বিড়ালের গলায় ঘন্টা
প্রণব কুমার মজুমদার, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
ছোটবেলা থেকেই কিংশুকের বেড়ালের প্রতি একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিলো। কচি কচি বাচ্চা বেড়াল দেখলেই আদর করবার জন্য হাতটা নিশপিশ করতো ঠিকই, কিন্তু একটু বড় বেড়ালের আঁচড়ের ভয়ে ঐ আহ্লাদটুকুকে আর সে ছুঁতে পারতো না। আসলে ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন এক সহপাঠীর বাড়িতে পড়তে গিয়েছিলো। ওর পড়ার টেবিলের ঠিক নিচেই ওদের একটা পোষা বেড়াল শুয়ে ছিলো, আর কিংশুক সেটা খেয়াল করেনি। পড়ার বা গল্পের ঝোঁকে পা নাড়াতে নাড়াতে বেড়ালটার গায়ে আচমকা পায়ের চাপ পড়ে যায়। বেড়ালটাও ভয় পেয়ে কিংশুকের পায়ের পাতায় একটা থাবা বসিয়ে দেয়। নখের আঁচড়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসে। মূহুর্তের মধ্যেই এইসব ঘটে যায়। বন্ধুর বাড়ি থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরতেই ডাক্তার, ইঞ্জেকশন ইত্যাদি শুরু হয়ে গেলো, যায় ধকল সামলে উঠতে মাসখানেক তো লেগেই যায়। আর এত কিছুর ফলস্বরূপ সেই থেকে কিংশুকের এক অদ্ভুত মার্জার-ভীতি জন্মালো। অনেক সময় দেখা যায় গাড়ি চালানোর সময় গাড়ির সামনে দিয়ে কোনও বেড়াল রাস্তা পার হতে দেখা গেলে গাড়ির ড্রাইভাররা গাড়ি থামিয়ে একটুক্ষণ অপেক্ষা করেন, তারপর রাস্তা দিয়ে এগোন। কিন্তু কিংশুক সামনে বেড়ালকে রাস্তা পার হতে দেখলে সটান উল্টোদিকে হাঁটা লাগাতো।
এভাবেই বেড়ালের থেকে কিংশুকের পালিয়ে বেড়ানো শুরু হলো, কিন্তু ধরা পড়ে গেল সময়ের কাছে। সময় তার বয়সটাকে বাড়িয়ে নিয়ে চললো। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতেও যোগ দিলো। এমনকি একা থেকে দোকা হয়ে গেল, বিয়ে করে দোলাকে বৌ করে নিয়ে এলো। কিন্তু দোলার সাথে এলো দোলার জীবপ্রেম। হ্যাঁ, বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে তার পোষা দু’জোড়া খরগোশ ছিল। বিয়ের পরে তাদের এই বাড়িতে নিয়ে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো দোলা, কিন্তু তার ছোট ভাই ঐ খরগোশদের উত্তরাধিকার দাবী করে তাদের লালন পালনের দায়িত্ব নিয়ে নিলো। আর নতুন বৌ হয়ে এসে দোলা নতুনভাবে খরগোশ কিনে পোষার আবদার করতে পারলো না।
যাইহোক, বেড়াল বিদ্বেষী কিংশুকের সঙ্গে খরগোশ তথা জীবপ্রেমী দোলার একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান শুরু হলো। এবার কোনও এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় কিংশুকদের বাড়ির পেছনদিকের বাগানের দরজার দিকে দোলা কিংশুকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো – কেমন যেন একটানা একাধিক ‘কুঁই কুঁই’ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আলো জ্বালিয়ে ঐ বাগানে যাওয়ার দরজাটা খুলতেই দেখা গেলো প্রায় অন্ধকারের মধ্যে দুটো বেড়াল ছানা এক্কেবারে জলে চুপচুপে ভিজে গিয়ে ডাকছে। দরজা খোলার কারণে এবং মানুষের সাড়া পেয়ে ঐ শিশুদুটো একটু নড়াচড়া করলো এবং আরও জোরে চেঁচামেচি করে ডাকাডাকি শুরু করে দিলো। দোলা একটা বেড়ালছানাকে হাতের তালুতে করে বারান্দায় নিয়ে এলো, আর কিংশুককেও ইঙ্গিত করলো আরেকটাকে ঐভাবেই নিয়ে আসতে। যে কোনও কারণেই হোক