সাহিত্যিকা

ভোলে বাবা, পার করেগা।

ভোলে বাবা, পার করেগা।
অনিরুদ্ধ রায়, ১৯৮৩ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

ক‍্যাম্পাসিং এর সেরা চাকরিটা অরুণের কপালেই লেগে গেল। এরা যা মাইনে দেবে বলছে সারা মাস ধরে তো সেই টাকা খরচা করাই অসম্ভব!

জামাকাপড়, সিনেমা, বন্ধুদের সাথে পার্টি, আর চাইনিজ মোগলাই ছাড়াও একটা কুকুর পুষলে কেমন হয়? তার পেছনেও তো কিছু খরচ হবে? আচ্ছা মেজদির ড্রাইভার, ভেঁকুর একটা জার্সি গরুর খুব শখ, ওকেও তো একটা জার্সি গরু গিফ্ট করা যায়?

শুরুতেই বন্ধুদের অনেক দামি দামি অখাদ‍্য খাওয়ানোর প্রমিস করেই ফেলল, কিন্তু তার খরচও তো মাসমাইনার অনুপাতে অতি নগন‍্য। প্রথম মাসের মাইনে থেকেই মাকে একটা হিরের নেকলেস আর পিসিমণির জন‍্য একটা সোনার বাউটি কিনে দিতে পারবে।

আসলে অরুণের জিনিসপত্রের দাম সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই, ওকে পাঁচ হাজার টাকা দিলে সারাদিনেও খরচ করতে পারবে না। বাড়ির গলির মুখে বুল্টিদের বাড়ি, বুল্টি অরুণের থেকে দুবছরের ছোটো হলে কি হবে অরুণকে বড়ো দাদা বলে মান‍্যি করে না। বুল্টি বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমচুর খাচ্ছিল। অরুণকে দেখে বলে- এই পচাদা,আমচুর খাবি?
অরুণের বুল্টির ওপর কেমন অনুকম্পা হলো, বুল্টিকে বললো – তোর ভালো- ভালো,দামি খাবার খেতে ইচ্ছে করে না?
– দামি খাবার কিরে?
– এই ধর রোগন জোশ, মটন কাটলেট।
– হ‍্যাঁ খুব ইচ্ছে হয় তো।
– জানিস আমি বিশাল টাকার চাকরি পেয়ে গেছি, তুই চাইলে আমি তোকে গ্ৰ‍্যান্ড হোটেলে খাওয়াতে পারি? তবে কন্ডিশন হলো তোকে আমায় সম্মান করতে হবে। অসভ‍্যের মতো রাস্তা ঘাটে তোর বন্ধুদের সামনে ‘এই পচাদা প‍্যান্টের জিপ না লাগিয়ে কই চললি?’, এসব বলে আমাকে হেয় করার অভ‍্যাসটা ছাড়তে হবে। আর ইয়ে তোর বন্ধু রাজশ্রীটাকেও সাথে নিতে হবে।

বুল্টি সেকেন্ড ইয়ার জুওলজি অনার্স পড়ে, সে পচাদার চাকরি প্রাপ্তিতে আশ্চর্য হয়ে বলল- কত টাকা মাইনে পাবি রে?
– মাসে সিটিসি এক লাখ।
বুল্টি চোখ গোল- গোল করে বলল – ওরেব্বাবা সে তো অনেক টাকা রে! ঢপ মারছিস না তো? রাজশ্রী তো বলে তুই যা ক‍্যাবলা, পাঁচ হাজার টাকার চাকরিও জোগাড় করতে পারবি না।
– ওকে শুনিয়ে দিস, সিটিসি এক লাখ। আমাকে অলরেডি অরূপের বোন প্রোপোজ করেছে।
– সিটিসি মানে কিরে?
– ওসব কঠিন কথা তোর বুঝে লাভ নেই। তুই খালি এক লাখ টাকা মাইনেটা রাজশ্রীর কানে তুলে দিস, তাহলেই হবে।
– ঠিক আছে কালই বলবো। কাল তো সরস্বতী পুজোর ঠাকুর কিনতে যাব, তুই যাবি তো আমার সঙ্গে?
অরুণ অনিচ্ছাতেও রাজি হলো, রাজশ্রীর কানে খবরটা পৌঁছানো দরকার, মেয়েটা একদম পাত্তা দেয় না।

