রাজায় রাজায় (ধারাবাহিক দ্বিতীয় পর্ব)
মনোজ কর, ১৯৮০ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
রাজা হল সিরাজ।
অন্য সবদিনের মতই সেদিনও আলিবর্দি খান রাত্রি তৃতীয় প্রহরের শেষে প্রায় অন্ধকার থাকতে থাকতে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে, কোরান পাঠ করে সকাল সাতটায় বন্ধুদের সঙ্গে কফি-পান সেরে রাজদরবারে গিয়ে বসলেন। প্রতিদিনকার মত প্রায় দু’ঘন্টা সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ ও বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে জরুরি আলোচনা সেরে বৈঠকখানায় যাবার আগে অন্দরমহলে খবর পাঠালেন যে আজ সন্ধ্যায় প্রাসাদের সকলে যেন বৈঠকখানায় আসে। আফসার রাজপরিবারের প্রত্যেক সদস্য যেন অবশ্যই হাজির থাকে।
আগুনের গতিতে খবর ছড়িয়ে গেলো রাজপ্রাসাদের সর্বত্র। সকলেই চিন্তিত এবং উৎসুক। সকলের মনে একই প্রশ্ন, কী ঘোষণা করতে চলেছেন নবাব আলিবর্দি খান? আবার কোনও দুঃসংবাদ নয় তো? আবার কোনও আসন্ন মারাঠা আক্রমনের প্রস্তুতি নয় তো? প্রাসাদ ছেড়ে কোনও গোপন আস্তানায় চলে যেতে হবে না তো? মারাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের আক্রমনে বারবার কেঁপে উঠেছে বাংলার মসনদ। এই বৃদ্ধ বয়সেও নিজের লোকেদের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজের বুদ্ধি আর নিপুণ রণকুশলতায় বাংলা , বিহার, উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দি খান নিজের সাম্রাজ্য এবং পরিবারকে বারবার রক্ষা করেছেন শত্রুদের হাত থেকে বিশেষ করে রঘুজি ভোঁসলের হাত থেকে। বিগত পাঁচ বছর ধরে রঘুজির সৈন্য ক্রমাগত আক্রমন করেছে আলিবর্দির সাম্রাজ্য। সেবার যখন মারাঠা সৈন্যরা উড়িষ্যা আক্রমন করল নিজের ভাগ্নে মিরজাফর উড়িষ্যার সুবেদার হওয়া সত্ত্বেও হাত-পা গুটিয়ে বসে রইল, যতক্ষণ পর্যন্ত না মিরজাফরকে সরিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে সত্তরোর্দ্ধ আলিবর্দি নিজে মোগলরাজের সাহায্য নিয়ে রণক্ষেত্রে পৌঁছলেন।
অবশ্য শেষ অবধি ফল খুব একটা আশাপ্রদ হয়নি। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লার সহায়তা সত্ত্বেও উড়িষ্যা হাতছাড়া হয়ে গেল। গতবছর মোগলরাজ আহমেদ শা বাহাদুর উড়িষ্যার বিনিময়ে ত্রিপাক্ষিক যুদ্ধবিরোধি চুক্তিতে রাজি করালেন রঘুজিকে। আহমেদ শা, আলিবর্দি আর রঘুজির স্বাক্ষরসম্বলিত এই শান্তিচুক্তি সত্ত্বেও রাজপরিবারের সকলের মন থেকে সন্দেহ সম্পূর্ণ দূর হয়নি। মারাঠারা তো বাইরের শত্রু, কিন্তু নিজের বাড়ির লোকেরাই তো বারবার বিব্রত করেছে আলিবর্দিকে। এই দু’বছর আগে মাত্র সতের বছর বয়সের আদরের নাতি সেনাবিহিনীর কিছু লোককে ভয় দেখিয়ে জোর করে পাটনা দখল করে নিলো। আলিবর্দির অত্যন্ত স্নেহের পাত্র এই ছোট নাতি। খেলাচ্ছলে এমন কান্ড করে ফেলেছে এই সব বলে বুঝিয়ে সুজিয়ে সে যাত্রায় সিরাজকে নিরস্ত করে শান্তি বজায় রেখেছিলেন আলিবর্দি। বাইরে তো শত্রুর অভাব নেই। তার ওপর নিজের নাতি এসব কান্ড করলে শত্রুরা যে তার সুযোগ নেবে সে কথা বলে নাতিকে ফিরিয়ে আনেন আলিবর্দি। কিন্তু দাদুর প্রশ্রয়ে দিন দিন অনাচারী হয়ে উঠছে সে। বিশেষ করে নারীদের প্রতি আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে চিন্তাও হয় আলিবর্দির। এই একই আসক্তিতে আক্রান্ত আলিবর্দির পূর্বসুরী নাসিরি বংশের শেষ নবাব সরফরাজের পরিণতির কথা তো সবাই জানে। তবুও এই নাতির মধ্যে কী যে দেখেন আলিবর্দি কে জানে? শুধুই কি অন্ধ দৌহিত্রস্নেহ না আরও কিছু?
