেজিত। পি কে রায় স্যারকে বলল – “স্যার ময়ূরাক্ষীর বালির চরে বিরাট বিরাট পায়ের ছাপ। আমরা দেখেছি। মনে হচ্ছে ওগুলো ইয়েতির।“
স্যার বললেন – “চলো দেখি তো।“ সবাই মিলে হ্যাজাক নিয়ে সেই পায়ের ছাপ দেখতে বেরোলাম। স্যার সেই ছাপগুলো দেখে বললেন – ইয়েতি কই?! এতো মনে হচ্ছে কোনো এক মহা-‘মানবের’ পদচিহ্ন। চলো আমরা সবাই গাই – “ওই মহা মানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে।“ আমরা সবাই গলা মেলালাম। আধখানা চাঁদের ঝাপসা আলোয় বালির চর মায়াময় হয়ে উঠলো। তারা বিছানো রাতের আকাশ লহমায় আমাদের সঙ্গী হয়ে গেল। শীতের রাতে ময়ূরাক্ষীর বালির চরে সে ছিল এক অপার্থিব অনুভূতি। আমি আজ নিশ্চিত সেদিন বালির চরে কোনো ইয়েতির পায়ের ছাপ ছিলো না।
পায়ের বিরাট ছাপগুলো ছিল স্যার আপনার – ঈশ্বরের অদ্ভুত সৃষ্টি এক অসাধারণ মানুষের।
এ সবই অঘটনীয় বর্তমান
নির্ভুল আগুন গনণায়-
এক অদৃশ্যগত অন্তরালে
পৃথিবীর খুব কাছে
মাটি একটু নীচে
আপাত থমকে আছে
লিখতে লিখতে চোখ ঝাপসা হয় বারবার, সন্তর্পণ মানে না। বি ই কলেজ নিয়ে সমস্ত লেখাই কি হৃদয় দিয়ে লিখতে হয়? কে জানে! তবুও ফিরে দেখা অনিবার্য, অপ্রতিরোধ্য। এ যেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে অসামান্য এক শিল্পকর্মের দিকে চেয়ে থাকা। চোখের পলক পড়ে না। দুর্নিবার আকর্ষণ। স্মৃতি যেন টিলার ওপর থেকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া, এক ঝাপসা মায়াময় জলরং, জলছবি। রঙের সাথে রঙ মিশে যাচ্ছে। স্মৃতি-সত্তা পরস্পরের মুখোমুখি, বিদ্রোহ করে। হার মানে না। মানবেও না কোনোদিন। একসাথে আমরা সবাই ষাট পেরিয়ে গেছি। আঠেরো থেকে বাইশ – সময়টাকে রেখে এসেছি ওই আশ্রমের মাটিতে। আর সাথে নিয়ে এসেছিলাম চিরসবুজ থাকার জাদুকাঠি। সযত্নে তোলা থাক সে কোনো রূপকথার এক গোপন কুঠুরিতে। তার নাগাল পায় কার সাধ্যি!!
মাঝে মাঝে মনে হয়
আগুনের ওপর হেঁটে আসি কয়েক পা
তারপর না হয় কাশ ফুলের বনের ধার ঘেঁসে একটা ধাবার খাটিয়ায় বসা যাবে
মাথার ওপর থাকবে এক আকাশ ছুটি নিয়ে শরতের মেঘ
সোনালি ফেনিল বীয়ারের ঘামে ভিজে যাবে একটা দুপুর
আপেক্ষায় আছি
খুব দেরী হয়ে যাচ্ছে না তো..
******
*বন্ধু মিলনের প্রাক্কালে*
অভিজিৎ ভৌমিক, ১৯৮৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়রিং
দীক্ষান্ত ভাষণ ছিলো না,
কিম্বা সমাবর্তনের সমারোহ
তবু বীজমন্ত্র গাঁথা ছিলো প্রাণে
তারই টানে
চার দশকের পথ চলা,
গ্রামে গঞ্জে নগরে শহরে
দেশে দেশান্তরে,
কারখানা বন্দরে ।
আজ একবার ফিরে ফিরে আসা
সেই মহিরুহ ছায়া পদতলে
জানাতে বিনম্র প্রণতি,
দাঁড়ায় পথিক যত হাতে হাত ধরে ।
ফিরে গেছে যারা
অজানার দেশে,
সুপ্রিয় সতীর্থ ছিলো তারা,
তাদের উদ্দেশ্যে থাক
স্মৃতির সজল শোকাঞ্জলি।
পিছু ফিরে দেখা আজ,
আপন কর্মের প্রয়াসে,
বসুধা কি বাসযোগ্য আরো?
বাতাস কি শ্বাসযোগ্য হোলো?
এখনো কি বাকি আছে দেনা?
শুধু এ চলা নিরন্তর,
এই হোলো জানা।
তবু মস্তিষ্কের রন্ধ্রে কোষে
প্রথিত ছিলো যে ভাষ্য জ্ঞান,
নতুন প্রজন্মে যেন
দিনশেষে হয় সঞ্চারিত,
এ ভাবেই ঋণ মাতৃকার
হোক পরিশোধ,
এই হোক প্রতিজ্ঞা সবার।
।।অভিজিৎ ভৌমিক।।
১০ই ডিসেম্বর,২০২৩
পুরনো এলবাম থেকে
দারুন হয়েছে