পরের দিন বিকেলে বুল্টি অরুণকে নিয়ে সরস্বতী ঠাকুর কিনতে বেড়িয়ে হাজরা পার্কের পাশে ফুচকাওয়ালাটাকে দেখেই বলে – এই পচাদা, সেই ফুচকাওয়ালাটা বসেছে, ফুচকা খাওয়াবি?
– বেশি খাবি না কিন্তু, আমার চাকরিতে জয়েন করতে এখনো ছ মাস লাগবে।
অরুণের প্রবল বাঁধা উপেক্ষা করে বুল্টি চল্লিশটা ফুচকা সাঁটিয়ে দিল, অরুণ নিজে মাত্র দশটা ফুচকা খেয়ে কিছুটা পয়সা বাঁচালো।
তারপর ক্ষীরোদ ঘোষ মার্কেটের উল্টোদিকের খোলা দোকানে কচুরি ভাজা হচ্ছে দেখে বুল্টি বলে – উঃ কী গন্ধ ছেড়েছে মাইরি! দুটো কচুরি না খেয়ে আমি যেতেই পারব না।
বুল্টি গুনে গুনে চার চারটে কচুরি খেলো, আর অরুণ মাত্র দুটো খেয়েই মনে প্রবল অতৃপ্তি নিয়ে হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ক্ষোভের সাথে বলে – তুই মাইরি একটা মিনি রাক্ষস।
– তুই তো একটা চিমসে হ‍্যাংলা। এই জন‍্যই রাজশ্রী তোকে পাত্তা দেয় না।

পটুয়া পাড়ার কাছে এসে একটা রোলের দোকানের সামনে দাড়িয়ে বুল্টি বলে -পচাদা একটা চিকেন রোল খাওয়া না?
এবার অরুণ রেগে গেলো, কিন্তু রাগটা দেখাতে পারছে না। মুখটা প্যাঁচার মতন করে বললো, “আমার কাছে আর টাকা নেই।“
– কেন? দেখলাম যে? কচুরির দোকানদার তো তোকে একশ টাকার চেঞ্জ ফেরৎ দিল? ওতেই হয়ে যাবে, বার কর।

বুল্টি তারিয়ে তারিয়ে চিকেন রোল খেতে লাগলো, অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে – তুই ডাক্তার দেখা, তোর শরীরে এডরেনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন লেভেল ভীষণ হাই, তাই এতো খাই-খাই স্বভাব।
– সবারই কিছু না কিছু হরমোন বেশি কাজ করে, তোর যেমন টেস্টোস্টেরন খুব হাই, তাই জুলজুল করে সবসময় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকিস।
– তোর কথাবার্তা পুরো ঐ উল্টোদিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোর মতো। আমি কিন্তু ঠাকুর নিয়ে ফেরার রিক্সা ভাড়া দিতে পারব না, বলে দিলাম।
– তোর যা এটিচিউড্, তোকে ঠিক এক মাসের মধ‍্যে চাকরি থেকে তাড়াবে।

ছমাস বাদে গ্রাজুয়েশন পাশ করে অরুণ চাকরিতে জয়েন করে গেল, কিন্তু রাজশ্রীর কানে কথাটা পৌছালো কিনা বোঝা গেল না। প্রবেশনারি পিরিওডে কোম্পানি অরুণকে তৈরি করার জন‍্য বেশ কয়েকটা ডেভালাপমেন্ট কোর্স করালো। আর কিছুদিনের মধ‍্যেই ও বেশ পোক্ত হয়ে গেলো। এখন সে উবেরে ঘোরাঘুরি করে, তবে ভেঁকুকে গরু কিনে দেওয়ার ইচ্ছাটা আর নেই। মা, পিসিমণিও কোনো গিফ্ট নিতে রাজি না হয়ে ওকে পোস্ট অফিসে রেকারিং ডিপোজিটের খাতা খুলে দিয়েছে।

একদিন বুল্টির বাড়ির আড্ডায় অরুণ ওকে জিজ্ঞেস করে – এই শার্টটা পরে আমায় কেমন লাগে রে? আড়াই হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি,জানিস? তোর ঐ রাজশ্রী আমার কথা কিছু বলে?
– হ‍্যাঁ, বলছিল- পচাদা যে হারে বিভিন্ন কোর্স করছে, বেটার টু এভোয়েড হিম, হি মাইট ডেভালপ আর্জ টু ডু দ‍্যা ইন্টার ওয়ান।
– ঈশশ্, তোরা ঐ কালিঘাটের মেয়েগুলোর থেকেও খারাপ মাইরি।

অরুণের কনফার্মেশন হয়ে গেল, অচিরে চেহারায় ভারিক্কি ভাব এলো। বুল্টিও এম এস সি করতে ক‍্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ঢুকলো।
একদিন পাড়ার বন্ধু অতীন ওকে বলে- এই বুল্টিটা কেল্টি হলে কী হবে, আজকাল একটা হ‍্যান্ডু মালের সাথে ঘুরে বেড়ায়।
কথাটা শুনেই অরুণ রাগে ফেটে পড়ল – বুল্টিকে কোন শালা কেল্টি বলে? ওর খুব ভালো টেকস্চার।
– তুই হঠাৎ এতো চটছিস কেন?
অরুণও ভাবল, সত‍্যিই তো হঠাৎ রাগ হলো কেন!কোনো বন্ধুর সাথে বুল্টি তো ঘুরতেই পারে?

