হকি নিয়ে কিছু কথা
ঋত্বিক দত্ত, ১৯৭৩ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
স্বপন ঘোষ দস্তিদার, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার, ১৯৭২ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
শুধু আমাদের ভারতবর্ষের নয়, আমাদের বিই কলেজেরও প্রথম দিকের হকির ইতিহাসটা খুবই উজ্জ্বল। কলকাতা হকি লীগের শুরুতেই ১৯০৫ সালে এবং ১৯০৬ সালে প্রথম দু’বছর বিই কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। একই সময়ে বিই কলেজ বেটন কাপ চাম্পিয়ন হয়েছিল ১৯০৫ সালেও। এইরকম গৌরবের ইতিহাস যেখানে জড়িয়ে আছে সেই মাঠে সেই ক্লাব ঘরে দাঁড়িয়ে আমদেরও গর্ব অনুভবের বেশ কারণ ছিল।
তবে ১৯৬০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক হকিতে ভারতের ভাগ্যসূর্য একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। তখনও পর্যন্ত অপরাজেয় ভারতের প্রথম হার সেবার রোম অলিম্পিকের ফাইনালে চির প্রতিদ্বন্দী পাকিস্তানের কাছে ১-০ গোলে। ওই খেলায় ক্যাপ্টেন ছিলেন কলকাতা কাস্টমস ক্লাবের লেসলি ক্লডিয়াস। ততদিনে তাঁর তিন তিনটে পর পর অলিম্পিক গোল্ড মেডেল পাওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেবার চতুর্থবারে সিল্ভারেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
যদিও আমি তখন স্কুলের নিচের দিকের ক্লাসে, তবুও ততদিনে আমি এই হার জিত গুলো বুঝতে শিখেছি। ২ বছর পর ১৯৬২ সালে দিল্লী এশিয়ান গেমস এ আবার ফাইনালে উঠে হার। এবারও পাকিস্তানের কাছে ২-০ গোলে। যদিও সেবার আমাদের সান্ত্বনা ছিল ফুটবলে। আমরা চুনী, পিকে, বলরাম, জারনেল, অরুন ঘোষ, থঙ্গরাজের সহায়তায় ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়া কে ২-১ গোলে হারিয়ে ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
এরপর হকিতে আমাদের হৃত গৌরব আবার ফিরে এলো ১৯৬৪ সালে টোকিয়ো অলিম্পিকে। ফাইনালে পাকিস্তানকে ১-০ গোলে হারিয়ে আমরা আবার স্বর্ণপদক পেলাম। এরপর থেকে ১৯৬৮, ১৯৭২, ১৯৭৬ আমদের হকি’র খারাপ্ সময়। পরের অলিম্পিক ১৯৮০ মস্কো অলিম্পিকে আমরা গোল্ড পেয়েছিলাম। সেটাই শেষ বার। এর অনেকদিন পরে ভারতীয় হকির আবার রিসারজেন্স হয় ২০০০ সালের পর কিন্তু সেটা অন্য গল্প। মোটের উপর আমাদের স্কুল কলেজ জীবনে আমরা সে ভাবে ভারতের সেই আগের গৌরবের জীবন প্রত্যক্ষ করতে পারিনি। এই নিয়ে পুরো ভারতবর্ষ তখন যথেষ্ট মনমরা হয়েই থাকতো।
হকি’র সাথে আমার প্রথম পরিচিতি অনেক ছোটবেলায় ১৯৬০ সালে, আমি যখন ক্লাস ফোরে। বেহালা ছাড়িয়ে ঠাকুরপুকুরের বিষ্ণুপুর শিক্ষাসংঘ ছিল আমাদের আবাসিক স্কুল। সেখানে সবরকম খেলারই ব্যাবস্থা ছিল। খেলার সমস্ত সরঞ্জাম স্কুল থেকেই আমাদের দেওয়া হত। তবে তখনো ফুটবল ক্রিকেট থেকে হকিকে আলাদা করে কিছু মনে হয়নি। সব খেলাই আমরা সমান আনন্দ নিয়েই খেলতাম। হকির প্রতি আসল ভালবাসাটা তৈরি হয়েছিলো নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে এসে আরও কয়েক বছর পরে।
আমার স্কুলের সময় মানে ষাটের দশকে আর কলেজের সময়ের ৭০ এর দশকে কলকাতার ময়দানে সব নামী নামী অলিম্পিয়ানরা খেলছেন। লেসলী ক্লাডিয়াস সদ্য অবসর নিয়েছেন। খেলছেন গুরুবক্স সিং, যোগীন্দর সিং, জাগনিন্দর সিং, ইনামুর রহমান, অশোককুমার, গোবিন্দ, গনেশ, ভি পেজ, এনারা। ময়দানের তথাকথিত বড় ক্লাব ছাড়াও ভালো টিম আছে যেমন কাস্টমস, বিএনআর, পুলিশ, রেঞ্জারস। আছে খালসা ব্লুজ, আর্মেনিয়ান্স এর মতন প্রবাসীদের টিম। তখন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ফার্স্ট ডিভিশনে খেলত, জ্যাভেরিয়ান্স নামে। বেঙ্গল ইউনাইটেড আর এন্টালি এসি প্রচুর প্লেয়ার তৈরি করছে।