অথবা অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট কারণেই হোক এবং মাঝে প্রায় আঠারো-উনিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় কিংশুকের বেড়াল বিদ্বেষ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছিলো। তাই দ্বিতীয় বেড়াল ছানাটাকে সে নিজের হাতে করে তুলে নিয়ে এলো। দোলা পরম যত্নে একটা ছোট্ট তোয়ালে দিয়ে বেড়াল ছানাদুটোর ভেজা শরীর মুছিয়ে যতটা পারে শুকনো করে, এবার একটু বুদ্ধি খাটিয়ে একটা প্রস্তাব দিলো – ওর ভেজাচুল শুকানোর হেয়ার ড্রায়ারটা চালিয়ে ছানা দুটোর লোম যদি শুকিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ছানাদুটো এতটাই ছোট যে ঠিকঠাক মতো হাঁটতেও পারে না। ঐ গরম হাওয়া ওদের শরীরের ক্ষতি করতে পারে। সুতরাং ড্রায়ার চালানোর প্ল্যান বাতিল। শরীরটা শুকনো হওয়ায় ছানাদুটোর ‘কুঁই কুঁই’ ডাকও কমে এসেছে।
এবারে দুজনের মাথায় চিন্তা যে ওদের কি খাওয়ানো হবে? ওরা তো নিশ্চয়ই মায়ের দুধ খায়, কিন্তু মা তো বেপাত্তা। ঠিক আছে, গরুর দুধ দেওয়া যাক। তাই খেয়েই আপাততঃ ওদের প্রাণ বাঁচুক। দোলা ছুটলো ফ্রিজ থেকে দুধ আনতে। ঠাণ্ডা দুধকে গরম করে, আবার ঐ গরম দুধকে ঠাণ্ডা করে ওদের খাওয়ার মত উষ্ণতা আন্দাজ করে আনতে আনতে কিংশুক নিজের একটা বাতিল পাজামা আর দোলার একটা ফেলে দেওয়া শাড়ি খুঁজে এনে চমৎকার একটা বিছানা বানিয়ে ছানাদুটোকে তার মধ্যে শুইয়ে দিয়েছে। কাপড়ের শুকনো ভাব আর উষ্ণতা পেয়ে ছানাদুটো ঘুমিয়ে পড়েছিলো। দোলা বাটি করে দুধ এনে ওদের মুখের সামনে ধরলো, কিন্তু ওরা ঘুমিয়ে কাদা। তাছাড়া বাটির কানাও অনেকটা উঁচুতে। তাই দোলা একটা প্লেট এনে তাতে দুধটা ঢেলে ওদের মুখের নিচে প্লেটটা গুঁজে দিলো। কিন্তু ঘুম থেকে তুলে খাওয়ার দিকে মন দেওয়াতে পারলো না। আঙ্গুল ডগায় একটু দুধ লাগিয়ে ওদের মুখে ঘষতে দুজনেই একটু চাটার চেষ্টা করলো। কিন্তু এভাবে তো আঙ্গুল করে আর দুধ খাওয়ানো যায় না। দুজনে আলোচনায় বসলো – মায়ের দুধ তো ওরা চুষে চুষে খায়, চুমুক দিয়ে তো খেতে পারে না।
কিংশুকের মাথা থেকে একটা কায়দা বের হলো। ঘর থেকে হোমিওপ্যাথি ওষুধের একটা ড্রপার এনে তাতে করে প্লেট থেকে একটু দুধ তুলে নিয়ে একটা ছানার মুখে গুঁজে দিয়ে ড্রপারে হাল্কা চাপ দিতেই ড্রপার থেকে খনিকটা দুধ ছানার মুখে চলে গেলো। দিব্যি চুকচুক করে গিলে নিলো। দ্বিতীয়জনকেও একইভাবে দুধ দেওয়াতে সেও গিলো নিলো। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই প্লেটের দুধ নিঃশেষ। নিজেদের বুদ্ধিমত্তায় কিংশুক আর দোলা খুব খুশি।
কিন্তু একটা দুশ্চিন্তা আছে। কিংশুকের বেড়ালের আঁচড় লাগার পর থেকেই কিংশুকের মায়ের বেড়ালদের প্রতি একটা প্রচণ্ড অনীহা তৈরি হয়েছিল। এই ছানাদুটোকে মা থাকতে দেবে তো? নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে আলোচনার সময় হঠাৎই নজরে এলো যে মা এসে পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তাদের কথাবার্তা শুনছেন, মুখে একটা মিষ্টি হাসি আর হাতে একটা ঝুড়ি। ছেলে আর ছেলের বৌ-এর নজরে পড়তেই মা বলে উঠলেন, “তোমাদের কাণ্ডকারবার আমি অনেকক্ষণ থেকেই দেখছি, বৌমা। বেড়ালের ওপরে যত রাগই থাকুক না কেন, এইটুকুন বেড়ালছানার ওপর কারও রাগই থাকতে পারে না। ওদের শোবার