সার্ভে ক্যাম্প, ৮৫র জানুয়ারি।
বিপুল চক্রবর্তী, ১৯৮৬, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
সার্ভে ক্যাম্প-প্রথম দিন…
বিই কলেজের ৩য় বর্ষে সার্ভে ক্যাম্প (সিভিল) না থাকলে কলেজ জীবনটা রসে পুরোপুরি টইটম্বুর হতই না। সেই রস জমাট বেঁধে আজ এমনই এক কাঁঠালের আঠায় (কলেজ প্রীতি) পরিণত হয়েছে যা লাগলে পরে আর ছাড়ে না। যতই দিন যায়, এই আঠা ততই যেন ফেভিকলের মতন লেপটে যাচ্ছে। কলেজে থাকাকালীন সিনিয়র দাদাদের থেকে সার্ভে ক্যাম্পের গল্প শুনে মনে হত যে সেই দিনটা আমার জন্য কবে আসবে? আমাদের সেকেন্ড ইয়ারে, ক্যাম্পাস সার্ভে করেছি, যদিও সে আমাকে একাই করতে হয়েছিল। এর সাথে সাথে তখন রাতে নিজের হস্টেল থেকে অন্য হস্টেলে থিওডোলাইট দিয়ে দেখা (কেউ আবার যেন লেডিস হস্টেল না ভাবে) কোন নতুন ঘটনা ছিল না।
৮৫র জানুয়ারি। আমাদের ক্যাম্প হবে ঝাড়গ্রামে। দাদাদের কাছে শুনেছি প্রফেসর পিকে রায় (প্রদীপ রায়) ছিলেন ক্যাম্পের প্রধান আকর্ষণ। ছাত্রদের সাথে একাত্মভাবে মেশেন, খোলামেলা এবং দারুণ মজার লোক। কিন্তু কয়েকদিন আগে আমরা খবর পেলাম ব্যক্তিগত কারণে উনি এবার যেতে পারছেন না, পরিবর্তে ইন-চারজ হয়ে যাচ্ছেন প্রফেসর গাইন, আমাদের থিওরি অফ স্ট্রাকচার পড়ান। কেউ ওনাকে কখনও হাঁসতে দ্যাখেনি। যে করেই হোক পিকে রয় স্যারকে রাজী করাতেই হবে। সবাই মিলে স্যারের কাছে গেলাম, এবং আমাদের কাতর মিনতিতে উনি অবশেষে ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য রাজীও হলেন।
সেই বহু প্রতীক্ষিত দিনটিতে ব্যাগ গুছিয়ে আমরা সকলে কলেজের ফার্স্ট লবিতে এসে দাঁড়ালাম। আমরা ৮৪ জন সিভিলিয়ান, পঙ্গপালের মত গিজগিজ করছি, আর চারিদিকে ছড়ানো আমাদের মালপত্তর। বিখ্যাত মুড়ির টিন বাস আসতেই শুরু হল সংগ্রাম। কে সবার আগে ওই ছোট্ট একটা গেট দিয়ে বাসে চড়ে একটা বসার জায়গা ম্যানেজ করবে? নিজে একটা তো ম্যানেজ করেই নিলাম, আর একটা রাখলাম গেজেলের (অভিজিত বোস) জন্য। ৮৪ জন, আর তার সাথে এত লটবহর আঁটে নাকি? বাকিরা সেকেন্ড ট্রিপে যাবে।
হাওড়া স্টেশনে ট্রেন যথাসময়ে এলো। আমরা উঠে পড়েছি, কিন্তু সেকেন্ড গ্রুপ পৌছোয়নি। যখন ট্রেন ছাড়ার কুউউউউ দিয়ে দিয়েছে, আমরা চেন টেনে দিলাম। কিছু যাত্রী প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু ৫০ জনের মিলিত সিদ্ধান্তে সে প্রতিবাদ পাত্তা পেলো না। বাসে সেকেন্ড গ্রুপের সবাই পৌছোনোর পর আরও ২০ মিনিট বাদে ট্রেন ছাড়ল। ঝাড়গ্রাম পৌছালাম সন্ধ্যার একটু আগে। রাজ কলেজের মাঠে আমাদের ক্যাম্প। এরকম ম্যাট্রিক্স ফর্মে ক্যাম্প কোনদিন দেখিনি। আমাদের জন্য ৬X৪ মানে ২৪ টা ক্যাম্প, একটা ক্যাম্পে ৩-৪ জন থাকতে পারে। আর আছে প্রফেসরের জন্য ফ্যামিলি ক্যাম্প, দুটো ব্যাচেলর ক্যাম্প, ড্রইং ক্যাম্প, ডাইনিং ক্যাম্প, এছাড়া কিচেন ও স্টোর। অবাক হলাম সিকিউরিটির ব্যবস্থা দেখে। আমাদের স্টুডেন্ট ক্যাম্পের চারিদিকে আটজন আদিবাসী দিবারাত্রি ধনুকে তীর লাগিয়ে এটেনশন হয়ে বসে আছে। সেই অভিনব সিকিউরিটি আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। তবে যে কদিন ক্যাম্পে ছিলাম পরম নিশ্চিন্তে ও নিরুপদ্রবে ছিলাম, কারোর একটা জিনিষও এদিক ওদিক হয়নি। টেন্টের ভিতরে বেশ গরম এবং আরামদায়ক। মালপত্র রেখে খানিক বিশ্রাম নিয়ে বাইরে এলাম। আমি গেজেল, বুড়ো (জয়ন্ত) ও ল্যাস্কি (অরুনাভ লস্কর) এই চারজন। শীতকালের রাত। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। কাছেই একটা চায়ের দোকানে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিলাম। গেজেল দোকানদারকে জিজ্জাসা করল, এখানে মাল কোথায় পাওয়া যাবে? উত্তর এলো স্টেশন যেতে হবে; তবে লোকাল বা মহুয়া সামনের দোকানেই পাবো, এই বলে সামনে একটা ঝুপড়ি দেখিয়ে দিল। মহুয়ার নাম শুনে মনটা কেমন যেন আনন্দে নেচে উঠল, সুনীল গাঙ্গুলীর কাহিনীতে মহুয়ার গল্প পড়েছি, শেষে কিনা এত নাগালের মধ্যে? বুড়ো বলল চল একটু টেস্ট করি। আমরা সেই ঝুপড়িতে গিয়ে বসলাম। চায়ের গ্লাসের চেয়ে একটু বড় গ্লাস, যতদূর মনে হয় সেই যুগেই ২ টাকা করে নিয়েছিল। আমরা সবাই দুগ্লাস করে মেরে দিলাম। তবে দেখলাম যে মহুয়ার ফুলের গন্ধ যতটাই আকর্ষণীয়, খেতে ততটা সুবিধের নয়। তবে নেশাটা ছিল বড় সুন্দর, এক নিঃশ্বাসেই মেরে দিলাম। