সাহিত্যিকা

দেনা-পাওনা

দেনা-পাওনা
সুদীপ সেনগুপ্ত, ১৯৮০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

গল্প রচনার বিষয়বস্তু ফেলে আসা পুরো জীবনটাকেই আরও একবার নতুন চোখে দেখার জন্য উত্যক্ত করলো। এই দীর্ঘ চলার পথে আজ অবধি নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপই তো দেনা-পাওনার নিক্তিতে ব্যাখ্যা করতে কোনও অসুবিধায় পড়তে হয় না। তবুও তার মধ্যে কিছু কিছু ঘটনা মনের মাঝে গভীর ছাপ ফেলে, কালের নিয়মে আবার ফিকে হতেও থাকে।

বছর ষোলো-সতেরো আগের কথা। সদ্য দেশের মাটি ছেড়ে প্রথম বারের মতো বাইরে থিতু হতে চলেছি। একটা অনিশ্চয়তার দোলাচল তো সব সময়ই মনে খেলা করছে। আগামী দিনগুলো যাতে সুচারুভাবে অতিবাহিত হয়, তার প্রার্থনা অজান্তেই চিন্তার মাঝে সর্বক্ষণ বয়ে চলেছে। শুধু আমার জন্য তো নয়, স্ত্রী ও শিশুকন্যা সঙ্গী হয়ে চলেছে ঐ নতুন জগতে। আমাকে তো মানাতে হবেই, ব্যস্ত থাকবো কাজের জগতে, কিন্ত ওদের যাপন করতে হবে অহোরাত্রব্যাপী আত্মীয় ও বন্ধুপরিহিত জীবন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এক বৃহৎ যৌথ পরিবারের সদস্য হওয়ার সুবাদে দিনরাত ভরে থাকতো আলাপচারিতায়, মতবিনিময়ে। সেই পরিবেশকে সাময়িক বিদায় জানিয়ে এবার নতুন এক অধ্যায়।

মধ্য প্রাচ্যে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হলো আলো ঝলমল এক আধুনিক শহরের আকাশ, সর্বসুবিধাযুক্ত জীবনযাপনের এক উজ্জ্বল বাতাবরণ। যে কোনও বৈষয়িক সমস্যার সুস্বাস্থ্যময় সমাধান। এ দেশে ধর্মীয় গোঁড়ামির ছোঁয়া মাত্র নেই, নেই রাজনৈতিক ত্রাসের অবকাশ, সামাজিক বহমানতা বর্তমান। ধীরে ধীরে দৈনিক প্রকরণ অভ্যস্ত হয়ে উঠলো এই নতুন আঙ্গিকে, সবাই মানিয়ে নিচ্ছিলাম এই নতুন স্বাচ্ছন্দ্যে। তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকলো এই নবীন পরিভ্রমণ।

তখনই একদিন মনে হলো, এই যে এত প্রাপ্তি, সত্যিই কি আমি এর যোগ্য ? আপন নিয়মে কাজ করে এসেছি এতদিন, অহেতুক মানসিক চাপ না নিয়ে। জীবনের মূল মন্ত্র ছিলো ‘অপরের ক্ষতি করিও না’, ছোটবেলায় পড়া ঈশপের নীতিকথা অনুসারে। এ কি তারই কর্মফল ! বিশ্লেষণে বসলাম, কি হতে পারে এই গতানুগতিক জীবনের এক ঘটনা যা আমাকে এই পথ দেখিয়েছে, সব কাজই তো ধরাবাঁধা নিয়মানুসারে করে এসেছি এতদিন। হঠাৎ একটি চাহনি, একটি অব্যক্ত ভাবপ্রকাশ দূর থেকে ভেসে এসে হৃদয়ে আঘাত করলো, ঠিক সতেরো বছর আগে যে রকম করেছিলো, এই এতকালের বিস্মৃতি ঠেলে।