ব্যবস্থা করেছো, খাইয়েও দিয়েছো। কিন্তু একটু নিরাপত্তার দিকটাও তো দেখতে হবে। এই ঝুড়িটা দিয়ে চাপা দিয়ে দিও, তাহলে ওদের অন্য বেড়াল, ইঁদুর, ছুঁচো কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। চলো এবার এদের ঘুমিয়ে রাতটা পার করতে দাও। আর তোমরাও খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলো।” অতি অল্প কথায় মা তার সম্মতি আর চিন্তাভাবনাটা পরিষ্কার করে দিলেন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনজনে দুইছানার পরিচর্যায় লেগে পড়লো। বিছানা পাল্টে দিতে হবে, কারণ তারা সেটা ভিজিয়ে ফেলেছে। একটু দুধ খাওয়ানো হলো। তারপর কিংশুক অন্যান্য সাংসারিক কাজের ফাঁকে পাড়ায় গেলো ঐ বেড়ালছানা দুটোর জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। জানা গেলো যে তাদের মা হচ্ছে ‘সুন্দরী’ যে তাদের পাশের বাড়িতে থাকতো। মুখটা খুব মিষ্টি, ইয়া মোটা বড় বড় লোমওয়ালা একটা লেজ, দেখতে অনেকটা কাবুলি বেড়ালের মতো। বোধহয় দিন দু’তিনেক আগে সে ঐ ছানাদুটোর জন্ম দিয়েছিলো ঐ বাড়ির জেঠিমার ঠাকুরের সিংহাসনের তোষকের ওপরে। সেটা আগের রাতে জেঠিমার নজরে আসে ঠাকুর শয়ন দেওয়ার সময়। তিনি ঐ তোষকের মধ্যেই মুড়ে ছানা দুটোকে দোতলার বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। বৃষ্টিতে জলে থৈ থৈ চারিদিক। ঐ জলেই বোধহয় ভাসতে ভাসতে পাশের বাড়ির বাগানে, মানে কিংশুকদের বাড়ির পেছনের বাগানে এসে তারা উপস্থিত হয়।
প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। ছানাদুটো এখন রীতিমতো হাঁটতে পারে। একটার রং সাদা, কিন্তু কপালে, লেজের আগায় আর চারটে পায়ে মোজার মতো কালো লোম। অন্য বেড়ালটা পুরোপুরি কালো রং-এর। নারায়ণ দেবনাথের কার্টুন কাহিনী কিংশুকের খুব প্রিয়, বেড়াল দুটোর নাম দিলো ‘নন্টে’ আর ‘ফন্টে’। কালোটা নন্টে আর সাদাটা ফন্টে। কিন্তু দেখা গেলো ফন্টের পেছনের ডান পা ঠিক মতো ফেলে হাঁটতে পারে না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। মনে হয় জেঠিমা দোতলার বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ায় আঘাত পেয়ে ঐ পা-টা খোঁড়া হয়ে যায়। আরও প্রায় মাসখানেক পরে দেখা গেলো ওরা বাড়ির বাইরে বের হওয়া শিখে ফেলেছে। ফন্টে অর্থাৎ সাদাটা খোঁড়া বলে বেশী বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে না। কিন্তু নন্টেটা বেশীরভাগ সময় বাড়ির বাইরেই ঘুরে বেড়ায়। একটা প্রশ্ন উঠলো যে দুটো বেড়ালের লিঙ্গ কি? কিংশুক বা দোলার কারোরই এই বিষয়ে জ্ঞান নেই। শেষ পর্যন্ত তারা মায়ের শরণাপন্ন হলো। অভিজ্ঞতার ঝুলি নেড়ে মা উত্তর দিলেন কালোটা হুলো মানে ছেলে বেড়াল আর সাদাটা মেনি অর্থাৎ মেয়ে বেড়াল।
আরও প্রায় মাসখানেক কেটে যাওয়ার পর হঠাৎই কালো বেড়ালটা অর্থাৎ নন্টে দিন তিনেক ধরে বেপাত্তা। বাড়ির বাইরে আশেপাশের বেশ কিছু রাস্তা আর গলি খুঁজে পাওয়া গেলো না। পরিচিত অপরিচিত কারও থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেলো না, শুধু দু’একজন জানালো যে তারা কুচকুচে কালো একটা বাচ্চা বেড়াল কয়েকদিন আগে দেখেছে, কিন্তু এখন কোথায় সে জানে না। একজন বিজ্ঞের মতন জানালো, “কালো বেড়াল? ওকে পাচার করে দিয়েছে। ভালো দামে এরকম কালো বেড়াল তান্ত্রিকদের