সেই সময় দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে একটি নতুন ছেলে এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হলো, দু বছর উঁচুতে। নাম, অমিত বিক্রম দাশগুপ্ত। ওর ছোট ভাই পার্থবিক্রম আমার এক বছরের জুনিয়র। আমরা ধ্যানচাঁদের খেলা দেখিনি কিন্তু অমিত বিক্রমের তখনকার খেলা সামনে থেকে দেখার পর ব্যাপারটা খুব ভালোই আন্দাজ করতে পারতাম। পুরো সেন্টার লাইন থেকে শুরু করে এক একজনকে বল কাটিয়ে কাটিয়ে ফিনিশিং এ গোল করা যেন ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। আমরা ঝাঁপিয়ে পরেও ওকে আটকাতে পারতাম না। তবুও ওঁর খেলায় আমরা এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে ওঁর সাথে খেলার জন্য আমরা সবসময় মুখিয়ে থাকতাম।
হকির প্রতি আমার সেই ভালবাসা বিই কলেজে এসে আবার যেন প্রাণ ফিরে পেলো। আমার কলেজের সময়কাল ১৯৬৮-১৯৭৪ সাল (৭৪ মানে রাজনৈতিক আশান্তিতে কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়, মানে আমাদের এক বছরের শাস্তি বলা যেতে পারে)। খুব ঘটনাবহুল সময়। সৌভাগ্য ক্রমে প্রথম বছরেই হকি সীজনে কলেজের ওভাল মাঠে গিয়ে দেখলাম আমার মতন আরও অনেকেই, আমাদের ক্লাসেরও বেশ কয়েকজন এসে জড়ো হয়েছে। খুব উৎসাহ পেলা্ম। ভালো লাগলো। সবাই আমরা খুব তাড়াতাড়ি বন্ধু হয়ে গেলাম। কিছুদিনের প্র্যাকটিসেই আমাদের ফার্স্ট ইয়ার একটা এগারো জনের টীমও তৈরি হয়ে গেলো। সে বছর ফাইনালে ফিফথ ইয়ারের কাছে আমরা হেরে রানারস আপ হলাম। সবাই একটা করে কাপ আর সার্টিফিকেট পেলাম। এই উৎসাহটাই পরের চার বছর আমাদের একসাথে বেঁধে রেখেছিল। এরপর সেকেন্ড ইয়ার থেকে প্রতি বছরেই আমরা চাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
আমাদের ৬৮-৭৩ সালের ইয়ারের টিমে তখন অনেক ভালো ভালো প্লেয়ার ছিলো। শোভন চ্যাটারজি (সেন্টার ফরোয়ার্ড), গাৌতম মজুমদার (লেফট আউট), রঘুনাথ মিত্র (লেফট ব্যাক), পিটার লি (রাইট ব্যাক), ভাস্কর সেন (লেফট হাফ), আমি ছিলাম রাইট হাফ। এইরকম আরও অনেকে, আজ পঞ্চাশ বছর বাদে এখন সবার নাম মনে আসছে না। রঘু’র বাবা ১৯৪০-৪১ সালে আমাদের কলেজের হয়ে হকি খেলেছিলেন। তাই ওর একটা আলাদা সেন্টিমেন্টও ছিলো।
প্রথম বছরেই (১৯৬৮-৬৯) আমাদের খেলার সুযোগ এল খড়গপুর আই আই টির সাথে। সেবার আমরা খুব ভাল খেলেও ২-১ গোলে হেরে গিয়েছিলাম। আমাদের ক্লাশের দুজন কলেজ টিমে সুযোগ পেয়েছিল। শোভন আর গৌতম। এই দুজনেরই আগে স্কুলে থাকার সময় থেকেই স্কুল আর ক্লাবের হয়ে খেলার অভ্যেস ছিল। শোভন সাউথপয়েন্ট স্কুল আর গৌতম তীর্থপতি ইন্সটি টিউশন। আর সিনিয়রদের মধ্যে ছিল রথীন ব্যানারজি, চার্লি দা, কোহলি’দা, অমিতাভ সেন, প্রকাশ শ্রেষ্ঠ, স্বপন ঘোষ দস্তিদার, রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার, গুরুবচন সিং, অশোক মুখারজি। তখনকার কলেজ টিমের ফুটবলের স্ট্রাইকার জনি’দা। জনি’দার পুরো নাম জ্ঞানরঞ্জন ভৌমিক। ফুটবলে ওঁর দু’পায়ে ছিল সমান কিক করার ক্ষমতা ছিল যেটা হকি গোলকিপারের জন্য খুব দরকার। তাই জনি’দাকেও গোলকিপিং এ টিমে এসে গেলো। ওদিকে স্বপন’দা তখন কোলকাতা হকি লীগের ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে, বেঙ্গল ইউনাইটেদের হয়ে। লীগের একটা ম্যাচে স্বপন’দা মাথায় চোট পায়, আর কলকাতা ময়দান থেকে পিজি হাসপাতালে গিয়ে স্টিচ করিয়ে আনতে হয়। অশোক’দার (মুখার্জি), বিশাল চেহারার জন্য তাকে আমরা ডাকাত মুখারজি নামেও ডাকতাম। (এই ডাকাত মুখার্জী পরে বাংলা সিনেমায় দু’একটা ছোট রোলে অভিনয় করেছে)। হকি না হলেও একজনের নাম উল্লেখ করবো, অজয় দেবনাথ ১৯৭০ সালের। বিই কলেজের পাঁচ বছরে পড়াকালীন এথলেটিক্স ক্লাবের ট্র্যাক আর ফিল্ড ইভেন্টে একের পর এক পুরনো রেকর্ড সব সে ভেঙে দিলো।
