স্মৃতির পাতা, ১৯৬৫-৭০ ওভাল
প্রদীপ (পপ) দাস, ১৯৭০, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমার কলেজের প্রাক্তনী ও বয়োকনিষ্ঠ অসীম দেব (১৯৭৭, ইটিসি) অনেকদিন ধরেই আমাকে ধরেছে, বিই কলেজের ১৯৬৫-৭০ সালের ওভাল মাঠের প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দিতে হবে। জীবনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অনেক প্রজেক্ট রিপোর্ট বানিয়েছি, অনেক সরকারি বেসরকারি টেন্ডারে জমা দিয়েছি। ফাইন্যাল ইয়ারেও প্রজেক্ট করেছি। তাই বলে ওভাল মাঠের? অসীম বলে, আরে দাদা কিছু মজার কথা (মানে রসালো ইতিহাস) আর আমার পাঁচ বছরের কলেজ জীবনের স্পোর্টসের অভিজ্ঞতার কথা লিখে দাও।
নাছোরবান্দা ছেলে। আমি আজকাল খেয়ে ঘুমিয়ে আর অন্য কিছু করার সময়ই পাই না। তবু ভাবলাম যে এই স্মৃতির পাতায় আমার জীবনী অন্তত কিছুটা তো থাকবে, ম্যাগাজিনে ছাপাবে। দেশেবিদেশে লোকজন পড়বে। মন্দ কি? পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু তো রেখে যাই। কেউ আমার লেখাপড়া নিয়ে জানতে উৎসাহী নয়। যদি আমার খেলাধূলা নিয়ে কেউ জানতে চায়? আমার লেখাপড়া ব্যাপারটাতেই জন্মগত অনীহা, (যদিও ভগবানের আশীর্বাদে আমার কলেজের পাঁচ বছরের কোর্স ১৯৬৫-৭০ একবারেই পার করেছিলাম)। তাই কলম ধরলাম।
আমি ফার্স্ট ইয়ারে ছিলাম E2 হস্টেলে। তখন কলেজে যে E1, E2 এইদুটো হস্টেল ছিলো, সেটা অনেকেই এখন জানে না। এখনের ১৪, ১৫, ১৬ নম্বর হস্টেলের পিছন দিকে যে স্টাফ কোয়ার্টার আছে, সেগুলিই ছিলো আমাদের E1, আর E2। কলেজের ছাত্রসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, আর হস্টেলে স্থান সংকুলান না হওয়ায় সেগুলিই ছিলো আমাদের হস্টেল। বি.ই কলেজের সবথেকে মজার ব্যাপারটা হলো, প্রথমেই কয়েকমাস নিজেদের মানিয়ে নিতে পারলে তারপর আর কোনো অসুবিধাই নেই। আমাদের হস্টেলে পরের বছর, মানে ১৯৬৬ থেকে performance ভালো হতে শুরু করেছিলো। ১৯৬৬ তে E2 হস্টেলে আমরা বেশ কিছু রিপিটার পেয়েছিলাম, যারা খেলাধূলায় ভালো ছিলো।
আমি থাকতাম E 2 হস্টেলের দোতলায়। রুমমেট ছিলো প্রবীর নন্দী। আমাদের হস্টেলের সামনেই একটা ছোটো নীচু মাঠের মত জমি ছিল। একদিন হঠাৎই E1 বনাম E2 এই দুই হস্টেলের একটা ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হলো। জার্সি “go as you like”, খেলার থেকে উন্মাদনাই অধিক। অনেকেই পায়জামা ফুলপ্যান্ট গুটিয়ে মাঠে নেমে গেলো। আমরা সামান্য কয়েকজনই হাফ প্যান্ট পরে খেলেছিলাম। দারুণ হৈচৈ ব্যাপার, ঐ যে বলেছি, উন্মাদনাই অধিক। তবে হোস্টেলে ফিরে যে বিপদে পড়বো, সেটা ছিলো চিন্তার বাইরে। মাঠ থেকে হস্টেলে ফিরে ঘরে ঢুকতে গিয়েই প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এলাম। ঘরে জনৈক প্রবীণ ভদ্রলোক ও মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। ওঁনারা দুজনেই প্রবীরের গেস্ট। আমার পরণে ছিল একটা heritage half pant ও উর্ধাঙ্গে কলকাতার পাতি এক P3 র স্যান্ডো গেঞ্জি। তার সাথে আমার vital statistics তখন মারমার কাটকাট। উচ্চতায় ৫ ফুট ২ ইঞ্চি, ওজনে ৪৯ কিলো, কোমর ৩২ ইঞ্চি আর গাঁয়ের রং আগমার্কা। স্বাভাবিকভাবেই ময়ুরমার্কা চেহারা আর পোষাকে সেথায় উদয় হওয়াতে প্রবীর রীতিমত অপ্রস্তুত। ব্যারাকের বরেনদাকে বললাম শার্টপ্যান্ট নিয়ে আসতে। সাজগোজ সেরে ভদ্রলোক হয়ে ঘরে ঢুকে আমি থমকে গেছি। আমার সামনেই শ্রী তেজেশ সোম। ময়দানের পরিচিত নাম বাঘা সোম। ভারতীয় ফুটবল জগতের এক প্রবাদপ্রতীম মানুষ। বুটজোড়া তুলে রাখলেও ময়দান ছাড়েন নি, উনি তখন ময়দানে ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল টিম উয়াড়ির কোচ, অনেক ভালো ভালো প্লেয়ার উনার হাতে তৈরি। আমাদের সাথে উনি অনেক গল্প করলেন। আমার আদি দেশ ঢাকা শুনে বেশ খুশি হলেন। আর কথা প্রসঙ্গে বললেন যে মাঠে এগিয়ে খেললে পিছনেও খেয়াল রাখতে হয়। জায়গা ফাঁকা রাখতে নেই। সেই আমার এক বিরাট বোধোদয়। বুঝলাম উনি মন দিয়ে আমাদের খেলাটা দেখছিলেন। সেই বাঘা সোম ছিলেন প্রবীরের দাদু। প্রবীরের বাবা অজিত নন্দী, আর দুই-কাকা নিখিল নন্দী, সুনীল নন্দী দুজনেই ফুটবল অলিম্পিয়ান ছিলেন। প্রবীর নিজেও খেলাধুলায় ভালো ছিলো। প্রবীরের গেস্ট চলে যাওয়ার পর দেখি ঘরের কোনে চারতলা এক বড় টিফিন বাক্স। খোলা হলো সেই টিফিন বাক্স। কি ছিলো না !! লুচি, বেগুনভাজা, মাংস, সন্দেশ, — ওঃ !! সে যেন ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের বুফে ডিনার।
ফার্স্ট ইয়ারের আরেকটি ঘটনা আমার বেশ ভালোভাবেই মনে আছে। আমাদের সিনিয়র ১৯৬৭ ব্যাচের সাথে ফুটবল ম্যাচ। আমরা পেনাল্টিতে ১-০ গোলে হেরে যাই। যতদূর মনে পড়ে নীলাদ্রী’দা (সরকার) সেই পেনাল্টির আবেদন করেছিলো। আর রেফারির সেই পেনাল্টি দেওয়া আমরা মেনে নিতে পারিনি। আমরা যারা সেইদিন মাঠে ছিলাম, আজও মনে করি ঐ বিতর্কিত পেনাল্টি ছিলো অনায্য। বিই কলেজের সেই যুগে আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের প্রতিবাদের বহর দেখে ‘৬৭ ব্যাচের সিনিয়ররাও বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলো আর সেইদিনই বিই কলেজ পেয়েছিলো ওভাল মাঠের একজন স্টার, একজন Sports Icon, নাম শঙ্কর মিত্র, আমাদের ব্যাচমেট, যার নাম এরপরেও বহুদিন লোকের মুখেমুখে ফিরেছে।