কাছে বিক্রি হয়। তান্ত্রিকরা কালো বেড়ালকে মেরে মাটিতে পুঁতে রাখে। তার মাংস, চামড়া সব পচে যায়। তারপর অবশিষ্ট হাড় মাটি থেকে তুলে বিভিন্ন তন্ত্রমন্ত্রের কাজে লাগায়।” কিংশুক তান্ত্রিকদের ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝলো না। তবে এটুকু বুঝলো যে তাদের নন্টের জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, সে আর বাড়িতে ফিরে আসবে না। এই দু’মাসে অদ্ভুত একটা মায়ার বাঁধনে সে যেন বেঁধে ফেলেছিলো তাদেরকে।
এদিকে একেই ফন্টের একে এক পা খোঁড়া, তার ওপরে সহোদর সঙ্গী ভাই সে বেপাত্তা, তাই কিংশুকদের আদরের পুরোটাই এসে পড়লো তার ওপরে। দোলার আপত্তি ওর ঐ নামটায় – নামটা তো ছেলের, কিন্তু ফন্টে তো আসলে মেয়ে। কিংশুক একটা নাম দিলো – সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার গুপি গায়েনের মেয়ের নাম – মণিকাঞ্চনা। কিন্তু এতো বড় নামে ডাকতে দোলার আপত্তি। অনেক অঙ্ক কষে ঠিক হলো ফন্টের নাম পাল্টে রাখা হোক মন্টি – এতে নামে একটা মেয়েলি আদল রইলো, আগের নামের সঙ্গে মিল রইলো আর নতুন পোষাকি নামের সংক্ষিপ্তকরণও বজায় রইলো। মায়েরও এই নামটা বেশ পছন্দ। এই নাম নিয়েই মন্টি এবার বড় হতে লাগলো।
বড় হওয়ার সাথে সাথে মন্টির বাইরে বের হওয়ার অভ্যাস একটু বাড়লো। আসলে বেড়ালের প্রাকৃতিক কাজকর্মগুলো, অর্থাৎ পটি-হিসু, ওরা প্রকৃতি প্রদত্ত পদ্ধতিতেই করতে চায় যার জন্য বাগানের মাটি ওদের খুব উপযুক্ত জায়গা। কখনও কখনও ওকে রাস্তাঘাটেও দেখতে পাওয়া যেতে লাগলো। কিন্তু দরজা খোলা না থাকলে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে ঘরে ঢুকতে ওর যে একটু অসুবিধা হয় খোঁড়া পায়ের কারণে সেটা কয়েকটা দিনেই পরিষ্কার বোঝা গেলো। কিংশুক আর দোলা দুজনে মিলে যুক্তি করলো যে মন্টির গলায় একটা ঘন্টা বেঁধে দিলে কেমন হয়? হাঁটাচলার সময় ঐ ঘন্টার টুংটুং আওয়াজ ওর উপস্থিতি জানান দেবে। আর শ্রুতিমধুর মিষ্টি আওয়াজটা কানে বাজলে বেশ ভালোই লাগবে। দুজনের সিদ্ধান্তে মায়ের অনুমোদনও পাওয়া গেলো। ব্যস, শুরু হয়ে গেলো অপারেশন ঘন্টা বাঁধা।
ঘন্টার ব্যবস্থাও মা করে দিলেন। কিংশুকের দিদির বিয়ের আগের সময়ের নাচের একজোড়া ঘুঙুর ছিলো, সেটা নিজের ভাঁড়ার থেকে বের করে দিলেন। তার থেকে চট করে একটা ঘন্টা খুলে নিয়ে একটা সুদৃশ্য রঙীন কিন্তু যথেষ্ট শক্তপোক্ত সরু দড়ি দিয়ে ঘন্টাটা মন্টির গলায় বেঁধেও দিলেন। কয়েকটা দিন মন্টি ঐ দড়ি আর ঘন্টা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত রইলো। ঘাড় বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে দড়িটা খুলে ফেলার চেষ্টা করে। দড়িটাও দাঁতের ফাঁকে আটকে যায়। তখন সে কিংশুক অথবা দোলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো – যেন বলছে দড়িটা দাঁতে আটকে গেছে, খুলে দে তো। সে খুলে দিলেই আবার টুংটাং সুরধ্বনি তুলে চলে যেতো। কিংশুকদের একতলা বাড়ি, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ছিল। বিশেষ করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা বা নামার সময় মন্টির গলায় বাঁধা ঘন্টার দ্রুত আওয়াজ বেশ লাগতো শুনতে। দোলারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে বলতো – ঐ যে দমকল আসছে!