বৈঠকখানায় ঘন্টাখানেক একটু হাসিমজা, একটু সাহিত্যচর্চা সেরে মধ্যাহ্নভোজের মেনুতে মনোনিবেশ করলেন আলিবর্দি। মধ্যাহ্নভোজ আলিবর্দির একটা বড় দুর্বলতার জায়গা। কিসের মাংস আর কী মশলা দিয়ে প্রতিটি ব্যঞ্জন তৈরি হবে সেটা আলিবর্দি নিজেই প্রতিদিন ঠিক করেন। তারপর দেশ বিদেশ থেকে আগত রন্ধনকুশলীরা তাঁর নিজের তত্ত্বাবধানে সেইসব পদ রান্না করেন। সুবিস্তৃত খাদ্যসম্ভার যখন নবাবের সামনে পরিবেশিত হত সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠত সমস্ত রাজপ্রাসাদ। নবাব আলিবর্দি তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি পদগুলি একটু একটু করে মুখে দেন আর রন্ধনকুশলীরা দমবন্ধ করে অপেক্ষা করে থাকেন নবাব কী বলবেন তা শোনার অপেক্ষায়। প্রতিটি পদের স্বাদ এবং গন্ধের বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যায় আলিবর্দির দক্ষতা অনবদ্য। সে ব্যাখ্যা অনেক কবিতাকেও হার মানায়। এই সময় কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন আলিবর্দি। দীর্ঘ মধ্যাহ্নভোজপর্বের পর একঘন্টাব্যাপী দিবানিদ্রা।
এই নিদ্রা সহজে আসে না। পেশাদার গল্পকথকের গল্প শুনতে শুনতে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যান আলিবর্দি প্রতিদিন। গল্পকথকের বড় অভাব। একে তো হাজারজনে একজন পড়তে পারে। দশলক্ষে একজনের প্রতিদিন পড়ার অভ্যাস আছে। তাই রাজপরিবারে গল্পকথকের বড়ই আদর। কিন্তু কেন? জ্ঞান আহরণের জন্য? না, ঘুম পাড়ানোর জন্য। নবাবকে ঘুম পাড়ানোর জন্য তাই দুর্লভ নিত্যনতুন গল্পকথকদের খুঁজে নিয়ে আসা হত রাজপ্রাসাদে। এই মহামূল্যবান রাজকীয় দিবানিদ্রার পর প্রক্ষালনের পর্ব। প্রক্ষালন ও পোশাক পরিবর্তনের পর নিয়মমাফিক প্রার্থনা এবং কোরানপাঠ সম্পূর্ণ করে আলিবর্দি এক পাত্র সোরামিশ্রিত জল পান করেন। এই সোরামিশ্রিত পানীয়জল বিশেষ পদ্ধতিতে দুইফুট গভীর মৃৎপাত্রে নির্মল শীতল বাতাসে জারিত করে প্রস্তুত করা হয় প্রতিদিন। মৃৎপাত্রের মধ্যভাগ থেকে এই পানীয় একটি পানপাত্রে পরিবেশন করা হয় নবাববাহাদুরকে।
এরপর শুরু হয় রাজদরবারের দ্বিতীয় পর্ব, যেখানে উপস্থিত থাকেন আমন্ত্রিত শিক্ষিতজনেরা। কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, কোরানবিশারদ ইত্যাদি নক্ষত্র সমাগমে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রাজদরবার। ধূমপায়ীরা নানাবিধ হুকা থেকে ধূমপান করেন। আলিবর্দির ধূমপানের অভ্যাস নেই তাই আলিবর্দির জন্য বিলাতি কফির বিশেষ ব্যবস্থা। নানা বিষয়ে আলোচনা বিশেষ করে কোরানের ব্যাখ্যা চলতে থাকে যতক্ষণ না সকলে গাত্রোত্থান করেন। তারপর সারাদিনের প্রশাসনিক কাজকর্মের হিসাব নিকাশ, গুপ্তচরদের থেকে শত্রুদের গতিবিধি, জগৎশেঠের কাছ থেকে আর্থিক খবরাখবর এবং নবাবের বেতনভোগী সাংবাদিকদের কাছ থেকে সাম্রাজ্যের বিভিন্নপ্রান্তের খবর শুনে সেদিনের মত দরবারের কাজ শেষ হয় আলিবর্দির।