সেকেন্ড ইয়ারে আমাদের E1, E2 হস্টেলের অধিকাংশই ১২ নম্বর হস্টেলে এসে উঠলাম। আর এখানেই কলেজের বাস্কেটবল প্লেয়ার রমেশ ডালমিয়ার (আমরা ডাকতাম ডালি নামে) সাথে আমার প্রথম পরিচয় আর পরে সেটাই বন্ধুত্বে পরিণত হলো। আজ এতবছর পরেও সেই বন্ধুত্ব অটুট রয়েছে। এই ডালিই আমাকে ধরেবেঁধে বাস্কেটবল কোর্টে নিয়ে গিয়েছিলো, যা বিই কলেজের পাঁচবছরে আমার অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছিলো, আর আমার স্মৃতিতে আজও অমলিন রয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গে ছোটো করে রমেশ ডালমিয়ার দু’একটা চরিত্রবর্ননা করি। ডালি ছিলো মেধা আর অলসতার এক সংমিশ্রণ। প্রচুর সময় বয়ে যেতো রেডিওতে বিনাকা গীতমালা শুনে। এর সাথে যদি ময়দানে ইস্টবেঙ্গলের ফুটবল খেলা থাকে, তো দুনিয়ার আর বাকী সবকিছুই তুচ্ছ। একবার ময়দানে খেলা দেখতে যাওয়ার সময় ডালহৌসির রাস্তায় দেখে কিছু লোক টিয়াপাখি নিয়ে বসে আছে। কথা প্রসঙ্গে জানলো যে টিয়াপাখি ভবিষ্যাতবাণী করতে পারে। এবার ডালি উৎফুল্ল হয়ে যানতে চাইলো সে ফার্স্ট ক্লাস পাবে কিনা? টিয়াপাখি জানালো, পাবে। ব্যাস……। ডালি হস্টেলে ফিরে জানালো যে ফাইন্যালে সে ফার্স্ট ক্লাস পাবেই, সুতরাং যেটুকু পড়াশোনা ছিলো, তাও কমিয়ে দিলো। তবে, ডালি খুব ভালো high first class মার্কস নিয়েই পাশ করেছিলো।
আমাদের সাথে ফোর্থ ইয়ার মেকানিক্যালের দাদাদের বেশ ভাব ছিলো, বিশেষ করে চন্ডীদা আর কল্যাণ’দা। চণ্ডীদা কলেজ টিমের খুব ভালো ভলিবল প্লেয়ার ছিলো। বলতে গেলে চন্ডী’দার উৎসাহেই আমরা হস্টেলের সামনের কোর্টে ভলিবল প্রাকটিস শুরু করলাম। সেই আমার এবং আমাদের অনেকের প্রথম ভলিবল খেলা। আমাদের মধ্যে শম্ভু মাত্র ৫ ফুট ২ ইঞ্চি হাইট নিয়ে অসম্ভব ভালো ভলিবল খেলতো। পরে কলেজ টিমের রেগুলার প্লেয়ার হয়ে গিয়েছিলো। ভাবলেও অবাক লাগে যে কলেজে ঢোকার সময় আমাদের দুজনেরই উচ্চতা ছিলো সমান। সেই শম্ভু তো কলেজে ঢোকার পরে আর লম্বায় বাড়েনি, কিন্তু আমি যখন কলেজ ছাড়ি আমি প্রায় ছ’ফুট। মানে বিই কলেজের পাঁচ বছরে হস্টেলের সেই ডালরুটি খেয়েই আমি ১০ ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেলাম। স্কুলজীবনে যারা আমায় দেখেনি, তাঁদের কেউ একথা বিশ্বাস করে না।
ভলিবল নিয়ে শুরু করি। একজনের কথা বলতেই হবে। আমাদের ব্যাচের শঙ্কর মিত্র। আমার যেমন ফার্স্ট ইয়ারে উচ্চতায় পাঁচ দুই, শঙ্কর আমার থেকে মাত্র তিন ইঞ্চি লম্বা, পাঁচ পাঁচ। আর সেই পাঁচ পাঁচ নিয়েই সে স্ম্যাশ করতো। শঙ্কর বেঙ্গল স্কুল আর কলেজের ভলিবল টিমের নিয়মিত প্লেয়ার ছিলো। শম্ভু নেটে বল লিফট করতো আর ফিনিশিং এ থাকতো শঙ্কর। তখন আমাদের ইয়ারের ভলিবল টিমটাও খুব ভালো ছিলো – শঙ্কর মিত্র, শম্ভুনাথ ব্যানার্জী, সুদীপ রয় (ক্যাপ্টেন), অমিতাভ মুখার্জী, প্রদীপ সেন, দেবকুমার রায়, অমিয় সেন, আর ছিলো লগা যার ভালো নাম ও ছাড়া আর অন্য কেউ জানে না। আমরা থার্ড ইয়ার থেকে ফিফথ ইয়ার টানা তিনবছর (‘৬৮-‘৭০) চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। এদের মধ্যে সুদীপ আর অমিতাভ ছিলো লম্বা। তাই ওরাও রোটেশন সিস্টেমে স্ম্যাশ করতো। আশ্চর্যের বিষয় ছিলো বেঁটেখাটো চেহারার শঙ্কর তিন চার ফুট স্পট জাম্প করতো। আমরা নিজের চোখে দেখেছি, নইলে আমরাও হয়তো বিশ্বাস করতাম না।
আমাদের শঙ্কর মিত্র ছিলো ‘৬৭ ব্যাচের নীলাদ্রী’দার (সরকার) যোগ্য উত্তরসূরি। সে ফুটবল আর ভলিবলে কলেজের ক্যাপ্টেন, আর ক্রিকেটে কলেজ টিমের প্লেয়ার। এর বাইরে ইয়ার টিমের বাস্কেটবল আর হকি টিমের মেম্বার। এককথায় পাঁচ পাঁচটি স্পোর্টস ইভেন্টে শংকরকে মাঠে দেখা যেতো। আমাদের পরে ৭৩ ব্যাচের প্রশান্ত ব্যানার্জীও অলরাউন্ড স্পোর্টসম্যান। শঙ্কর, নীলাদ্রী’দা আর প্রশান্ত এই তিনজনেই ছিলো ভীষণ Competitive। ক্যাপ্টেন হওয়ার সব ভালো গুণই ছিলো এঁদের মধ্যে। তবে খেলার মাঝে আমাদের শঙ্কর টিমের অন্যদের বেশ বকাবকি করতো। ’৬৭ ব্যাচের নীলাদ্রি’দা, শংকর’দা আর শ্যামল’দার মতো আমাদের শঙ্করও অসাধারণ স্পোর্টসম্যান ছিলো। দুর্ভাগ্য, নিয়তির নিষ্ঠুর বিধানে শঙ্কর পাশ করার কয়েক মাসের মধ্যেই পাঞ্চেত ড্যামে জলে ডুবে মারা যায়।
আমাদের সময়ে Heaton Hall এর নীচে একটা stationary দোকান ছিলো যেখানে খাতা, কলম, স্লাইড রুল, ড্রয়িং শিট, ইত্যাদি পাওয়া যেত। সন্ধ্যাবেলায় কখনও ওদিকে গেলে দেখতে পেতাম ফ্লাডলাইটে বাস্কেটবল খেলা চলছে। মনে পড়ে, কলকাতার ময়দানে গিয়ে অনেকবার দেখেছি সুন্দরী তরুনীরা বাস্কেটবল খেলছেন। সেই বয়সে মনে হতো যেন হলিউডের সিনেমার দারুণ এক রোমান্টিক মুহুর্ত। তখন কেই বা জানতো যে অদূর ভবিষ্যতের ফাইন্যাল ইয়ারে আমিই একদিন কলেজের বাস্কেটবল ক্যাপ্টেন হবো!
সেই প্রসঙ্গেই আসি। ১৯৬৬ সাল, আমাদের সেকেন্ড ইয়ার। এক শীতের বিকেলে ডালি (ডালমিয়া) ডেকে বলে আজ নাকি ইয়ার টিমের বাস্কেটবল খেলা আছে। আমাকে, শম্ভুকে আর কুমারকে (মজুমদার) খেলতে হবে। আমরা বাস্কেটবল খেলবো? ইচ্ছে আছে, উৎসাহ আছে, কিন্তু তাই বলে আমার মতন আনাড়িদের নিয়ে টিম? খেলার নিয়মকানুনই তো ঠিকমতন জানি না। ডালি আশ্বাস দিলো, কই বাত নেহি। সব ঠিক হো যায়েগা। ১২ নম্বর হস্টেল থেকে বাস্কেটবল কোর্টে পৌঁছানো পর্যন্ত যেটুকু মূল্যবান সময়, আমাদেরকে প্রায় ৩০/৩২ টা খেলার নিয়ম গড়্গড় করে বলে গেলো। আর আমাকে বিশেষ করে সাবধান করে দিলো, আমি যেন একেবারেই পায়ে বল না মারি আর ফুটবলের মতন ফাউল না করি কারণ ৫-টার বেশি ফাউল করলে মাঠ থেকে বার করে দেবে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ৩০ সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে হাতে বল রাখা যাবে না। বড়োই কঠিন খেলা। আমার দমদম মতিঝিল স্কুলের ৫০ জনের ক্লাসে, এত এত ফুটবলের দাপাদাপি করেও কোনমতে টিমে চান্স পেতাম। আর এখানে ৩০০ জনের ইয়ারে আর কাউকে পেলো না, যে আমাকেই মাঠে নামিয়ে দিলো?