অরুণের বন্ধু পিকু, খুব এডভেঞ্চার প্রিয়। যে কোনো কিছুর মধ‍্যে এডভেঞ্চারের গন্ধ পেলে ও ভীড়ে যায়। পিকু একদিন অরুণকে বলল- চল, বাঁক নিয়ে তারকেশ্বরে বাবার মাথায় জল ঢেলে আসি। একটা জম্পেশ এক্সপেরিয়েন্স হবে, তাছাড়া তুই এতো ভালো চাকরিতে স্থিতু হলি, তোরও তো শিবকে গ্ৰ‍্যাটিচুড্ দেখানো উচিৎ। সবই তো বাবার দয়ায় হলো।
প্রস্তাবটা বেশ মনে ধরলেও অরুণ বলল- ধুস, আমাদের কি ওসব পোষাবে? ওসব তো ফেকলু লোকরা করে।
– কেন পারব না? বাবার কাছে তো কেউ ফেকলু নয়। চল যাই, হেব্বি এডভেঞ্চার হবে।

অরুণ বুল্টিকে গিয়ে তাদের প্ল‍্যানের কথা বলতেই সে বলে – ওহ্ এটা একটা দারুণ ব‍্যাপার হবে। চল, আমিও তোদের সাথে যাই।
– ধ‍্যাৎ ওসব সারা রাত হেঁটে যাওয়া মেয়েদের কাজ না। পথে ঘাটে অনেক বিপদ হতে পারে।
– তুই তো থাকবি, পচাদা। কি আর হবে? আমার মামার বাড়ি তো তারকেশ্বরে ওখানে একদিন রেস্ট নিয়ে আসব।
অরুণ কিছুক্ষণ ভেবে বলল – নারে বুল্টি, ঐ সব লোক জনের সাথে তোকে নিয়ে আমি যাব না। আমি বরঞ্চ বাঁকের জলটা তোর নাম করে বাবার মাথায় ঢেলে দেব। তাতেই তোর বিয়েটা হয়ে যাবে।
বুল্টি ফ‍্যাল- ফ‍্যাল করে তাকিয়ে রইল, কিছু বললো না।

যেদিন বিকালে ওরা রওনা দেবে, দুপুর থেকে পিকুর প্রবল পেট খারাপের সাথে ধূম জ্বর, ও আর যেতেই পারলো না। অরুণও যাওয়া ক‍্যানসেল করবে ভাবলো, তারপর মনে হলো বুল্টির জলটা তো দিতেই হবে।
একটা অপরিচিত দলের সাথে সাদা হাফ প‍্যান্ট পরে আর কাঁধে গামছা নিয়ে অরুণ বেড়িয়ে পড়ল।

ভোলে বাবা, পার করেগা।
ব‍্যোম-ব‍্যোম, তারক ব‍্যোম।
যাচ্ছি কোথায়? জল ঢালতে।
কার মাথায় ? বাবার মাথায়।
এই বলতে বলতে কুড়ি জনের দলটা কাঁধে বাঁক নিয়ে যাচ্ছে। রাত নটা নাগাদ এক জায়গায় একটা খাবারের দোকান দেখে সবাই কাঁধ থেকে বাঁক নামিয়ে বাশের স্ট‍্যান্ডের ওপর রেখে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন‍্য থামলো। দোকানে শুধু পেটা পরোটা আর আলুর ছোঁকা ছাড়া আর কোনো খাবারই নেই। সেটা একদিনের জন‍্য অরুণ চালিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু ঐ মাটির ঘড়ার জলটা খাওয়া কি ঠিক হবে? দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো- মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতোল পাওয়া যাবে না?
– বাড়ি থেকে আনতে হবে, একটু সময় লাগবে, চল্লিশ টাকা দাম পড়বে।
অরুণ রাজি হয়ে গেল।
সহযাত্রী পাশের ছেলেটা অরুণের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে- দাদা, মিনারেল জল খাচ্ছেন, দেখে তো মনে হচ্ছে খুব ভালো চাকরি করেন, দশ হাজার টাকার ওপরে নিশ্চয়ই মাইনে পান?
অরুণ একটু হেসে বলল – না, না, পেট খারাপে ভুগে উঠলাম তো, তাই একটু সাবধানতা বজায় রাখছি।
মনে মনে ভাবলো- কাদের সাথে যাচ্ছি? আমার আসল মাইনে শুনলে তো এরা ভিরমি খেয়ে মরবে।

সকাল বেলা মন্দিরের তোরণের কাছে বিশাল লাইনে দাড়িয়েছে, পেছন থেকে বুল্টি এসে কাঁধে হাত রাখল। অরুণ চমকে উঠে বলল – তুই এখানে কী করে এলি?
– কাল রাতে মামাবড়ি এসে আজ ভোর থেকে তোর অপেক্ষা করছি। তুই আমার নামের জল বয়ে এতদুর হেঁটে এলি, এ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি রে পচাদা। চল, দুজনে একসাথে বাবার মাথায় জল ঢালি।

অরুণ খুশিতে বুল্টির হাত দুটো চেপে ধরল।

Sahityika Admin

1 comment