পরের বছর ১৯৬৯ সালে আমাদের কলেজেই প্রথম উইন্টারমিটে্র আয়োজন করা হলো। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম সারির পাঁচটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ অংশ নিয়েছিল। আমরা ছাড়া আর ছিল যাদবপুর, দুর্গাপুর, জলপাইগুড়ি, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, তারাতলা। তাঁদের সমস্ত অংশ গ্রহণকারী ছাত্রদের আমাদের বিভিন্ন কলেজ হস্টেলেই থাকা ও খাওয়ার সম্পূর্ণ ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। সেই ক’দিন পুরো ক্যাম্পাসে একটা্ উৎসবের মেজাজ এসে গিয়েছিলো। সেই সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। তখনই আবার আমাদের কলেজ হকি টিমের হয়ে খেলার সুযোগ এলো। আমরা খুব ভালো খেলে ফাইনালেও উঠেছিলাম। কিন্তু তখনকার অমিত বিক্রমের বিক্রমে যাদবপুরের কাছে আমরা বড় ব্যবধানেই হারলাম। বলা যায়, সে একাই আমাদের হারিয়ে দিলো।
এরপরেই শুরু হল সত্তরের গণ্ডগোলের সময়। বেশ কিছুদিনের জন্য কলেজ বন্ধ হয়ে গেলো। সাথে খেলাধুলাও বন্ধ। তার বছর দুয়েক পর ১৯৭১-৭২ সাল থেকে আবার সব কিছু স্বাভাবিক হলো, খেলার পরিবেশ আবার ফিরে এলো। আমাদের সমস্ত কলেজের ভেতরের ইন্টারইয়ার টুর্নামেন্টগুলো শুরু হল। ততদিনে অনেক সিনিয়র প্লেয়ারই পাশ করে বেরিয়ে গেছে। অমিতাভ সেন, স্বপন ঘোষ দস্তিদার, রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার, গৌতম মজুমদারের মতন কয়েকজন তখনও আমাদের সাথে ছিল। এইসময় আমাদের ব্যাচেরও আরও কয়েকজনের কলেজ টিমে জায়গা হলো। এর সাথেসাথেই আমাদের পরের ব্যাচের নতুন ছেলেরাও আসতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল মানিক ব্যানার্জি। তারও পরের ব্যাচে ছিল কৈলাস মল্লি্ক (৭৫), বিনিময় দত্ত (৭৬) অমিতাভ জানা (৭৬), দেবব্রত দত্ত (৭৬)। আবার নতুন উৎসাহে, ভালো খেলার সুবাদে, এবার আমাদের কোচিং এর জন্য কলকাতা ময়দান থেকে একজন প্রফেশনাল কোচের ব্যাবস্থা করা হলো। এক শিখ পাঞ্জাবি, পুরনো দিনের খেলোয়াড় সপ্তাহে দু’ দিন আসতেন, আর আমাদের এক ঘণ্টা করে প্র্যাকটিস করাতেন।
সব স্বাভাবিক হবার পর ১৯৭৩ সালে আবার দ্বিতীয়বার উইন্টারমিটের আয়োজন করা হল। এবারও আমাদের কলেজেই। এবারও আগেরবারের মতই চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এসেছিল। আর এবারও আমরা আবার ফাইনালে উঠেছিলাম, কিন্তু যাদবপুরের সাথে ড্র করে আবারও রানারস আপ হয়েছিলাম। এই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনাল খেলার সময় একটা ঘটনা ঘটলো। দুর্গাপুর আর ই কলেজের সাথে খেলা। আমাদের বিক্রমজিত’দার মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে খেলেছিলো। আর জিম’দার (অচিন্ত্য ভট্টাচার্য্য) পায়ে চোট ছিলো, খেলতে পারে নি। সুনীলদাও (পুরো নাম জানি’না) টিমে ছিলো।), খেলা শুরুর ঠিক আগে আমরা যখন মাঠে নেমে গা গরম করছি তখন হঠাৎ আমাদের নির্ভরযোগ্য স্টপার অজয় সরকার মাথায় চোট পেলো। আমরা একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রক্তপাতের জন্য। কিন্তু অজয় কিছুক্ষনের মধ্যেই ফার্স্টএইড করে মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে এসে আবার খেলা শুরু করলো প্রথম থেকেই। সেই খেলা জিতে আমরা ফাইনালে উঠেছিলাম এবং তাতে অজয়ের অনেক আবদান ছিল।