সেদিন আমাদের প্রতিপক্ষ ফার্স্ট ইয়ার। ওঁদের, মানে ৭১ ব্যাচের কল্যাণ রয় ভালো খেলে। পরে আমার সাথে কলেজ টিমেও খেলেছে। সেদিনের খেলায় আমাকে বোধহয় ভগবান ভর করেছিলেন। শেষের Winning Score টা আমিই করেছিলাম। তখনের ফাইন্যাল ইয়ারের (৬৭ ব্যাচ) দীপক’দা (পুরো নাম এতদিন পরে মনে আসছে না) কলেজ টিমের ক্যাপ্টেন, মাঠে ছিলো। আসলে রিক্রূটার, কলেজ টিমের জন্য “উদিয়মান” (????) প্লেয়ার খুঁজছে। খেলার শেষে গ্রাউন্ড-স্টাফ (আমরা সাধারণত মালি বলে ডাকি) হলধর’দা কে বলে দিলো আমার জন্য স্পোর্টস কিটস দিতে, আর আমার প্রতি নির্দেশ যে আমি যেন এখানে এসে নিয়মিত অনুশীলন করি। বোঝো ঠ্যালা!! পাঁচ দুই হাইটের আমাকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। জানি না সেই আমি’র মধ্যেই দীপক’দা কি উজ্জল ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে। সেদিন ৬৭ ব্যাচের আরও দু’একজন মাঠে ছিলো, একজনকে মনে আছে – বদ্যিনাথ’দা (পুরো নাম মনে নেই)। সেইদিনই জানতে পারলাম যে পরের খেলা ফাইন্যাল ইয়ার, মানে দীপক’দার ৬৭ ব্যাচের সাথে। বুঝলাম, শনির দশা এখনও কাটে নি।
ফাইন্যাল খেলার দিনে দেখলাম, প্রতিপক্ষের পাঁচজনের মধ্যে দু’জন প্রায় ছ’ ফুট লম্বা। আর আমাদের টিমে ডালিই একমাত্র ৬ ফুটের, বাকি সকলের গড় উচ্চতা আন্দাজ পাঁচ তিন হবে। খেলার সেকেন্ড হাফে আমরা দু পয়েন্টে এগিয়ে আছি। খুবই উদ্দীপনার সাথে লড়ে খেলছিলাম। কিন্ত বিধাতা আমাদের বিপক্ষকেই আশীর্বাদ করছেন। নইলে কেন ঠিক সেই সময়েই নীলাদ্রী’দা উলফেন্ডেন হস্টেলের সামনে দিয়ে যাবে? আর ফাইন্যাল ইয়ারের ছেলেরাও নীলাদ্রী’দাকে ডেকে নিয়ে এসে মাঠে নামিয়ে দিলো। নীলাদ্রি’দার কথা আগেই বলেছি, দুর্দান্ত স্পোর্টসম্যান। খুব লম্বা। নীলাদ্রী’দা মাঠে নামতেই ওঁরা খেলাটা ধরে নিলো। তার উপরে নীলাদ্রী’দাকে আটকাতে গিয়ে আমাদের পরম নির্ভরযোগ্য ডালি আহত অবসৃত হয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। আমাদের যত লড়ালড়ি সেখানেই শেষ। ৬’ফুট লম্বা লম্বা প্লেয়ারদের বিপক্ষে আমরা পাঁচ ফুটিয়া লিলিপুটের দল ক্যারম কিংবা লুডো মিয়ে লড়ে যাবো, কিন্ত বাস্কেটবল? নেহি, কভি নেহি। যথারীতি নীলাদ্রীদাই সেদিন আবার খলনায়কের ভূমিকায়। ফাইন্যাল ইয়ারের কাছে হেরে গেলেও মাঝে মাঝে মনে হয় বিধাতা আর নীলাদ্রী’দার কাছেই হেরেছিলাম।
বদ্যি’দা কিন্ত আমার সেকেন্ড ইয়ারের ফাইন্যাল পরীক্ষায় ত্রাতার কাজ করেছিলো। আমাদের দুজনেরই সীট একই বেঞ্চে। একটা পরীক্ষার সময় বদ্যি’দা নিজেই খেয়াল করলো যে আমি নার্ভাস, বেশ উসখুস করছি। জিজ্ঞেস করাতে বললাম যে একটা প্রশ্নের উত্তর দরকার, নিজে পারছি না। বদ্যি’দা খানিক পরে waterman এর কাছে জল চাইলো। খুব সম্ভবত মধু’দা ছিলেন। মধু’দার সেই জল নিয়ে আসার সময়টুকুতে আমি বদ্যি’দার ইশারা মতো মধুদাকে কত নম্বর প্রশ্নটা আর তিনটে বেঞ্চ সামনে যার কাছ থেকে উত্তরটা পাবে, দেখিয়ে দিলাম। আর খানিক পরেই মধুদা আমার জন্য জল আর উত্তর, দুটোই নিয়ে এলেন। পরীক্ষা শেষ, ক্যান্টিনে এসে বসে ঘটনাটা সবিস্তারে বন্ধুদের বললাম। ওদের মধ্যে একজন বলল, আরে এটা তো এক্কেবারে মান্না দের গান “এই কোণে আমি আর ঐ কোণে তুমি, মাঝখানে উত্তর বয়ে চলে যায়”। এই কথাগুলোয় যা বলতে চাইছি, যে বিই কলেজে শুধু খেলাধূলার মাধ্যমেই কত যে অযাচিত সাহায্য, বন্ধু, বা শুভার্থী পেয়েছি, সে গুনে শেষ করা যাবে না।
আমার দেখা ৬৫-৭০ সময়ের খেলাধুলায় সামগ্রিকভাবে সেরা ব্যাচ ৬৭ সালের। মোটামুটি সবরকম খেলাতেই অপ্রতিদ্বন্দী। এক ব্যাচে এত একঝাঁক প্রতিভাবান খেলোয়াড় বোধহয় হয়তো আগে বা পরে আরও এসেছে, আর যদি এসেও থাকে সেগুলি ৬৭ ব্যাচের মতনই হাতে গোনা। এই ৬৭ ব্যাচের নীলাদ্রী’দার নামটাই প্রথমে উঠে আসবে। ওর মতো অলরাউন্ড স্পোর্টসম্যান বিই কলেজের ইতিহাসে খুবই কম এসেছে। ক্রিকেট ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, আর এথলেটিক্স টিমের ক্যাপ্টেন। এক কথায় He was cut above the class. তবে সবথেকে সেরা ছিলো ব্যাডমিন্টন আর টেবিল টেনিসে। একটু চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ। আমাদের ব্যাচমেট সোমনাথ ভট্টাচার্য ফার্স্ট ইয়ারে ১২ নম্বর হোস্টেলে নীলাদ্রী’দার রুমমেট ছিলো। সেই সোমনাথের কাছে নীলাদ্রী’দাকে নিয়ে দু একটা মজার কথা জানতে পারি। নীলাদ্রী’দা নাকি একদমই পড়াশোনা করতো না। সময় পেলেই নিজের রুমে ব্যাডমিন্টন র্যাকেট বা টেবিল টেনিসের ব্যাট হাতে শ্যাডো প্র্যাকটিস করতো। দুই, আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের শুরুতে সিনিয়ররা নাকি সোমনাথকে র্যাগিং করার জন্য এসে নীলাদ্রী’দার অনুমতি চেয়েছিল। নীলাদ্রী’দা মাত্র দশ মিনিটের সময় দিয়ে বলেছিলো, “ও আমার রুমমেট। দশ মিনিটের মধ্যে ফেরত দিয়ে যাবি”। আর যারা র্যাগিং করতে এসেছিল, নীলাদ্রীদাকে অমান্য করার মতন স্পর্ধা তাদের কারও ছিলো না।
৬৭ ব্যাচে নীলাদ্রী’দা ছাড়া আরও কয়েকজন আমাদের চোখে আইকন ছিলো। শ্যামল সরকার (তোপ’দা), শঙ্কর বোস দুজনেই ক্রিকেট আর ফুটবলের সেই সময়কালের সেরা দু’জন। শঙ্কর বোস ফার্স্ট ইয়ারেই ক্রিকেটের বছরের সেরা প্লেয়ার হয়েছিলো। খেলোয়াড় হিসেবে অলরাউন্ডার, আর সাথে যাকে বলে towering personality. বোলিং-এ খুব ভালো হাতের কাজ ছিলো। অলোক মিত্র স্টাইলিশ আর নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। শঙ্কর’দা, অলোক’দা আর শ্যামল’দাকে ইউনিভার্সিটি ট্রায়ালে ডেকেছিলো। তবে একমাত্র শঙ্কর’দাই ইউনিভার্সিটি টিমের হয়ে খেলেছে। অন্যদিকে লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারার শ্যামল’দা মূলত ফুটবলের স্টপারে খেলতেন আর শংকর’দা খেলতেন প্রধানত রাইট আউটে। আর টেবিল টেনিসে ছিলো দেবাশীষ’দা।
আমাদের শিবাজী ভট্টাচার্য্য (১৯৬৪-৭০) ফার্স্ট ইয়ারেই কলেজ ক্রিকেট টিমে নিজের জায়গা করে নেয়। সম্প্রতি ২০২২ সালে আমাদের ব্যাচের (BECCA) সম্মেলনে দেখা হয়েছিল। ওর থেকেই শ্যামল’দা, শংকর’দা এঁদের কথা শোনা যাক।
১৯৬৪ সালে কলকাতার Anderson Club এর মাঠে বার্নপুর স্টিল প্ল্যান্টের বিরুদ্ধে আমাদের কলেজ টিমের একটা খেলা ছিলো। ওদের টিমের দু’জন প্লেয়ার রাজগুরু আর জাগনানী তখন বিহার রঞ্জি টিমের প্লেয়ার। আমাদের টিমের যাদের নামগুলো মনে পড়ছে – অশোক দত্ত (১৯৬৪, ক্যাপ্টেন), শঙ্কর বোস (৬৭), অলোক মিত্র (৬৮), শ্যামল সরকার (৬৭), বিপ্লব গুহ (৬৮), শুভাশীষ মজুমদার (৬৯), আর আমাদের ব্যচের শিবাজী, অলোক ব্যানার্জি (মাইনিং)। প্রথমে বার্নপুর ব্যাট করে দু’শোর উপরে রান তুলে নেয়।, বোলিং এ আমাদের শংকর’দা আর অশোক’দা (৬৮), দু’জনেই পাঁচটা করে উইকেট তুলে নেয়। এবার আমাদের ব্যাটিং-এর সময় শুরুতেই তিনটে উইকেট হারাই। এরপর শ্যামল’দা (তোপ’দা) আর অলোক মিত্র জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রান তুলে নেয়।
শীতকালটা আমাদের খুব প্রিয় ছিলো, খুব ভালো সময় কেটে যেতো। প্রতি বছরই স্পোর্টিং ইউনিয়ন, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, এম এন দস্তুর আমাদের কলেজের ওভাল মাঠে নিজেদের ক্রিকেট টিম নিয়ে এসে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলে যেতো। প্রোকটর পারমিশন দিতেন। আমরা শীতের দুপুরে দল বেঁধে খেলা দেখতাম। খেলা থাকলে রবিবার আর বাড়ি যেতাম না। স্পোটিং ইউনিয়নের খেলা থাকলে পঙ্কজ রায় আসতেন। দিল্লিতে তাপস’দার (রায় চৌধুরী, ৬৭ ব্যাচ) কাছে শোনা, পঙ্কজ রায় নাকি একবার আমাদের প্রোকটর এস কে চক্রবর্তীকে খেলা চলাকালীন অভিযোগ করেন যে ওভাল মাঠের আউটফিল্ড খুব স্লো, নইলে শিবাজী রায়ের (বাংলার রঞ্জি প্লেয়ার) সেঞ্চুরি এতক্ষণে হয়ে যেতো। আমাদের প্রোক্টর তৎক্ষণাৎ নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলেছিলেন, “আমাগো শ্যামল সরকার যখন সেঞ্চুরি মারে, তখন কি আউটফিল্ডটা ফাস্ট হইয়া যায়?” পঙ্কজ রায় এর উত্তর দেন নি।
