জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক)
দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১, ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।
************
১. অর্থাভাব
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে শান্তিনিকেতনের অর্থাভাব রবীন্দ্রনাথকে সর্বদাই পীড়া দিত। ভিক্ষার ঝুলি হাতে তিনি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়বার আমেরিকা আসার উদ্দেশ্য ছিল খুব পরিষ্কার। শান্তিনিকেতনের অর্থাভাব দূর করতে এবং তাঁর কিছু আর্থিক ঋণ পরিশোধ করতে তাঁর আমেরিকায় আগমন। রবীন্দ্রনাথ Mr. J. B. Pond নামের একজন এজেন্টের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন এই শর্তে যে তিনি সেপ্টেম্বর (১৯১৬) থেকে এপ্রিল (১৯১৭) আমেরিকার নানা শহরে আনুমানিক চল্লিশটি বক্তৃতা দেবেন এবং বক্তৃতার আয়ের অংশ পাবেন। আমেরিকা আসার প্রথম দিন সিয়াটেল বন্দরে মিঃ পন্ড রবীন্দ্রনাথকে স্বাগত জানাতে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মিঃ পন্ডকে বলেন: ” The lectures I am to give in the United States are for the purpose nearest to my heart – to get funds to carry on my school for boys in India…..” রবীন্দ্রনাথকে Shakespeare of India আখ্যা দিয়ে মিঃ পণ্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকারটি ‘Los Angeles Times’ সংবাদপত্রে ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯১৬ প্রকাশিত হয়। যাক সে অন্য গল্প।
রবীন্দ্রনাথ বলতেন, অর্থ জোগাড় না হলেও শান্তিনিকেতনের ভাবধারাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা গেল সেটাও তো এক বড় পাওনা। এই অর্থভাবের জন্য তাঁকে কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।
আজকের দিনে চাকরি থেকে কাউকে বরখাস্ত করা অতি সহজ। সকালে অফিসে গিয়ে দেখলাম চাকরি চলে গেছে, নিজের মালপত্র নিয়ে দু তিন ঘন্টার মধ্যে চাকরি থেকে বিদায়। শুনেছি বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে নাকি একটি গোটা ডিপার্টমেন্টের সবাইকে মানে মুড়ো থেকে ল্যাজা অবধি সবাইকে একদিনে বা কয়েক ঘন্টার নোটিসে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে বলে। দয়ামায়া দেখানোর কোন প্রশ্নই নেই। হায়ার এন্ড ফায়ারের যুগ। তবে সেকালও যে হুট্ হাট্ করে চাকরি যেত না সেরকম বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই।
১৮ই অক্টোবর ১৯০৯ সালে, রবীন্দ্রনাথকে এই রকম একটি অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায় মহাশয়কে বিদ্যালয়ের কর্ম থেকে বিদায় দিতে হয়। কিন্তু এই কাজটি করতে তিনি কি ব্যথা পেয়েছিলেন তা জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণকে লিখিত চিঠিটি পড়লে বোঝা যায়।
