সাহিত্যিকা

অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে একটি সন্ধে

অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে একটি সন্ধে
গণেশ ঢোল, ১৯৮৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং

দাঁড়িয়ে ছিলাম রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। সন্ধে নামছে। খুব গরম। অপেক্ষা করছি বাসের জন্যে। যাব শ্যামবাজার, ওখান থেকে মেট্রো ধরব। একটা মিটিং ছিল, তাই ইতিমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বেশ গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, পঁচিশটা টাকা ছাড়ুন তো।

আমি অবাক হয়ে দেখি একজন প্রায় ছ’ ফুটের ওপর লম্বা লোক, ঈষৎ কুঁজো, প্যান্টের তলাটা গোটানো, গায়ে জিনসের জামা, মাথায় গরমের মধ্যেও লাল পুলিশ টুপি, বড় বড় কাঁচা-পাকা দাড়ি নেমে এসেছে বুক অবধি এবং কাঁধে বেশ বড় একটা কাপড়ের ঝোলা। পায়ে দামি নতুন রীবকের বেল্ট দেওয়া স্লীপার যা ওঁর পোশাক এবং ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। আমি অবাক হয়ে বলি, হঠাৎ আপনাকে পঁচিশ টাকা দিতে যাব কেন?
– তা তো ঠিক আমায় দেবেন কেন? এদিকে আইনক্সে দল বেঁধে সিনেমা দেখার সময় যখন গান্ধীমার্কা পাঁচশোর বড় বড় পাত্তি বেরিয়ে যায় তখন তো কোনো হুঁশই থাকে না। যত কঞ্জশি শ্লা আমার বেলায়! এক প্লেট চাউমিন খাব ভেবেছিলাম তার উপায় নেই।
বুঝতে পারি লোকটার মধ্যে কিছু গোলমাল আছে। তাই মজা পেয়ে জিজ্ঞেস করি, আপনার নাম কী, আর করেনই বা কী আপনি?
– বলব কেন? পঁচিশটা টাকা বার করতে তো হালুয়া ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে একসঙ্গে দু’টো প্রশ্ন। যেন শ্লা বাই ওয়ান গেট ওয়ান। মুফতে আমি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিই আর কী! তিরিশ টাকা দিন, তারপর দেখি কী করা যায়।
– এই তো পঁচিশ টাকা বললেন, আবার তিরিশ চাইছেন কেন?
– যখন পঁচিশ চেয়েছিলাম তখন ছিল ছ’টা পঁয়তাল্লিশ, এখন ছ’টা ঊনপঞ্চাশ। যত দেরি করবেন তত রেট বেড়ে যাবে। কেননা এখন আমার চিকেন চাউমিনের পরে একটা খুঁড়ির চা এবং তারপরে ক্লাসিক মাইল্ড সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।
– বাঃ, বেশ রাজকীয় ইচ্ছে তো আপনার।
– হুঁ হুঁ বাবা, মেজাজটাই তো আসল রাজা আমি রাজা নয়। উত্তমকুমারই বলে গেছেন, এরপরে কোনো কথা হবে না। তাছাড়া আমার বাবাও বলতেন, লীভ লাইক আ লর্ড। শ্লা হস্টেলে যখন অন্য ছেলেরা বাড়ি থেকে প্রতি মাসে কেঁদে-ককিয়ে দু’শো তিনশো টাকা আনত, তখন আমার বাবা আমায় মাসে পাঁচশো করে টাকা দিতেন, শেষ হয়ে গেলে আরও। অথচ বাবা তখন রিটায়ার্ড, ছোড়দি-মেজদির বিয়ে হয়নি, পাগল মা। শেষের দিকে বাবা টিউশনি ধরেছিলেন। বড়লোকের বখা ছেলে-মেয়েদের ইংরিজি শেখাতেন। আরে তখন থেকে আমার মাথা বকিয়ে যাচ্ছেন, পঞ্চাশটা টাকা ছাড়ুন।
– আবার পঞ্চাশ?
– অত সস্তায় দাঁও মারলে চলে? আমার ইন্টারভিউ নেবেন অথচ তার ফী দেবেন না, তা কী হয়?
– ইন্টারভিউ?
– ইন্টারভিউ নয়? তখন থেকে মজার মজার কথা বলে আপনাকে এন্টারটেন করে যাচ্ছি সবই কি জল-হাওয়ার মতো ফ্রী? এখন তো জলও কিনে খেতে হয়। ঐ যে পঞ্চাশ টাকা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন না, আসলে আমি এক বোতল মিনারেল ওয়াটারের দামও ওর সঙ্গে অ্যাড করে দিয়েছি।
– আপনি মিনারেল ওয়াটার খান?
– না খেলে বাইসেপিটাল টেন্ডেনাইটিস হয়ে যাবে না?
– সেটা আবার কী বস্তু?
– আপনার মশাই জেনারেল নলেজের খুব খারাপ অবস্থা।