তৎকালীন সময়ে বাইরে থেকে যারা আমাদের কলেজ মাঠে বেশ কয়েকবার এসে ক্রিকেট খেলে গেছেন তাঁদের মধ্যে দু/তিনজনের কথা বলতেই হবে। একজন হলেন Mr. Rabadi, উনি M N. Dastur কোম্পানির একাউন্টস ডিভিশনে কাজ করতেন, অন্যান্যদের থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড়ো ছিলেন, মাথার সব চুল সাদা। খূব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। মোটামুটি steady batsman. ক্রিকেট ছিলো ওনার প্যাশন। মাঠে নামলেই উনি খুব হাততালি পেতেন। আর আমরা পেতাম রুশী জিজিভয়’কে, বাংলার বহুদিনের নির্ভরযোগ্য উইকেটকিপার, ভারতের হয়েও কয়েকবার খেলেছেন। উল্টোদিকে আমাদের উইকেটকিপার ছিলো সুভাষ (মজুমদার, ’৬৯ ব্যাচ)। সুভাষ ছিলো মজার মানুষ। জিজিবয় ব্যাট করতে নামলেই নাকি উইকেটের পিছন থেকে কমেন্টস করে যেতো আমাদের পরিভাষায় যাকে বলি চুটকি। পরে স্লেজিং ব্যপারটা এসে গিয়েছিলো। আসলে সেই সময়ে ক্রিকেট ছিলো ভদ্রলোকের খেলা।
যাদবপুরের হয়ে আসতো চুণী গোস্বামীর ভাই বেণু গোস্বামী, খুব ভালো ব্যাটসম্যান ছিলো। আর ছিলো তানচি অজিত, আর ভাইয়া। ভাইয়ার ভালো নাম মনে নেই। তানচি ছিলো স্পেশাল। ফাস্ট বোলার, তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যাটসম্যানদের জন্য কিছুটা ত্রাসের কারণ। আমি জানি না এর আগে আর কোনও চাইনিজ ক্রিকেট খেলেছেন কিনা। বাউন্ডারি লাইনের ধারে ফিল্ডিং করার সময় মাঠের দর্শকদের সাথে খুব মজা করতো। ব্যাক্তিগত জীবনে চাইনিজ ভারতীয়। কলকাতায় জন্ম, লম্বা, দোহারা সুদর্শণ চেহারা। বাঙলাটা খুব ভালো বলতে পারতো। শুনেছি ওর বোন নাকি শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। ভাইয়া কিছুদিন কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশনে খেলেছে। হ্যান্ডসাম, স্টাইলিশ প্লেয়ার, অনসাইডে খুব স্ট্রং। বিশেষ করে কভার ড্রাইভগুলো হতো দেখবার মতন। কিন্ত সেই ভাইয়ার ছিলো একটাই সমস্যা। ওভাল মাঠের পাশেই লেডিজ হস্টেলের বারান্দায় দর্শকসংখ্যা ভালো হলেই বেচারা আর উইকেটে টিকে থাকতে পারত না।
কলেজে আমি ক্রিকেট খেলিনি, কেননা আমার শক্ত লাল ডিউজ বলে ভীষণ ভয় ছিল। গায়ে লাগলে ভীষণ ব্যথা হয়। তার উপরে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে নরি কনট্রাক্টর এর ঘটনা জানার পরে সেপথে আর এগুই নি। তবে খেলা দেখতে যেতাম। এমনিতে আমাদের সময়ে কলেজ টিমটা বেশ ভালো ছিল। ১৯৭২এর ব্যাচেরও আনেকেই ভালো খেলত, তবে প্রশান্ত ব্যানার্জির কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। ও ছিলো ফাস্ট বোলার, ব্যাটেও ভালো হাত ছিলো, যাকে বলে অলরাউন্ডার।
আমাদের ’৭০ এর ইয়ার টিমটাও বেশ ভাল ছিলো। যতদূর মনে পরে, আমাদের ইয়ার টিম রিপ্রেজেন্ট করত অমিত মিত্র, শঙ্কর মিত্র, কিরীটী গুপ্ত, শিবাজী ভট্টাচার্য, আশীষ ঘোষাল (WK), তপন দাসগুপ্ত, দীপক কর, অশোক কর্মকর, অমিতাভ মুখারজি, প্রলয় মুখার্জী। আরও কয়েকজন ছিলো, কিন্তু এই পঞ্চাশ বছর পরে নামগুলো আর মনে আসছে না। আমরা ফোর্থ আর ফিফথ ইয়ারে ক্রিকেটের ইন্টার ইয়ার রানার্স হয়েছিলাম। আর আমাদের ব্যাচের বেশ কয়েকজন কলেজ টিমেও খেলত। আমাদের ব্যচের অমিত্ মিত্র ভাল প্লেয়ার ছিলো। কভার ড্রাইভগুলো ছিলো দেখবার মতন। ইউনিভার্সিটি ট্রায়ালে ডাক পেয়েছিল, যায় নি। টেবিল টেনিসেও ভালো ছিলো। আরও একটা গুন ছিলো, খুবই ভালো গান গাইত। দুষ্ট লোকজন বলে, গানের জন্য সে নাকি মহিলামহলে খুবই সমাদ্রিত ছিলো। আমি অবশ্য এর সত্যতা যাচাই করিনি। তবে আমাদের ব্যাচের গেট টুগেদারে গান বাজনার প্রোগ্রামে সেই লিড করে।
আমাদের প্রোক্টর নিজেও খূব ভাল প্লেয়ার ছিলেন। শুনেছি বিই কলেজে আসার আগে প্রেসিডেন্সী কলেজে ছিলেন। ছাত্রদের যেমন শাসন করতেন, তেমনই স্নেহও করতেন। ইন্টার ইয়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টের প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের সময় শঙ্কর’দার (বোস) জামার বোতাম খোলা ছিলো। যখন সে প্রোক্টরের হাত থেকে প্রাইজ নিতে গেছে, উনি প্রাইজ দেন নি। বলেছিলেন, “আগে জামার বুতাম লাগাইয়া আয়, তারপরে প্রাইজ পাবি।” তাই হলো। শঙ্কর’দা শার্টের বোতাম লাগিয়ে প্রাইজ নিতে গেল।
’৬৭ ব্যাচ মোটামুটি সব খেলাতেই ভালো হলেও it was not a cake walk for them in all the games. ফুটবলে ’৬৯ ব্যাচ ছিলো ওদের শক্ত প্রতিপক্ষ। ফরোয়ার্ড লাইনে চন্দন’দা, আফতাব’দা, ডিফেন্সে দীপক সেন আর খালি পায়ে রাইট উইঙে ৬ ফুট লম্বা ছিপছিপে চেহারার সাধন’দা (ঘোষ)। তাঁর চলনে বলনে একটা মস্ত্ ভাব ছিলো। কোনোদিনও প্রাকটিস করতো না। ইয়ার টিমের ম্যাচের দিন সোজা খেলতে চলে আসতো। ঈষৎ ডানদিক ঘেঁষে বুলেটের মতো বল নিয়ে দৌড়ে প্রতিপক্ষের একেবারে নাভিশ্বাস তুলে দিতো। খুব ভালো টেবিল টেনিসও খেলতো, কলেজের চ্যাম্পিয়ন ছিলো। আমাদের ’৭০ ব্যাচের সেরা টেবিল টেনিস প্লেয়ার শিবাজীও অসাধারণ ছিলো, কিন্তু সেও সাধন’দাকে কোনোদিন টেবিল টেনিসে হারাতে পারেনি। শিবাজী ক্রিকেটও খুব ভাল খেলত। ফার্স্ট ইয়ারেই কলেজ ক্রিকেট টিমে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলো।
চন্দন’দা, একটু আগেই যার কথা বলেছি, খেলতো লেফট ইনসাইডে। দীপক আর চন্দন’দ দুজনেই দুর্দান্ত খেলোয়াড়। দীপক আমাদের মতিঝিল স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। ওর মতো লেফট ব্যাক আমাদের সময়ে কাউকে দেখিনি। প্রচার বিমুখ, চুপচাপ স্বভাবের। একবার ম্যাচের আগে দীপককে প্রশ্ন করেছিলাম, হ্যাঁরে, শঙ্কর’দাকে কিভাবে ট্যাকল্ করবি? দীপক ঠান্ডা মাথায় জবাব দিয়েছিলো, কাল শঙ্কর’দাকে ১২ গজের মধ্যে ঢুকতেই দেবো না, দেখে নিস। শংকর’দা ছিলো রাইট উইঙার, বাউন্ডারি লাইন দিয়ে দৌড়ে লাস্টে সেন্টার করতো। ওটাই ছিল শংকর’দার ট্রেড মার্ক। আর আউটসাইড ডজও ভালো ছিলো, যদিও দীপককে সহজে টপকাতে পারতো না।
পরের দিন ’৬৭ বনাম ’৬৯ এর খেলা শুরুর কিছুক্ষণ মধ্যেই বোঝা গেলো যে ৬৭ ব্যাচ নিজেদের সুনাম অনুযায়ী সাবলীলভাবে খেলতে পারছে না। যদিও রাইট উইঙে সাধন’দা আর লেফট ইনে চন্দন’দা বিপক্ষের ত্রাস হয়ে উঠেছে। দেখা গেল যে একদিকে শ্যামল’দা আর অন্যদিকে দীপক মহীরূহ হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত থার্ড ইয়ার (’৬৯ ব্যাচ) জিতে গেলো। দীপক প্রায় প্রতি বছরই Best Player of The Year আর ফাইন্যালে Man of The Match হতো। যেন নিজের নাম খোদাই করে রেখেছে। এরপরে আইআইটি খড়গপুরে M. Tech করার সময়েও Best Player হয়েছিল। কলেজে আমার দেখা ডিপ ডিফেন্সের সেরা দু’জন হলো দিলীপ কয়াল আর দীপক সেন।
চন্দন’দার অন্য প্রসঙ্গে আসি। খুব ভালো গীটার বাজাতেন, আর বেশ মজা করতেন। পাশ করার পরে খুব সম্ভবত Texmaco বা সেখানেই অন্য কোনও কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মাঝেমধ্যে দমদম স্টেশনে দেখা হয়ে যেতো। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন আছ? বলল, কেলো হয়ে গেছে। অফিসে ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার আশায় resignation দিয়ে দিলাম আর, অফিসও মাইরি accept করে নিল। অতএব আবার বেকার।
কলেজ টিমের ফুটবলে সেদিনের ’৬৭ ব্যাচ পাশ করে চলে যাওয়ায় কলেজ টিমে যতটা শূন্যতা হবে ভাবা হয়েছিলো, ততটা কিন্ত হয় নি। কারণ সেই ‘৬৭-’৬৮ সালে ওভালের বড় আবিস্কার ফার্স্ট ইয়ারের জ্ঞান রঞ্জন ভৌমিক, আমাদের সকলের জনি (১৯৬৫-৭২)। ওভালে নামার সাথে সাথেই কলেজ টিমে সে নিজের জায়গা করে নেয়। লেফট ইনের প্লেয়ার, বাঁ পা ছিলো যেন সোনা, ছিলো অসাধারণ ড্রিবলিং আর গোল করার ক্ষমতা। তখন চন্দন’দা (১৯৬৪-‘৬৯) কলেজ টিমের লেফট ইনের প্লেয়ার। তাই ৬৯-৭০ সীজনে জনি চলে গেলো লেফট আউটে, আর ’৭০-এ আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলো। শ্যামল সরকার পাশ করার পরে আমাদের ব্যাচের প্রীতিগোপাল সাহা স্টপারের জায়গায় আসে। খুব ভাল প্লেয়ার ছিল। অসাধারান পজিশন সেন্স এবং ভাল ট্যাকলে করটো, যাকে বলে মিঃ Dependable.