এই দরবারের কাজ রাজপরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানত একাই করেন আলিবর্দি। মাঝে মধ্যে আসে বড় জামাই নওয়াজিস মহম্মদ খান। এই বড় জামাই আবার আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমেদের ছেলে। আলিবর্দির তিন কন্যার মধ্যে দুই কন্যার বিবাহ হয় আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমেদের দুই পুত্রের সঙ্গে। আলিবর্দির কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা জামাতারাই ছিল পুত্রসম। বড় মেয়ে মেহেরুন্নিসা বা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে বিবাহ হয় নওয়াজিসের। সেই সুবাদে রাজদরবারে অবাধে আসার অধিকার অর্জন করেছিল নওয়াজিস। নবাব বড় আদরের মেহেরুন্নিসা এবং নওয়াজিশের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন এক অপূর্ব সুন্দর প্রাসাদ। এই প্রাসাদের নাম ছিল সঙ্গ-ই- দালান। মতিঝিলের তীরে অবস্থিত বলে এই প্রাসাদকে সকলে মতিঝিল প্রাসাদ বলেই জানে।
নবাবের স্নেহ, নিজস্ব রাজপ্রাসাদের মালিকানা এবং রাজদরবারে অবাধ প্রবেশের অধিকার অর্জন করে নিজেকে মুকুটহীন নবাব বলেই মনে করে নওয়াজিস। রাজপরিবারে আর একজনের অবাধ প্রবেশের অনুমতি ছিল নিজের ইচ্ছেমত রাজদরবারে আসার। সে আলিবর্দির অত্যন্ত স্নেহের নাতি সিরাজ, আলিবর্দির দ্বিতীয় কন্যা আমিনা বেগমের সন্তান। তাঁর বয়স এখন উনিশ। সিরাজের প্রতি আলিবর্দির দুর্বলতার কথা সর্বজনবিদিত। আলিবর্দির নিজে ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদর্শী এবং সংবেদনশীল। শিল্প এবং শিল্পীর প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং সম্মান ছিল আন্তরিক এবং গভীর। দক্ষ প্রশাসক এবং সেনাপ্রধান হিসাবে সেই সময়ে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই। প্রয়োজনে ঘোড়ায় চড়ে, অস্ত্রহাতে নিজেও সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পিছপা হতেন না আলিবর্দি। পরিবারের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল অপরিসীম। তাঁর স্ত্রী এবং তিন কন্যার মাতা সারফুন্নিসাকে আজীবন আগলে রেখেছিলেন সব শক্তি এবং ভালোবাসা দিয়ে। অন্য নবাবদের মতো বহুবিবাহে আবদ্ধ হননি আলিবর্দি। তাঁর উত্থানের পথে যারা তাঁর প্রতি সাহায্য এবং সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল তাদের হাত ভরে দিয়েছেন আলিবর্দি। তারা রাজপ্রাসাদের দাস-দাসীই হোক বা কোনও দপ্তরের সাধারণ কর্মচারি বা সামান্য কোনও মদ্য পরিবেশক। তারা আজও আলিবর্দিকে পিতার মত শ্রদ্ধা করে। আলিবর্দির আশ্রয় তাদের কাছে মাতৃক্রোড়ের চেয়েও নিরাপদ।
আসলে এই মানুষগুলির প্রতি তাঁর দুর্বলতার প্রধান কারণ এই যে তিনি নিজেও একসময় এই শ্রেণীর মানুষদের অন্তর্গতই ছিলেন। তাঁর বাবা মির্জা মহম্মদ মাদানি ছিলেন মোগলরাজ আওরঙ্গজেবের পিতা শাহজাহানের এক পালিত পুত্রের সন্তান। কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন আওরঙ্গজেবের ছেলে আজম শাহের অত্যন্ত বিশ্বাসী মদ্য পরিবেশক। আজম শাহের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিল মাদানির দুই সন্তান মহম্মদ আলি এবং মির্জা আহমেদ। মহম্মদ আলি থেকে নবাব আলিবর্দি খান হয়ে ওঠার গল্প এক কঠিন জীবনসংগ্রামের কাহিনী। অনেক পথ পেরিয়ে, অজস্র বাধা অতিক্রম করে আলিবর্দি যখন বাঙলার নবাবিয়ানা দখল করলেন তখন তাঁর বয়স প্রায় সত্তর। সেও আজ থেকে বারো তেরো বছর আগেকার কথা।