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে, ক্যাম্পে ফিরে এসে রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল ৮-৩০ তৈরি হতে হবে। ছোট ছোট সব টেম্পোরারি টয়লেট করা হয়েছে, কিন্তু মনে হল ফাঁকা মাঠে যাওয়াটাই বেশী সুবিধার। জনা চার-পাঁচজন একজোট হয়ে কাছেই একটু ঝোপের মতন জায়গায় গিয়ে বসলাম। এবং সাথে গ্রুপ ডিসকাশনও চলছে যে গেজেল বোধহয় সারারাত মহুয়া নিয়ে রিসার্চ করেছে। আবিস্কার করেছে যে মহুয়া এক আদিম নেশা এবং এর সাথে নাকি মানুষের আদিম প্রবৃত্তির একটা যোগাযোগ আছে। গতকাল রাতে সে এটা অনুভবও করেছে। আর বুড়োর মতামত এ খেলে নাকি পেট পরিস্কার হয়, ওর বাবা থানজোড়া টি- স্টেটের ম্যানেজার, ওখানের লেবাররা খুব খায়। তবে বুড়োর কথাটা তারপরেই উপলব্ধি করেছিলাম। বিই কলেজের জলে কোষ্ঠকাঠিন্যের যে বীজ বপন হয়েছে, তার থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছিলাম, খুবই কুইকলি মাল নেমে গেল।
ফ্রেশ হয়ে ক্যাম্পের সামনে সবাই এসে লাইন করে দাঁড়ালাম। স্যারেরা এসে আমাদেরকে ৪-৫ জনের গ্রুপে আলাদা আলাদা ভাগ করে দিয়ে কি কি করণীয় তা নিয়ে এক দীর্ঘ লেকচার দিলেন। লোকাল লোক বা আদিবাসীদের সাথে যাতে কোন গণ্ডগোল না হয় সেটাও সবাইকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখলেন। আমরা ব্রেকফাস্ট শেষে কাঁধে লেভেল মেসিন, স্টাফ ইত্যাদি নিয়ে চললাম সাইটের উদ্দেশ্যে। মেসিনের ব্যাপারে একটু-আধটু আইডিয়া সকলেরই ছিল, সে যতই ফাঁকিবাজ হোক না কেন। আমাদের গ্রুপের সিরিয়াস জনতারা কাজ সুরু করে দিয়েছে। নন সিরিয়াসরা স্টাফ ধরা বা public control এর মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো সামলাচ্ছি। লোকাল লোকজন অতি কৌতুহলে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁদের সামলানো বা কৌতুহলের প্রশ্নের জবাব দেওয়া, এরকমই এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আমি আছি। কত যে তাদের প্রশ্ন, অপুকেও হার মানিয়ে দেয়। বাবু কি করছিস এখানে তোরা? বললাম, এখান দিয়ে রেলের লাইন যাবে, সেই কাজ হচ্ছে। এবার প্রশ্ন, কবে রেল চলবে? উত্তর, ছমাসের মধ্যে। অজস্র প্রশ্ন। সামনের চায়ের দোকানের মালিক আমাদের খাতির করতে চা নিয়ে এল, যদিও আমরা কেউ চায়ের অর্ডার দিইনি। খেয়ে নিলাম, কিছুতেই পয়সা নিল না। বলল, বাবু, আমার দোকানটার উপর দিয়ে যেন রেললাইন না যায় এটা দেখবেন, গরীব মানুষ চা বিক্রি করেই সংসার চালাই। আমরা গম্ভীরভাবে বললাম, ঠিক আছে দেখছি কি করা যায়। গ্রামের লোক ভেঙ্গে পড়েছে, আমাদের কাজ দেখছে। আমাদের গ্রুপে গেজেল বা বুড়ো নেই। ওদের আলদা গ্রুপ, সেটা অবশ্য একদিকে ভালই। সবাই ফাঁকিবাজ হলে সার্ভের আসল কাজটা কাউকে তো করতে হবে।
প্রথম দিন বেলা তিনটে অবধি কাজ হল। দুপুরে শুধু চা বিস্কুট খেয়েছি। পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। মেসিন গুটিয়ে ক্যাম্পের দিকে হাঁটা দিলাম, সোজা ডাইনিং ক্যাম্পে। অপূর্ব রান্না হয়েছে, ঠেসে মুরগী-ভাত খেলাম। ক্যাম্পের কুক আমাদের হস্টেল থেকেই এসেছে। ক্যাম্পের এটাও এক আকর্ষণ, রোজের খাওয়ার মেনু। আমদের হোস্টেল ঠাকুরই এখানে রান্না করছে, অথচ কি করে এত ভাল স্বাদ হলো এটাও এক রহস্য। আমাদের যারা ম্যানেজার ছিল, তাঁরাও নিরলস পরিশ্রম করেছে। এদের মধ্যে ব্যাং (শান্তনু) গাবু (স্নেহাশিস) ও সূর্যের কথা বলতেই হয়।
এবার ছোট্ট করে একটা দিবানিদ্রা মেরে দিলাম। পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে গেজেলের টেন্টে গিয়ে দেখি আমাদের মেস ম্যানেজার ব্যাং (শান্তনু) বসে। এবং অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে ছিলিম বানানো চলছে। বসে গেলাম এবং যোগদানও করলাম। কোথা থেকে যে টাইম পাস হয়ে যায় বোঝাই যায়না। আর ধুমকিতে বিশ্বের কত বিভিন্ন টপিক নিয়ে যে আলোচনা হয়!