১৯৬৯ উইন্টার মিটের ফুটবল টিমে যারা খেলেছিল, তাদের নাম যতটা মনে পড়লো, গোলকিপার-শেখর রঞ্জন ভদ্রচৌধুরি / সমীর কুমার দত্ত। ব্যাক/স্টপার মানস রায়, আশিস সাহা (ইঞ্জিন), প্রীতিগোপাল সাহা। হাফ ব্যাক স্বপন কুমার ঘোষ (নান্টু), শংকর মিত্র। স্ট্রাইকার মনোজ বর্মন, প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী, জ্ঞান রঞ্জন ভৌমিক (জনি), প্রবীর দেব (বালু)। এতদিন আগের কথা, এখন আর বাকি সব নাম মনে আসছে না। সূত্র – জ্ঞান রঞ্জন ভৌমিক (জনি)
আমাদের ‘৭০ এর কলেজ ফুটবল টিমের সব নাম মনে না থাকলেও কিছু কিছু নাম মনে আসছে। শেখর রঞ্জন ভদ্রচৌধুরি, ডিফেন্সে মানস রায়, শুভঙ্কর দে, আশিস সাহা (ইঞ্জিন), প্রীতিগোপাল সাহা, কীর্তি গুপ্ত, হাফে স্বপন কুমার ঘোষ (নান্টু), শংকর মিত্র। স্ট্রাইকার মনোজ বর্মন, প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জী, জ্ঞান রঞ্জন ভৌমিক (জনি), প্রবীর দেব (বালু)। ’৭২ ব্যাচের মনোজ ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ট্রায়ালে সুযোগ পেয়েছিল। ’৬৯ উইন্টার মিটে যাদবপুরের বিরুদ্ধে ২৫ গজ দূর থেকে ওর দুর্দান্ত ভলির গোল এখনও মনে আছে।
আমাদের ’৬৫-‘৭০ ব্যাচের ফুটবল টিমটাও মোটামুটি ভালোই ছিল। টিমের যাদের নাম মনে পরছে, ধ্রুব (GK), কিরীটী গুপ্ত, প্রীতিগোপাল সাহা, অমিতাভ মুখার্জী, প্রলয় মুখার্জী, অশোক কর্মকার, কুমার মজুমদার, শঙ্কর মিত্র, আর আমি পপ দাশ। বাকি দুজনের নাম মনে পরছে না। আমরা নকআউট আর লীগ দুটোতেই রানার্স হয়েছিলাম। আর দুটোতেই ’৬৭-‘৭২ ব্যাচ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ‘৭২ ব্যাচের ফুটবল টিমও খুবই ভাল ছিল। কিন্তু সব নামগুলো এখন আর বলতে পারবো না।
৬৯-৭০ সালে হকিরও ভালো টিম ছিলো। রথীন ব্যানারজি, চার্লি, কোহলি, অমিতাভ সেন, প্রকাশ শ্রেষ্ঠি, স্বপন ঘোষ দস্তিদার, রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার, গুরুবচন সিং, শোভন, গৌতম মজুমদার আর গোলে অশোক মুখারজি। স্বপন তখন কোলকাতা হকি লীগের ফার্স্ট ডিভিশনে বেঙ্গল ইউনাইটেডের হয়ে খেলে। লীগের একটা ম্যাচে স্বপন মাথায় চোট পায়, আর কলকাতা ময়দান থেকে পিজি হাসপাতালে গিয়ে স্টিচ করিয়ে আনতে হয়।
আমাদের ইন্টার ইয়ার হকির খেলায় ফাইন্যাল ইয়ারে লীগ আর নকআউট, দুটোতেই রানার্স হয়েছিলাম। তবে ইন্টারেস্টিং ইতিহাসও আছে। একদিন ডালমিয়া আমাকে বলে যে শঙ্কর মিত্র আমার খোঁজ করছে। আর ডালিকেও হকি খেলতে বলেছে। ডালি UP-তে স্কুলে পড়ার সময় খেলটো। পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজেও খেলেছে। আমি শঙ্করের সাথে দেখা করলাম। সে বলে আমাকে হকি খেলতে হবে। আমি বলি, পাগল? জীবনে একবারও হকিস্টিক হাতে ধরিনি। তখন সে বলে যে দমদমের যে ছেলে বাঁশ হাতে নিয়ে দৌড়াতে পারে, সে হকি স্টিক হাতে নিয়েও খেলত পারবে। অগত্যা আমি মাঠে নেমে পরলাম, আর বাকিটুকু এক মধুর স্মৃতি। তালে গোলে দুটো প্রাইজ পেয়ে গেলাম। আমাদের ইয়ারের টিমের দুজনের কথা মনে আছে, প্রকাশ শ্রেষ্ঠি আর গৌতম চ্যাটার্জি (Gogo). প্রকাশ বাস্কেটবল আর হকি দুটোই খুব ভাল খেলত। গোগো’র ইতিহাস একটু বলি। ও বালীগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ক্লাস এইটেই খেলা থেকে অবসর নেয়। এরপর আবার খেলা সুরু করে কলেজে এসে, ১৯৬৮ সালে আমাদের থার্ড ইয়ারে। এতবড় কামব্যাক সেই যুগে আর হয়েছিলো কিনা আমার জানা নেই। সেই গোগো ছিল আমাদের গোলকিপার।
আরও একজনের নাম উল্লেখ করবো, অজয় দেবনাথ ১৯৭০ সালের। বিই কলেজের পাঁচ বছরে পড়াকালীন এথলেটিক্স ক্লাবের ট্র্যাক আর ফিল্ড ইভেন্টে একের পর এক পুরনো রেকর্ড সব সে ভেঙে দিলো।
এবার ১৯৬৯ সালের উইন্টার মিটের প্রসঙ্গে আসি।
সেই উইন্টার মিটের বাস্কেটবলে আমরা মাঠে নেমেছিলাম কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই। এমনকি মাঠটাও তৈরি ছিলো না। জলপাইগুড়ি আর দুর্গাপুরের বিরুদ্ধে আমরা জিতেছিলাম, কিন্তু মেরিন আর যাদবপুরের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। দুর্গাপুরের চিকেন আর যাদবপুরের মনোজ উদানী সকলের নজর কেড়েছিলো। চারিদিকে চিকেন চিকেন। তাঁর নাম আজও জানিনা, তবে সেই নামটাই মনে আছে। আর জনগনের বিচারে সেই ছিলো সেই উইন্টার মিটের সবথেকে জনপ্রিয় এবং বৈচিত্রময় চরিত্র। খুব ভালো টেবিল টেনিসও খেলতো। তবে ফাইন্যালে মনে হয় আমাদের বিজয় জয়সওয়ালের কাছে হেরে গিয়ে রানার্স আপ হয়।
এই চিকেন আমাদের উপর কতটা প্রভাব ফেলেছিলো তার একটা উদাহরণ দি। আমাদের টেবিল টেনিসের সেরা প্লেয়ার শিবাজীও পাঁচ সেটের খেলায় ওঁকে হারাতে পারে নি। অসম্ভব ভালো ডিফেন্স ছিলো। সেই চিকেনের খেলা দেখে আমাদের সিরিয়াস ছেলে হায়ার সেকেন্ডারির ন্যাশনাল স্কলার বয়, আর অন্যদিকে দারুণ স্পোর্টসম্যান ভলিবলের ক্যাপ্টেন সুদীপ রায়ও রাত দুটোর সময় আমাদের কয়েকজনকে ডেকে বলে চিকেনের মতন ডিফেন্স প্র্যাকটিস করতে হবে। অতএব হস্টেলের কমন রুমে সিরিয়াস প্র্যাকটিস শুরু হলো। সেই সিরিয়াস ছেলে সুদীপকে পরে আমরা সবাই ভয় পেতাম।
উইন্টার মিটে আশানুরূপ ফল করতে না পারায় সেই শীতের আগেই আমি বাস্কেটবল টিমটাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নি। সবার আগে যোগাযোগ করি West Bengal Basketball Association এর সাথে আর সেই সূত্রে সুভাষ’দার সাথে পরিচয় হয়। উনি ছিলেন আমাদের আর্কিটেকচারের প্রফেসর অবনী কুমার দে’র শ্যালক, তাই ওনাকে আমাদের কোচের দায়িত্বে রাজি করাতেও খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হলো না। সুভাষ’দা ছিলেন পুরোদস্তুর প্রফেশনাল কোচ, টিমকে একটা ডিসিপ্লিনে নিয়ে এলেন। আমাদের খেলার মানের উন্নতি আমরা নিজেরাই বুঝতে পারলাম। এবার আমরা West Bengal Basketball Association এর ইন্টারমিডিয়েট লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করি আর লীগের রানার্স আপ হই। সম্ভবত আমরাই প্রথম কলেজ বাস্কেটবল টিম যারা West Bengal Basketball Association স্পোর্টস বডির রেজিস্টার্ড মেম্বার হতে পেরেছিলাম। কলকাতা ময়দানে খেলার সুবাদে আমাদের সবাই অনেক ভালো ভালো খেলোয়ারদের সাথে খেলার সুযোগ পেয়েছিলো, আর বাংলা রাজ্য টিমের অনেকের সাথে সম্পর্কও গড়ে উঠেছিলো। ময়দানে আমাদের পরিচিতিও বেড়ে গেলো। আমাদের ’৭০ এর ব্যাচ এই উদ্যোগের কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে।
