Obituary and Tributes
Sudipta Ghosh, Mechanical, 1968
Prof. Sujay Dutta, 1975 Metallurgy
Aloke Bhuiya, 1981 ***
Kalyan Chakrabarty 1980 Electrical
*******
*কল্যাণ চক্রবর্ত্তী – আমার দেখা এক এবং একমাত্র কিশোর আধুনিক কবি।*
(A tribute from Dhruba Jyoti Chakraborty on behalf of BECA1980)
১৯৭৫ সালের অগাষ্ট মাসের প্রথম দিকে মাথায় কালো রঙের টিনের ট্রাঙ্ক আর বগলে শতরঞ্চি জড়ানো পোটলা নিয়ে প্রথম কলেজে পড়তে আসি।
সেটাই ছিল আমাদের জীবনের চরৈবেতির শুরু।
দূর্গসম ডাউনিং হল হোস্টেলের E – Block – এর দোতলার আমার জন্য নির্দিষ্ট একটা ঘরে যখন থানা গাড়ি তখন দেখি সেই ঘরের আর এক বাসিন্দা হাজির।
নাম : কল্যাণ চক্রবর্ত্তী
সাকিন : উলুবেড়িয়া
উচ্চতায় প্রায় ছয় ফুটের কাছে আর যাকে বলে সেই tall – dark – handsome চেহারা।
ধীরে ধীরে প্রাথমিক বরফ গলবার পর পরিচয় পর্ব সমাপ্ত হবার হল।
ডাউনিং হলের বিশাল সেই ঘরে যে পঞ্চপাণ্ডবদের আস্তানা নির্দিষ্ট হয়েছিল তাদের মধ্যে আমি আর কল্যাণই ছিলাম যাকে বলে ওই ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস।
বাকি তিনজনই ছিল এক্কেবারে ভরপুর কলকাত্তাইয়া।
আমার সাকিন ছিল তৎকালীন ২৪ পরগনা জেলার মছলন্দপুরের ঘোষপুর গ্রাম আর কল্যাণ ছিল উলুবেড়িয়ার এক গ্রামের।
আবার দুজনের পদবীও ছিল চক্রবর্ত্তী।
ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টে রোল নম্বরও ছিল কাছাকাছি। কাজেই হৃদ্যতা হতে দেরি হয় নি।
মনে পড়ে যাচ্ছে ডাইনিং হোস্টেলের সেই প্রথম রাতের কথা।
তখন ভরপুর জরুরি অবস্থা চলছে। স্কুলের গণ্ডি সবে পেরিয়েছি। ছাত্র রাজনীতির কিছুই বুঝি না।
রাতে ডাউনিং হলের ডাইনিং হলের মেসে রাতের খাবার সেরে যে যার লোহার খাতে বিছানা পেতে বসে আছি। নিজেদের মধ্যে একটু আধটু ধীর শব্দে কথাবার্তা বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
মনের মধ্যে সবসময় একটা ভয় কাজ করছে ওই ragging ব্যাপারটা নিয়ে। সত্যি – মিথ্যে – কল্পনা মাখানো ragging – এর হাত থেকে নিজেদের কি করে রক্ষা করা যায় তখন সেটাই আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় ছিল।
ক্ষমতাশীল ছাত্র নেতারা এসে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে ragging নিয়ে যেন আমরা একদম বিচলিত না হই। কোন কিছু অন্যায় হলেই তারা ব্যবস্থা নেবে।
যাইহোক, রাতে একসময় মশারি টাঙিয়ে সবাই শুয়ে পড়লাম। পরের দিন কলেজের প্রথম দিন। আমরা, বিশেষ করে আমি আর কল্যাণ বলা যেতে পারে গোষ্পদ থেকে এক্কেবারে সমুদ্রে এসে পড়েছি – ঢেউ এর ঢেউ এসে আমাদের দু জনকেই নাকাল করে ছাড়ছে।
ঘুমটা কখন যে দু চোখের ওপর এসে বসেছিল জানি না। ঘুম ভেঙে ধরমর করে উঠে বসলাম দরজায় অসম্ভব জোরে জোরে করা যেন ধাক্কা দিয়ে চলেছে।
ভয়ে, বিস্ময়ে একেবারে কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থা!