তারপর টেন্টের বাইরে এলাম। শীতের দিন। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে গেছে। দেখি একটা ভ্যান রিক্সায় মেসের মালপত্র এসেছে। এর আগে শখ করে অনেক ভ্যান বা রিক্সা চালিয়েছি। ভ্যান নিয়ে রাস্তায় উঠলাম, পিছনে বসে তিন চারজন। সোজা উঠলাম স্টেশন যাবার রাস্তায়। রাস্তা নির্জন, দু’দিকে সারি সারি গাছ, একটা গা ছমছম করা পরিবেশ। বেশ কিছুক্ষন চলার পর হঠাতই খেয়াল করলাম যে আমাকে আর প্যাডেল মারতে হচ্ছে না, ভ্যানটা নিজে নিজেই চলছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে। আমার গা ছমছম শুরু হলো। কেউ যেন ভ্যানটাকে ঠেলছে, কিন্তু পিছনে কেউই নেই। ওদেরকে কিছু বলতে পারছিন কারণ সাহসী বলে নিজের খানিক অহঙ্কারও আছে। এভাবেই একটুও প্যাডেল না মেরে প্রায় দু-কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে স্টেশন পৌছালাম। এবার ফেরার পালা। স্টেশনে তাও কিছু লোকজন আছে, কিন্তু তারপরই আবার গা ছমছম করা রাস্তা। এতক্ষণে বুঝলাম তখন কে ঠেলছিল। আসবার রাস্তার স্লোপ ছিল স্টেশনের দিকে। ফেরার সময় চারজনকে টানতে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ধুমকির গুণেই টেন্টে ফিরলাম। এতদিনে বুঝলাম কেন সমস্ত রিক্সাওয়ালা, ভ্যানওয়ালারা গাঁজা খায়। গাঁজা খেলে যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকা, শারীরিক বিকার কমে যায়, যে কারণে সাধু-সন্নাসীরা গাঁজা খায়। অনেক দেশে ক্যান্সার পেশেন্টকেও গাঁজা প্রেস্ক্রাইব করা হয়, অসহ্য ব্যাথা থেকে কিছুটা রিলিফ দেওয়ার জন্য। তাই গঞ্জিকা সেবন একান্তই অপরিহার্য।
সেই রাতের শেষ কাজগুলো ছিল মহুয়া পান, তারপর ভাট করা ও ডিনার। এইভাবে ক্যাম্পের প্রথম দিনটা কেটে গেলো। আমাদের ক্লোজ গ্রুপের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে আমরা নিজেদের মধ্যে এতটাই কনফাইন্ড হয়ে থাকতাম যে একমাত্র কাজের ব্যাপার বাদে অন্যদের সাথে কমিউনিকেশন বেশ কম হত। চার বছর কলেজটা এইভাবেই কেটেছে। আমাদের মধ্যে আমি যেহেতু একটু আধটু খেলাধুলা বা সাঁতার নিয়ে থাকতাম তাই কিছুটা এর বাইরে বেরতে পেরেছিলাম, কিন্তু অনেকেই আমাদেরকে অন্য গ্রহের জীব ভাবত।
সার্ভে ক্যাম্প- দ্বিতীয় দিন
দ্বিতীয় দিনটা আগের দিনের মতই শুরু হলেও আজকের দিনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। সকালের রুটিন কাজকর্ম সেরে মেশিন নিয়ে আমাদের সাইটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। সাড়ে এগারোটা নাগাদ গেজেল ও বুড়ো এলে আমরা তিনজনে সেই চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। চা আর সিগারেট চলছে। গেজেল দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের এখানে হাঁড়িয়া পাওয়া যায়? দোকানদার জানিয়ে দিল যে সামনে পাঁচ মিনিটের রাস্তা, সেই গ্রামের এক আদিবাসী মেয়ে ওর নিজের বাড়িতেই বিক্রি করে। শুনেই আমরা তৎক্ষণাৎ উঠে সেই গ্রামের দিকে রওয়ানা দিলাম। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বাড়িটাও দেখিয়ে দিল। মাটির ঘর, খড়ের চাল, বাড়ীর সামনে উঠোন, শুকনো খেজুরের পাতায় সীমানা দেওয়া, কিছুটা প্রাইভেসি, সমস্ত উঠোন গোবর দিয়ে লেপা, ঝকঝকে পরিষ্কার, একপ্রান্তে ইট দিয়ে পাতা এক বসার জায়গা, তার উপরে ছোট এক চালা। দুজন আদিবাসী এলুমিনিয়ামের বাটিতে সাদা মত থকথকে একটা পানীয় খাচ্ছে। বুঝলাম এটাই হাঁড়িয়া। একটা বাচ্চা সারা গায়ে মাটি মাখা, নিজের মনে উঠোনে হামাগুড়ি দিয়ে খেলছে। আমরা গিয়ে সেই ইটের উপর বসলাম। খানিক অপেক্ষা করার পর দেখলাম এক আদিবাসী মেয়ে মাথায় এক বিশাল হাঁড়ি নিয়ে ঢুকল। হাঁড়ির ভিতরের সাদা পানীয় ছল্কে ছল্কে মেয়েটার শাড়ী ভিজিয়ে দিয়েছে। যে লোক দুটো হাঁড়িয়া খাচ্ছিল মেয়েটি তাঁদেরকে আদিবাসী ভাষায় কিছু বলতেই তাঁরা উঠে হাঁড়িটা নামাতে মেয়েটাকে সাহায্য করল। বাচ্চাটা হামাগুড়ি দিয়ে মেয়েটার কাছে এলো। তাঁকে একটু আদর করে মেয়েটা ঘরের ভিতর চলে গিয়ে খানিক পরে অন্য এক শাড়ি পড়ে এলো। এবার মেয়েটিকে ভালভাবে দেখলাম, বয়স একুশ-বাইশের হবে, রঙ শ্যামলা বা কালো, মুখের আদল্টা বেশ আকর্ষণীয়, কপালে ছোট একটা টিপ, মাথায় ফুল গোঁজা। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আমাদের জিজ্ঞাসা করল, বাবু, হাঁড়িয়া খাবি তো? আমরা মাথা নাড়াতেই সে তিনটে বাটিতে হাঁড়িয়া নিয়ে এলো, সাথে একটু ছোলা, আদা। সব দেখে বিই কলেজের ব্যাতাইতলা গার্ডেন বারের কথা মনে এলো।
আমরা ধীরগতিতে পান করছি, আদিবাসী মেয়েটা আমাদের সামনে এসে বসল। জিজ্ঞাসা করল, তুরাই কি রেলের কাজ করছিস? বুঝলাম সারা গ্রামেই একথা রটে গেছে। আমরা হ্যাঁ বলায় সে নিজে থেকেই বলল, আমার মরদ লেবারের কাজ করে, মাঝেমাঝেই কাজ থাকে না, তাই সে হাঁড়িয়ার ব্যবসা করে। ওর যখন কাজ থাকে না, আমাকে মদত করে। মেয়েটা আমাদের সাথে এমনভাবে অনর্গল কথা বলতে লাগল যেন কত দিনের চেনা আপনজন। আরও কত যে কথা, ওর বাবা, মা, ভাইবোন। ওরা বিয়ের পর থেকেই আলাদা থাকে, ইউরোপিয়ান কালচার। মাঝে মধ্যে বাচ্চাটাকে আদর করছে। আমি প্রশ্ন করলাম হাঁড়িয়া কি তুমি নিজে বানাও? বলল না। সে অনেক ঝামেলা। গ্রামেই একজন বানায়, সেখান থেকে নিয়ে আসে। দাম জিজ্ঞাসা করায় বলল পাঁচ টাকা। ৮৫র জমানায় পাঁচ টাকা? দাম দিয়ে ফিরে আসছি, মেয়েটি বলল কাল আসিস, তুদের রসসি খাওয়াব। সে আবার কি? বলল এই হাঁড়িয়াকেই রিফাইন্ড করবে। সে নাকি খেতে আরও ভালো আর হাঁড়িয়ার থকথকে ভাবটাও থাকে না। ভাবি, কত সহজ সরল অনাড়ম্বর এঁদের জীবন যাপন। গরীব অথচ কত উচ্ছল, সাবলীল, পরিশ্রমী। বাচ্চাটাও ধুলোময়লায় গড়াগড়ি খাচ্ছে অথচ কত প্রানবন্ত, একফোঁটা কাঁদতে দেখলাম না। গেজেল জিজ্ঞাসা করল, কিরে কি ভাবছিস? কিছু না বলে এড়িয়ে গেলাম, নইলে আওয়াজ খেতে হবে।
রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আজ আর অতটা খিদে পায়নি, আর বেশ এনারজেটিক লাগছে। সার্ভে গ্রুপে ফিরে গিয়ে মন লাগিয়ে কিছু কাজ করলাম, এবং দিনের শেষে, আবার ব্যাক ট্যু দ্যা টেন্ট। রাতে শুয়ে শুয়ে কত কথাই যে ভাবছিলাম। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ হয়ে একটা নির্দিষ্ট জীবনের বৃত্তে ঘোরাফেরা করি, জীবনটা কত যে ছোট এক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে কত মানুষ যে কিভাবে দৈনন্দিন বেচে থাকার লড়াই করে চলেছে। কত দারিদ্র, অভাব, অনটন তার কোন খবরই রাখিনা। আজ কিছুটা সময় ওদের সাথে কাটিয়ে আমার অদ্ভুত এক অনুভুতি হলো। আমি যদি এরকম পরিবারে জন্মাতাম? এরপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরও পাইনি, স্বপ্নে দেখলাম আদিবাসী মেয়েটি তার স্বামী ও বাচ্চাকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, আমি মেয়েটিকে ডাকছি কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোচ্ছে না। মেয়েটি আমাকে চিনতেই পারল না, ওরা সকলে ধীরে ধীরে অনেক দূরে চলে গেল।
সার্ভে ক্যাম্প-আরও কয়েক দিন
এভাবেই দুতিনদিন কেটে গেল, সিরিয়াস এবং ভাল ছেলেরা রোজ সন্ধ্যেবেলা ড্রয়িং ক্যাম্পে ফিল্ডওয়ার্ক আর লেভেলবুক বা ড্রইং একটু একটু করে তৈরি করছে। হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে কাজ হচ্ছে। আমরাও মাঝেমধ্যে ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সাহায্য করার সদিচ্ছা জানিয়ে তারপরই কেটে পড়ছি। ভাবটা এই যে মালটা আগে নামুক। তারপর চোথা মেরে দেব। ওরাও জানে, তাই তেনারাও আমাদেরকে খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে রাখেন না। ওনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাল আমাদেরকে বিনা বাক্যব্যয়ে দিয়ে দেন, আর সেটাই আমরা চোথা মেরে সাবমিট করি।