এতদিনে আমাদের কলেজ হকি টিম মোটামুটি একটা ভালো অবস্থায় এসে গেছে। এবার বাইরের টুর্নামেন্টে খেলার ভাবনা শুরু হল। শুনলাম আমরা কলকাতা হকি লিগের থার্ড ডিভিশনে খেলার জন্য রেজিস্টার্ড হয়েছি। খুবই আনন্দের খবর। সেই প্রথম আমাদের ময়দানে যাতায়াত শুরু, মহাম্মেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ঠিক উলটো দিকে ইউনিভার্সিটি গ্রাউণ্ডে খেলার জন্য। সে এক আনন্দের সময়, কোনোদিন ভুলতে পারবো না। বাইরের কোন টুর্নামেন্টে কলেজের হয়ে খেলছি, আর শুধু খেলা তো নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে আরও অনেক কিছু। আমাদের যাতায়াতের ভাড়া, খেলার পরে টিফিন ইত্যাদির জন্য অর্থও বরাদ্দ হয়ে গেল। পুরো খরচাটাই হতো ক্যাপ্টেনের হাত দিয়ে। খেলার দিনে দুপুরে হস্টেলে খাওয়া হয়ে গেলে সবাই একসাথে ফার্স্ট গেটের কাছে জড় হয়ে, তারপর বাসে করে মল্লিক ফটকে নেমে, ষ্টীমারে গঙ্গা পার হয়ে, আমরা ইউনিভার্সিটি গ্রাউণ্ডে পৌঁছতাম সাড়ে তিনটে নাগাদ। এই বাবুঘাট থেকে মোহনবাগান ক্লাবের পাশ দিয়ে পুরো রাস্তা আমরা সকলে একসাথে দল বেঁধে হেঁটে পার হতাম। তারপর তৈরি হয়ে ম্যাচ শুরু হত সাড়ে চারটে নাগাদ। ছয়টার আগেই খেলা শেষ হয়ে যেতো। তারপর আবার ড্রেস চেঞ্জ করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যেতাম এসপ্ল্যানেডের নিজাম রেস্টুরেন্টে। সেখানে বসে সদ্য খেলার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা সহ রোল খেয়ে চা খেয়ে আবার বাসে করে কলেজে ফেরা। এর অনেক অনেক দৃশ্য আজও আমার চোখে ভেসে ওঠে।
আমরা প্রায় ২-৩ বছর ওই কলকাতা থার্ড ডিভিশনে হকি খেলেছিলাম প্রায় একই টিম নিয়ে। এইজন্য আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটাও খুব সুন্দর তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা সেই সময় অনেক ক্লাবের সাথে খেলেছিলাম, কিছু কিছু নাম মনে আছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম এন্টালি এথলেটিক ক্লাব, ঐক্য সন্মিলনী, খালসা স্পোর্টিং, তালতলা স্পোর্টিং, ছোটনাগপুর স্পোর্টিং ইত্যাদি। এদের আনেকের সাথেই আমরা যেমন জিতেছিলাম আবার অনেকের কাছে হেরেও ছিলাম। তবে আমরা কখনওই চ্যাম্পিয়নশিপের দূরত্বে ছিলাম না। খেলার আনন্দটাই আমাদের অভিভুত করে রাখতো।
১৯৭৩-৭৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন হকি টিম ট্রায়ালে আমাদের কলেজকেও ডাকা হলো। মানে আমরা তাতে অংশ গ্রহণের সুযোগ পাবো। ট্রায়ালের জন্য আমরা সবাই নির্দিষ্ট দিনে ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ডে গিয়ে উপস্থিত হলাম। কিন্তু ততদিনে আমাদের সকলের ফাইনাল পরীক্ষার সময় এসে যাচ্ছিল, সুতরাং সেই সময় আর পুরো সীজন ডেট অনুসরণ করে খেলা সম্ভব ছিলনা। তাই আমরা এরপর সেই বছর আর ময়দানে খেলিনি। তবে আমাদের থেকে শর্টলিস্টেড হয়েছিলো আমাদের ব্যাচের পিটার লী, রঘু, গৌতম মজুমদার, ’৭৪ ব্যাচের মানিক ব্যানার্জী, ’৭৫ ব্যাচের কৈলাস মল্লিক, আর ’৭৬ ব্যাচের তিনজন বিনিময় দত্ত, দেবব্রত দত্ত আর অমিতাভ জানা। এতজনের শর্টলিস্ট হওয়াটাও প্রতিষ্ঠানের গৌরবের ব্যাপার।
সত্যি কথা বলতে কি, বাইরের কথা ছেড়ে দিলেও আমাদের হকি খেলাটা কলেজের ভেতরেই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। পুরো সীজন বলতে প্রায় তিন মাস জানুয়ারি থেকে মার্চ। তার আগে ক্রিকেট আর পরে ফুটবল। এই তিন মাসের ভেতর পাঁচটা ইয়ার টিম, আর একটা এম ই টিম, মোট প্রায় ছ’টা টিমের মধ্যে লীগ আর নকআউট ধরলে অনেকগুলো খেলা এমনিই হয়ে যায়।
