দুটি গল্পঃ গর্ভ, শ্রীকৃষ্ণের স্বামী
দেবাশিস দে চৌধুরী, ১৯৮৫, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
গর্ভ
জন্ম সত্যি? যদি জাতক জননীহীন? অযোনিসম্ভূত?
তিনি পিতৃলোকে বসে ধরিত্রীর পানে চেয়ে ভাবছেন। ভাবছেন প্রকৃতি ছাড়াই কি পুরুষ সম্পূর্ণ! মাতৃজঠর কি তবে আবশ্যিক নয় আত্মার আকরের ছন্য? মাতৃস্তন্য ছাড়াই কি মাতৃত্ব সম্ভব!
ইক্ষ্বাকু বংশের প্রতাপশালী রাজার পুত্র ছিলেন তিনি। কিন্তু আজও তিনি নিশ্চিত নন্। তার পিতা কি পিতা না মাতা! রাজা প্রসেনজিৎ-এর মৃত্যুর পর অকালবৈধব্য নিয়ে রাণী শিলাবতী বল্লভী রাজত্বের হাল ধরেছিলেন। কিন্তু সেই পুত্রবতী রমণীর আনুগত্য ব্রাক্ষ্মণরা মানতে চায়নি। শিশুপালক রমণীর সাথে শাস্ত্রালোচনা তাদের পক্ষে অসম্ভব। ভারতবর্ষের বুকে আবার এক যোগ্যতমার অধিকারকে অস্বীকার।
তার পুত্র রাজ্যাভিষেকের সুযোগ্য হয়ে উঠেছেন। কিন্তু অতবড় দায়িত্বের ভার সঁপে দেওয়ার সঙ্গে তার ইচ্ছে, পুত্র বিবাহ করে সংসারের দায়ভার বইতে শিখুক। শুধু তাই নয়। এই বংশের পূর্বপুরুষদের বড় লোভ পিতৃলোক থেকে জন্মান্তরের সূত্র ধরে ফিরে আসা। তারাও বিভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়ে শিলাবতীকে ক্রমাগত বিরক্ত করে চলেছেন বংশধারা সুনিশ্চিত করতে।
শিলাবতী বিবাহ দিলেন পুত্রের। তিনটি। সীমন্তিনী, পৌলমী, কেশনী। পুত্রলাভ সুনিশ্চিত করতে। একএক দিন এক এক পত্নীর সাথে পুত্রার্থে শয়ন করেন পুত্র। সেই রতিক্রিয়ায় আনন্দ নেই। প্রেম নেই। আছে সন্তান উৎপাদনের যান্ত্রিক যোজনা। ঘরের বাইরে অধীর পূর্বপুরুষেরা কাক হয়ে ডানা ঝাপটান। কেন এই রতিক্রিয়া এত দীর্ঘ? রাজা কি বীজবপনে অসমর্থ?
সত্যিই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হল। অথচ কোনো রাণীই গর্ভবতী হলেন না। দুশ্চিন্তা। যে রাজা পুত্রোৎপাদনে ব্যর্থ, তাকে প্রজারা মানবে কেন! রাজা বের হলেন ঐশ্বরিক ক্ষমতার সন্ধানে। খুঁজে পেলেন একদল ঋষিকে যারা সম্মত হলেন। তারা যোগবলে প্রস্তুত করলেন এক মন্ত্রপূত তরল। কলসীতে ভরে রাজা নিয়ে চললেন মহিষীদের জন্য। রাত্রে দারুণ পিপাসাক্লান্ত রাজা পান করলেন সেই তরল ওষধি। কি আর হবে? সামান্যই তো!
সেই তীব্র অব্যর্থ তরলে নিজেই গর্ভবতী হয়ে পড়লেন রাজা যুবনাশ্ব। ভ্রূণের আবির্ভাব হল তার জঠরে। গর্ভের লক্ষ্মণ প্রস্ফূট হোলো। লুকিয়ে রাখা হল রাজাকে লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রসব বেদনা উঠলে দ্রুত খবর পাঠানো হোল ঋষিদের। যোনিহীন রাজা কোন পথে প্রসব করবেন? নিপুণ শলাকাঘাতে উন্মুক্ত করা হল জঠরের পার্শ্ব। পিতৃগর্ভ হতে জন্ম নিল পুত্র। ধরিত্রীতে প্রথমবার।
কিন্তু মাতৃদুগ্ধ! দুধ ছাড়া সন্তানের প্রতিপালন কী ভাবে সম্ভব? এলেন দেবরাজ। আপন অমৃতক্ষরা তর্জনী শিশুর মুখে রেখে বললেন “মাম ধাস্যতি”- আমাকে পান করো। আমা হতে শক্তি পাও। ইন্দ্রের সেই উচ্চারণ থেকে নবজাতকের নাম হলো মান্ধাতা। ইন্দ্রের তর্জনী লেহনে বারো দিনে বারো বৎসরের বালকের রূপ পেলেন মান্ধাতা।
মান্ধাতার মনে পড়ছে। যুবনাশ্বের দ্বিধা। তার মাতৃহৃদয় সন্তানের স্পর্শসুখউন্মুখ। তার পিতার হৃদয় অনিশ্চিত। তিনি কী শুনতে চান শিশু মান্ধাতার কাছে – মাতৃডাক না পিতৃসম্বোধন। মান্ধাতা কেঁদে উঠলেই কি আকুল যুবনাশ্ব। কি রূপে ধরা দেবেন!