ইদানীং রোজই ফিল্ড ওয়ার্কের ফাঁকে আমরা দুপুরে রসসি বা হাঁড়িয়া খেতে যাই। আদিবাসী মেয়েটি আমাদের এত খাতির করে কেন কে জানে? হয়ত সমবয়সী, বা কিছুটা হয়তো সম্ভ্রম দেয় শহুরে বাবুদের। একদিন মেয়েটি বলল, আজ মকর সংক্রান্তি, ওঁদের সবথেকে বড় পরব। সেদিন সকালে তাঁরা স্নান করে সবাই নতুন জামাকাপড় পড়ে পূর্বপুরুষদের পূজা করে। দুপুরে হাঁড়িয়া, মাংস, ভাত খাওয়া হয় আর সন্ধ্যে থেকে সবাই মিলে নাচ, গান আর মহুয়া, এসব চলে। এরপর যা বলল সেটা শুনে আমাদের চক্ষু ছানাবড়া। বুঝলাম না সত্যি বলছে না রসিকতা! বলে এরপর গভীর রাত অবধি নাচ আর মহুয়া চলে, যে ছেলেমেয়েরা পাশাপাশি নাচে বা নিজের ইচ্ছেমতন তাঁরা একসাথে রাত কাটায়। মনে হল নিশ্চই আমাদের ঢপ মারছে। গেজেল বলল আমরাও যদি এসে তোদের সাথে নাচি, তাহলে? শুনে তো সে হি হি করে হেসে উঠল। আমরা মোহিত হয়ে, কিছুটা বোকার মত ওর হাসি থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রথমে হাসতে হাসতে বলল তাহলে তুরাও এক একটা মেয়ের সাথে রাত কাটাবি। এই বলে আবার হাসি শুরু করল। গেজেল মাঝেমধ্যেই এমন বেফাঁস বলে ফেলে, নিজেদেরই বোকা বনে যেতে হয়। মেয়েটি জানালো ওই নাচের অনুষ্ঠানে বাইরের কাউকে অনুমতি দেয় না। বলল, তুরা পরেরদিন আসিস। তুদের জন্য খাবার ও মহুয়া রেখে দিব (ওরা অতিথিকে এই দিয়েই আপ্যায়ন করে)। সেদিন তাড়াতাড়িই ক্যাম্পে ফিরে গেলাম।
এদিকে কয়েকদিন ধরেই শুনছি রাজ কলেজের কিছু কন্যাকে আমাদের ক্যাম্পের ধারেকাছে দেখা যাচ্ছে। একদিন ফিরে এসে দেখি এক ঝাঁক মেয়ে। আর আমাদেরই কিছু ছেলেপুলে তেনাদের সাথে দিব্যি গপ্পে মশগুল। আমাদের জ্বলন শুরু হল। তাড়াতাড়ি খেয়ে ক্যাম্পের বাইরে এলাম। তিন চারটে মেয়ে আমাদের সামনে দিয়েই হাঁটছিল। গেজেল বলল, আপনারা কি এই কলেজেই পড়েন? ওনাদের একজন স্মার্টলি বলল, হ্যাঁ। আর বাকিদের দেখি মিটিমিটি হাসছে। বুঝলাম, দুপক্ষেরই পারস্পরিক পরিচয় করার ইচ্ছে। এবার সেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কোথায় পড়েন, এখানে কি করছেন ইত্যাদি। আমি মেয়েদের সাথে কথা বলায় বরাবরই অপটু, এবং ভীষণ আতা আনস্মার্ট। কোএড স্কুলে পড়িনি, আমার কলেজ ব্যাচেও কোনও মেয়ে নেই। শুধুমাত্র কলেজের সিনিয়র করবীদির সাথেই যা কিছু ফ্রি কথাবার্তা হতো। গেজেল আর শেখরই তখনের প্রশ্নোত্তর পর্ব সামলাচ্ছে। আমাদের কোন চান্সই দিচ্ছে না। আমি মরিয়া হয়ে শুরু করলাম, আপনারা কোথায় থাকেন? এরপরই ধীরে ধীরে আমার বা আমাদের কথাবার্তা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেল। কাছেই এক গাছতলায় আমরা সবাই গিয়ে বসে ঘন্টা দুয়েক সময় ভাটালাম। সময় যে কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারি না। ওদের একজন বলল, বাড়ী ফিরতে হবে। শেখর বলল, আর পাঁচ মিনিট প্লিজ। মনে হল ওরাও যেন সময়টা ভালোই উপভোগ করছে। অবশেষে বলল, আজ উঠি, কাল আবার দেখা হবে। ওরা চলে গেল। আমাদেরও সই বিকেলটা কেমন বেশ রঙ্গীন রঙ্গীন লেগেছিলো। পরদিন কি কি কথা বলব সেটাই মনে মনে ভাবতে শুরু করে দিলাম, এবং কে কি বলল সেই নিয়ে মন্থন করে সময়টাও কাটিয়ে দিলাম।
পরের দিনের মর্নিং মিটিঙে স্যার বললেন যে আগামীকাল সংক্রান্তি, আদিবাসীদের বড় উৎসব, ঐদিন ওরা সবাই নেশা করে থাকে। কোনরকম গণ্ডগোল যাতে না হয় তাই সারাদিন ছুটি, সেদিন সার্ভের কোন কাজ হবেনা। শেখর বুদ্ধি দিল, আমরা চারজন আর রাজ কলেজের চারজন মিলে কোথাও ঘুরে আসি। প্ল্যানটা খুবই ভাল, তবে মাত্র দুদিনের আলাপ। মেয়েগুলো কি রাজী হবে? শেখর বলল, আজ দেখা হলে কনভিন্স করব। তাড়াতাড়ি কাজকর্ম মিটিয়ে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। মনে চাপা উত্তেজনা, এক মিশ্রিত আনন্দ। খাওয়ার পরে ওই গাছতলায় বসে রইলাম। খানিক পরেই মেয়েরা এলো। অনেকটাই টেনশনমুক্ত। শেখর বলল, কাল আমাদের ছুটি, চলুন না কোথা থেকে ঘুরে আসি। কোথায় যাওয়া যায় সেই নিয়েও বেশ কিছু আলোচনা হল। ওদের তিনজন রাজী, কিন্তু একজন বলল হবেনা, বাড়ীতে জানলে অশান্তি হবে। বাকীরাও সেই শুনে উৎসাহে ভাটা পড়ল। প্ল্যানটা আর এগুলই না। আমাদেরও মুডটা অফ হয়ে গেল, আর মুড ফেরাতে সন্ধ্যে থেকেই, ওই ঝুপড়িতে গিয়ে বসলাম।