আমাদের মধ্যে কেউ একজন গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই একদল ছেলে হৈ হৈ করে ঘরে ঢুকে পড়ে সব লাইট জ্বালিয়ে দিল।
তারপর, আমাদের খাটে, চেয়ারে, টেবিলের ওপর গুছিয়ে বসে তাদের আসর বসিয়ে ফেলল।
রাত তখন প্রায় একটা – দেড়টা হবে।
অবাক হয়ে দেখলাম যে সকল সিনিয়র ছেলেরা সন্ধ্যা বেলাতে আমাদের ragging হবে না বলে আশ্বস্ত করে গেছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখলাম মাঝরাত পেরোনো আক্রমণাত্মক দলটার সাথে এসে হাজির হয়েছে আমাদের ঘরে।
চারিদিকে হল্লার আওয়াজে বুঝতে পারলাম আমাদের আশেপাশের ঘরেও একই পরিস্থতি চলছে।
সিনিয়রা আমাদের মশারিগুলোর হুক সব খুলে ফেলে দিয়েছে। আমরা মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে স্নান করানো বলির পাঁঠার মত পরবর্তী ঘটনার জন্য করুন দৃষ্টিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সিনিয়রদের দিকে তাকিয়ে আছি।
এইবার কল্যাণের খাটের দিকে নজর গেল।
দেখি সে হুক খোলা মশারির মধ্যেই জালে পড়া বড় মাছের মত বসে আছে।
তাই দেখে ওই কঠিন পরিস্থিতিতেও আমার হাসি পেয়ে গেছিল।
পরে জেনেছিলাম যে কল্যাণের চশমার পাওয়ার বেশি ছিল বলে ও ওই পরিস্থিতে বিনা চশমায় মশারির থেকে বেরিয়ে আসতে অসুবিধে বোধ করছিল।
যাইহোক, সেই রাতে কল্যাণের ওই অবস্থা আমাদের সিনিয়রদের হাত থেকে সবটা না হলেও কিছুটা রেহাই দিয়েছিল।
সিনিয়ররা সবাই ওকেই প্রথমে ধরেছিল।
যাইহোক, নিজেকে introduce করতে গিয়ে বলেছিল যে ও আধুনিক কবিতা লেখে।
এই কথাটা শুনে শুধু আমরাই নয় সিনিয়র ছেলেগুলোও কেমন যেন যাকে বলে কথা হারিয়ে ফেলেছিল।
সদ্য এগার ক্লাস পাশ করা একজন আধুনিক কবিকে সেইরাতে আমি আমার সামনে প্রথম স্পর্শ করার দূরত্বে দেখতে পেয়েছিলাম।
পরবর্তীকালে স্বল্পবাক কল্যাণকে আমরা ওর আধুনিক কবিতা নিয়ে অনেক পেছনে লাগলেও ও কিন্তু খুবই নির্লিপ্ত থাকত।
পরে কল্যাণ আমাকে সেই সময়ের little magazine – এ ছাপা ওর লেখা কবিতা দেখিয়ে ছিল।
আমি আর শিশির (রায়) কলেজ জীবনে কল্যাণের একটু কাছাকাছি ছিলাম বলা যায়।
শিশির থাকত বাউড়িয়ায়। আর আমি ছিলাম ওর ল্যাব পার্টনার।
আমরা দুজনেই ওর উলুবেড়িয়ার বাড়িতে গিয়েছি।
এমনিতে কল্যাণ খুবই কম কথা বলত। ওই সময়ে কল্যাণ একটা মারত্মক কথা আমাকে বলেছিল। ও বলেছিল যে সাহিত্য রচনাতে যদি আগ্রহ গড়ে তুলতে হয় তবে প্রতিদিন নিয়ম করে তিন – চারশ শব্দ লিখতেই হবে – তা সেই লেখা যতই অপরিণত হোক না কেন। প্রথমে disciplined হতে হবে।
এই বিষয়ে ও রবীন্দ্রনাথের কথা বলেছিল।
তখন কথাটার অতটা মূল্য বুঝিনি। পরে বুঝেছি।
রবীন্দ্রনাথ শিশুকাল থেকেই তাঁর সকল ব্যস্ততার মধ্যেও শুধু নিয়ম করে লিখেই যান নি, এমন কি সেই সকল লেখাই যত্ন করে preserve করে রাখতেন।
কলেজে থাকাকালীন কল্যাণের সঙ্গে একসাথে তৎকালীন WBSEB – তে ইন্টার্নশিপও করেছি।
সেটাতে একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল।
সেইসময় আমরা অন্দুল রোডে বকুলতলায় থাকতাম।
WBSEB letter head – এ লেখা internship – এর চিঠিতে Diamond Harbour Road – এর ঠিকানা ছাপা থাকায় আমরা প্রথম দিন সেখানে পৌঁছে গেছিলাম – চিঠিতে কি লেখা আছে সেটা না দেখেই।
তারপর WBSEB ‘ র ডায়মন্ড হারবারের অফিস থেকে আমাদের আন্দুল রোডের সাব – স্টেশনে যেতে বলে।
এটা আমার বাড়ির খুব কাছে থাকায় আমরা দুই বন্ধুই মাঝে মাঝেই ট্রেনিং থেকে সোজা আমাদের বাড়িতেই চলে আসতাম।
অনেক পারিবারিক কথাও আলোচনা হয়েছে যা খুবই স্পর্শকাতর ছিল।
তারপর কলেজের গণ্ডি পার হয়ে আমি পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করি।
শুনেছিলাম কল্যাণ সেই WBSEB – তেই চাকরি পেয়ে গ্রামে-গঞ্জে rural electrification department – এর কাজে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে
হঠাৎ একদিন হাওড়া স্টেশনে দেখা। দু জনেরই তারহুরো ছিল। অল্প কিছু কথাবার্তা বলে যে যার গন্তব্য স্থলের দিকে চলে গেছিলাম।
তারপর একদিন শুনলাম কল্যাণ বিদ্যুৎ ভবনে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন দপ্তরের সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার (S.E) হয়ে দপ্তর সামলাচ্ছে।
একদিন গিয়ে হাজির হলাম ওর অফিসে।
দেখলাম যদিও designation S.E তবে Acting CE হিসেবে কাজ চালাচ্ছে।
এবার অনেকক্ষণ ধরে গল্প হল।
জিজ্ঞেস করলাম কবিতা এখনও লেখে কিনা।
বলল যে সে সব পাগলামি নাকি অনেকদিনই চলে গেছে।
আমি বললাম – সে কিরে! তোর উপদেশ মেনে আমি এখন কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লিখে যাচ্ছি, আর তুই কিনা লেখা ছেড়ে দিলি!