“সম্প্রতি আমাদের একটি বৈষয়িক পরিবর্তনে সহসা আমার স্কন্ধে দুর্ভর দায় চাপিয়াছে। এতদিন আর্থিক বিষয়ে বিদ্যালয়ের চরম দায়িত্ব আমি নিজের পরেই রাখিয়াছিলাম। এখন তাহা রাখা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অসাধ্য হইবে। সুতরাং যে পরিমাণ অতিরিক্ত ব্যয় বিদ্যালয় এক্ষণে নিজের আয় হইতে যোগাইতে পারিতেছে না, তাহা নিতান্তই সংক্ষেপ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় আমার হাতে নাই। ত্রিপুরার দানসাহায্যও (বাৎসরিক এক হাজার টাকা) বন্ধ হইয়া গেল। এই কারণেই গভীরতর আন্তরিক বেদনার সহিত আপনাকে কর্ম্ম হইতে নিষ্কৃতি দিতে বাধ্য হইতেছি। ……বিদ্যালয়ের হিসাবপত্র সম্প্রতি যে অবস্থায় আসিয়া ঠেকিয়াছে, তাহাতে এই অত্যন্ত অপ্রিয় পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইতে হইল। এজন্য আপনাকে যে আঘাত দিতেছি তাহা অপেক্ষা যে অল্প আঘাত নিজে পাইতেছি, এমন কথা মনেও করিবেন না। “
এখানেই শেষ নয়, রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণের জন্য অন্যত্র চাকরির চেষ্টা অবধি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : ‘আজই আমি আগরতলায় ত্রিপুরার রাজকুমারকে বিশেষভাবে আপনার জন্য অনুরোধ করিয়া পত্র লিখিয়া দিলাম।’ যদিও রবীন্দ্রনাথের এই প্রচেষ্টা সফল হয় নি। কারণ অনেক আগেই ত্রিপুরারাজ্যের সঙ্গে তাঁর পুরোনো সম্পর্কের অবসান ঘটেছিল।
সামান্য অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলতে ইচ্ছে করছে যে রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনে, তাঁর অতি কাছের মানুষ, সকল গানের ভান্ডারী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী বা সবার শাস্ত্রীমশায় আশ্রম ছেড়ে চলে যান। রবীন্দ্রনাথ যারপরনাই আঘাত পেয়েছিলেন। শোনা যায় সেই সময় আশ্রমের ভিতর নানা রকম দলাদলি ছিল। রবীন্দ্রনাথ থাকা সত্ত্বেও তার নিষ্পত্তি হয় নি। গবেষণা ও সংগীতের এক বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। গুণী ব্যক্তিরাই বোধহয় চিরকাল স্বার্থপরতা ও দলাদলির শিকার হন।
*******
২. গানের উৎস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সৈয়দ মুজতবা আলী খুব সুন্দর একটি বর্ণনার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে “রবীন্দ্রনাথকে সমগ্রভাবে গ্রহণ করার শক্তি আমাদের নেই। গীতাতে উক্ত তিন মার্গেই একসঙ্গে একই মানুষ চলেছে এর উদাহরণ বিরল। তিনি জ্ঞানী ছিলেন; শব্দতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। তিনি কর্মী ছিলেন ; গ্রামোন্নয়ন, কৃষির উৎকর্য, সমবায় সমিতি, শ্রীনিকেতন বিদ্যালয় তিনি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি রসের সাধক ছিলেন – এটাকে ভক্তিমার্গ বলা যেতে পারে – তিনি তাঁর ভগবানকে প্রধানতঃ রসস্বরূপেই আরাধনা করেছিলেন এবং ইহজগতের প্রিয়া, প্রকৃতিকে সেই রসস্বরূপেই কাব্যে, নাট্যে, গানে প্রকাশ করেছেন। অথচ কোনো স্থলেই তিনি খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন নন।”
আমরা আমাদের অতি সীমিত ক্ষমতা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মত বিশাল ব্যক্তিত্বকে জানার চেষ্টা করি। তাঁর বৃহৎ সাহিত্যভান্ডারের সামান্য একটু আধটু পড়ি, তাঁর গান শুনি। মনে শান্তি পাই। সুখে দুঃখে সর্বদাই তিনি যেন আমাদের সহায়। তিনি আমাদের শিক্ষাগুরু, আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য পেয়েছিলেন যাঁরা অর্থৎ যেমন ক্ষিতিমোহন সেন, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রমথ চৌধুরী, প্রমথনাথ বিশী, কালিদাস নাগ, সীতা দেবী, রানী চন্দ, মুজতবা আলী, সুধীরঞ্জন দাস, সুধীরচন্দ্র কর এবং আরও অনেকের কাছ থেকে আমরা তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা শুনি, রবীন্দ্রকাব্যের বিশ্লেষণ বোঝার চেষ্টা করি। রবিজীবনের অনেক তথ্য আমরা পাই প্রশান্তকুমার পালের বিরাট গবেষণামূলক কাজ থেকে।