রাতে আমি আর ল্যাস্কি (অরুনাভ) ঠিক করলাম যে পরের দিন আমরা ঘাটশিলা যাবো। ওখানে ধারাগিরি নামে নাকি এক বিখ্যাত জলপ্রপাত আছে। আমি অত খবর রাখিনা, এটা ল্যাস্কির ফান্ডা। আরও দুজন বলল আমাদের সাথে যাবে। সন্দীপ কুমার আর বিজুদা (বিশ্বজিত)। এসব ব্যাপারে গেজেলের ইন্টারেস্ট থাকে না (ফিজিকাল এক্টিভিটি বা খেলা ধুলোর সাথে ওঁর কোন সম্পর্কই নেই)।
পরের দিন সকালে ঝাড়গ্রাম স্টেশন থেকে ইস্পাত ধরে, ৪০ মিনিট পর ঘাটশিলায় নামলাম। টিকিট না কাটার ব্যাপারে আমি একটু ডেয়ারিংই ছিলাম, তাই আবার WT । স্টেশনে নেমে ল্যাস্কি তাঁর প্ল্যানটা জানালো। প্রথমে যাব ধারাগিরি ফলস, তারপর ফিরে বিভূতিভূষণের বাড়ী। সন্ধ্যে ৫ টায় ফেরার ট্রেন স্টিল এক্সপ্রেস। তার আগেই ফিরে আসতে হবে। ল্যাস্কি দেখতে ছোটখাটো হলেও ধানিলঙ্কা। হিন্দুস্কুলের ছেলে, নিজস্ব মতামত বা কখন কি করা উচিত এই সম্বন্ধে নিজের একটা পরিস্কার ধারণা ছিল। স্টেশনে নেমে স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসা করে হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় এক ঘন্টা হাঁটার পর ক্লান্ত হয়ে এক গাছতলায় গিয়ে বসলাম। আমরা হাল্কা জংগল গাছপালা এসবের মধ্যে দিয়ে চলছিলাম, মানুষ খুব কমই। চারিদিকে সবুজ আর উঁচু টিলা, মনে হচ্ছে পৃথিবীতে শুধুমাত্র আমরাই চারটি প্রানী। আবার চলা শুরু করলাম, স্থানীয় লোকের সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করছি ধারাগিরি আর কতদূর? সেই একই উত্তর, আরও সামান্য কিছুটা গেলেই পেয়ে যাবেন। এদিকে সময় বেলা প্রায় ১২ টা, খিদেও পেতে শুরু করেছে। মাঝের দু একটা গ্রাম ছেড়ে এলাম কিন্তু খাওয়ার মতন কিছুই দেখলাম না। এবার পাহাড়ি রাস্তা শুরু হয়ে গেল। প্রায় দু’টো নাগাদ ধারাগিরি পৌছালাম, ফলস সন্মন্ধে যা ধারণা ছিল তাতে আশাহতই হলাম। উপর থেকে তিরতির করে জল নেমে একটা ছোট ডোবার মত হয়ে আছে। জলটা অবশ্য খুবই পরিষ্কার। খিদেয় তৃষ্ণায় শরীর অবসন্য, এছাড়া ফেরার ট্রেন নির্ঘাত ফেল করব এইসব দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলাম। জলের প্রতি আমার বরাবর অমোঘ আকর্ষণ। জামা প্যান্ট খুলে ছোট্ট জলাশয়ে ঝাঁপ দিলাম। অসম্ভব ঠাণ্ডা জল কিন্তু রিফ্রেশিং, আমার দেখাদেখি ল্যাস্কিও জলে নামল। স্নান করে কিছুটা যেন এনার্জি পেলাম। বুঝতে পারছি ফেরার ট্রেন পাবো না তবু এবার স্টেশনের দিকে রওয়ানা দিলাম। খিদের চোটে মনে হচ্ছে নাড়িভুড়ি ডাইজেস্ট হয়ে যাবে। যদি ক্যাম্পে ফিরতে না পারি তাহলে কপালে কি আছে এই আলোচনা করতে করতেই চলেছি। এখন একমাত্র ভগবান বা কোন মিরাকলই আমাদের রক্ষা করতে পারে।
আজও যখন সেইদিনের কথা চিন্তা করি কেমন যেন গল্পের মত লাগে, এবং সব কিছুর পিছনে যে সর্বশক্তিমান কেউ আছেন এটাও বারে বারে মনে হয়। বেশ কিছুটা আসার পর হঠাত দূরে দেখলাম, কিছু লোকজন মনে হয় পিকনিক করতে এসেছে। এটা যাওয়ার সময় খেয়াল করিনি। আমি ওনাদের দিকে এগিয়ে গেলাম, বাকি তিনজন পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে, কিন্তু আমি মরীয়া। একজনকে ডেকে বললাম, দাদা, আমরা শিবপুর বিই কলেজের ছাত্র, খুবই খিদে পেয়েছে। কিছু খাবার পেলে ভাল হত। জানলাম এনারা সবাই বাঙালী, জামশেদপুর টিস্কোতে কাজ করেন, এবং পিকনিক করতে এসেছেন। তখন ওনাদের পিকনিক শেষ, উদ্বৃত্ত খাবার স্থানীয় গ্রামের কাঙ্গালীদের দিতে যাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকজন ভিখারী ধরনের লোক পাত পেতে বসেছে। আমাদের উনি বললেন কিছু যদি মনে না করেন তো এখানেই বসে পড়ুন। আমি আমার তিন বন্ধুকে ডাকলাম। ওরা লজ্জায় কনে বউএর মতন বেশ কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ছিল। আমরা ভিখারীদের থেকে একটু তফাতে গিয়ে বসলাম। কিছু ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন ছিল। জীবনে অনেক হোটেল রেস্টরেন্টে খেয়েছি, কিন্তু সেদিনের মতন এত তৃপ্তি করে বোধহয় খুব কমই খেয়েছি। শেষে ছিল চাটনি আর মিস্টি।
