আমাদের বাড়ির কার্তিক পুজো
দেবাশীষ তেওয়ারী, ১৯৬৯ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমাদের বাড়িতে কার্তিক পুজো দুশো বছরেরও বেশী পুরোনো, সেই যবে নাকি ইংরেজদের কাছ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষ এক সময় জমিদারি কিনেছিলেন। খুব কম লোক জানে যে কলকাতা শহরের পত্তনেরও বেশ কিছু আগে বর্ধমানে ইংরেজদের জমিদারি ছিল এবং কলকাতার জমিদারির ফরমান মুঘলদের কাছ থেকে ইংরেজরা নাকি পেয়েছিল এই বর্ধমানেই। এটা নিয়ে পরে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে। বক্সারের যুদ্ধের পর অবশ্য ইংরেজরা দুর্বল মুঘলদের কাছ থেকে বাংলা বিহারের পুরো দেওয়ানীটাই নিয়ে নেয় এবং কর সংগ্রহ সিস্টেমে আমূল পরিবর্তন আনে। তখন বর্ধমানের জমিদারি তারা বিক্রি করে দেয় আমাদের এক পূর্বপুরুষের কাছে।
কার্তিক় সংক্রান্তিতে হত পুণ্যাহ, অর্থাৎ ঐ দিন জমিদাররা তাদের প্রধান প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত, আবার ঐদিনই হয় কার্তিক পুজো। প্রধান প্রজা! লর্ড কর্নওয়ালিস যে জমিদারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপ্রথা চালু করে ছিলেন তাতে কিছু বড় জমিদার সরকারকে সরাসরি খাজনা দিত। সেই জমিদাররা আবার তাদের খাজনা আদায় করত কিছু ইজারাদারের মাধ্যমে যাদের বলা হত পত্তনিদার, দর পত্তনিদার ইত্যাদি। এরাই হল প্রধান প্রজা।
সানসেট ল অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে জমিদারদের সরকারকে খাজনা জমা দিতে হত। খাজনা না দিতে পারলে জমিদারীটাই নিলাম হয়ে যেত। পত্তনিদারদের ওপরও প্রায় একই রকম নিয়ম লাগু ছিল। অর্থাৎ পূণ্যাহের দিন যে পত্তনিদার খাজনা মেটাতে পারবে না তার পত্তনি চলে যাবে। বাধ্য হয়ে পত্তনিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে জোর করে খাজনা আদায় করত। বাংলা গল্পে উপন্যাসে যে সমস্ত অত্যাচারী জমিদার দেখা যায় তাদের অধিকাংশই এই পত্তনিদার বা গ্রামীণ জমিদার শ্রেণীর বলেই মনে হয়।
অতএব পূণ্যাহের দিন সূর্যাস্তের আগে খাজনা জমা দিয়ে চাপ মুক্ত হয়ে তারা রাত্রে যোগ দিত জমিদার বাবুদের কার্তিক পুজোতে। অনেক রাত পর্যন্ত চলত সেই পুজো এবং অবশ্যই সেইসঙ্গে নানারকম বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকত।
এই হল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলায় কার্তিক পুজোর সাধারণ ইতিবৃত্তান্ত। যদিও স্থান ও জমিদারের ইচ্ছা বা প্রথা অনুযায়ী ব্যাতিক্রমও ছিল। পরবর্তী কালে সানসেট আইন উঠে যায় কিন্ত ব্যবস্থার সুবিধার জন্য পুণ্যাহ ও কার্তিক পুজো চলতেই থাকে।