– মনে করুন আপনি ঘর থেকে অ্যাকোয়াগার্ডের জল নিয়ে বেরোলেন না। রাস্তায় তেষ্টা পেল। এখন পেটখারাপ বা জন্ডিসের ভয়ে টালার ট্যাঙ্কের জল খাবেন না। এদিকে জল কিনে খেতেও মন সায় দিচ্ছে না। আপনাদের তো পেছন দিয়ে হাতি গলে যায় অথচ সামনে দিয়ে ছুঁচও গলতে দেবেন না। ডাক্তারের পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে পারেন. কিন্তু সামান্য বারো-পনেরো টাকা দিয়ে এক বোতল জল কিনতে বুক ফেটে যায়। তখন কী করবেন? না সারাটা দিন জল না খেয়েই কাটিয়ে দেবেন। ফলে ডিহাইড্রেশন। শরীরের মাসল, টেন্ডন সব শুকিয়ে কাঠ। এদিকে পিঠে ভারী ব্যাগ, ছ’ কেজির ল্যাপটপ। ব্যস টেন্ডনে টান ধরে টেন্ডিনাইটিস। কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা। হাত নাড়াতে চাড়াতে গেলে লাগে। যান এখন অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে। তিনি প্রথমদিন পেন কীলার ট্যাবলেট দিয়ে আপনাকে কাঁধের এক্সরে করে আনতে বলবেন। এক্সরেতে কিছুই পাওয়া যাবে না। তখন তিনি টিপে-টাপে কাঁধের একটা জায়গায় এমনভাবে টিপে ধরবেন যে আপনি যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠবেন। ডাক্তারের মুখে হাসি ফুটে উঠবে। তাঁর ডায়াগনোসিস হয়ে গেছে। তিনি তখন আপনাকে পাঠাবেন তাঁরই নার্সিংহোমের নীচের ওষুধের দোকান থেকে ইঞ্জেকশন কিনে আনতে। আপনি তো এখনকার দিনের শিক্ষিত লোক, ঘরে মেডিক্যাল ডিক্সনারি আছে, ড্রাগ টুডে বলে যে জার্নালটা বেরোয় তার পাতা উল্টে দেখার অভ্যাস এবং সর্বোপরী ইন্টারনেটে গুগলবাবার শরণ নেওয়ার অভ্যেস আছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করবেন, এই ট্রাইকর্ট-৪০ ওষুধটা স্টেরয়েড নয় তো? ডাক্তার খুব স্মার্টলি ইংরিজিতে বলবেন, ইট ইজ স্টেরয়েড। বাট ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু বি ওয়ারিড অ্যাবাউট ইট। আবার বাংলায় ফিরে এসে বলবেন, এই ইঞ্জেকশন. ওয়েট লিফটার, স্পোর্টসম্যানেরা মুড়ি মুড়কির মতো নেয়। শচিন কত নিয়েছে যখন ওর টেনিস এলবো হয়েছিল। এসব শুনে আপনার বেশ গর্ববোধ হবে। আপনি কিনে আনবেন। ডাক্তার নিজে গরুকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো অ্যাত্ত বড় একটা সিরিঞ্জ বার করবেন। কম্পাউন্ডার এসে স্পিরিট-ফিরিট কীসব লিক্যুইড লাগিয়ে দেবে। তারপর ডাক্তার হাসতে হাসতে গ্যাঁক করে ছুরি মারার মতো ঢুকিয়ে দেবেন সেই সিরিঞ্জ। আপনি মুখ বুজে সব সহ্য করবেন। ডাক্তার সেদিনের ফী ইঞ্জেকশন চার্জসহ পাঁচশো টাকার বিল ধরিয়ে দেবেন। তারপর তাঁরই চেনাশোনা এক ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে রেফার করে দেবেন। এখন রোজ সেই সেন্টারে যাও। সুইস বল, ডান্ডা, রাবার ব্যান্ড দিয়ে এক্সসারসাইজ করো। হিটপ্যাড দিয়ে জায়গাটা সেঁকো, কাঁধে কারেন্টের স্পার্ক নাও, ম্যাসাজ করাও। এমনি চলবে পনেরো দিন। ততদিনে আপনার হাজার হাজার টাকা ড্রেন হয়ে গেছে। সামান্য এক বোতল জল কিনে না খাওয়ার জন্য কী থেকে কী হয়ে গেল দেখলেন তো। কিন্তু এখন আর মাত্র পঞ্চাশ টাকায় হবে না। এখন থেকে ট্যাক্সি করে চলুন পার্ক স্ট্রীটের কোনো বারে। সেখানে আমি এক বোতল চিল্ড বীয়ার খাব। আপনি যদি ড্রিংক করেন তো ভালোই নইলে কোল্ড ড্রিংকের বোতল নিয়ে বসবেন। আমার জন্যে যে বাইটস্ নেবেন তার থেকেও একটু খাবেন। আমার আবার চিকেন পাকোড়ার সঙ্গে বীয়ার খেতে খুব ভালো লাগবে। চলুন, চলুন আর দেরি করবেন না। ওখান থেকে আমায় হাওড়া স্টেশন যেতে হবে। সেখান থেকে আমেদাবাদ এক্সপ্রেস ধরে সোজা চলে যাব খড়্গপুর। আপনি কিন্তু যাওয়ার আগে আমায় হাওড়া যাওয়ার ট্যাক্সি ভাড়া এবং ট্রেনের টিকিটের টাকা দিয়ে যাবেন। সেই কোন সকালে খড়্গপুর থেকে বেরিয়েছিলাম ছ’টা গান্ধীমার্কা হলুদ পাত্তি নিয়ে, এখন সব ফক্কা। বই, সিডি , সেলের জুতো কিনে, আর রেস্টুরেন্টে খেয়ে এখন আর আমার কাছে কিচ্ছু নেই। মাইরি বলছি, বিশ্বাস না হয় পকেট সার্চ করে দেখতে পারেন।

