সাহিত্যিকা

বি ই কলেজের প্যাঁচালি (১৯৬৫ – ১৯৭০)

বি ই কলেজের প্যাঁচালি (১৯৬৫ – ১৯৭০)
সুদীপ রায়, ১৯৭০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

ভূমিকা – একবার পঁচিশে জানুয়ারি তারিখে পার্ক স্ট্রীটে ফ্রীম্যাসন হলে আমরা যারা বি ই কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে পাশ করে বেরিয়াছিলাম, তাদের একাংশ সপরিবারে আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার স্বর্ণ জয়ন্তী উৎসবে সামিল হয়েছিলাম এক মনোরম অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে আমি স্বরচিত একটি পাঁচালি পাঠ করে শুনিয়েছি। নীচে সেটি দিলাম।

********

স্বর্গে এক মনোরম সন্ধ্যায় লক্ষ্মী নারায়ণ বসে গল্পগুজব করছেন। এমন সময়ে লক্ষ্মী দেবীর ইচ্ছে হল নারায়ণের মুখে মর্তের কিছু অমৃত বাণী শোনার। স্ত্রীকে খুশী রাখতে ভগবান বিষ্ণু পত্নী লক্ষ্মীদেবীকে যা শোনালেন সেটাই আমি পাঁচালীর ছন্দে এই পাতায় সবাইকে শোনাচ্ছি।
মনে রাখবেন এটি পাঁচালি … তাই সুর করে পড়তে এবং শুনতে হবে। না হলে মজা মাটি।

********

বৈকুণ্ঠে একদা বসি লক্ষ্মী নারায়ণ,
প্রেমালাপে মত্ত ছিল তারা দুইজন।
হেনকালে লক্ষ্মীদেবী বলিল হঠাৎ,
‘মর্ত্যলোকের গল্প আজ শুনাও প্রাণনাথ।’
নারায়ণ বলে ‘দেবী শুন তুমি তবে,
এমন এক স্থানের কথা বিচিত্র যা ভবে।
মর্তলোকে ভারতবর্ষে আছে এক স্থান,
যার কথা ত্রিভুবনে অমৃত সমান।
বঙ্গদেশে গঙ্গাপাড়ে শিবপুর ধামে,
আছে সে পবিত্র স্থল বি ই কলেজ নামে।
বি ই কলেজের কথা অমৃত সমান,
শুনিয়া সে কথা লোকে হয় পুণ্যবান।
তাদের-মধ্যে সত্তরের পাশ করা ব্যাচ,
অসাধারণ, অনবদ্য, ট্রুলি আনম্যাচ।‘
লক্ষ্মীদেবী সেই কথা শুনি কর জোড়ে,
বি ই কলেজের কথা শোনে ভক্তিভরে।
নারায়ণ কহে ‘তবে শুন লক্ষ্মীদেবী,
অমৃতবচন শুনে পূণ্য কর হেভি।
উনিশশো পঁয়ষট্টি হতে উনিশশো সত্তর,
পাঁচ বছরের গল্প শুন হে সত্ত্বর।‘

এই কথা বলে ভগবান নারায়ণ বি ই কলেজের অমৃত বাণী শোনাতে আরম্ভ করলেন।
বি ই কলেজের কথা অমৃত সমান,
শোনায় যে, যে শোনে সে দুইই পূণ্যবান।
আমি সুদীপ শোনাই সেই কথা পুণ্যময়,
জয় জয় পঁয়ষট্টি সত্তরের জয়।
শ্রোতারা তোমরা যারা আছ হেথা বসে,
মাঝে মাঝে তিনখানি ‘হুয়ো’ দিয়ো কষে।
বি ই কলেজের নামে একটা হুয়ো …
আর একটা হুয়ো
আরও একটা হুয়ো

********

ভগবান নারায়ণ কিঞ্চিৎ অধিক পঞ্চাশ বৎসর আগেকার কাহিনী শুনাইতে শুরু করিলেন … ভগবান কী বলিলেন ?