তবুও মনে হয় কেউ যদি রবীন্দ্রনাথের কবিতার ব্যাখ্যা করে দিতেন, মানে কবির কোন ভাবনার বা জীবনের কোন অনুভূতির ফসল হিসাবে সেই সব কবিতা বা গানের প্রকাশ, তবে বড়ই ভালো হত। রবীন্দ্র-গবেষকরা দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ কোথায়, কখন বা কার উদ্দেশ্যে এক বা একধিক কবিতা লিখেছেন, খুঁজলে সে সব তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু কবির সেই সময়কার মনোজগতের খবর কে দিতে পারবে – একমাত্র কবি নিজে ছাড়া? এ ব্যাপারে কবির চিঠিপত্র থেকে আমরা কিছু কিছু অবশ্যই জানতে পারি। প্রমথনাথ বিশীর ‘রবীন্দ্রকাব্য প্রবাহ’ থেকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু এতো সব কথা বলছি কেন? আসলে সেদিন মুজতবা আলীর লেখা ‘রবির বিশ্বরূপ’ নিবন্ধে একটা মজার ঘটনার উল্লেখ পেলাম। সেই গল্পটা শুনলে বুঝতে পারবেন কেন এতো কথা বলছি।
অনেকেই মনে করেন “এস এস, হে তৃষ্ণার জল” রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের একটি গান বা বর্ষার গান, অন্তত সেই ঋতুতেই গাওয়া হয় (গানটি নিচে দেওয়া হল) । কিন্তু প্রশ্ন উঠবে ‘ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল’ ‘গূঢ় অন্ধকার হতে’ কে আসছে ? মরুদৈত্য কোন্ মায়াবলে তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে। – কে সে ? মুজতবা আলী বলেছেন: ‘আসলে এটি রচিত হয় শান্তিনিকেতনের প্রথম টিউব-ওয়েল খননের সময়। মাটির নিচে যে জল বন্দি হয়ে আছে তাকে বেরিয়ে আসার জন্য কবি কর্মযোগের প্রতীক কলকব্জার বন্দনা-গীতি ধরেছেন।’
আচ্ছা, বলে না দিলে এই গানের ব্যাখ্যা কি করে বুঝতুম বলুন তো ?
—————–
“এসো এসো হে তৃষ্ণার জল, কলকল্ ছলছল্–
ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল কলকল্ ছলছল্॥
এসো এসো উৎসস্রোতে গূঢ় অন্ধকার হতে
এসো হে নির্মল কলকল্ ছলছল্॥
রবিকর রহে তব প্রতীক্ষায়।
তুমি যে খেলার সাথি, সে তোমারে চায়।
তাহারি সোনার তান তোমাতে জাগায় গান,
এসো হে উজ্জ্বল, কলকল্ ছলছল্॥
হাঁকিছে অশান্ত বায়,
‘আয়, আয়, আয়।’ সে তোমায় খুঁজে যায়।
তাহার মৃদঙ্গরবে করতালি দিতে হবে,
এসো হে চঞ্চল, কলকল্ ছলছল্॥
মরুদৈত্য কোন্ মায়াবলে
তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে।
ভেঙে ফেলে দিয়ে কারা এসো বন্ধহীন ধারা,
এসো হে প্রবল, কলকল্ ছলছল্॥“
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
************
তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১. রবিজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা – ১০৫, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স ।
২. রবীন্দ্রনাথ – সুপ্রিয় ঠাকুর, পৃষ্ঠা – ১২৮, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স ।
৩. রবিজীবনী, সপ্তম খন্ড : প্রশান্তকুমার পাল। প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।
৪. সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী – দ্বিতীয় খন্ড (অপ্রকাশিত রচনা) – প্রকাশক : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।
৫, রবীন্দ্র রচনাবলী – ডিজিটাল সংস্করণ (পশ্চিমবঙ্গ সরকার)
Add comment