অন্য খেলা বলতে ভলিবল, বাস্কেটবল খেলাও হতো একই সময়ে। একবার এমন হয়েছিল যে আমরা ভলিবল ম্যাচে ১-০ জিতে পরের গেমেও অনেক এগিয়ে আছি আর একটু এগোতে পারলেই আমরা ২-০ জিতে ম্যাচ জিতে যাবো। ঠিক সেই সময় পাশেই চলতে থাকা হকি ম্যাচ শেষ হলো আর সেখান থেকেই একজন ভাল প্লেয়ার এসে যোগ দিল আমাদের প্রতিপক্ষ টিমে। তার অত্যন্ত ভাল খেলার জোরে আমরা শুধু যে আমাদের জেতা গেম হেরে গেলাম তাই নয় পরের গেমটাও খুব বাজে ভাবে ২-১ ব্যবধানে হেরে গেলাম। আসলে যেটা বলার ছিল সেটা হল যে এই নানানরকম খেলাধুলো নিয়ে ওভাল মাঠটা সারা বছরই ভরে করত। আমরা কলেজের ভেতরেই স্বয়ং সম্পূর্ণ ছিলাম। আর এর তদারকিতে এথলেটিক্স ক্লাবের যে যে ইন্সট্রাকটররা পুরো ব্যাপারটা দেখাশোনা করতেন তাঁরাও আমাদের কাছে অন্যান্য শিক্ষকদের মতই সন্মান পেতেন। স্পোর্টস স্যার দেবেশদা আর গ্রাউণ্ডসম্যান রামজীবন এদের অনেক অবদান ছিল এই কর্মকাণ্ডে। সমস্ত জার্সি, খেলার সরঞ্জামের হিসেব রাখা, কেচে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, প্রতিটা ম্যাচের হাফ টাইমে ড্রিংক্স (জল) এর ব্যাবস্থা করা, প্রতিটা ম্যাচের শেষে দুটো টিমের পনেরো পনেরো তিরিশজনের জন্য সেকেন্ড গেট থেকে কোল্ড ড্রিংক্স (কোকাকোলা) আনিয়ে পরিবেশন করা, সবটাই ছিলো এলাহি কাজ।
এই সময় সেকেন্ড হাফের ক্লাস কাট করে ঘন ঘন ময়দানে গিয়ে ওখানকার ফার্স্ট ডিভিশনের খেলাগুলো দেখাও আমাদের অনেকের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মোহনবাগানের কোন খেলাই আমরা মিস করতে চাইতাম না। ওইখানেই আমরা আবার অমিতবিক্রমের খেলা দেখি মোহনবাগানের হয়ে। ১৯৭১ -৭৪ এই তিন চার বছরে আমরা অনেক ভাল প্লেয়ারের খেলা দেখেছিলাম। তাদের মধ্যে নাম করা অলিম্পিয়ান ছিলেন গুরুবক্স সিং, অশোক্কুমার (ধ্যানচাঁদের ছেলে), গোবিন্দা, ভি পেজ। ষাটের দশকের লেসলি ক্লাডিয়াস ছিলেন কাস্টমসে। ইনামুর আর ইক্রামুর রহমান (দু’ভাই), মোহনবাগানে। বিএনআর টিমে যোগীন্দর সিং। কলকাতা হকি লীগে তখন অনেক নক্ষত্র। ষাট বছর পরে সব নাম আজ আর মনে আসে না। মোহনবাগান তখন ১৯৬৯-১৯৭২ সাল পর পর চারবার লীগ চাম্পিয়ন হয়েছিল। চির প্রতিদ্বন্দী ইস্টবেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো ১৯৬৯ আর ১৯৭৪ সালে। তবে ফুটবলের সাথে হকির মাঠের চেহারায় একটা বড় পার্থক্য ছিল। ফুটবলের সময় বৃষ্টির জন্য মাঠের অবস্থা প্রায়ই খারাপ থাকলেও হকির সময় সেরকম কোন ব্যাপার ছিলনা। মাঠ সব সময়েই শুকনো খটখটে আর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
• তথ্য সহযোগীতায়:
স্বপন ঘোষ দস্তিদার, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং,
মানিক ব্যানার্জি, ১৯৭৪ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
*******
Swapan Ghosh Dastidar, of 1971 Civil Engineering adds,
Ritwik had placed some good stuff, but he missed the very fact that why in B.E. College the culture of hockey abolished totally after winning even Beighton Cup. When I joined B.E. College, there was no culture of hockey except some worn-out sticks at one corner of our Gym. Yes, some “ele-bele” game between different batches used to be arranged where some batches cannot even put up a bunch of 11 players.