ততক্ষণে আমার ভয় লাগতে শুরু করে দিয়েছে। এ তো সাঙ্ঘাতিক লোক, চিকেন চাউমিন থেকে যেভাবে বারে পৌঁছে যাচ্ছে, এর শেষ কোথায় কে জানে! তাই কথা ঘোরাবার জন্য বলি, আপনার নামটা কিন্তু এখনও বলেননি।
– তার আগে নিজের নাম বলুন। আপনার মশাই কোনো সহবত্‍ শিক্ষা নেই। প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে অন্যের নাম জিজ্ঞেস করতে হয়। হিন্দি সিনেমায় দেখেন না, নায়ক পার্টিতে গিয়ে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, আই অ্যাম রাহুল, রাহুল খান্না। মেয়েটিও মিষ্টি হেসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আই অ্যাম প্রিয়া। ব্যস, তারপর শুরু হয়ে যায় দু’-আড়াই ঘন্টার ক্যালাকেলি, ঢলাঢলি, গলাগলি, গান-নাচ, চোখের জল, ডায়ালগ, কাউন্টার ডায়ালগ। নায়ক বলবে, ম্যায় তুমকো ধুল চাটা দুঙ্গা। তো ভিলেন বলবে, ম্যায় তুমহারা খুন পী যাউঙ্গা। যাই হোক, অনেক হল, এবার আপনার নামটা প্রথমে বলুন। আমার নামটা শুনলে আপনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন, তাই পরে বলছি।
– আমার নাম মহম্মদ জামালউদ্দিন।
– অ্যাঁ! আপনি মুসলিম? দেখে তো পাঁচপেঁচি বাঙালির মতোই মনে হয়।
একটু গম্ভীর হয়ে বলি, আমিও বাঙালি। আপনি ভাষার সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেছেন।
– এইতো আপারহ্যান্ড নিয়ে নিলেন। এতক্ষণ ডিফেন্সের প্লেয়ার ছিলেন, সুযোগ পেয়েই অ্যাটাকে চলে এলেন। আসলে, বাঙালি মুসলমানদের নাম ঠিক আপনার নামের মতো বলদর্পী হয় না। তাদের নাম হয় এরকম — ইমানুল, সিরাজুল, হাফিজুর, কবিরুল, বেলাল, আতাউর ইত্যাদি। আপনার নামটা শুনেই কীরকম যোশ এসে যায়। মনে হয় ঘোড়ায় চড়ে তাতার সৈন্য নিয়ে চলে যাই কুঁচলি পরগণা লুঠতে। তা আপনি কী করেন? এই প্রশ্নের উত্তর শুনেই আমি নিজের নাম বলব।
– আমি রবীন্দ্রভারতীতে বাংলা পড়াই।
– অ্যাঁ! প্রফেসর! তাও আবার বাংলার! বাংলা আবার পড়াতে হয় নাকি? বাংলা তো এমনিই সবাই জানে। বাংলায় এম এ তো মেয়েরা পড়ে। বিয়ে হওয়ার কোয়ালিফিকেশন। আপনার ক্লাসে কোনো মেল স্টুডেন্ট আছে? নাকি সবই ফিমেল? বেড়ে আছেন মাইরি! একেবারে চাপকি, চটকে চল্লিশ। ঘরে বউকে বোরখা পরিয়ে রেখে সারাদিন ধরে অল্পবয়সি মেয়েদের সঙ্গে এফএসটি, এনএসটি; মানে ওই ফস্টিনস্টি।