খাওয়া তো হল এবার যাওয়ার চিন্তা। হেঁটে গেলে কমসে কম আরো তিন ঘন্টা, ট্রেন ধরা সম্ভব নয়। আবার সেই ভদ্রলোককে বললাম, ট্রাকে কি আমাদের ঘাটশিলার কাছাকাছি কোথাও ড্রপ দিতে পারবেন? আবার আশ্চর্য। ভদ্রলোক বললেন, ওনারা ওই রাস্তা দিয়েই যাবেন আর আমাদের স্টেশনে ছেড়ে দেবেন। তিন ঘন্টার পায়ে হাঁটা রাস্তা আমরা মাত্র ২০ মিনিটে পৌছে গেলাম। অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা স্টেশনে গিয়ে উঠলাম। ট্রেন আসার এখন অনেক দেরী, তাই বিভূতিভুষনের বাড়ী আর গ্রাম দেখতে গেলাম। সামান্য কুঁড়েঘর, সামান্য পরিবেশে ওনার জন্ম, এবং কি অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যে। যথাসময়ে স্টেশনে ফিরে ট্রেনে চড়ে আবার ঝাড়গ্রাম স্টেশন এবং অবশেষে ব্যাক ট্যু দ্যা টেন্ট। ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল, স্যারেরা বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যেরকম বাড়িতে দেরী করে ফিরলে বাবা-মা বাইরে অপেক্ষা করেন। ভাবলাম বকাবকি করবেন, উল্টে আদ্যপ্রান্ত আমাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত শুনে বাহবাই দিলেন আমাদের এডভেঞ্চারাস জার্নির জন্য। হ্যাচাকের আলোয় দেখলাম স্যারেদের ( পিকে রায় ও গাইন স্যার) সদ্য উৎকন্ঠামুক্ত স্নেহমিশ্রিত গর্বিত মুখ। আজ নতুন রুপে স্যারদের দেখে ওনাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তির ফল্গুধারা নিজের মধ্যে অনুভব করলাম।
সার্ভে ক্যাম্প – অন্তিম ভাগ
পরের দিন সকালে রুটিন মাফিক যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গেজেল বলে রেখেছে যে আজ আদিবাসী মেয়েটি আমাদের যেতে বলেছে, আমরা যেন ভুলে না যাই। গেজেল একটু পরেই আসবে। আমরা সার্ভের কাজ শুরু করে দিলাম। তার প্রায় ২ ঘন্টা বাদে গেজেল এলো। শুধু আমরা দুজনেই গেলাম। মেয়েটি মনে হয় আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমরা যেতেই একটা প্লেটে দুটো ভাজা আর গ্লাসে মহুয়া নিয়ে এলো। বলল, ঊটা হচ্ছে পিঠা, খেয়েই দেখনা কেমন? আমরা খেতে শুরু করলাম। মনে হচ্ছে ভেতরে মাংস আছে, স্বাদ বেশ ভাল। এতক্ষনে বলল শুয়োরের মাংসের পিঠা। এরকম অদ্ভুত খাদ্য কোনদিন খাইনি, তবে ভালই লাগছিল। সঙ্গে মহুয়া। আমরা খেয়ে চলেছি, মেয়েটি বিস্তারিত বলা শুরু করল গতকাল রাতে কি কি করেছে। গেজেল প্রশ্ন করল কাল তুই কার সাথে নেচেছিস? জবাবে বলল, নিজের মরদ থাকতে আমি অন্যের সাথে নাচব কেনে? গেজেল আরও কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, আমি ইশারায় বারণ করলাম। সে ঘরে গিয়ে আরও দুটো পিঠে নিয়ে বলল এটা তুর আর একটা বন্ধুর জন্য। এরকমই কথাবার্তা চলছে, হঠাত খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম দূরে আমাদের দুজন ইয়াং স্যার (এক্স বিই কলেজ) এদিকেই আসছেন। গেজেলকে দেখিয়েই আমরা উঠে পড়লাম, মুখে হাত চাপা দিয়ে খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলাম, কিছু দূরে গিয়ে পিছন ফিরে দেখলাম আমাদের দুই স্যার এদিক ওদিক দেখে সেই ঠেকে ঢুকে পড়লেন।
এভাবেই কটা দিন কোথা দিয়ে কিভাবে যে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ক্যাম্পের শেষ রাতে হল ক্যাম্প-ফায়ার। আমাদের তরফ থেকে একটা নাটক পরিবেশন করলাম। চারজন স্যারকে নিয়ে একটা ক্যারিকেচার, তাদের চলন, বলন, খুটিনাটি নকল করে দেখান হল। সবাই খুব আনন্দ মজা করলাম এবং স্যারেরাও উপভোগ করলেন।