Before I come to the subject, let me share that my interest in hockey started when I was in class VIII, IX, at our club Kallol at Ekdalia Park, Calcutta and by the time I was in class XI I started my training with Dipu Ghosh, the Bengal captain playing for Railways. The whole team of Bengal United Club was raised by him from local boys of Ekdalia, Farn Road, Kankulia, Southern Avenue, I mean mostly from South Calcutta. All along I played for the Bengal United Club right through Calcutta hockey’s third division, second division, and finally the First Division.
On joining BE College, I could be in the college team in my very first year itself, due to Kohli Da, who was the captain to go to IIT and play. In second year, I again approached our Proctor requesting him for getting B.E. College registered in Calcutta third division hockey league. It fructified in my third year when I was playing in the First division, and obviously became the captain of our college team. This was possible only due to the whole-hearted support of Prof. Jadhab Lal Chakrabarty of our Mining Engineering department. It was Prof. Chakrabarty and my constant persuasion with Bengal Hockey Association
I was a College Blue from 2nd year till 5th year. And Calcutta University Blue in 1970 and 1971. I played inter University in Rajnandgaon in MP (now in Chattisgar). Most of our Calcutta University boys were my Club mate studying in Asutosh College and I was the loner from BE College. Vase Pase was then a student of The Medical College. I was a team member of my clubs winning Lagden Shield and Kaivan Cup (the league and knock out tournament of Bengal Hockey Association, the BHA). I had received medals from General Dias, the Governor of West Bengal. I had the privilege to access all the games of Calcutta First division hockey league and Bengal Hockey Association knock out shield, except the Exhibition matches. This helped me to come close to many Olympians playing for Railways, Customs, Rangers, Ports, Armed forces, BSF etc. My Idol was Ajit Pal Sing of Western Railways, the Center Half of Indian Team. My last game was against Mohan Bagan club, and I am sharing the coverage in Calcutta daily The Statesman.
During college days, I was playing in Calcutta second division club. However, my involvement in Calcutta league had the problem to balance between my studies, and my interest in hockey, to be precise in regular practices. My practice was getting hampered, so I had to bunk classes now and then to reach Maidan on my own. Our Procter (Sri Chatterjee) was not much interested in supports due to low participation of boys.
Now the problem cropped up as to how I can play, representing a first and a third division club simultaneously. So, I used to play in Ranjan’s name, my younger brother who was also a good hockey player and a regular member of our college team. I was almost identified on the last game of our third division league play, but fortunately the objection was raised after the final whistle. As I was through with the rules, I could turn down the objection that final whistle is blown, and the game is over.
I had the opportunity to play opposite Olympian Ashok Kumar, Govinda, Gurbax Singh, Joginder Singh etc. I personally took tips from Lesli Claudious at Rangers ground. He was one of the patrons then of the club. and my idol was Ajit Pal Singh, the Indian captain who was playing for western Rail and have seen him playing at Mohan Bagan Ground. This ground was my favourite and I cherished all the games against Mohan Bagan.
Then we received a separate budget for the hockey, and unrestrained permission to use our collage bus (Murir Tin, as it was traditionally called) with deputation of one Mali (Narsing) exclusively with me. With a handsome budget I could get two dozen of Chakraborty make hockey sticks from G.K. Sports at Esplanade. On practice days at Oval we will have Fanta, and Channar Payesh from Jethamasai sweet shop.
We used to start for Maidan on game days and really had the fun. The pocket money was utilised with good tiffin at Nizam Restaurant (cucumber onion salad, two paranthas with seek kabab of lean meat). Probably when I passed in ’71, the next batches could not continue with division games due to huge disturbances at the campus.
I am having lot of fond memory of Prof Jadhav Lal Chakrabarty. He was a true patron of sports and helpful to that he never let me down on various crisis. As I said earlier, I had faced the problem to balance my study, my exams etc. I had mentioned that I had to skip lot of classes for playing in Division hockey. So, I became a non-collegiate in my third year and got cleared on the last day and got my admit card to sit for the final exam. It went to the extreme when I became dis-collegiate in my fourth year. I could not attend classes after lunch and couldn’t attend most of the classes of Prof Dasgupta, the then HOD of higher Maths. I almost lost one year, but due to personal intervention of Prof Jadhav Lal Chakrabarty, I got cleared by Prof Durga Banerjee when he informed our Principal that this boy is a brilliant student as per his performance in last three years result and he is 4 times College Blue and also a Calcutta University Blue.
To balance my studies, to be precise to pass and move on to the higher classes, of course, I had my private tutors, Swapan Bhushan Ghosh Dastidar, my room-mate with almost same name who later went to Indian Railway Service (late), and Suprasad Mukherjee, the First boy of our Civil batch, etc. They took care of mine to teach and guide whole heartedly.
So, that’s all.
I could enjoy the whole College life and my love for Hockey to the hilt.