তারপর হঠাৎই যুবনাশ্ব পৌলমীর গর্ভে জন্ম দিলেন এক সন্তানের। আরও সুকঠিন হলো তার পরিচয়। একাধারে শরীরের মধ্য থেকে, অন্যদিকে শরীরের বাইরে ঔরসে প্রাণ সৃষ্টি করেছেন। কী হতে পারেন তিনি। কোনটা সত্য? তিনি পিতৃরূপ না মাতৃরূপিনী!
দ্রুত বেড়ে ওঠা মান্ধাতা রাজা হলেন। জয় করলেন পৃথিবী। যুদ্ধ করলেন রাবণের সাথে। অমীমাংসিত যুদ্ধের পর দুজনে সখ্যতা হলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিহত হলেন শিবের ত্রিশূলের একটি শূল অস্ত্রভান্ডারে থাকা লবণাসুরের হাতে। মান্ধাতা তৃপ্ত যে তার উত্তরপুরুষ রামের ভ্রাতা শত্রুঘ্ন হত্যা করেন লবণাসুরকে।
আজ মান্ধাতা ভাবেন। পিতার দ্বিধাদীর্ণতা তাকে আজও বেদনা দেয়। যদি ক্ষমতার অনস্বীকার্য ডাক, যদি প্রজারঞ্জনের আবশ্যিক ভার তাকে অস্থির না করে তুলত, তিনি তো শুধু বাৎসল্যসুখেই খুশি থাকতেন।
মান্ধাতা জানেন অম্বার শিখণ্ডী হয়ে পিতা দ্রুপদের সম্মান রক্ষায় পুরুষাঙ্গ ধার করা। তিনি জানেন অর্জুনের কেন বৃহন্নলা বেশ। কেন মোহিনী বিষ্ণুর সাথে শিবের সঙ্গম। নটরাজ গোপিনী হয়ে নেচেছিলেন নটবরের (শ্রীকৃষ্ণের) সাথে – তাই তিনি গোপেশ্বর।
ক্ষমতা, প্রতিহিংসা, লোভ, বিভেদ – মানুষ, ঋষি, দেবতা – সবার মধ্যে নিয়ে এসেছে অকারণ লিঙ্গ ভাবনা। অথচ মান্ধাতা বেশ বোঝেন আজ – লিঙ্গ রক্তমাংসের ভেদ চিহ্ণ মাত্র। আত্মার লিঙ্গ নেই। সত্য লিঙ্গ অনির্ভর। প্রেম মননে।
তিনি শান্তিতে শয়ন করলেন এবার।
** ঋণঃ নেট, বিভিন্ন বই, বিশেষ করে “The Pregnant King”- দেবদত্ত পট্টনায়েক
*******
শ্রীকৃষ্ণের স্বামী
কাঁদছেন পরমপুরুষ। বৈধব্যের বেশে। আকুল বারিধার তাঁর দু’নয়নে। তিনি শ্বেতবসনা। বিবাহবাসরের সব অলংকার আর রঙ্ মুছে দিয়েছেন। নিরাভরণা।
সম্মুখে চন্দনকাঠের চিতা। শায়িত তাঁর মৃত স্বামী। সবে কৈশোর পার। ছিন্নশির। কুরুক্ষেত্র থেকে স্বল্প দূরত্বে এক পাহাড় চূড়ায় স্থাপিত হয়েছে সেই উষ্ণীষখচিত মস্তক। চোখদুটি জাগ্রত। দৃষ্টিসম্ভব। পঞ্চপান্ডব ক্রন্দনরত। বিশেষ করে মধ্যমবীর।
এখানে নেই, কিন্তু কাঁদছেন আর এক নারী। অন্যভুবনে। ভবিতব্য।
যুধিষ্ঠির সেদিন পাঞ্চালীর সাথে একান্তে অন্তরঙ্গ। নিকটে এক ব্রাহ্মণের ধন চুরি করে পলায়নপর তস্কররা। অর্জুন ধনুর্বাণ নিতে সেই ঘরে প্রবেশহেতু ভঙ্গ করলেন শর্ত। এক ভ্রাতা যখন দ্রৌপদীর সাথে থাকবেন, অন্য কারও সেখানে প্রবেশ শাস্তিযোগ্য। অর্জুনকেও মেনে নিতে হল দ্বাদশ বৎসরের বনবাসী তপশ্চর্যার জীবন।
তিনি বার হলেন বিভিন্ন তীর্থ পরিক্রমায়। হরিদ্বারে গঙ্গায় স্নানরত একদিন। এক অপরূপা উপস্থিত সম্মুখে। অর্জুনের দীপ্ত রূপ, শালপ্রাংশু উন্মুক্ত শরীরে তিনি মুগ্ধা। কামনা করলেন অর্জুনকে। অর্জুন অস্বীকার করায় সেই নারী আত্মাহুতির প্রস্তুতি নিলেন। মানতে রাজী হলেন মধ্যম পান্ডব। সেই নাগকন্যা অর্জুনকে নিয়ে গেলেন পাতালের সর্পলোকের প্রাসাদে। মিলিত হলেন। তারপর অর্জুন চলে গেলেন বনবাসের বাকি সময় অতিবাহিত করতে। সম্ভোগসুখী উলুপীকে রেখে।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ উপস্থিত। দুই পক্ষের সেনানীসজ্জা সম্পূর্ণ। অস্ত্র ভান্ডার প্রস্তুত। সহদেব ডাকলেন বাকি পান্ডবদের আর কৃষ্ণকে। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ। গণনা করে বললেন মাকালীর চরণতলে নরবলি দিতে হবে। যুদ্ধজয় সুনিশ্চিত করতে। আর সেই বলিপ্রদত্তকে হতে হবে পুরুষ ও বত্রিশটি গুণের আধার। কে আছেন এমন পুরুষ?