এবার আমার বিরক্ত লাগে। অথচ লোকটার কথার মধ্যে একটা যাদু আছে। ঠিক রাগ করা যায় না। তাই গম্ভীর হয়ে বলি, আমার স্ত্রী বোরখা পরেন না। তিনিও একটি কলেজে বাংলা পড়ান।
– বাঃ ঠিক ধরেছি, নিশ্চয়ই ক্লাসমেট। কিংবা এক-দু ইয়ার জুনিয়র, আপনি কলেজে ইউনিয়ন করতেন, সাম্যবাদের বুলি আওড়াতেন। সেখান থেকেই ওই ইন্টুমিন্টু। সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে। কলেজ ক্যান্টিন, কফি হাউস, ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, দু’-চার বছর বেকার অবস্থা। এম ফিল, পি এইচ ডি; তারপর বিয়ে। তবে বৌদি নিশ্চয়ই মুসলিম নন। বিয়ের সময়ও নিশ্চয়ই বৌদির বাপের বাড়ি থেকে ঝামেলা হয়েছিল।

আমি অবাক হয়ে যাই লোকটির অনুমানশক্তি দেখে। সত্যিই আমি ছাত্র রাজনীতি করতাম। রুচিরাও আমার থেকে দু’ বছরের জুনিয়র। ওর বাবা ছিলেন জাঁদরেল নেতা। অবশ্য ছিলেন বলছি কেন, এখনও আছেন। পাশ করার পর দু’বছর পার্টির মুখপত্র জনশক্তিতে রিপোর্টারের চাকরিও করেছি ওঁর সুপারিশে। তখন উনি আমাকে পছন্দই করতেন। কিন্তু বিয়ের কথাতেই একেবারে বেঁকে বসলেন, আমার চাকরিটাও গেল। তারপর ওঁর থেকেও বড় নেতাদের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চাকরি। পরে রুচিরাও স্লেট কোয়ালিফাই করে যোগমায়া কলেজে চাকরি পায়। তখনই বিয়ে করি আমরা। এখনও শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্য রুচিরার সঙ্গে ফোনে ওঁদের মাঝে মাঝে কথা হয়।
আমি বলি, হ্যাঁ একেবারে ঠিক বলেছেন। এবার আপনার নামটা বলুন।
– বলব? তাহলে বলেই দিই, আমার নাম হল গিয়ে অমিতাভ বচ্চন।
– কী ফালতু বকছেন? ঠিক আছে, আপনার নাম জানার আমার দরকার নেই।
– বলেছিলাম না, আমার নাম শুনলেই আপনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। তাই এতক্ষণ বলিনি। তবে চিরদিন এই নাম আমার ছিল না। আগে আমার নাম ছিল অমিতাভ বর্মন। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এফিডেভিট করে পাল্টে নিয়েছি এই নাম।
– পাল্টালেন কেন পিতৃদত্ত নাম?
– দূর মশাই পিতৃদত্ত! মাতৃদত্ত পাগলামির বীজ যে মাথায় নিয়ে ঘুরছি সবসময়, তার বেলা?
– তা কী করেন আপনি?
– আমি পিপিএস
– মানে?
– পার্সোনাল প্রব্লেম সলভার।
– সেটা কীরকম?
– সেটা এরকম — ধরুন আমি আপনার শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে সিক্স ফিগারের একটা ডীল করেছি। আপনাকে সরিয়ে দেবার কন্ট্রাক্ট, উহুঁ নড়বেন না। একটা আওয়াওজও বার করবেন না মুখ দিয়ে। ঝোলার মধ্যে আমার হাতে ধরা আছে কোল্ট পকেট পিস্তলের ট্রিগার। একবার চাপ দিলেই ব্যস। এখন এই জায়গাটা ফাঁকা এবং অন্ধকার। ওই দেখুন একটু দূরে হেলমেট পরে একটা ছেলে মোটর সাইকেলের ওপর বসে আছে। আমি ট্রিগারটা টিপে আপনার পড়ে যাওয়াটা দেখেই ছুটে গিয়ে উঠে পড়ব ওর পেছনে। ভাবছেন, আমি সত্যি বলছি কি না? নাকি পাগলামি করছি? আমি কিন্তু একটুও বাজে বকছি না। গত সাতদিন ধরে ফলো করে আপনার সমস্ত গতিবিধি আমার নখদর্পণে। আজ বাগে পেয়েছি, আর ছাড়ব না। দুম- ফট ব্যস। আগামীকাল পেপারে বেরোবে, জনৈক আততায়ীর গুলিতে প্রফেসরের মৃত্যু, কারণ অজ্ঞাত। আপনার স্ত্রী কদিন খুব কাঁদবেন, তারপর ফিরে যাবেন আবার বাপের বাড়িতে। যেহেতু আপনাদের কোনো ইস্যু নেই। তাই দু’-এক বছরের মধ্যে ওঁর আবার বিয়ে হতেও কোনো অসুবিধে হবে না। তবে এবার বিয়ে হবে আপনার শ্বশুরমশায়ের পছন্দসই হিন্দু পাত্রের সঙ্গে।

আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। বলে কী লোকটা! ঠিক তখনই একটা বাস আসে। আমি যা হবে কপালে ভেবে পড়ি কী মরি করে লাফিয়ে উঠে পড়ি সেটায়। একেবারে সেঁধিয়ে যাই ভিড়ের মধ্যে। একে গরম তায় টেনশন। সারা গা, জামা, প্যান্ট-গেঞ্জি ঘামে সপসপে ভিজে। খুব অবসন্ন লাগে। বাস চলতে থাকে, আমার শরীর এলিয়ে পড়তে চায়। কোনোরকমে ঠিক রাখি নিজেকে। ধর্মতলার মোড়ে নেমে যাই। হাঁটতে হাঁটতে মেট্রোর কাছটায় চলে আসি। এখন ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। কোনো চিন্তা মাথায় আসে না। ভেতরটা কীরকম ফাঁকা ফাঁকা লাগে। হাঁটছি অথচ পা দু’টো যেন ঠিক আমার বশে নেই। ক্যাথেতে ঢুকে পড়ি। এখানে কলেজ- ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় দু’-একবার এসেছিলাম। আবছা অন্ধকার, কোণের দিকের একটা টেবিলে গিয়ে বসি। বিয়ার আর কাজুবাদামের অর্ডার দিই। হঠাৎ দেখি আমার টেবিলের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সেই অমিতাভ বচ্চন।
একগাল হেসে বলে, কী জামালভাই একা একাই বিয়ার খাবেন, আর আমি আমড়ার আঁটি চুষব? আমার জন্যেও একটা হেওয়ার্ডস ফাইভ থাউজেন্ডের অর্ডার দিন। কেমন দিলাম বলুন তো! সাধে কি আর নিজের নাম অমিতাভ বচ্চন রেখেছি! আসলে ওটা ছিল নিজের কাছেই একটা পরীক্ষা।
আমাদের থেকে একটু দূরে একটা ছেলে বাইকে স্টার্ট দিয়ে না দাঁড়ালে আইডিয়াটা মাথায় আসত না। তাছাড়া ব্যাক অফ দ্য মাইন্ডে রিজওয়ানুরের ঘটনাটাও ছিল। আজকাল চারিদিকে যা হচ্ছে, কখন যে দুইয়ে দুইয়ে চার আর চারে চুয়াল্লিশ হয়ে যায় কে বলতে পারে? তবে আপনি মশাই দেখালেন বটে। আপনি যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলেন সেখানে আপনার মুখের ওপর একটা আবছা আলো পড়ছিল। আমি স্পষ্ট দেখলাম আপনার নাকের ডগাটা মাইরি মেয়েদের মতো ঘেমে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে গেল। কলজের এই জোর নিয়ে আপনারা রাজনীতি করেন। আমি তো ওই বাসেরই পেছন দরজা দিয়ে উঠে কিছুটা দূর থেকে আপনাকে ফলো করতে করতে এখানে এসে পৌঁছেছি। নিন, আমার জন্যে বিয়ার ছাড়াও এক প্লেট চিকেন চাউমিনের অর্ডার দিন। সারা জীবন নিশ্চয়ই মনে রাখবেন আজকের সন্ধেটার কথা। আজ রাতে বাড়ি ফিরেই আশা করি ডায়েরি লিখতে বসবেন। ‘অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে একটি সন্ধে’ । হাঃ, হাঃ, হাঃ …

 

Sahityika Admin

Add comment