কিন্তু কেন কার্তিক পুজো! প্রথমেই বলি, আমাদের এই কার্তিক কিন্তু বাবু কার্তিক নয় যা কলকাতার বাবু সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত বাবুরা বা একটি বিশেষ মহলার নগর কামিনীরা সেকালে বেশ ধুমধাম করে পালন করতো। পুজোর নামে মদ মাংস মেয়েমানুষের ফোয়ারা ছুটতো। এই অসংবৃত পুজোতে ভক্তি ছিল না, ছিল লাগামহীন ফুর্তি। বাবুদের এইসব বেলেল্লাপনা থেকেই হয়ত কি রকম করে যেন বাংলায় কার্তিক তার যোদ্ধা রূপ হারিয়ে ফুলবাবুতে রূপান্তরিত হয়ে যান। এখন কোন রোমিও টাইপের বেশী সাজগোজ করা ছেলে দেখলেই লোকে তাকে দেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, ‘দেখেছ, ছোকরা যেন কার্তিক ঠাকুরটি।’ নববিবাহিতদের দুয়ারে যে কার্তিক ফেলা হয় তাও মোটামুটি এই ধরণেরই।
আমাদের বাড়ির পূজিত কার্তিক কিন্তু মোটেই তেমন বাবু মার্কা নন, তিনি যুদ্ধরত, মহা পরাক্রমী তারকাসুর সংহারী দেবতাদের সেনাপতি কার্তিকেয় যাঁকে এখানে লড়িয়ে কার্তিকও বলা হয়। জমিদারদের জীবন মোটেই সহজ সরল ছিল না, তাঁদেরকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হত যারা সর্বদাই অন্যের ক্ষতি করে নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা করতো। সুতরাং লড়াই ছিল তাঁদের জীবনের এক অতি আবশ্যিক অঙ্গ, তাঁদের আরাধ্য দেবতাও তাই ছিলেন অসুরবিজয়ী, অশুভনাশক দেবসেনাপতি কার্তিকেয়, যিনি উত্তর ভারতে স্কন্দ বা কুমার ও দক্ষিণে মুরুগান বা সুব্রমণীয়াম নামেও পরিচিত।
আমাদের বাড়ীর দেউড়িতে কার্তিকের মেড় সারা বছরই পড়ে থাকতো। কালীপুজোর পরে তাতে খড়কঞ্চি দিয়ে মাটি লেপে ঠাকুর তৈরি শুরু হত। ঠাকুর গড়তে আসতেন চান্নাগ্রামের হরিশঙ্কর দে মশায়। সেই মূর্তি আর মেড়ের ওপরের চালচিত্র ঠিক পুজোর আগের রাত্রে শেষ হত এবং মেড়কে নিয়ে যাওয়া হত কার্তিক চালায়। আনুমানিক চল্লিশ ফুট বাই তিরিশ ফুট চালাতে কার্তিকের মেড়কে নিয়ে যাবার পর সকালে তাতে ডাকের সাজ পরাতে আসতো ঘোষদা। কার্তিকচালার মেঝেতে গালচে পাতা হত। একটা ঢোল আর কাঁসি সকাল থেকেই ডুগডুগ করে মাঝেমাঝেই বাজতো। দিদিমণির কাছে শুনেছিলাম জমিদারির সময় নাকি চল্লিশটা ঢাক বাজত। আমরা অবশ্য কখনও তা দেখার সুযোগ পাইনি।
আমাদের বাগানে ভিয়েন বসতো। কার্তিকের বাসনের ভাঁড়ার থেকে শ’খানেক (কি আরও বেশী) পিতলের পাতলা বড় থালা আর গেলাস বের হত। সেগুলোকে তেঁতুল দিয়ে মেজেঘষে পরিস্কার করা একটা বিশেষ বড় কাজ ছিল। রাত্রিবেলায় খাওয়ানো হবে যারা পুজো দেখতে আসবে তাঁদের সকলকেই। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম যেমন করে হোক এবার রাত্রে জেগে থাকতেই হবে, ভোজ কিছুতেই ছাড়া চলবে না।