**********
হকি কথা।
রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার, ১৯৭২ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
হকি কথা। সে এক কলেজ ছিল বিই কলেজ। এখানে সেই কলেজের কথা। আই আই ই এস টি র নয়। সে কলেজে আমি পড়িনি, খেলা দূর অস্ত।
কলেজ টিমে খেলেছি। একটু গর্বের টক ঝাল এখনও আছে। আর আছে নানান রকম স্মৃতি। মনে আছে সেই সব স্মৃতি, সন তারিখ মনে নেই। সেই সব গল্প বলেই ফেলি।
কলেজের হয়ে খেলার একটা ইচ্ছে তো মনের মধ্যে ছিলই। কারন মেজদা খেলছে। ও আমার থেকে অনেক ভালো খেলে ঠিকই, কিন্তু আমরা ক্লাব টিমে তো একসাথে খেলেছি। তাহলে এখানে কেন নয়?
ক্লাস করা গোল্লায় গেল। চারটের পর থেকে ওভালে। এর পরিণতি কি হবে আমার আন্দাজ ছিল না। একদম ডিসকলেজিয়েট হয়ে গেলাম। হাতে পায়ে ধরে ছাড় পেলাম। কলেজ আর ইয়ার টিমে নাম না থাকলে যে কি হত কে জানে!
এবার শুরু হল আরো নিবিড় প্র্যাক্টিস। আর তখনই ঘটল অঘটন। নিয়ম ছিল বল হাঁটুর নীচে থাকবে। কোথায় কি? একেবারে বাঁ চোখে। আমার ক্লাস এইট থেকে চশমা। মাসকাবারি মার খেতাম চশমা ভাঙ্গার জন্য। সেদিক থেকে আমি বীরপুরুষ। ৫৫ এ বসে আমার ভয় চোখটা ঠিক আছে তো? সেই যে চোখে রুমাল চাপা দিয়েছি একেবারে আমার ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ওনার কথায় খুললাম। উনি দেখে বললেন বাহ, সব ঠিক আছে। কিন্তু এবার হকি খেলাটা ছেড়ে দাও। এম্নিতেই তোমার বাঁ চোখটা নিয়ে আমি চিন্তিত। রেটিনা ডিট্যাচমেন্ট হলে মুশকিল। মাথা নীচু করে খেলা তো। আমি আর মেজদা চুপি চুপি বাড়ির পথে চললাম।
এর পরের আমাদের আদরের মুড়ির টিনের কথা বলতেই হবে। এই বাসটি কবে কেনা হয়েছিল কেউ জানেনা। এখন যে সব বাস আমরা দেখি তাদের মুখটা ফ্ল্যাট। এর একটা বেশ টিকোলো নাক ছিল। দুপাশে লম্বা টানা বেঞ্চ। আর মাঝখানেও একটা টানা বেঞ্চ। বাস চললেও গড়িয়ে পরতে হবে, থামলেও। গদি হয়ত কোন কালে ছিল, এখন নেই। আমাদের অসুবিধে নেই। আমরা আড্ডা মারতে মারতে যাব ময়দান। তারপর হা ক্লান্ত আমাদের কে মুড়ির টিন নিয়ে যাবে নিজাম। আমাদের মাথা পিছু আটআনা বরাদ্দ। গোস্ত করে দিলে দুটো আসত, না হলে একটা। বেশির ভাগ দিন আমরা তাই করতাম। আজকের দিন হলে কি হত কে জানে!
খেলা হত এবড়ো খেবড়ো মাঠে। বড় বড় ঘাস। ফলে আমাদের বল কন্ট্রোল বাড়ল। বিরক্তি কি হত না? হত। নিজেদের সান্ত্বনা দিতাম। অমিতাভ’দার স্টিকে বল পড়লে কেউ নিতে পারতো না ওভালে, এখানে পারতাম। তাতেই আনন্দ। আর ছিল রথিন ব্যান। রঙ্গিন মানুষ। খুব একটা যে ভালো খেলত তা নয়, তবে দলে থাকলে মজাই মজা। দুজনেই আমাদের সিনিওর। শুনে ছিলাম রথিনদা জাহাজি। অনেক দিন বাদে বম্বে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে দেখা হয়েছিল। আমাকে চিনতে পেরে ডেকে নিল। অনেক আড্ডা হল সেদিন। তাতে আমাদের হকিও ছিল।
আমাদের স্মৃতি চারণে এল মোহনবাগানের সাথে ফ্রেন্ডলি। মোহনবাগানের সেই টিমে ছিলেন লেসলি ক্লডিয়াস, গুরবক্স সিং আর ভেস পেজ। এনারা সবাই অলিম্পিয়ান। আমাদের এখনকার টিমের মত হেরো টিমের প্লেয়ার নয়। দেখলাম ক্লডিয়াস একটু হাইটে ছোট। খেলায় জোশ কম। ওরা বল নিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে যেন বলটা ছেড়ে দিল। আমরা তো আর লুজ খেলছি না। যদি একটা গোলও দিতে পারি…।। হঠাত দেখা গেল মেজদা গুরবক্সকে পেরিয়ে গেছে। বল টুপ্টাপ করতে করতে ডান দিক দিয়ে ছুটছে। ক্লডিয়াস মেজদাকে থামাতে এলেন। মেজদা একদম বাঁ দিকে বল পাঠাল আমাকে লক্ষ্য করে। বল রিসিভ করেছি। সামনে ভেস পেজ। টপকাতে পারলে ডি তে ঢুকে পড়ব। আমার হার্ট বিট ২০০ হবে। রিভার্সে ধরেছিলাম। ছোট্ট ট্যাপে ডানদিকে পেজ একটু বেসামাল দেখেই বল গলিয়ে দিলাম পায়ের ফাঁক দিয়ে। এবার ওনাকে টপকে যাব। পড়ে গেলাম ওনার স্টিকে হোঁচট খেয়ে।
পেজ আমাকে হাত ধরে তুললেন। বললেন “এটাও তো শিখতে হবে। বাড়িয়ে দেওয়া স্টীক কি করে টপকে যাবে। বেটার লাক নেক্সট টাইম”।
এখন তো কত রকম অলিম্পিক। সেকালে একটাই ছিল। তবে আমরা একটু স্বাদ পেয়েছিলাম আমাদের বি ই কলেজের শীতকালীন অলিম্পিকের মাধ্যমে। অংশ গ্রহণে যাদবপুর, আমরা শিবপুর, আই আই টি খড়গপুর, দুর্গাপুর আর তারাতলা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং। আর কোন কোন কলেজ ছিল মনে নেই। যাদবপুর এ প্লেয়ার কোটায় ছেলেরা পড়ত। ওদের জেতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
কলেজে প্রচুর বাইরের লোক। দুঃখ হল মেয়ে নেই। নুন কম পড়ে যাচ্ছে না সব্জিতে?