গণনায় দৃষ্ট হল, এমন পুরুষ তিনজনই – কৃষ্ণ, অর্জুন আর ইরাবান। প্রথম দুজনের প্রশ্নই নেই, এ যুদ্ধ ওদের ব্যতীত অসম্ভব। অতএব একমাত্র সমাধান ইরাবান। কৃষ্ণের উপর দায়িত্ব ন্যস্ত হল। তিনি ইরাবানকে বোঝাবেন। কিন্ত একী? ইরাবান যে দুর্যোধনকে কথা দিয়ে ফেলেছেন এই অমাবস্যায় তিনি কৌরবের হয়ে আত্মদান করবেন।
সমস্যার সমাধান করলেন শ্রীকৃষ্ণ। পিতৃলোকযজ্ঞের আয়োজন করলেন অমাবস্যার একদিন আগে। চন্দ্র আর সূর্য একসাথে উপস্থিত হয়ে কৃষ্ণকে এই অদ্ভূত ব্যতিক্রমের কারন জিজ্ঞাসা করলেন। কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন এই যে দুজনে একসাথে উপস্থিত, এইই তো অমাবস্যা। দুজনে মেনে নিলেন যুক্তি।
কালীপূজার আয়োজন হল একদিন আগেই। ইরাবান মুক্ত হলেন দুর্যোধনকে দেওয়া অঙ্গীকারের পাশ হতে।
শুধু ইরাবান প্রার্থনা করলেন দুটি বর। কৃষ্ণের কাছে। এক তিনি বিবাহিত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে ইচ্ছুক। যাতে কবরের বদলে দাহ হতে পারে তার শরীর। আর এই যুদ্ধ শেষ অবধি দেখে যেতে পারেন তিনি। কৃষ্ণ প্রথমে দ্বিতীয় বর দিলেন। কিন্তু এমন নারী পাওয়া গেল না যিনি এই নিশ্চিত অকাল বৈধব্যে প্রস্তুত।
কিন্তু তিনি কৃষ্ণ! রূপ থেকে অরূপে যার নিত্য আনাগোনা। যিনি পুরুষপ্রধান হয়েও সখীভাবে বিভোর। এই ত্রিভুবনপালকের মধ্যে পুরুষ কখন যে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়! তিনি শিবের মতন সর্বত্যাগীকে গৃহমুখী করেছেন। ভগিনী মীণাক্ষীর সাথে বিবাহ দিয়ে। মোহিনী মূর্তি ধরে শিবকে সঙ্গমে টেনে এনেছেন। আজও তিনি আবার নারীরূপ ধরলেন। বিবাহ করলেন ইরাবানকে। একরাত্রি তিনি ইরাবানকে দিলেন সমস্ত তৃপ্তি। কামনাবসান।
পরদিন মাতৃমূর্তির সামনে বলি হল। আকুল কাঁদলেন বিধবা শ্রীকৃষ্ণ। এমন হাহাকার কেউ দেখেনি আগে। ইরাবানের কর্তিত শির রইল জাগ্রত। চক্ষু সজাগ। তিনি আঠারো দিন ধরে দেখলেন সেই চোখে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ।
আর নাগলোকে ইরাবানজননী উলুপী অশ্রুসিক্তা হয়ে সেই শরীরীবাসনার কর্মফল নিয়ে ধূলায় লুন্ঠিতা হলেন।
জেগে রইলেন কৃষ্ণ। তিনি কর্মলক্ষ্যে অবিচ্যুত। তাঁর বুকে বেদনার সুর বাজে। তবু মহাকালের যে নির্দেশ তাঁর উপর, তিনি তা পালনে বাধ্য। ত্রিভুবনকে পাপমুক্ত করতে হবে। তিনি সব ব্যথা নিজেই বহন করবেন। সব মৃত্যুর দায়িত্ব তিনিই নেবেন। অবিচলিত।
এবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন শ্রীকৃষ্ণ।
Add comment