কিছুদিনের মধ্যেই মন্টি বুঝলো যে ঐ ঘন্টার ফাঁস বোধহয় তার সারাজীবনের জন্যই। মানিয়ে নিলো, কারণ দাঁতে দড়ির ফাঁস এরপর থেকে কমই আটকায়, শুধু জিভ দিয়ে গলা চুলকানোর সময় মাঝে মধ্যে দড়ির ফাঁসটা দাঁতের ফাঁকে আটকে যেতো। সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে এসে দাঁড়াতো মাথাটা উঁচু করে যাতে দেখাতে পারে যে ওদের বাঁধা দড়িটা তার দাঁতের ফাঁকে আটকে আছে। মজা হলো শুধু ঐ ফাঁসটা ছাড়িয়ে দেওয়ার সময়টাতেই মন্টির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করা যেতো, এছাড়া অন্যসময় কিছুতেই ওর গায়ে হাত দেওয়া যেতো না। গৃহপালিত বেড়াল সম্পর্কে কিংশুকরা শুনেছিলো যে মানুষের গা ঘেঁষে থাকতে, কোলে বসে আদর খেতে খুব পছন্দ করে, কিন্তু মন্টির এই ধরণের কোনও অভ্যাসই দেখা গেলো না। অথচ বাইরের কাজকর্ম সব মিটে গেলে বাকি সময়টা কিংশুকদের কাছেকাছেই ঘুরে বেড়ায়। অদ্ভুত কিছু আচরণ ওর মধ্যে লক্ষ্য করা গেছিলো। বাড়িতে সে বেশিরভাগ সময় মানুষের কাছাকাছি থাকে। কিংশুকের অফিস যাওয়ার সময় ওর চেয়ারের পেছনে চুপটি করে বসে থাকে। কিংশুকের খাওয়া শেষ হওয়ার পর জল খেয়ে গ্লাসটা টেবিলের ওপর ঠক করে নামানো মাত্র ম্যাঁও করে একবার আওয়াজ দিতো, অর্থাৎ আমি আছি। কিংশুক একটু মাছ দিয়ে কিছুটা ভাত মেখে রান্নাঘরের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতো, মন্টির ওটাই ছিল দ্বিপ্রাহরিক আহার। এছাড়া সকালে আর বিকালে মায়ের তরফ থেকে নিরামিষ টিফিন আর দোলার কাছ থেকে রাতের আমিষ ডিনার প্রাপ্তি প্রায় বাঁধাধরা ছিল। বাজার থেকে মাছ আসার পরে অথবা রান্না হওয়ার পরে ভুলে রান্নাঘর খোলা থেকে গেলেও মন্টিকে কেউ কখনও মাছ বা অন্য কোনও খাবার চুরি করতে দেখেনি। একদিন কেবল ভুলক্রমে বেশ কিছুক্ষণ রান্নাঘরে আটকা পড়ে যাওয়ায় মন্টি মাছ খেয়ে নিয়েছিলো, একে অবশ্য চুরি করা বলে না। এতে করে কিংশুকরা কখনও মনে করেনি যে মন্টির চরিত্র খারাপ, বরং এটাই মনে করেছে যে মন্টির মধ্যেও ওর বেড়ালধর্ম পুরোপুরি বজায় আছে।
মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে মানুষের কিছু ধর্মও বোধহয় মন্টির মধ্যে আপতিত হয়েছিলো। যেমন বিকালে দোলারা যখন চা খেতো তখন মন্টিকে দেখা যেতো রাস্তার দিকের ছাদের কার্নিশে পা মুড়ে বসে রাস্তার লোকজন, গাড়িঘোড়া ইত্যাদির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে, বা উপভোগ করছে। সন্ধ্যের পরে সবাই যখন একসঙ্গে বসে টিভি দেখছে তখন টিভির কাছাকাছি ড্রেসিং টেবিলের একটা তাকের ওপর বসে সেও টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতো, তার খানিক বাদে ঘুমিয়েও নিতো। কিংশুকরা কখনও বুঝে উঠতে পারেনি যে মন্টির ঐ ঘুমটা আসতো টিভি দেখার আমেজে নাকি চোখের ক্লান্তিতে?
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্টি চেহারাতেও বড় হতে হতে কয়েক বছরেই পূর্ণ যুবতী বেড়ালের আকারপ্রাপ্ত হলো। বাড়ির বাইরে ঘোরাঘুরিও বেড়ে গেলো। ইদানিং বাড়ির পিছনের বাগানে অন্য একটি বেড়ালের আগমন লক্ষ্য করা গেছে এবং উভয়ের মধ্যে ধীরে ধীরে বোধহয় একটু হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠছে। আরও একটা ব্যাপার, মন্টি এখন নিজের খোঁড়া পা নিয়ে বেশ খানিকটা লাফ দিতে পারে। এখন আর খোলা দরজা দিয়ে নয়, জানালা খোলা থাকলে লাফ দিয়ে জানালা টপকেই সে বাগানে চলে যেতে পারে। এই উন্নতি বোধহয় হর্মোনের প্রভাবে, দয়িতর সঙ্গে মিলনের আকাঙ্খায়।