১৫ দিনের ঝাড়্গ্রামের মায়া কাটিয়ে পরের দিন সকালে ঘরে (হস্টেলে) ফিরে যাবো। জায়গাটার জন্য একটা মায়া পড়ে গেছে, আর কত ঘটনার যে সাক্ষী হয়ে রইল ছোট্ট এই জায়গাটা। মানুষ বড় অদ্ভুত জীব, মায়ার বাঁধনে বাধতে সময় লাগেনা আবার কাটিয়ে উঠতেও সময় লাগেনা। শুধু থেকে যায় স্মৃতির মানসপটে আঁকা ছবি যা সময়ের সাথে সাথে মলিন ও অস্পষ্ট হয়ে যায়।
এবার আমাদের গন্তব্য কাকড়াঝোড় ফরেস্ট। আমরা অনেকেই বাসের ছাদে চড়ে বসলাম। সারাটা রাস্তার দুধারে ডালপালা ছড়ানো সারি সারি গাছ, যার ফলে গাছের ডালের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে মাঝেমধ্যেই শুয়ে পড়তে হচ্ছে। বাস চলছে তার পুরো গতিতে। একটা মোটা ডালের সাথে লাগলে মারাত্মক চোট এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারত। অথচ “আঠারো বছর বয়স কি দুঃসহ”র নেশায় তখন ব্যাপারটাকে খেলা হিসাবেই নিয়েছিলাম। দীর্ঘ ২ ঘন্টার সফর শেষে কাকড়াঝোড় পৌছালাম। জঙ্গলের মধ্যে গেলাম, যদি কোনও জন্তু জানোয়ার দেখা যায়। এখানেও সেই সারি সারি শাল-মহুয়ার দিগন্ত, নানান পাখির ডাকে মুখর জঙ্গল। খানিক দূরে হাতির ফেলে যাওয়া গু দেখলাম। রাতে হয়ত তেনাদের আগমন ঘটে। আরও খানিক গিয়ে দেখি এক আদিবাসী একটা হাঁড়ি মাটির উনুনে চাপিয়েছে। হাঁড়ির মুখ থেকে একটা পাইপ আর একটা হাঁড়ির মুখে লাগানো। সেই দ্বিতীয় হাঁড়িটা একটা জলের ধারায় বসানো, মানে একটা হাড়ি থেকে গরম হয়ে সেই বাষ্প দ্বিতীয় হাড়িতে গিয়ে ঘনীভূত হচ্ছে। মনে পড়ল, এ তো ক্লাস ৭-৮ এ পড়া পাতন (ফিল্ট্রেশন) প্রক্রিয়া। আদবাসী লোকটিকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে মহুয়া ফুল থেকে মহুয়া মদ তৈরী হচ্ছে। যেটা গরম হচ্ছে সে ফারমেন্টেড মহুয়া ফুল, আর যেটা ঘনীভূত হচ্ছে সেটা ১ নং মহুয়া, একদম খাটি ইথাইল এলকোহল। এটা খুব কড়া, জল না মিশিয়ে খাওয়া যাবেনা। কথায় বলে ঢেকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে, আমাদেরও সেই অবস্থা, যেখানেই যাই মহুয়া আর হাঁড়িয়া। অগত্যা বসতেই হল, কটেজ ইন্ডাস্ট্রি’র এমন খাঁটি জিনিষ তো আর সবজায়গায় পাবো না, তাই জল সহযোগেই খাঁটি মহুয়া সেবন করলাম। কাছাকাছি একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। খাওয়া সেরে আবার বাসে উঠলাম, এবার ট্যুর প্ল্যানে সবার শেষের যাওয়ার জায়গা মুকুটমনিপুর, তারপর ব্যাক ট্যু কলেজ। মুকুটমনিপুর পৌছালাম প্রায় ৪টে নাগাদ। কংসাবতী আর কুমারী নদীর সঙ্গমে এই বাঁধ। Irrigation department এর ইঞ্জিনিয়ার, আমাদের কলেজের সিনিয়র, ঘুরে ঘুরে আমাদের বাঁধটা দেখালেন। চারিদিকে শুধুই জল। প্রকৃতির সৃষ্ট নদীকে বাঁধ দিয়ে বশ মানিয়ে সেই জল চাষের কাজে লাগান হচ্ছে, এছাড়া বর্ষার সময় যে ব্যাপক বন্যা হত তাও এখন অনেক নিয়ন্ত্রণে। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের উদ্যোগেই এই বাঁধের নির্মাণ হয়েছিল। বেশ কয়েকঘন্টা কাটিয়ে আবার বাসে উঠলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। পরে শুনেছি আমাদের পরের ব্যাচ থেকে আর ক্যাম্প হয়নি।
সার্ভে ক্যাম্পের দৌলতে ক্ষণিকের জন্য বাইরের জগতটাকে দেখেছিলাম, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়েছিলাম, গরীব আদিবাসীদের খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম। পরবর্তী জীবনে সেই অভিজ্ঞতাই আমাদের কর্মক্ষেত্রে আরও সাহায্য করেছিল। তাই আমাদের ৮৫র জানুয়ারীর সেই ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা সারা জীবন স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করবে।
ছেলেদের আসল নামগুলো
বুড়ো (জয়ন্ত)
ব্যাং (শান্তনু)
গাবু (স্নেহাশিস)
খুবই ভালো কলেজ জীবনের সেই দিনগুলির বিবরণ লিখেছেন।