মফস্বল শহরে মানুষের ভিড়ে ভরা বাজারের রাস্তা। সকাল এগারোটা। পসরা সাজানো চারিদিকে, গ্রাহকরাও ব্যস্ত পুরোদমে। কিছু ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাও পথে পথে ফেরি করে বেড়াচ্ছে। রোদ চড়ছে একটু একটু করে। রিক্সাওয়ালারা তার মাঝেই পথ করে এগিয়ে চলেছে মোটরবাইকের আধিপত্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আর পরিবেশ ভরে আছে হাই ডেসিবেলের মিশ্র শব্দছোঁয়ায়, পরস্পর কথা বলতে গেলেও চিৎকার অবশ্যম্ভাবী। আমরা দু’জনও সেই জনস্রোতে ভাসমান। হঠাৎ আকাশ-বাতাসের বুক চিরে এক ভাষাহীন আর্তনাদ। আর পাশ দিয়ে ধাবিত হয়ে গেলো এক উন্মত্ত বিশালদেহী ষাঁড়। এগিয়ে গিয়ে দেখি এক মাঝবয়সী লোক পথে বসে অস্ফূট শব্দ করছে, মাঝে মাঝে স্বর উচ্চ হয়ে আবার গোঙানিতে পর্যবসিত হচ্ছে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে অসংখ্য খোলা লজেন্স, যা একটু আগেই ধাক্কা খেয়ে দু’টি বড় কাঁচের বয়াম ভাঙার ফল। এ ঘটনা তো অহরহ ঘটে থাকে, ব্যস্ত জনতা আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর ভূলুণ্ঠিত মানুষটি সেই ভাবেই কেঁদে যায়।

কাছে আসতে বোঝা যায় যে সে বিশেষ ভাবে সক্ষম, আর চোখের চাহনিতে এক সকরুণ আর্তি। হাতে ভাবে বোঝায় এই ছিলো তার সব সম্পদ, এ বিক্রি হলেই হতো দিন গুজরান, একদম নিঃস্ব হয়ে গেলো। বহমান জনতার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, দিন এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব গতিতে। কিছু এমার্জেন্সি অর্থের প্রয়োজন ছিলো, একটু আগেই বেরিয়েছিলাম ব্যাঙ্ক থেকে। ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, কত ক্ষতি হলো, কত পেলে তার একটু সুরাহা হবে। যা জানালো, বুঝলাম আমার সাথে থাকা অর্থের অনেকটাই দরকার। এক লহমা, সঙ্গী ইশারা করলেন দেওয়ার জন্য, আমি দিলাম। তারপরেই সেই কিছুটা অদ্ভুত হৃদয় ভেদ করা চাহনি এবং কৃতজ্ঞতার অব্যক্ত অভিব্যক্তি আমাদের স্তব্ধ করে দিলো। জীবনধারণের নতুন অবলম্বনে তার হয়তো একটু সুবিধা হলো, কিন্ত আমাদের যে পরম প্রাপ্তি হলো, তা অনুভব করলাম পরবর্তী জীবনে যার কথা লিখেছি প্রথমে।

এক জাগতিক জীবনে দেনা-পাওনার হিসেব হয়তো এইভাবেই মিলেমিশে যায়।

******

আতস কাঁচ

বিনায়ক আর একবার আতস কাঁচটা ঘষে নিলেন। কেন নিলেন জানেন না, সেই বহুদিনের চশমার কাঁচ ঘষার অভ্যাস। তাহলেও ওই খুদে খুদে ছবি আর লেখা পড়ার জন্য তাঁকে আতস কাঁচ ব্যবহার করতে হয়। আর এই ব্যবহার করার প্রসঙ্গে মনে পড়লো, তাঁর পিতৃদেবের একটা বড় বিদেশি ম্যাগনিফাইং গ্লাস ছিলো, খুব ভালো কোয়ালিটির। এটা ওঁর প্রয়োজনে লাগতো ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার এর অ্যানসার শিট চেক করার সময়, বিভিন্ন ধরনের হ্যান্ডরাইটিং এর মধ্য থেকে সার শব্দগুলো আহরণ করতে। কিশোর বিনায়ককে সেই আতস কাঁচটা খুব টানতো। মাঝেমধ্যেই সেটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন বাগানের দিকে। উত্তল-উত্তল লেন্সের সাহায্যে আনন্দ পেতেন সূর্যরশ্মি কনভার্জ করে পুরনো কাগজপত্র জ্বালিয়ে দিতে, দেশলাই কাঠি ছাড়াই।