যথারীতি কিছুদিন ধরে কিংশুকদের বাগানটাকে বৃন্দাবনের লীলাক্ষেত্র বানিয়ে মাস দুয়েক পরে মন্টি দুটি শাবক প্রসব করলো। কিন্তু কিংশুকরা এটা বুঝতে পারেনি। ওদের রান্নাঘরের পাশে একটা ছোট্ট ভাঁড়ার ঘর ছিল। একদিন দোলা লক্ষ্য করলো যে মন্টি ঐ ভাঁড়ার ঘরের জানালায় লাফিয়ে উঠে সেখান থেকে সেই জানালার পাশের কাঠের আলমারির মাথায় উঠলো। তারপর ঐ আলমারির মাথা থেকে একটা লফ্টের ওপর। তখনই একাধিক ‘কুঁই-কুঁই’ আওয়াজ কানে এলো। সঙ্গে সঙ্গে দোলা কিংশুককে ডেকে নিয়ে আসতেই কিংশুকও ঐ আওয়াজ সমর্থন করলো। কিন্তু অতি উৎসাহী হয়ে তখনই লফ্টের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি মারলো না। পরের দিন মন্টির অনুপস্থিতিতে দেখা গেলো যে লফ্টের ওপর রাখা একটা বাক্সের আড়ালে ঘুমন্ত অবস্থায় দুটি বেড়ালশাবক। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিংশুক-দোলার আনন্দ হলো দুর্ঘটনার ফলে তাদের মন্টির এক পা খোঁড়া হলেও সে এক সুস্থ সবল মা হয়ে উঠতে পেরেছে।
এরপর একদিন দেখা গেলো মন্টি তার দুটো ছানাকেই মুখে ঝুলিয়ে লফ্ট থেকে নামিয়ে তার প্রিয় ড্রেসিং টেবিলের খোপে এনে ঢুকিয়ে দিলো। আর নিজে মেঝের ওপর রইলো পাহারায়। রাত্তিরে আবার ওদের লফ্টের ওপর নিয়ে গেলো। এর কয়েকদিন পরে হঠাৎ দেখা গেলো গর্বিত মা মন্টি ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে আর তার গায়ের ওপর দিয়ে তার দুই সন্তান হুটোপুটি করছে। মন্টির মুখের কাছে এলেই ওদের চেটে দিচ্ছে যাতে ওরা ধুলোবালি, রোগজীবানুর হাত থেকে সুরক্ষিত থাকে। মানুষ এদেরকে ইতর প্রাণী মনে করলেও প্রকৃতি এদের এক সুশৃঙ্খল জীব হিসাবে তৈরী করেছে। বাচ্চাদুটোর নরম রোঁয়াভরা তুলতুলে দেহ দুটো দেখলেই ওদের আদর করতে ইচ্ছা হয়।
কিন্তু সেইসঙ্গে আরেক উপদ্রব এসে হাজির, একটা হুলোবেড়ালের আনাগোনা শুরু হইয়েছে। মা সবাইকে সতর্ক করে দিলেন। এটা মেয়ে বেড়ালের আকর্ষণে ছেলে বেড়ালের আগমন নয়, বরং শিশু বেড়ালকে ভাবী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভয় পেয়ে কংসের মতো শিশু অবস্থাতেই তাকে নিধন করার মানসিকতা। দোল্রা ঐ সময় বেশ কিছু দিন সন্তানকে বাঁচাতে মন্টির রূদ্রমূর্তি প্রত্যক্ষ করলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য মন্টির। বোধহয় নিজের প্রাকৃতিক প্রয়োজনের তাড়নায় সন্তানদের ছেড়ে রেখে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যেতে হয়েছিলো, সেই ফাঁকে একটা বেড়ালছানা বেপাত্তা হয়ে যায়। সবাই আন্দাজ করলো এটা ঐ হুলোটারই কাজ, কারণ ঐ বাচ্চাটা ছিল ছেলে।
এবার অবশিষ্ট ছানাটাকে বাঁচানোর তাগিদে শুধুমাত্র মন্টির নজরদারি আরও আঁটোসাঁটো হলো তাই নয়, কিংশুকের পরিবারও সদা সতর্ক হয়ে গেলো। এভাবে হুলো আর বাড়ির মধ্যে আসতে ভরসা পায় না। বেড়ালছানাটাও বড় হতে থাকলো। দোলা বুঝে গেছে যে এটা হচ্ছে মেয়ে বেড়াল। তার শরীরে সাদা-কালোর পরিবর্তে একটু বাদামী ঘেঁষা রঙের আধিক্য বলে আদর করে তার মেয়েলী নাম রাখা হলো ‘লালী’।
লালী বড় হতে থাকলো। ইদানিং দরজা খোলা পেলে ঘর ছেড়ে বাগানে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। গাছপালা শুঁকতে থাকে। মাঝে মধ্যে পোকামাকড় ধরে খেতে দেখা গেছে। আর পাখি দেখলে তার মধ্যে একটা উন্মাদনা দেখা যায়, এমন লাফ দেয় যেন ঐ উড়ন্ত পাখিকে ধরে ফেলবে। কিন্তু আগের দুই বেড়াল ভাইবোনের খেলাধূলা যতটা জমতো, লালীর একার পক্ষে আনন্দ করা যেন অতটা জমছিলো না। মা এলে মায়ের কাছে তার তখন খেলার আবদার শুরু হয়ে যেতো। মন্টি তার লেজটাকে দোলাতো, আর লালী ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে মায়ের লেজটাকে ধরতো। এভাবেই খেলতে খেলতে লালীর বয়স কয়েক মাস হয়ে গেলো।