সুভাষ’দা কোচিং-এর শুরুতেই আমাদের zonal marking-এ খেলানো শুরু করেন, কারণ personal marking-এ খেলার মতন প্রয়োজনীয় স্কিল আর স্ট্যামিনা, কোনটাই আমাদের ছিলো না। আমাকে pivot-এ খেলিয়ে ডালমিয়া আর প্রকাশকে attacking offence-এ খেলানোর প্ল্যান করলেন। ডালমিয়া, প্রকাশ শ্রেষ্ঠি আর কল্যাণ মূলত cut-এ বল নিয়ে (ফুটবলের পরিভাষায় বলে থ্রু পাস) dee-র মধ্যেই খুব ভালো নেট করতে পারতো। আর long distance spot jump গুলো সাধারণত আমিই নিতাম। pivot-এ খেলার জন্য আমাকে গোটা মাঠ জুড়ে খেলতে হতো। পাশাপাশি game making-এর দায়িত্বটাও আমার উপরেই ছিলো। এইভাবে সুভাষ’দার কোচিং-এ খেলে আমরা কিছুদিনের মধ্যেই ভালো ফল পেলাম। আগে আমরা যাঁদের কাছে বাজেভাবে হেরে যেতাম, যেমন চেতলা রাখী সঙ্ঘ, পুলিস, কল্যাণী বাস্কেটবল টিম, এঁদেরকে হারাতে শুরু করলাম। আমাদের প্রকাশ খুব খেটে খেলতো। পরের ব্যাচের (’৭১) অমিত রয় এসে অনেক উন্নতি করলো। অরিজিতের স্বাস্থ্য ছিলো দেখার মতন। dee-র এসে মধ্যে অনায়াসে নেট করতো। তবে নেদারল্যান্ডের যোহান ক্রূয়েফের মতন একটা অভ্যাস করে ফেলেছিলো। হাফটাইমে উলফেন্ডেন হলের সামনে গিয়ে সিগারেটে কয়েকটা টান মেরে আসতো।
ফাইন্যাল ইয়ারে (৬৯-৭০) শীতকালে আমরা রোজ কোর্টে এসে প্রাকটিস শুরু করলাম। সেইসময় কলেজ টিম ছিলো আমি ক্যাপ্টেন, সাথে রমেশ ডালমিয়া, প্রকাশ শ্রেষ্ঠি, অমিত রয়, কল্যাণ রয়, পিটার লী, বাসনেট, উদিত ধর, তপন মুখার্জি, সঞ্জয় চক্রবর্তী। সবার ছোট ছিলো সঞ্জয়, ’৭৪ ব্যাচের। তবে সে নানানভাবে টিমকে তৈরি করতে আমাদের সাহায্য করেছে। ইতিমধ্যে সুব্বা রাও, আর সৌমিত্র’দা অন্য কলেজ থেকে বি টেক করে এবার আমাদের এখানে এসে মাসস্টার্সে ভর্তি হলে টিমটা আরও ভালো হয়ে যায়। সবাই আন্তরিকতার সাথে মাঠে নামতো। ফলে টিমের মধ্যে একটা বন্ডিং তৈরি হয়। “ছোটা পরিবার, সুখী পরিবার”। পাশাপাশি এথলেটিক ক্লাব, মেটালার্জির প্রফেসর পিপি দাস, আর প্রোকটর আমাদের খুব উৎসাহ দিতেন। তবে আমরা আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ম্যাচ প্র্যাকটিস করেছি, ময়দানে গিয়ে ম্যাচ খেলেছি। তাই আগের বছরগুলির তুলনায় আমাদের বাজেটে ঘাটতি পড়েছিলো। সেই কারণে প্রোকটর প্রায়ই আমাদের ডেকে বকাবকি করতেন। প্রফেসর পিপি দাস (মেটালার্জি), প্রফেসর সি কে সরকার (সিভিল), রেজিস্ট্রার এবং আরও কয়েকজন, সকলের নাম মনে আসছে না, আমাদের খেলা দেখতে ময়দানে আসতেন। সকলেই আমাদের খুব স্নেহ করতেন, এমনকি ভাইভা-তেও ভালো নম্বর দিয়েছিলেন। কপাল আর কাকে বলে?
আমাদের বাস্কেটবলের কল্যাণ ছিলো যেমন ভালো মানুষ তেমনি ভুলো মনের। দিনক্ষণ মনে রাখতে না পেরে কয়েকবার পরেরদিন সেজেগুজে তৈরি হয়ে উপস্থিত। আর আমি প্রায়দিনই ফ্লাড লাইটে রাত আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত প্রাকটিস করতাম। শেষ বেলায় আমার পার্টনার হতো আমাদের ব্যারাকের রানধনীর ভাইপো, “জিপো” (Zipo) নামে যাকে সবাই চিনতো। খেলাধূলায় জিপোর এক জন্মগত উৎসাহ আর স্কিল ছিলো। আমার সাথে বাস্কেটবল ভালোই শিখে নিয়েছিলো। আর দম ছিলো, প্রায়ই পুরো কোর্টে একা একাই আট-দশটা চক্কর দিয়ে আসতো। একটা চালু কথা হয়ে গিয়েছিলো যে, যাদবপুর হলে ওঁকে প্লেয়ার্স কোটায় কায়দা করে ঢুকিয়ে দিতো। পরে রামধনীর কাছে জানতে পারি, সে একটা মোটর গ্যারেজ খুলেছে।
প্রসঙ্গত বলি, আমাদের আবাসিক কলেজের একটা বৈশিষ্ট ছিলো যে যাঁদের আমরা ক্লাস ফোর স্টাফ বলি, যেমন মালী, ড্রাইভার, বা ক্লাস থ্রি মেস ডিপার্ট্মেন্ট, একাউন্টস ডিপার্ট্মেন্ট, ওয়ার্কশপের কর্মচারী, বা কন্ট্রাকচুয়াল যেমন ব্যরাক স্টাফ, এঁদের প্রত্যেকের সাথেই আমাদের একটা নিকট সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতো। এমনকি ক্যাম্পাসের বাইরে চা-সিঙারার দোকানেও। অন্য কোনখানে এর দ্বিতীয় উদাহরণ আছে কিনা জানিনা।
শেষে বলি, আমাদের ফাইন্যাল ইয়ারের সময় ইন্টার ইয়ার বাস্কটবেলের ফাইন্যালে উঠেছিলো ফোর্থ আর ফিফথ ইয়ার। আর আমি ছিলাম থার্ড ইয়ারের কোচ। সেমিফাইন্যালে ফোর্থ ইয়ারের কাছে থার্ড ইয়ার হেরে যায়। তাই কিছুটা আপসেট ছিলাম। খেলার শেষে সুভাষ’দা বলেছিলেন আমি ঠিকমতো প্লেয়ার substitute করি নি। তখন ফোর্থ ইয়ারের ছেলেদের সাথে আমাদের সখ্যতা ছিলো। বিশেষ করে আমাদের উলফেন্ডেন হস্টেলের সিভিলের ছেলেদের সাথে। যাদের নামগুলো মনে পড়ছে, শ্যামল সরকার, সুপ্রসাদ মুখার্জী, সৌমেন রায়, বিপ্লব দাশগুপ্ত, শ্যামাপ্রসাদ মন্ডল। এরা সকলেই ব্রিলিয়্যান্ট এবং বেদম বিচ্ছু। জেতার পরে বলে কিনা ফাইনালে আমাদেরকেও হারাবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম। একটু কথা কাটাকাটিও হলো। তখন ওরা বলে, কথা দাও, হারলে শাড়ি-গয়না পরে মাঠে ঘুরবে। বললাম “তথাস্তু “।
সেই ফাইন্যাল খেলাটা আজও আমার পরিষ্কার মনে আছে। যেন চোখের সামনে এখনও দেখতে পাই, that was one of my best games. আমাদের ইয়ার টিমের প্রথম পাঁচজনের মধ্যে ছিলাম আমি, প্রকাশ ডালমিয়া, কুমার কান্তি মজুমদার, সব্যসাচী চ্যাটার্জী (সবু)। যেহেতু ফাইন্যাল খেলা, তাই অনেক প্রফেসরেরাও খেলা দেখতে মাঠে এসেছিলেন। আর রেফারির বাঁশি নিয়ে ছিলেন সুভাষ’দা। আমরা সাজগোজ করে কোর্টে গিয়ে দেখি সবু আর প্রকাশ বেপাত্তা। আমাদের মাথায় হাত। তবে কি শেষ পর্যন্ত শাড়িগয়নাই কপালে আছে? খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে প্রকাশ সেজেগুজে সেই সকালেই Lady Brabourne College এ যাবে বলে বেরিয়ে গেছে, কলেজে কবে কখন ফিরবে কেউ জানে না। আর সবু গেছে একটা ইন্টারভিউ দিতে। ওদিকে ফোর্থ ইয়ার তাঁদের পুরো টিম নিয়েই মাঠে নেমেছে। তখন বাধ্য হয়ে ওদের বদলে আমাদের শম্ভুনাথ ব্যানার্জি আর তপন মুখার্জীকে নামলাম। তপন কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ছেলে, তখন বাস্কেটবল আর টেবিল টেনিসে বেঙ্গল স্কুলের হয়ে খেলেছিলো, কিন্তু পরে তাঁর পুরো কলেজ জীবনটাই ক্যান্টিনে, শুয়ে আর ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। একেবারে Rare Earth Element. কিন্তু উপায় নাই।