কলজে কল্যাণের একটা নির্মল মিষ্টি হাসি ছিল।
সেই হাসিটা আবার হাসল দেখলাম।
আমি ভারি দুঃখ পেয়েছিলাম সেদিন।
অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি নিয়েও।
আমাদের শিক্ষাগুরু ডক্টর শঙ্কর সেন তখন বিদ্যুৎ মন্ত্রী। উনি যে ভাবে WBSEB – কে অন্ধকার থেকে আলোকিত জগতে ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই বিষয়েও কথা হয়েছিল।
সেদিন কল্যাণ একটা কথা আমায় বলেছিল। ও বলেছিল দুর্নীতিময় পরিবেশে রামকৃষ্ণের পাঁকাল মাছের মতন জীবন ধারনের কথা।
কল্যাণের এই জীবন যাত্রার খবর ডক্টর সেন রাখতেন। তাই দপ্তরে আসা যাওয়ার মাঝে কল্যাণের সাথে দেখা হলে দু দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলতেন।
এই ব্যাপারটা অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ ছিল।
আজ অকালে কল্যাণের এই চলে যাওয়াটা আমার কাছে খুবই দুঃখের।
ওর সাথে চোখের শক্তি কমছে। বলেছিলাম – হায়দ্রাবাদে আমি আছি। তুই একবার সময় করে চলে আয়। LV Prasad নাম করা চোখের হাসপাতাল – একবার দেখিয়ে যা।
রাজিও হয়েছিল।
তারপর আবার শিরদাঁড়ার একটা কষ্টদায়ক সমস্যা ওকে খুবই ভোগাচ্ছিল। বোধহয় স্নায়ু সংক্রান্ত।
ফোনে কথা হত মাঝে মাঝে। বছর খানেক – দেড়েক আগে মেয়েকে নিয়ে মেয়ের কর্মক্ষেত্রীয় বিষয়ে হায়দ্রাবাদে আসার কথা ছিল – সপরিবারে।
বলেছিলাম – এসেই জানাস।
অনেকদিন কোন খবর নেই দেখে আবার ফোন করেছিলাম।
বলল – গেছিলাম। কিন্তু শরীর খারাপ হয়ে যাওয়াতে ফোন করে উঠতে পারেনি।
ফোনে কল্যাণের চোদ্দপুরুষের শ্রাদ্ধ করেছিলাম।
বলেছিলাম – একটা ফোনও করতে পারলি না।
ফোনে বেশ বুঝতে পারলাম যে কল্যাণ কলেজের সেই নির্মল শিশুসুলভ হাসিটা হাসছে।
ব্যস, সেই শেষ ফোনালাপ।
তারপর আমার ফোন কোন এক fishing attempt – এ corrupt হয়ে গেছিল বলে factory reset করতে গিয়ে সব ফোন নম্বর হারিয়ে গিয়ে এক বিশাল সমস্যার সম্মুখীন হই।
একটা একটা করে ফোন নম্বর সংগ্রহ করে আস্তে আস্তে আবার সবার সাথে যোগাযোগ রাখার অবস্থায় ফিরে আসছিলাম।
I 2.0 যুগে তো ফোন নম্বর হারিয়ে গেলে মানুষই হারিয়ে যায়।
আমার কাছ থেকে কল্যাণও হারিয়ে গেল হঠাৎ করে।
আমার দেখা স্বল্পবাক নির্মল শিশুসুলভ হাসিমাখা মুখটা হঠাৎ করেই যেন ছবি হয়ে আমার স্মৃতির ভান্ডারে ঢুকে পড়ল।
কল্যাণ – আমার দেখা এক এবং একমাত্র কিশোর আধুনিক কবি – আমার স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকবে।
যেখানেই থাকিস কল্যাণ, আশা করি সেখানে তুই তোর শারীরিক কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছিস।
Add comment