কিন্তু এই পৃথিবীতে কোনও কিছুই দীর্ঘদিন বোধহয় একভাবে চলতে পারে না। একদিন দোলা লালীকে ঘরে না দেখে বাগানে গিয়ে দেখে লালী মাটিতে শুয়ে আছে। অনেক ডাকাডাকি করেও লালীর নড়াচড়া লক্ষ্য না করতে পেরে কাছে গিয়ে দেখলো মাথার কাছে চাপ চাপ রক্ত। পাশে একটা আস্ত ঝুনো নারকেল পড়ে আছে। দোলার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তাদের বাগানের নারকেল গাছ থেকে নারকেল খসে পড়ে লালীর মৃত্যু ঘটিয়েছে। তাড়াতাড়ি ফোন করে কিংশুককে। কিংশুক অফিস থেকে এসে লালীকে পর্যবেক্ষণ করে দোলার সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করে – লালী খসে পড়া নারকেলের আঘাতে মারা গেছে। মাটির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে লালীকে কবর দিয়ে দেয়। তিনজন মিলে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে লালীর আত্মার শান্তি কামনা করে, প্রার্থনা করে। মন্টি বেশ কয়েকবার লালীকে শুঁকে শুঁকে তারপর সরে গিয়ে কিংশুকদের ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করছিলো। এরপর কয়েকটা দিন মন্টি মনমরা হয়ে একা একা ঘুরে বেড়াতো। মাঝে মধ্যে লালীর কবরের জায়গায় গিয়ে একটু শুঁকে আসতো।
জীবন শুধু সুখ সম্বল করে অথবা কেবলমাত্র দুঃখ নিয়ে চলতে পারে না – উভয়ের একটা মিশ্রণ জড়িয়ে থাকে জীবনে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলতে হয় সব প্রাণীকেই – মন্টির ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না। মন্টি যথারীতি তার সন্তানরা ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে যেরকম ভাবে থাকতো সেই জীবনেই আবার ফিরে গেলো। তবে তার সেই প্রেমিক বেড়ালকে আর আসতে দেখা যাচ্ছিল না। মন্টি তার নিজস্ব বেড়াল পরিবার বানাতে না পেরে কিংশুকদের পরিবারের অঙ্গ হিসাবেই নিজের জীবন কাটাতে লাগলো। তার গলায় বাঁধা ঐ ঘন্টা এখনও সারা বাড়িতে বাজতে থাকে তার চলার ভগ্ন ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে।
এভাবেই চলতে থাকলো। মন্টির বিভিন্ন সময়ের খাওয়ার ধরন, বিকালে কার্নিশে বসে থাকা, সন্ধ্যাবেলা ড্রেসিং টেবিলে বসে টিভির সামনে ঝিমোনো এসবই যেন রুটিন হয়ে গেছে। কিন্তু ঈশ্বরই বলি বা প্রকৃতিদেবীই বলি অথবা ভাগ্যদেবতাই বলি – এদের ইচ্ছাতেই বোধহয় জীবনের চাকা ঘোরা বা থেমে যাওয়া নির্ভর করে।
এক ছুটির দিন সন্ধ্যাবেলা সবাই চা খেতে খেতে টিভি দেখছে। হঠাৎই কানে বাজলো এক কুকুরের ডাক। বেশ জোরালো আর তারই আড়ালে একটা বেড়ালের মৃদু ডাক। কিংশুকের মনে সন্দেহ হতেই ছুটে চলে গেলো বাগানের দিকে। ঘরের জানালাটা বন্ধ, বোধহয় মশার ঘরে ঢোকা আটকাতে। দরজাটা তো বিকালেই বন্ধ হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে একটা কুকুর বাগানের মধ্যে ঢুকে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ডেকে চলেছে আর মন্টি জানালার নিচে শুয়ে কোঁকাচ্ছে। কিংশুক উৎকন্ঠিত হয়ে ছুটে গিয়ে দেখলো যা আশঙ্কা করেছিলো সেটাই – মন্টির পেটের কাছে আঘাতের চিহ্ন, রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মনে হয় পাকেচক্রে পড়ে কুকুরের তাড়া খায় মন্টি। পালিয়ে বাগানের জানালা দিয়ে লাফিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে বন্ধ পাল্লায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যায় আর তখনই কুকুরটা কামড়ে দেয়। পা খোঁড়া থাকায় তাড়াহুড়ো করে ছুটে বাড়ির সামনের দিকের খোলা জানালা দিয়ে আর ঢুকতে পারেনি। কুকুরটাকে তাড়িয়ে মন্টিকে দুহাতে আলতো করে তুলে ঘরে নিয়ে আসে। ততক্ষণে কিংশুকের ডাক শুনে দোলা এসে একটা