সেদিন শুরুতেই ফোর্থ ইয়ার ঝড় তুলে দিলো, কল্যাণ আর অরিজিতের সবকটা থ্রো নেট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ডালমিয়া একাই খেলে যাচ্ছে। ৪০ মিনিটের খেলায় শুরুর ৩-৪ মিনিটেই ওরা অনেক পয়েন্টে এগিয়ে গেলো। আর ঠিক তখনিই ডালমিয়া আমাকে একটা দুর্বুদ্ধি দিলো। বলল, অরিজিতের থেকে ফাউল নে। খেলায় পাঁচটা ফাউল করলে সে আর খেলতে পারবে না। আমি তখন সেইমতন বল ধরে খেলতে শুরু করলাম, আর অরিজিতকে ট্র্যাপে ফেলে পরপর দুটো ফাউল নিলাম। ঠিক তার পরেই আমার পর পর দুটো প্রায় ১৫ ফুট দূর থেকে জাম্পশট নেট হয়ে গেলো। আমাদের ইয়ারের সাপোর্টাররা আনন্দে সারা মাঠ চিৎকার করে উঠল। আর আমিও খুব charged হয়ে গেলাম। এবার খেলার প্রায় ৭-৮ মিনিটের মাথায় দেখি সাবু আর প্রকাশ ড্রেস করে কোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সুযোগ থাকলে দৌড়ে গিয়ে এক ঘুষি মেরে আসতাম। তখন সঙ্গে সঙ্গে টাইম আউট নিয়ে প্লেয়ার Substitute করি। এবার খেলাটা পুরো আমাদের দখলে চলে আসে। মনে আছে, খেলাটা খুব High Score এর হয়েছিল, যদিও সঠিক স্কোর এখন আর মনে নেই। খেলার শেষে সুভাষ’দা বলেছিলেন যে আমার ঐ দু’টো জাম্পশটই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। আর আমি highest scorer এর প্রাইজ পেয়েছিলাম। আমরা জিতেছিলাম, তবে সেদিনের ফোর্থ ইয়ারের ভালো খেলার কথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে, ওরা সত্যিই খুব ভাল খেলেছিল। Kalyan, Arijit were at their best.
কিন্ত আমার কাছে খেলাটা যেন শেষ হয়েও শেষ হয় নি। প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের পরে ফোর্থ ইয়ারের সেই বিচ্ছু গুলোকে ধারেকাছেও দেখতে পেলাম না। হস্টেলের ঘরে ফিরে দেখি, ওরা আমারই ঘরে বসে আমারই পয়সায় চা বিস্কুট খাচ্ছে। শ্যামল বলে, “তোমারে অত ভালো খেলতে কে কইছিল?”
মানে!! হেরে গেলে তোরা আমাদের শাড়িগয়না পরাবি, আর আমি ভালো খেলূম না ?
বাঁদর ছাড়া ওদের আর কি বলব !!
সিনিয়র জুনিয়রদের মধ্যে এরকম এত মজা আর কোন কলেজে পাবো বলুন তো ?
ফাইন্যাল ইয়ারে চ্যাম্পিয়ন তো হলাম, তবে আমাদের বাস্কেটবল সিজন “শেষ হইয়াও, হইল না শেষ”। পিকচার আভি ভি কুছ বাকি হ্যায়। একটু ব্যাকগ্রাউন্ডে যেতে হবে। অনেকেই জানেন না যে সেই ১৯৭০ এর রাজনৈতিক কারণে শুধুমাত্র আমাদের ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষাটাই আলাদা করে নেওয়া হয়েছিল। তখন ক্যাম্পাসে আর অন্য কোনো ইয়ারের ছাত্রছাত্রীরা ছিলোই না। তাই বাকি ইয়ারের পরীক্ষাও তখন হয়নি। তার ফলে পরীক্ষার হলে আমাদের উপর চাপ বেশি ছিলো, কারণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কম আর ইনভিজিলেটর বেশি।
ফাইন্যাল ইয়ারে আমাদের সিভিলের একটা পেপার ছিল Planning and Professional Practice (PPP), আর্কিটেকচারের প্রফেসর অবনী কুমার দে পড়াতেন আর পরীক্ষাও নিতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, PPP-র সেই প্রশ্নপত্র বেশ কঠিন হয়েছিল, এবং প্যাটার্নও অন্যান্য বছরের তুলনায় অন্যরকম। কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলাম না। বিশেষ করে আমাদের উলফেন্ডেনের “অ্যান্টি স্টাডি পার্টি” (এ.এস. পি) মেম্বারদের বেশ বেগ দিচ্ছিল। আনসার সাপ্লাই-চেন সিস্টেমও কাজ করছিল না। ৫০ নম্বরের পরীক্ষায় ১৬ নম্বরের একটা প্রশ্ন ছিল “দোতলা বাড়ির ডিজাইন”। সবাই হিমসিম খাচ্ছিলাম। হঠাৎ খবর এলো সব্যসাচী চ্যাটার্জী, আমাদের সবু, অ্যান্টি স্টাডি পার্টি’র প্রেসিডেন্ট মালটা নামিয়েছে। আর সে সবাইকে সাহায্য করার জন্য অন্য একটা আলাদা পাতায় ডিজাইনটা করে টেবিলের উপরে রেখে দিয়েছে। আমি আর কমল দাশগুপ্ত প্রথমেই সেটা টুকে নিই। আমাদের দুজনেরই eye sight খুব ভাল ছিল। (যাকে বলে) বসিরহাটে দাঁড়িয়ে গড়িয়াহাটে “ইয়ে” দেখতে পাই। কলেজে সর্বজনবিদিত যে আমরা সবাই কম বেশি ইনোভেটিভ। ততক্ষণে উত্তরটা ঢেউয়ের মত সারা হলে ছড়িয়ে পড়ছে। সময় প্রায় শেষ। তখন কমল ভাবলো, একটা অন্যরকম নতুন কিছু করা দরকার। ওর কথামত আমরা দুজনেই ডিজাইনটা চেঞ্জ করলাম, দেখাদেখি অন্যান্যরাও সেটা টুকল। শেষে সবাই যখন উত্তরপত্র জমা দিয়ে চলে যাচ্ছে, ঠিক তখনই কমল আমাদের সেই disastrous ডিজাইন আবিষ্কার করল। বলে উঠল “পড়ে যাবে”। কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। কমল বললো, দরজা খুললেই পড়ে যাবে। মানে, আমরা এক্সটার্নাল ওয়ালে একটা দরজা দিয়েছিলাম, অথচ সেখানে কোনো বারান্দাই ছিল না, মানে সুইসাইড করার খুব সুবিধা। দরজা খুললেই সটান নীচে পড়ে যাবে। কি করে তরিঘরি করে ড্রইঙের সেই দরজা যে মুছেছিলাম সেটা আর আজ মনে নেই তবে সেই “ট্রমা”টা মনে আছে।
বাইরে বেরিয়ে প্রফেসর দে’র সাথে দেখা। সব শুনে বললেন ৭/৮ পাবে। মানে ফেল করে যাবো এবং সি, এন, আর (Cannot repeat) অবধারিত। অতএব সর্বোচ্চ কোয়ালিফিকেশন > ব্যাক টু হায়ার সেকেন্ডারি। উলফেন্ডেন এ এস পি’র এমারজেন্সি সামিট মিটিঙে ঠিক হলো যে কোচ সুভাষদাই এখন আমাদের ভরসা কারণ প্রফেসর দে, ওনার জামাইবাবু।
অনেক প্ল্যান করে প্রচুর বকা খাওয়া সত্ত্বেও আমি আরেকটা বাস্কেটবল ফ্রেন্ডলি ম্যাচের ব্যবস্থা করি, বেশ জাঁকজমক সহকারে। যেহেতু কলেজে তখন অন্য কোন ইয়ারের ছেলেরা নেই, তাই আমাদের ফাইন্যাল ইয়ারের সাথে বাইরের একটা টিমের ম্যাচ হবে। যেন আমাদের ফেয়ারওয়েল ম্যাচ, আমরাই আয়োজন করছি। সুভাষ’দার জন্য একটা ফ্রেড পেরির গেঞ্জি, আর কলেজের মেমেন্টোর ব্যবস্থা করা হলো, –একবারে শেষের কবিতা।
কিছু অধ্যাপক, এবং বিশেষ করে প্রফেসর দে’কে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। কেন এত আয়োজন (এবং আসল উদ্দেশ্য), সুভাষদাকে প্রথমে জানানোই হয় নি। খেলার শেষে সবাই সুভাষদাকে গিয়ে ধরলাম। সম্মিলিতভাবে একটাই অনুরোধ যে আপনি দয়া করে জামাইবাবুকে একবার রাজি করান, আমাদের সবাইকে ভালো নম্বর দিতে। নাহলে আমরা সবাই পথে বসব। সুভাষ’দা আমাদের কথা রেখেছিলেন আর প্রফেসর দেও ওনার.কথা রাখেন নি। মানে আমাদের সকলকেই ৭-৮ এর থেকে অনেক বেশি নম্বর দিয়েছিলেন। আমরা সবাই পাশ করেছিলাম।
ফাইন্যাল ইয়ারে আমি আর ডালমিয়া, দুজনেই কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে সিলেক্ট হয়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত খেলার সুযোগ হয় নি, কারণ তখন দেওয়ালে দেওয়ালে আবেদন এসেছে “বিপ্লব ত্বরান্বিত করুন”।