আরো একটা কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। বাড়িতে ছিল খুব ছারপোকার উপদ্রব। এদিক-ওদিক বিছানা ভরে থাকতো। আর শোনা ছিল একটা প্রবাদ, ছারপোকারা হচ্ছে রক্তবীজের বংশধর। একটি ছারপোকা মারলে যে রক্তপাত হতো তার মধ্যেই নাকি লুকিয়ে থাকতো ভবিষ্যতের হাজারো প্রাণ। রক্তপাত ঠেকাতে সূর্যালোককে কেন্দ্রীভূত করতেন সেই ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে আর লক্ষ্য ছিলো ছারপোকার দেহ। দেখতেন, ধীরে ধীরে গরম হয়ে গিয়ে লম্বা হয়ে যাচ্ছে দেহটা, আত্মাকে বিদায় দিয়ে এবং নতুন জন্মকে রোধ করে। উপলব্ধি করেছিলেন ক্ষুদ্র বস্তুকে পরিষ্কার এবং বড় করে দেখানোর সাথে সাথে শুদ্ধিকরণেও একটা বিরাট ভূমিকা আছে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই আতস কাঁচের।

বিনায়ক ফিরে এলেন বর্তমানে। খবরের কাগজের শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপন বা ইংরেজি কাগজের ক্লাসিফায়েড এডভার্টাইজমেন্ট তাকে আকর্ষণ করে খুব। বার্ধক্য এবং হরফের ক্ষুদ্রতা তাকে বাধ্য করেছে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের নিয়মিত ব্যবহারে। এই ভাবেই এক শীতের দুপুরে একটি বিজ্ঞাপন তাঁর ভ্রূজোড়াকে কুঞ্চিত করলো, মনকে করলো বিচলিত, চোয়াল হয়ে উঠলো শক্ত। কাঁপা হাতে আতস কাঁচ টেবিলে নামিয়ে রেখে চশমার কাঁচ মুছতে লাগলেন পুরানো অভ্যাসে। পাশে রাখা জলের বোতল থেকে অল্প জল খেয়ে নিলেন। চশমা চোখে লাগিয়ে আবার হাতে তুলে নিলেন ম্যাগনিফাইং গ্লাস। দেখলেন, ঠিকই পড়েছিলেন বিজ্ঞাপনটি।

এইখানে বিনায়ক বাবুর পরিবারের একটা পরিচয় আবশ্যক। খুবই সাধারণ মধ্যবিত্ত রিটায়ার্ড চাকুরের পরিবার। যুগের চলনের মত একটি মাত্র ছেলেকে সুশিক্ষিত করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে থিতু হওয়ার পর ফুটফুটে তিন বছরের নাতনিকে নিয়ে নিয়ে তারা ভারতবর্ষের অন্য এক শহরে সংসার পাতিয়ে সুখে আছে। বছরে দু-একবার কলকাতা আসে, বিশেষ করে দুর্গাপুজো আর নববর্ষের সময়। এছাড়া রোজকার ভিডিও কল তো আছেই। দাদুর নাতনি-অন্ত প্রাণ স্বাভাবিক কারণেই। নির্ঝঞ্ঝাট নিস্তরঙ্গ জীবন। সঙ্গত কারণেই কিছুদূরের এক বয়স্ক প্রতিবেশী সন্ধ্যা বেলায় আসেন সঙ্গ দিতে।