শুকনো কাপড়ের ওপর মন্টিকে শুইয়ে ক্ষততে একটু ডেটল লাগিয়ে দিলো। তারপর মন্টির ছোটবেলার সেই ড্রপারটা বের করে দোলার আনা দুধ একটু খাওয়াবার চেষ্টা করলো। কিন্তু অতি সামান্য, বোধহয় কয়েক ফোঁটা দুধ মন্টি পান করলো। তারপর কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে রইলো। রাতে কয়েকবার বিছানা থেকে উঠে কিংশুক আর দোলা মন্টিকে দেখেছে, কিন্তু সে ঐরকম নিস্তেজ হয়েই পড়ে ছিল। শুধু ওর বুকটা ওঠানামা করছে, ধুকপুক ধুকপুক করছে। সকালবেলা দেখা গেলো মন্টির শরীর নিথর। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লো মন্টির অভিভাবক তিনজন। তবুও বিয়োগ ব্যাথার কষ্টকে চেপে ধরে রেখে কিংশুক তাঁদের বাগানেই মন্টিকে তার মেয়ের পাশে কবর দিলো। একটু ধূপ জ্বালিয়ে দিলো।
তারপর বেশ কয়েক মাস কিংশুকের পরিবারের বিভিন্ন ব্যাপারে মন্টির প্রসঙ্গ চলে আসতো। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনরা এলেও তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় মন্টির কথা আলোচিত হতো। আর তখনও পর্যন্ত কিংশুক-দোলারা নিঃসন্তান থাকায় মন্টি কয়েক বছর ওদের জীবনটাকে ভরিয়ে রেখেছিলো, সন্তানের অভাব বুঝতে দিচ্ছিলো না। কিন্তু মন্টির পরলোক প্রাপ্তিতে ওদের জীবনে আবার একটা আংশিক শূন্যতা নেমে এলো।
এরই বছর দুয়েক পরে দোলার কোল আলো করে এক পুত্রসন্তান এলো। খুশিতে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো ওদের জীবন। আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলো – দেবাংশু, দোলার এবং কিংশুকের নামের অক্ষরের মিল রেখে। মন্টি এতটাই কিংশুক-দোলার মন ছেয়ে ছিল যে দেবাংশুর একটু বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মন্টির গল্প ও এত শুনেছিলো যে মন্টি ওর চেতনাকেও ছেয়ে ছিল।
দেখতে দেখতে দেবাংশুর বয়স এখন ত্রিশ ছুঁই ছুঁই, এখন সে চাকরিজীবী। এদিকে কিংশুক তার চাকরি থেকে অবসর পেয়েছে, মাও আর বেঁচে নেই। দেবাংশু এনজিও-তে ভালো চাকরি করে, নিজের পছন্দের কাজ করে – বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়। নতুন কোনও জঙ্গলে পোস্টিং পেলে থাকার ব্যবস্থা ঠিক করে, ঘরদোর একটু গুছিয়ে নিয়ে বাবা-মাকে নিয়ে আসে। বাবা-মা দু’এক মাস থেকে যান, ওর একার সংসারটা একটু গুছিয়ে দেন। আর বিয়ের জন্য ক্রমশঃ তাগাদা দিতে থাকেন। কিন্তু দেবাংশু এড়িয়ে যায়। বলে আমার মত জংলী ছেলের সঙ্গে কোনও মেয়ে নিজের জীবন জড়াবে না। একটা জিনিস দেবাংশু কখনও কাছছাড়া করে না – যেখানেই পোস্টিং পাক ওর শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে একটা ছোট্ট ঘন্টা ঝুলতে দেখা যায়। হ্যাঁ, সেই ছোট্ট ঘন্টাটা, তার পিসির ঘুঙুরের থেকে তার আম্মা যেটা দিয়েছিলো তার বাবাকে, আর বাবা বেঁধে দিয়েছিলো মন্টির গলায় যাতে তার চলাফেরার গতিপথ সবাই জানতে পারে। একটু বড় হয়ে দেবাংশু তার মা, বাবা আর আম্মার কাছে কতবার যে মন্টির গল্প শুনেছে তার ইয়ত্তা নেই। চাকরির প্রয়োজনে বাড়ি ছাড়ার সময় সে ঐ ঘন্টাটা তার বাবার কাছ থেকে নিয়ে নিজের হেফাজতে রেখে দিয়েছিলো আর নিজের ঘরের দেওয়ালে চোখের সামনে ঐভাবে ঝুলিয়ে রাখতো। সমগ্র বিশ্বের সমস্ত প্রাণীকুলের নিরাপত্তার সংকেত যেন ঐ ঘন্টার মধ্যে সে অনুভব করতে পারতো। সে চাইতো একটা বেড়ালের নিরাপত্তার দায়িত্বে একসময় যেই ঘন্টা ছিল, তার এখনকার ভূমিকা যেন হয় সকল প্রাণীকে এক নিরাপত্তার বলয়ে বেঁধে রাখতে পারা – তার উপস্থিতিই যেন সেই ইঙ্গিত বহন করে, যেন বলতে পারে তোরা কেউ অপরের থেকে আলাদা হয়ে সরে যাস না, একসাথে বেঁধে বেঁধে থাক।।
Add comment