আমাদের আর দুর্গাপুরের মধ্যে ফারাক গড়ে দিল চিকেন। আসল নাম জানিনা। পঞ্চাশ বছর হয়ে গেলো, সেই উইন্টার মিটের লোকের মুখে মুখে ফেরা নামটাই মনে রেখেছি। এত জনপ্রিয় যে চারিদিকে চিকেন চিকেন আওয়াজ। রোগা পাতলা ঐ চেহারায় কত যে হর্স পাওয়ার থাকতে পারে কেউ আন্দাজ করতে পারে নি। দুর্গাপুরের সব টিমে চিকেন। কোন কোন টিমে ক্যাপ্টেন। ফুটবল খেলল। কেউ একজন অসুস্থ হলেই ঠেকা দিয়ে দিল। হকি মাঠে আগুন লাগিয়ে দিল। তারপরে বাস্কেটবল। আমরা একটা হকি ম্যাচ খেলেই, এক্সট্রা টাইম হলে ভাবনায় পড়ে যেতাম। এদিকে চিকেন অবলীলায় খেলছে।
এর চুড়ান্ত দেখা গেল ফাইন্যালের দিন। আমি অন্য কোথাও নেই। চিকেনের হ্যাংলা ফ্যান। ওর পেছন পেছন ঘুরছি। হকি ফাইনাল খেলল। আজ ওর টিটি ফাইনাল। বাস্কেট বল থেকে ছুটকারা চাইল। পেল না। হিসেব বলছে, ওখানে ওদের পয়েন্টস থাকলে ওরা এগিয়ে থাকবে। চল, ঠিক আছে। পরের ম্যাচ ওর সিংগলস টিটি ইভেন্ট এটা টিম। ও খালি অনুরোধ করল, ম্যাচটা আট্ট্যয় শুরু করা যায় কিনা। ডিফেন্ড করে সেই বল নিয়ে ছুটে স্কোর করতে হলে বুকের কলজেতে যে কোটা হাওয়া থাকতে হয় সেটা আমার আন্দাজ আছে। বার বার তাই করে জেতাল!! তার পর একদম জিভ বার করে মাটিতে বসে পড়ল। ওদের থেকে আমি বেশি উদ্বিগ্ন।
খেলা শুরু হল। ওদিকে বেঙ্গল নাম্বার তিন। একদম তাজা। এদিকে আমার হিরো চিকেন। যাদবপুর ৮-১ এ এগিয়ে গেল। চিকেন খেলার গতি কমিয়ে দিল। টপ স্পিনের ওপর খেলা চলছে। বলে র্যাকেট ছোঁয়ালেই সোজা নেটে। এইবার ওদিক থেকে স্ম্যাস, এদিকে চিকেন দশ ফুট পিছিয়ে আছে। ঠান্ডা মাথায় বল টস করছে,আকাশ ছুঁয়ে বল পড়ছে নেটের ওপারে আবার স্ম্যাশ আবার টস। চলছে র্যালি। যাদবপুর ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। চিকেন দম পাচ্ছে। র্যালি চলছে কুড়ি, তিরিশ, চল্লিশ। আম্পায়ার খেলা থামিয়ে বললেন যে ভাবে চলছে সারা রাত চলবে খেলা। তখন রাত সাড়ে দশটা। যে সারভ করছে তাকে দশটার পর কিল করতে হবে। না হলে পয়েন্ট অন্য দিকে। আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম চলবে না, চলবে না।
আমার হকির কথা শেষ। কিছু আনুষাঙ্গিক কথাও লিখে দিলাম।
Add comment