‘পঁয়ষট্টির মাঝামাঝি এক সন্ধ্যাকালে,
পঞ্চ শত বালকেরা আসিল সদলে।
ডাউনিং, স্লেটার, আর হোস্টেল তেরো, বারো,
ছাত্রেরা ঢুকিল, ই-ওয়ান, ই-টু কারো কারো।
মুষ্টিমেয় বালিকাও ছিল সেই দলে,
লেডীজ হোস্টেলে তারা ঢুকিল সকলে।
কোয়েলা, ভারতী, চিত্রা, বিনীতারা আসি,
ছাত্রগণের ক্লিষ্টমুখে ফুটাইল হাসি।
পঞ্চ শত ছাত্র ছাত্রী ছিল র মাল,
ঘরেতে সকলে ছিল দুলালী, দুলাল।
পাঁচটি বছর তারা থাকিয়া সেথায়,
ইঞ্জিনীয়রিং শাস্ত্র তারা পড়িতে যে চায়।
গুরুকুলে চারিতলা ছিল ছাত্রাবাস,
প্রথম রাতেই খাইল র‍্যাগিং এর বাঁশ।
‘র‍্যাগিং কী বস্তু’ লক্ষ্মী প্রশ্ন যবে করে,
বিষ্ণু বলে ‘কাছা খুলে দলাই মলাই করে।’
শান্ত-সুবোধ-ভদ্র সেই বালকের দল,
ভালো ছাত্র হইবার পাইল সুফল।
সিনিয়র দাদারা সব রাতে শুভ ক্ষণে,
গুপ্ত বিদ্যা শিখাইল ধরি জনে জনে।
কচি পেয়ারার মত এসেছিল খাসা,
সপ্তাহান্তে বাড়ি গেল হয়ে পাকা ডাঁশা।
পঁয়ষট্টি সত্তরের কথা অমৃত সমান,
যে বলে, যে শোনে দুইই অতি পূণ্যবান।‘
আমি সুদীপ শোনাই সেই কথা পুণ্যময়,
জয় জয় জয় বি ই কলেজের জয়।
উপস্থিত যারা আছো সব এই দিনে,
এক নয়, দুই নয়, হুয়ো দিও তিনে।
বি ই কলেজের নামে একটা হুয়ো …
আর একটা হুয়ো
আরও একটা হুয়ো

********

তা কলেজে ঢোকার পরে ছাত্রদের কী হল ? লক্ষ্মীদেবী প্রশ্ন করিলেন।
নারায়ণ বলিলেন …

‘কলেজে ঢুকিয়াছিল ছাত্ররা সব সেরা,
আড্ডা মারা, মাসকাট শিখিল সব ত্বরা।
পরীক্ষার খাতায় তার পড়িল অসর,
ফেল করে কিছু ছাত্র নষ্টাইল বছর।
কিছু ছাত্র ছিল সেথা অতীব শয়তান,
অন্য ছাত্রের দিলো তারা নাম ধরে টান।
বাপ মায়ের দেওয়া ভালো নামগুলি হায়,
রিজেক্ট হইল নিক নেমের তাড়ায়।
কেউ হল ‘উচ্ছে’ আবার কেউ হল ‘মুলো’,
কেউ বা ক্যামেল ‘হল’, কেউ হল ‘হুলো’।
কেউ ‘স্যার’, কেউ ‘গুরু’ কেউ বা আবার,
‘রাক্ষস’ নামেতে ঢের খাইত খাবার।
দুই অশোক ‘কাঁচা’, ‘পাকা’, ‘দাদু’ সৌমেন,
‘জ্ঞানাদা’ পাইল নাম প্রবীর রঞ্জন সেন।
কিছু নিক নেম ছিল চুড়ান্ত অশ্লীল,
কিছু ছিল ব্যাঙ্গে ভরা সরল ও জটিল।
এইসব বুদ্ধিমান বালকেরা সবে,
মনেতে পুষিছে বাঞ্ছা ইঞ্জিনীয়র হবে।
দিন যত কাটে তত গজাইল পাখা,
প্রেমেতে পড়িল কেহ … বুম শাকালাকা।
বাড়িতে-বাপ-মায়ের কাছে পৌঁছাল সংবাদ,
হিড়িক মারিতে খোকা হয়েছে ওস্তাদ।
চারমিনারের ধোঁয়া করে উদগীরণ,
কভি কভি বীয়ারেতে স্খলিত চরণ।‘
এ’কথা বলিয়া ক্ষণিক থামে নারায়ণ,
সেই ফাঁকে হুয়ো দিই আমরা জনগণ।
বি ই কলেজের নামে একটা হুয়ো …
আর একটা হুয়ো
আরও একটা হুয়ো

********

 

এই পর্যন্ত শুনে লক্ষ্মী দেবী হায় হায় করে উঠলেন।
বললেন ‘সর্বনাশ … ‘
‘এ কেমন অমৃত বাণী শুনাইলে প্রভু,
এরাই সেরার সেরা ভাবি নাই কভু।‘
নারয়ণ বলে ‘দেবী শুন হে এবার,
ভালো মন্দ মিশাইয়া এরাই সুপারস্টার।
ক্রীড়াঙ্গনে পারদর্শী ছিল কেহ কেহ,
জিমে ছিল দেবনাথ, বরুণের দেহ।
কিরীটী, শঙ্কর, প্রলয়, পপ, ডালমিয়া,
খেলিত সকলে মাঠে জান, প্রাণ দিয়া।
লরডস, ওভালেতে তারা ফুটাইত ফুল,
কারো বা মন্দির ছিল স্যুইমিং পুল।
অমিত, রজত ছিল বাজনায় গানে,
সিটু অজয়েরা স্টেজে এক্টিং এর টানে।
এতৎ সত্ত্বেও তারা উইদাউট এনি ফিয়ার,
পাশ করে সত্তর সালে হইল ইঞ্জিনীয়র।
সুনামের সাথে তারা আজ রিটা’র করে,
অবসরে আছে সবে যে যাহার ঘরে।
নাতি পুতি নিয়ে তাদের ভরা সংসার,
বি ই কলেজ তবু চোখে ভাসে বারবার।
পঞ্চাশটি বছর হল কলেজ ছাড়িয়া,
স্মৃতির জাবর কাটে লেজটি নাড়িয়া।
সত্তরের ব্যাচের কথা অমৃত সমান,
স্বর্ণ জয়ন্তিতে গেলে মিলিবে প্রমাণ।‘
আমি সুদীপ শোনাই সেই কথা পুণ্যময়
জয় জয় জয় বি ই কলেজের জয়।
উপস্থিত যারা আছো মিলি এইদিনে,
এক নয়, দুই নয়, হুয়ো দাও তিনে।
বি ই কলেজের নামে একটা হুয়ো …
আর একটা হুয়ো
আরও একটা হুয়ো