সন্ধ্যেবেলা থেকেই একে একে অতিথি অভ্যাগতরা আসতেন। নামীদামীরা এসে গালিচায় দাদুর পাশে বসতেন। আমরা তখন তাঁদের ওপর গোলাপজল ছেটাতাম। আতরদানীতে আতর থাকত। তারপর একটু রাত করে পুজো শুরু হত। দুই ভট্টাচার্য মশায় রামরঞ্জন স্মৃতিতীর্থ ও এককড়ি বেদান্ততীর্থ(?) ছিলেন আমাদের কুলপুরোহিত, তাঁরাই পুজো করতেন। অনেকক্ষণ ধরে সেই পুজো চলতো। ‘লং নম, ঢং নম’ ইত্যাদি কি সব দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণের মাঝে আমরা ছোটরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম, সেই রাতের ভোজ আর খাওয়াই হত না। পরদিন সকালে বড়দের কাছে শুনতাম, ‘লুচিটা রবারের মত হয়েছিল, টানলে বেড়ে যাচ্ছিল, ঠিকমত ময়েম দেয়নি’, বা ‘ফুলকপিটাতে ঝোল বেশী হয়েছিল’ ইত্যাদি ইত্যাদি, আর আমাদের আফসোস হত কেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? আর কি দারুণ সব জিনিস মিস করলাম।
সেদিন ঘুম থেকে উঠেই মন খারাপ, কার্তিক আজ চলে যাবে। কার্তিকেরও কি মন খারাপ করছে না? দাদা বললো, ‘দেখ কার্তিক ঠাকুর কাঁদছে।’ কাছে গিয়ে দেখলাম, তাইতো, ঠাকুরের চোখে যেন জল। আমাদেরও চোখে জল এসে গেল। অনেক পরে জেনেছিলাম ওটা কোপাল বার্নিশের ক্রিয়া কলাপ। হরিশঙ্করবাবু সকালে আসতেন প্রসাদ খেতে, তখন একটু কোপাল বার্নিশ লাগিয়ে দিতেন কার্তিকের চোখে।
সন্ধ্যে হতে হতেই চলে আসত দুটো হ্যাজাক। সে গুলিকে পাম্পটাম্প করে জ্বালানো হত। একটু পরে আসত সাউদের লরী। তাতে মেড় সমেত কার্তিককে তোলা হত। দুধারে দুটো হ্যাজাক রাখা হত যাতে কার্তিককে লোকেরা দেখতে পায়। একান্নবর্তী পরিবার, আমাদের অনেক বড় বড় দাদা কাকারা ছিল। আমরা ছোটরাও তাঁদের সঙ্গে লরীতে উঠতাম। তিনবার আগুপিছু করে লরী রওয়ানা দিত। আমরা ছোটরা চিৎকার করতাম, ‘কার্তিক মাই কী জয়।’ অনেক পরে বুঝেছিলাম যে ওটা কার্তিক মা নয়, বাবা হবে।
গাড়ী মৃদুমন্দ লয়ে শহরের মধ্যে দিয়ে চলে এক সময় কেষ্ট সায়রের পশ্চিম পাড়ে বড় ঘাটের কাছে এসে দাঁড়াত। তখনও বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি, চারদিক জনমানবহীন, ঘন অন্ধকার, কেবল হ্যাজাকের আলোয় ঘাটটাতে আলো হয়ে আছে।
এবার বিসর্জনের পালা। কোন এক বড় দাদা বা কাকা তুলে নিত কার্তিককে। তার চেয়ে ছোট দুজন নিত দুই সখাকে। আমাদের ভাগে পড়ত সখাদের হাতের লাঠি। সবকিছু বিসর্জন হয়ে গেলে লরীতে চেপেই আমরা আবার ঘরে ফিরে আসতাম। ভয়ানক মন খারাপ করতো, কিছুই ভাল লাগত না বেশ কয়েকদিন ।
আমাদের সেই জমিদারী কবেই অতীত হয়ে গেছে , নেই সেসব ঠাটবাটও। কালের নিয়মে সেই একান্নবর্তী পরিবারও ভেঙ্গে নিউক্লিয়ার হয়ে গেছে। এখন এক একজনের পুজোর পালা আসে বেশ কয়েক বছর পর পর।
এখন আর সেই কার্তিক চালাও নেই, নেই বত্রিশটা পরাতে ভোগ নিবেদন। নিজেদের ঘরে যে যেমন করে পারে তার পালিতে পুজো করে। কেউ বসিয়ে লোক খাওয়ায়, কেউ বা খাওযায় না, স্রেফ খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়, কোন রকমে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। এরপরে ধীরেধীরে একদিন তাও বন্ধ হয়ে যাবে।
** ছবিটি ২০০০ সালের পুজোর।
Add comment