সাহিত্যিকা

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

ছোটবেলায় শরৎকাল টের পেতাম ঘাসের ওপর শিশিরকণায় আর খোলা মাঠে কাশফুল দেখে। বড় হয়ে কাশফুল দেখি রুপোলী পর্দায় অপু আর দূর্গার সাথে। সে দূর্গা আর এ দূর্গা এক নয়, সে অভাগিনী একটি মেয়ে আর ইনি জগজ্জননী। এনার আগমনের প্রতীক্ষায় আপামর বাঙালী, এমনকি উত্তর ও পশ্চিম ভারতের লোকও সারা বছর নবরাত্রির কয়েকটি দিনের জন্য অপেক্ষা করে।

দক্ষিন ভারতে দূর্গাপুজো বা নবরাত্রির সেরকম চল নেই। রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের সময় শ্রীরামের অকালবোধনের কারনে কিনা জানা নেই। কাল কি আশ্চর্য শক্তিশালী, একটা জাতির পুজোর ইতিহাসকেই বদলে দিলো। না হলে বাঙালীর দূর্গাপুজোর দিনক্ষন এভাবে আমূল বদলে যায়! পুরাণে বলে চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের বাসন্তী পুজোই প্রকৃত দূর্গপুজো। রাজ্য হারানো রাজা সূরথ সমাধি নামক এক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে বসন্তকালে ঋষি মেধসের আশ্রমে দূর্গা মুর্তি গড়ে তার আরাধনা করেন, যা বাসন্তীপুজো নামে পরিচিত হয় এবং সেটাই চলতে থাকে যতদিন না রামচন্দ্র সীতা উদ্ধারের সময় শরৎকালে আশ্বিনমাসে দেবীর অকালবোধন করেন।

অকালবোধনই হোক বা বাসন্তীপুজো, আমাদের দূর্গাপুজো দেবতার আরাধনার চেয়েও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন হিসেবেই বেশী পরিচিত। মহালয়ায় স্তোত্রপাঠ থেকে শুরু করে মন্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা, ঢাকের আওয়াজ, নতুন নতুন সাহিত্য পত্রিকা, নতুন জামাকাপড়, সপরিবারে মায়ের কৈলাশ থেকে আগমন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধুনুচি নাচ, সারারাত ধরে ঠাকুর দেখা ও নানারকম খাবারের স্টল মিলে আমাদের এ শুধু ঠাকুর পুজো নয়, সামগ্রিকভাবে একটি উৎসব।

এই আনন্দের দিনগুলোতে আমরা সবাই এক হয়ে উৎসবে মেতে উঠি, মানবজাতির মঙ্গলকামনা করি, অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য আদ্যাশক্তির আরাধনা করি আর চারপাশের মানুষগুলোকে মানুষের মতো দেখি।

দুর্গাপূজা এখন আর পুজোয় সীমাবদ্ধ নেই, আমরা এখন দুর্গোৎসব পালন করি। হিন্দু দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি মহা উৎসব। পুজোর মাসখানেক আগে থেকেই সাজ সাজ রব ওঠে। তাই আজ বাংলা ও বাঙালি সমাজে এটি এখন প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা নামে এবং চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। শারদীয়া দুর্গাপূজার জনপ্রিয়তাই বেশি। বাসন্তী দুর্গাপূজা মূলত কয়েকটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করা হয়। মহালয়া বা পিতৃপক্ষের দিন থেকেই মূলত দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিক উৎসবের সূচনা হয়, যদিও এ দিনটির তাৎপর্য মূলত ভিন্ন। এই তিথিকে পিতৃপক্ষও বলা হয়ে থাকে। এই দিনে পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের শুরু হয়। এই মহালয়া তিথিতে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের স্মরণ করি, পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করি। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকেই মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষেরও শেষদিন এটি। মহালয়াতে যারা নদীতে অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্মার শান্তির জন্য, তারা শুধু পূর্বদের নয়, পৃথিবীর সমগ্র শুভ ও শান্তির জন্যও প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন। যাদের পুত্রকন্যা নেই , যাদের কেউ নেই আজ স্মরণ করার তাদের জন্যও অঞ্জলি প্রদান করতে হয়।

এ সম্পর্কে মহাভারতে একটি কাহিনী বর্ণীত আছে যে: প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তার পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।এই কাহিনির কোনো কোনো পাঠান্তরে, ইন্দ্রের বদলে যমকে দেখা যায়।

আমাদের শাস্ত্রে পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষ নিয়ে এরকম অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে।

এই শারদোৎসবের শুভক্ষনে আমরা সাহিত্যিকা পত্রিকার তরফ থেকে আমাদের সকল লেখক, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের আমাদের শ্রদ্ধা জানাই।

– সাহিত্যিকা সম্পাদকমন্ডলী
– সরসিজ মজুমদার, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
– অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
– সোহম দাসগুপ্ত, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
– শ্রুতি গোস্বামী, ২০০৪ আর্কিটেকচার

Sahityika Admin

Add comment