১৯৭০ সালের ন্যাশনাল বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপ আমাদের বাংলায় হয়েছিল। সেই প্রথমবার আমি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ দেখবো। খুবই উত্তেজনা ছিলো। মাঝেমাঝেই মাঠে যেতাম। সেবার বেঙ্গলের ওয়মেন’স টিম খুবই ভালো, আগের পাঁচ বছরের চ্যাম্পিয়ন। ওঁদের কোচ ছিলেন মিহির মুখার্জি, ইন্ডিয়া টিমের প্লেয়ার। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেরও কোচ ছিলেন। আমাদের সাথে পরিচয় ছিলো। একদিন আমাকে মাঠে দেখে বললেন যে মেয়েদেরকে প্র্যাকটিস দাও। বুঝলাম না, প্যাকটিস দেবো মানে কি? তখন বললেন, মাঠের দু’ধার দিয়ে খুব জোরে দৌড়তে হবে, তবে দেখিস বডি টাচ যেন না হয়। টিমের বেশিরভাগ মেয়েই এংলো ইন্ডিয়ান, আর ইংরেজিতে কথা বলে। বুঝলাম, বেশ কঠিন কাজ। কিন্তু না বলতে পারলাম্ না। ভয়ে ভয়ে ৫ মিনিট করে দুধারের বাউন্ডারি লাইন ধরে খুব জোরে দৌড়েছিলাম। বলতে পারেন মিক্সড বাস্কেটবল গেম, rare experience. ভালোয় ভালোয় সেই প্র্যাকটিস শেষ করেছিলাম। আগে ধারণা ছিলো না, সেদিন জানলাম যে মেয়েরাও খেলাতে এত চেঁচায়। মিহিরদাকে আমি পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এটা আমাকে দিয়ে কেন করালেন? মিহির’দার জবাব মেয়েদের স্পীড বাড়াবার জন্য। এরপর ভয়ে আমি বেশ কিছুদিন ময়দানে আর যাইনি।
ময়দানে খেলার সুবাদে বেশ কিছু ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। পুলিশ এথলেটিক ক্লাব প্রতি বছর আমাদের কলেজে প্র্যাকটিস ম্যাচে আসতো। তাই মাঠের সীমানায় পুলিশকে আর ভয় করতো না। দু’জনের নাম বিশেষভাবে মনে আছে, সৌম্য’দা আর আর্য’দা। দুজনেরই সুপুরুষ বলিষ্ঠ গঠন। সৌম্য’দা চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে কলকাতার রাস্তায় যখন মোটরসাইকেলে যেতেন, তখন হলিউডের রক হাডসনের চেহারাটা মনে আসতো। পুলিশও কিন্তু সহৃদয় হয়। একটা ঘটনা। কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়ে গেছি, ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে গেছি, টিকিট পেলাম না। এমন সময় সৌম্য’দার সাথে দেখা। উনি আমাকে মোটরসাইকেলে বসিয়ে এক্কেবারে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের গেটে এসে আমাকে মেম্বার’স গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। তখন পাস করে আমি কিছুদিন বড়বাজার যুবক সঙ্ঘের হয়ে খেলেছিলাম। আর অন্য নানান কাজেও ময়দানে আনাগোনা ছিলো। ওনাদের সাথে দেখা হলে ডেকে কথা বলতেন। আর বলতেন খেলাটা যতদিন সম্ভব যেন চালিয়ে যাই। কিন্তু একবার চাকরিতে ঢুকে গিয়ে আর বেশিদিন পারিনি। তবে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত খেলাটাকে চালিয়ে গেছি।
কলেজে খেলার মাথে দর্শকদের (ছাত্র) বিদ্রুপ (প্যাঁক) সব্বজনবিদিত। তবে সেই প্যাঁকে রসবোধটাই বেশি থাকে।তেমনই কিছু ঘটনা মনে পড়ে গেলো, না লিখলে লেখাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমাদের অজয়’দা (৬৯ মেকানিক্যাল) মাঠে থাকলে বেশ ভয় পেতাম। একবার হাওড়ার একটা টিমের সাথে ফুটবল ম্যাচ চলছে। ওঁদের টিমের একজন বয়সে একটু প্রবীণ, আর সাথেসাথে যেন কি কারণে ছটফট করছিলেন। অজয়’দা গ্যালারি থেকে আওয়াজ দিলো, “দাদু , অত দৌড়োবেন না।”
ভদ্রলোক অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে গ্যালারিতে এসে বললেন, “একবার খেলে দেখিয়ে দিন।“
অজয়দার তাৎক্ষণিক জবাব,”আগে আপনার মতো বয়স হোক, তারপর খেলব।” পরে শুনেছিলাম, ভদ্রলোক কিছুদিন পরেই খেলা ছেড়ে দেন, মানে খেলা থেকে রিটায়ার করেন।
এর সাথে আমাদের ব্যাচের একটা মারকাটারি প্যাঁকের টিম ছিল। সদস্যরা অমিয় সেন, শঙ্কর দাস, প্রণব দত্ত (মেকানিক্যাল), আর মেটালার্জির সুজিত সিনহা। অমিয়কে বলা যায় বিচ্ছু। আমাদের একটা ম্যাচে আমরা তখন হারছি, প্রণব আমদের ডিফেন্সের একজনকে চেঁচিয়ে বললো, “ওরে, তুই গোলের পিছনে গিয়ে দাঁড়া”। আমাকে একবার বলেছিলো, তুই অত দৌড়াদৌড়ি না করলেই ভালো ছিলো, তাহলে ওঁদের গোল দিতে আরও কষ্ট হতো। সেসব অতীতের দুঃখের কথা, তবে ভুলি নি।
আমার খেলোয়াড় জীবনে সবচেয়ে মধুর প্যাঁক খেয়েছিলাম যাদবপুরে খেলতে গিয়ে। এমনিতেই শিবপুর যাদবপুরের খেলা মানে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের টেনশন। তার উপর বাস্কেটবল খেলাটা আরও একটু বেশি চাপের। কারণ মাঠটা খোলা আর ছোটো মাঠ। দর্শকেরা খুব কাছে থেকে খেলা আর খেলোয়াড়দের দেখতে পায়। সেই একটা ম্যাচ খেলতে সবে নেমেছি, ঠিক তখনই এক তরুনী কণ্ঠের সুমধুর আওয়াজ পেলাম “এ যে Axis Xero” . বিশ্বাস করুন, বুক আর হাঁটু দুটোই কেঁপে উঠেছিলো। তবুও মাঠ কিন্তু ছাড়ি নি।
একদিন ময়দানে বড়বাজার অঞ্চলের বাসিন্দা কিছু মাড়োয়াড়ী ছেলে আলাপ করতে এলো। ওদের ল’ কলেজে নাম লেখানো আছে। জানতে চাইলো পাশ করার পর ল’কলেজের হয়ে খেলতে উৎসাহী কিনা। আমি জানালাম যে আমার সেরকম কোনরকম ইচ্ছে নেই, আর তাছাড়া কোনো পয়সাও খরচ করতে পারবো না। ওরা বলল যে, না ভর্তি হওয়ার দরকার নেই। এই বলে আমার আর বাবার নাম লিখে নিয়ে চলে গেলো। বলে গেলো, আবার দেখা করবে। কিছুদিন পরে আবার দেখা করতে এসে বললো, আমার খেলতে কোনো অসুবিধা নেই। ভর্তি হতে হবে না। কেননা, আমার নামেই অন্য একজন ছাত্র আছে, তবে বাবার নাম আলাদা। সুতরাং খেলার মাঝে যদি কেউ প্রশ্ন করে, তখন আমাকে নতুন বাবার নাম বলতে হবে। এরপর আমি আর এগোই নি। বাবার নাম বদল করার সাহস বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার ছিলো না।
খেলার মাঠে শুধু মজাই হয় নি। আরও অনেক কিছুই শিখেছিলাম, যা পরবর্তী জীবনেও কাজে লেগেছে। তার মধ্যে একটা কথা সারা জীবনের জন্য মনে গেঁথে রয়েছে। কলকাতা বাস্কেটবল ময়দানে একটা ম্যাচ দেখছি, কোন একটা টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ। খেলা শেষ হওয়ার পরে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের সময়ে যে ভদ্রলোক প্রাইজ দিচ্ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, “আজ তোমাদের কোনো best player এর প্রাইজ নেই” The reason, Everyone is at his best” এর চেয়ে বড়ো সত্য আর হয় না। শুধু খেলার মাঠে নয়, অফিসের প্রজেক্টের টিমের সাফল্য কিংবা আমাদের সময়ের যৌথ পরিবারের ভিত কিন্ত এই বাক্যটিই “””Everyone is at his best.”””
আমার কলেজ জীবনের পাঁচ বছরের পড়াশোনার চেয়ে “”ওভাল”” এর অবদান অনেক অনেক বেশি ।
“”জয়তু ওভাল “”।
Add comment