নবাব আজম শাহ মহম্মদ আলিকে হাতিশালা এবং অপরূপ সূচীকার্যে অলঙ্কৃত রাজপোশাক ভান্ডারের রক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন। অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করে অচিরেই আজম শাহের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন মহম্মদ আলি। কিন্তু আজম শাহের অকস্মাৎ মৃত্যুতে মহম্মদ আলির জীবনে নেমে এল প্রচন্ড আঘাত এবং দারিদ্র। বেশ কিছুদিন চরম দারিদ্রের মধ্যে কাটিয়ে কটকে এক পারিবারিক আত্মীয় সুজাউদ্দিনের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন সস্ত্রীক মির্জা মহম্মদ মাদানি এবং তার দুই সন্তান মহম্মদ আলি, মির্জা আহমেদ এবং তাদের পরিবার।
মির্জা মহম্মদের স্ত্রী এবং সুজাউদ্দিনের স্ত্রী দুজনেই ছিল আফসার সম্প্রদায়ভুক্ত। মোগলসম্রট আওরঙ্গজেবের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র বাঙলা, বিহার এবং উড়িষ্যার স্বঘোষিত প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খানের জামাতা সুজাউদ্দিন তখন উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর। নবাবের সঙ্গে নানা কারণে সুজাউদ্দিনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। নারী এবং সুরায় আসক্ত সুজাউদ্দিনকে রাজধানী থেকে দূরে রাখার জন্য নবাব তাকে উড়িষ্যার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেন। সুজাউদ্দিনের দপ্তরে নিজেদের কর্মদক্ষতা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্য মহম্মদ আলির ভাগ্য ক্রমশই খুলতে থাকে। বেশ কাটছিল সময় কিন্তু অকস্মাৎ সুজাউদ্দিনের জীবনে নেমে আসে বিপদ। নবাব মুর্শিদকুলি খানের দুই কন্যা আজমউন্নিসা এবং জিনাতুন্নিসাকে বিবাহ করেছিল সুজাউদ্দিন। সুতরাং মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর রাজসিংহাসনের একমাত্র অধিকার যে তারই সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিল সুজাউদ্দিন। নবাব মুর্শিদকুলি খানের বড় মেয়ে আজমুন্নিসা ছিল মানসিক বিকারগ্রস্ত। কথিত আছে মৃত মানুষের বিশেষত পুরুষমানুষের কলিজা ছিল তার অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। লোকে তাকে কলজেখাকি বেগম বলে ডাকত। এক অজ্ঞাত অসুখে অত্যন্ত অল্পবয়সে কোনও সন্তানের জন্ম না দিয়েই মারা যায় আজমুন্নিসা। মুর্শিদাবাদের দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় যে আজমুন্নিসাকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল ক্রোধান্ধ সুজাউদ্দিন। এরপর নবাবের ছোট মেয়ে জিনাতুন্নিসাকে বিবাহ করে সুজাউদ্দিন এবং তাদের একটি পুত্রসন্তান হয় যার নাম সরফরাজ। মুর্শিদাবাদের রাজপ্রাসাদে পিতামহ পিতামহীর কাছেই বড় হতে থাকে সরফরাজ। জিনাতুন্নিসাও রয়ে গেল মুর্শিদাবাদে।