 

********

ভগবান নারায়ণ জল খাওয়ার জন্য ক্ষণিক থামিতেই
লক্ষ্মীদেবী বলিলেন ‘ওগো প্রাণনাথ,
শিক্ষকদের উপর তুমি করো আলোকপাত।‘
নারায়ণ বলে ‘তবে শোনো বিষ্ণুপ্রিয়া,
যাহা আমি বলিতেছি শোনো মন দিয়া।
‘ঘোড়া’ ছিল কলেজেতে, ছিল ‘হাতির ছানা’,
বি ই কলেজ ছিল সে এক আজব চিড়িয়াখানা।
‘ভুলু’, ‘লেগু’, ‘নাড়ূ’, ‘থ্রি-ফোর্থ’ পড়াত সব ক্লাসে,
‘মিনুদি’, ‘অপেরা’, ‘খাসী’ ছিল পাশে পাশে।
‘পাগলা’ ব্যানারজি ছিল, ছিল ‘আনারকলি’,
কাকে ছেড়ে কাকে রাখি কার কথা বলি ?
আরো কত শিক্ষকেরা কত মহাশয়,
নিক নামে রেখে গেছেন আত্মপরিচয়।
পাঁচ বছরেতে এঁরা তত্ত্ব গুলে গুলে,
ইঞ্জিনীয়র বানাতেন সর্ব কার্য ভুলে।
বি ই কলেজের কথা অমৃত সমান,
শুনিয়া দেবী গো তুমি হলে পুণ্যবান।‘
আমি সুদীপ শোনাই সেই কথা পুণ্যময়,
জয় জয় জয় বি ই কলেজের জয়।
উপস্থিত যারা আছো সবে এক্ষণে,
এক নয়, দুই নয়, হুয়ো দাও তিনে।
বি ই কলেজের নামে একটা হুয়ো …
আর একটা হুয়ো
আরও একটা হুয়ো

********

নারায়ণ থামিতেই …
লক্ষ্মী দেবী সব শুনে নমস্কার করি,
কহিলেন ‘ধন্যবাদ আপনারে হরি।
এমন কলেজে আসি পড়িয়াছে যারা,
আমার বরেতে সুখে থাকিবেন তারা।
কেউ পাবে ধনরাশি, কেউ ভালোবাসা,
কেউ বা সুন্দরী স্ত্রী রূপে গুণে খাসা।
কারো হবে পদোন্নতি, কারো জমি বাড়ি,
কেউ পাবে দু’নম্বরী চাকরী সরকারী।
সত্তর সালেতে যারা করেছিল পাস,
এখন সত্তরে তাদের দিলাম চ্যবনপ্রাশ।
যে’কটা বছর তারা আছে ধরাধামে,
মস্তি করে বাঁচে যেন নিজ নিজ নামে।
বছরেতে দুটি তিনটি গেট টুগেদার,
তাদের জীবনে যেন আসে বার বার।
টোয়েন্টি ফোর সীন ত্তারা হোয়াটস এপ গ্রুপে,
রাজা-উজির মারুক তারা নিত্যিনতুন রূপে।
গোল্ডেন জুবিলী করুক দু হাজার বিশে,
মদ্যপানে, নাচে গানে, খাদ্যে মিলেমিশে।
এদের সকলকে আমরা লক্ষ্মী এবং হরি,
স্বর্গ হইতে শতবার আশীর্বাদ করি।
পঁয়ষট্টি সত্তর ব্যাচ নয় সাধারণ,
সুখে থাকো সবে’ কহে লক্ষ্মী নারায়ণ।
বি ই কলেজের কথা অমৃত সমান,
যে বলে, যে শোনে দুইই ভারি পুণ্যবান।
আমি সুদীপ শোনালাম কথা পুণ্যময়,
জয় জয় বলো বেকা সত্তরের জয়।
উপস্থিত যারা আছো, পূণ্যবান সবে
বেকা র নামেতে হুয়ো এইবার হবে।
বেকা সত্তরের নামে একটা হুয়ো …
আর একটা হুয়ো
আরও একটা হুয়ো

********

Sahityika Admin

5 comments