কিন্তু এই অনাবিল জীবন যাপনে অভ্যস্ত বিনায়কের ভুরু কুঁচকে গেল কি এমন বিজ্ঞাপন দেখে ? একটি পিতৃমাতৃহীন সদ্যবিবাহিত দম্পতি বসবাসের জন্য চাইছে এক নির্ঝঞ্ঝাট প্রৌঢ় সংসার, যেখানে তারা পাবে বাবা-মায়ের স্নেহ আর সাহচর্য। বিনায়কের খুবই অবাক লাগলো। আজকাল যেখানে কপোত-কপোতী সাজানো পরিবার ছেড়ে স্বাধীন থাকতে চায়, সেখানে এরা চাইছে মায়ায় আবদ্ধ হতে ? কৌতুহল হলো, ভাবলেন একবার কথা বলিই না ওদের সাথে। গিন্নিকে জানাতেই শুনলেন, তুমি কি পাগল হলে নাকি ? বললেন, জানো তো খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওরা কেন এমন চাইছে, ডাকিই না ওদের। বিজ্ঞাপনের দেওয়া ফোন নাম্বারে কথা বলে ওদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলেন। নির্দিষ্ট দিনে সমিধ আর অরণি এসে উপস্থিত হলো। ওরা জানালো, দুজনেরই বড় হওয়া ভিন্ন ভিন্ন অনাথ আশ্রমে। পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট করে দুজনেই কর্মরত। থাকে যথাক্রমে পুরুষ এবং মহিলা পিজিতে আলাদা আলাদা। এবার তারা থাকতে চায় একসাথে আর ভীষণভাবে পিয়াসী একটুখানি স্নেহ আর আশীর্বাদের। আজকাল বিভিন্ন সূত্রে সহকর্মীদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় জেনেছে, বহু প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ দম্পতি আছেন যারা একটুখানি অপত্য স্নেহ বিতরণের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। যেহেতু তাদের সন্তানেরা চলে গেছে বহু দূরে, কর্মসূত্রেই আর যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেই রকম কোন একটি সংসারে এরা ঠাঁই নিতে চায় ”দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে”র আদর্শ বহন করে। আর সেই থাকাতেই পরখ করে নিতে চায় সংসারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দৈনন্দিন ভালো-খারাপ গুলো অভিজ্ঞতার আতস কাঁচ দিয়ে। আর শুদ্ধ হয়ে উঠতে চায় প্রয়োজনে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তরণের আঁচলে। সম্মান দিতে চায় মানব ধর্মকে তাদের সীমিত সামর্থ্য কিন্তু প্রবল অভিলাষ দিয়ে।

বিনায়ক স্তব্ধ হলেন, আনন্দিত হলেন। সমিধ আর অরণিকে আপ্যায়ন করলেন অত্যন্ত আদরে। জানালেন, আমরা হয়তো তোমাদের চাওয়া মতো এক দম্পতি হতে পারতাম। কিন্তু আমাদের পুত্র পুত্রবধূ নাতনি সবাই আছে যদিও কাছে নয়, বছরের অধিকাংশ সময় দূরে। তবুও তাদের প্রাপ্য স্নেহ-ভালোবাসাকে আমরা কিছু কম করতে পারবো না। জানি, স্নেহ বিতরণ করলে আরো বর্ধিত হয়। তাই তোমাদের প্রতি আমাদের যথেষ্ট স্নেহ রইলো। আশীর্বাদ করি, তোমরা তোমাদের গন্তব্য নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে একদিন। নিয়মিত সংসারের খুঁটিনাটি-দোষত্রুটি যখন উপলব্ধি করতে পারবে অভিজ্ঞতার আতস কাঁচ দিয়ে, সমাধানের আলোকরশ্মিকে কেন্দ্রীভূত করে তখনই জ্বালিয়ে দিতে পারবে সেইসব মন্দ কারণ।

সমিধ আর অরণি নতুন আশা নিয়ে বিদায় নিলো। বিনায়ক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন হাতে ধরা বাবার দেওয়া উপহারটির দিকে।

© সুদীপ সেনগুপ্ত, ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৩

 

Sahityika Admin

Add comment