এরপর অনেকটা সময় কেটে গেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়তে থাকল সুজাউদ্দিনের। ইতিমধ্যে জিনাতুন্নিসার সঙ্গেও সম্পর্কও খারাপ হতে থাকল সুজাউদ্দিনের। অন্যদিকে মহম্মদ আলি নিজের কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধিতে সুজাউদ্দিনের কাছের মানুষ হয়ে উঠল। প্রশাসন এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য মহম্মদ আলির ওপর সুজাউদ্দিনের নির্ভরতা ক্রমাগত বেড়েই চলল। সে কথা রাজপরিবারের কারও অজানা ছিল না। এদিকে মুর্শিদকুলির শরীর আস্তে আস্তে খারাপ হতে হতে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছল যে তিনি সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সুজাউদ্দিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যখন রাজধানী থেকে খবর এল যে মৃত্যুশয্যায় শায়িত নবাব মুর্শিদকুলি জামাতাকে রাজ্যভার সমর্পণ না করে সাতাশ বছরের দৌহিত্র এবং সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজকে পরবর্তী নবাব হিসাবে ঘোষণা করেছেন। রাগে দুঃখে কাতর সুজাউদ্দিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। সেই সময় তার পাশে এসে দাঁড়াল মহম্মদ আলি। এই বিপদের দিনে মহম্মদ আলি আর হাজি মহম্মদ এই দুই ভাই ছাড়া তার কাছে আর কেউ নেই। মহম্মদ আলি সুজাউদ্দিনকে বোঝাল যে নবাবের এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক এবং কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। পুত্রের অধীনস্থ কর্মচারী হয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সুজাউদ্দিনের উচিৎ এই মুহূর্তে উড়িষ্যার দায়িত্ব টাকি খানের হাতে সমর্পণ করে সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের দিকে এগিয়ে যাওয়া। জিনাতুন্নিসার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর আরও একবার বিবাহ করে সুজাউদ্দিন। টাকি খান সেই তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান।
মহম্মদ আলি বোঝাল যে বাঙলার মসনদ সুজাউদ্দিনের অধিকার এবং সে অধিকার ছিনিয়ে নেবার জন্য নিজের সন্তানের সাথে যুদ্ধে পিছপা হওয়া উচিৎ হবে না সুজাউদ্দিনের। এই ব্যাপারে দিল্লির সমর্থন সংগ্রহ করার জন্য যা করার তা করবে মহম্মদ আলি। মহম্মদ আলির ভরসায় মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সুজাউদ্দিন। ওদিকে মাতামহের ইচ্ছা অনুযায়ী কাতরা মসজিদের সিঁড়ির নিচে নবাবের দেহ সমাধিস্থ করে এসে সিংহাসনে আরোহণের প্রস্তুতি শুরু করে দিল সরফরাজ। সুজাউদ্দিনের রক্ত বইছে সরফরাজের ধমনীতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পিতার মতই সুরা ও নারীর প্রতি সরফরাজের আসক্তি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সুজাউদ্দিন মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করতে আসছে শুনে পিতৃহত্যার পরিকল্পনা শুরু করে দিল সরফরাজ। সুজাউদ্দিনের সেনাবাহিনী মেদিনীপুর পৌঁছবার আগেই দিল্লির সম্মতিপত্র নিয়ে পৌঁছে গেল মহম্মদ আলি। দ্বিগুন উৎসাহে মুর্শিদাবাদের দিকে ধেয়ে চলল সুজাউদ্দিনের বাহিনী। সরফরাজ ঠিক করল মুর্শিদাবাদের অনেক আগে কাটোয়াতেই প্রতিহত করতে হবে সুজাউদ্দিনের বাহিনীকে।
সবকিছু দেখেশুনে প্রমাদ গুনলেন মুর্শিদকুলির স্ত্রী সদ্যবিধবা নাসিরি বানু বেগম। নাতি সরফরাজকে ডেকে বললেন হাজার হলেও সুজাউদ্দিন সরফরাজের জন্মদাতা পিতা। পিতৃহত্যা পাপ এবং তার ফল কখনই ভাল হতে পারে না। তাছাড়া সুজাউদ্দিনের কাছে দিল্লির অনুমতিপত্র আছে। রাজপরিবারের আস্থাভাজন কর্মচারি এবং সুজাউদ্দিনের একান্ত অনুচর মহম্মদ আলি নিজে এ কথা জানিয়েছে তাকে। সুজাউদ্দিনের বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। উশৃঙ্খল জীবনযাপনের ফলে তার আয়ুও হয়ত খুব একটা বেশি নয়। খুব বেশি হলে হয়ত আর দশ বারো বছর। তারপর সরফরাজের নবাব হওয়ার আর কোনও বাধা থাকবে না। শত্রুর সাথে লড়াই আর নিজের জন্মদাতা পিতার সঙ্গে লড়াই এক নয়। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় সম্মানের কিন্তু পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় সম্মানের নয়। আর তাছাড়া কে বলতে পারে যুদ্ধে কী ঘটে। যদি সরফরাজের কোনও অঘটন ঘটে তবে সমস্ত রাজপরিবার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই এই কঠিন সময়ে যুদ্ধের পথ থেকে সরে এসে সুজাউদ্দিনকে নবাব হিসাবে মেনে নেওয়া অনেক বেশি দূরদর্শিতার কাজ হবে। এই সিদ্ধান্তের ফল হবে সুদূরপ্রসারী। পিতা পুত্রের সুসম্পর্ক রাজ্যচালনার ক্ষেত্রেও অনেক বেশি সহায়ক হবে।
প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও মাতামহীর পরামর্শ মেনে নিল সরফরাজ। বাঙলার সিংহাসনে বিনা বাধায় আসীন হল সুজাউদ্দিন। আর তার প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে মুর্শিদাবাদে এল মহম্মদ আলি। নবাবিয়ানা দখল করেই মহম্মদ আলিকে রাজমহলের ফৌজদার পদে নিযুক্ত করল সুজাউদ্দিন। মহম্মদ আলির নতুন নাম হল আলিবর্দি খান। এর পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি আলিবর্দিকে। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই সুজাউদ্দিন আলিবর্দিকে বিহারের নায়েব নাজিম বা ডেপুটি গভর্নর পদে নিযুক্ত করল। কথিত আছে সুজাউদ্দিন তার প্রতিদ্বন্দী পুত্র সরফরাজকে বিহারের নাবিব নাজিম হিসাবে নিযুক্ত করে পাটনা পাঠিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে। এই খবর মুর্শিদকুলির কন্যা সরফরাজের মা জিনাতুন্নিসার কানে পৌঁছতেই তিনি আলিবর্দিকে রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠান এবং ফটকের বাইরে দাঁড় করিয়ে তাকে বিহারের নায়েব নাজিম পদে নিযুক্ত করেন। আদরের সরফরাজকে পিতা সুজাউদ্দিনের প্রতিশোধস্পৃহার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই দ্রুত এই সিদ্ধান্ত নেন জিনাতুন্নিসা।
Add comment