সাহিত্যিকা

পুনরাগমনায়চ

পুনরাগমনায়চ
বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

এবারে যখন মেয়ে এসে দাঁড়ালো, চোখ ফেরাতে পারেন নি মেনকা, আহা কি সুন্দর ফুটফুটে হয়েছে সে দিনের সেই ছোট্ট উমা। সত্যি যেন রাজরাজেশ্বরী, জগজ্জননী। দুই মেয়ে, মায়ের মুখ যেন কেটে বসানো, আর শূরবীর দুই ছেলে। আভরণহীনা উমার সর্বাঙ্গে যেন ঝলমল আলো ঠিকরে পড়ছে, মেনকা মেয়ের জন্য যে ছাইপাঁশ চুড়িটা, হারটা গড়িয়ে রেখেছিলেন তা কেমন যেন মিটমিট ঠেকছে সেই ভুবনমোহিনী রূপের পাশে।

অথচ উমা আর সকলের মতই ছিল পাঁচপেঁচি মেয়ে, রঙটা একটু কটা বলে নাম ছিল গৌরী, তবে সে তেমন কিছু না। চোখে মুখে এই ধিকিধিকি তেজই বা কোথা থেকে এল, মনে হয় যেন কপালে আঁকা এক তৃতীয় নয়ন – জ্যোতি বেরোয়। পলকহারা ঘুমন্ত মেয়েকে দেখতে দেখতে এসব কথা মনে হয় মেনকার। জগতের কি যে নিয়ম, মায়ের শরীর ছিঁড়ে যে ভ্রূণ জন্ম নেয় , মায়ের তিল তিল যত্নে আস্তে আস্তে একটা অবয়ব গড়ে ওঠে, সেই নিজের হাতে গড়া জিনিসই কিছুকাল পরে যেন অচেনা মনে হয়, অপরিচিত মনে হয়। সবসময় সুরে সুর মেলে না, তাল সোমে এসে পড়ে না। একবার বাঁধন খুলে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়লে ঝর্ণা আর আপন করে টানতে পারে না নদীকে।

কাজেই দোজবরে বিয়ে, নেশা ভাঙ করেন ঠাকুর, রোজগারপাতিও তেমন কিছু নেই, ভিক্ষে সিক্ষে করে কোন রকমে চলাচলতি। তার ওপর চার চারটি সন্তান, ঠাকুরের সে গুণে ঘাট নেই। উমার মুখের দিকে তাকাতে পারেন না মেনকা। সাধ হয় মেয়েটাকে নিজের কাছে এনে রাখি কিছুদিন, আদর যত্ন করি। ওমা জামাই জাতে মাতাল তালে ঠিক। মান-অপমান জ্ঞান টনটনে। বছরে মাত্র একবার চার দিনের জন্য ছুটি মেলে, ছেলে মেয়ে নিয়ে মেয়ে আসে মার কাছে, সারা বছরের সমস্ত জমা কথা মায়েতে মেয়েতে বলাবলি হয়, কখনও মা কাঁদে কখনও মেয়ে। কখনও মেয়ে খুশি ঝলমল কখনও মায়ের মুখে আলো আলো হাসি। লোকে বলে উমা নাকি খুব কাজের হয়েছে, জগদ্ধাত্রীর মত, দশভূজার মত সংসারের দশদিক আগলে রাখে, কিন্তু ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে কিছুই বুঝতে পারেন না মেনকা, ঐ তো উমা, সেই ছোটবেলার মত বাঁ কাতে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে, ঝুরো চুল সেই আগের মতই ছোট্ট কপালে এসে পড়েছে, আহা মেয়েটা স্বপ্ন দেখে কাঁদছিল বুঝি, গালের ওপর জলের দাগ। ছোট বেলায় একটু শাসন করলেই আহ্লাদী মেয়ে অমন করে রাতের বেলা বালিশ ভিজিয়ে কাঁদত।

নবমীর চাঁদ হালকা হয়ে ফুটে আছে আকাশে, দশমীর সূর্য ওঠে নি এখনও, আর কতক্ষণই বা। আবার তো এক বছরের জন্য চোখ বিছিয়ে রাখা। আবার আসছে শরতকালে কাশফুল ঝাঁকড়া সাদা হলেই, উঠোনে শিউলির গন্ধ ম ম করলেই গিরিরাজকে আর্জি জানাতে হবে, আমার উমাকে এনে দাও। স্বামী তার মানুষটা খারাপ নয়, তবে বড় আলাভোলা, ঠেলা না দিলে চলেন না। রাতে যখন স্বামী অঘোরে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যান, মেনকা যেন দেখতে পান উমা তার কষ্টের সংসারে ভিক্ষে পাওয়া চাল ডাল আনাজ পাতি এটা ওটা জড়ো করে রাঁধতে রাঁধতে চোখে ধুঁয়ো দিয়ে কাঁদছে। বুকটা ছাঁৎ করে ওঠে, অন্ন রোচে না মুখে। ভোরে উঠেই স্বামীকে দিব্যি দেন উমার মুখ না দেখে আর জলস্পর্শই করবেন না।

আজ দশমী, উমার শ্বশুরঘরে ফেরার দিন। মেনকা কাল সারারাত জেগে পিঠে, পুলি, পায়েস বানিয়েছেন, আহা উমাটা বড় ভালবাসে। অক্ষম ছেলের হাতে নিরুপায় হয়ে মেয়েকে তুলে দেওয়ার দুঃখ মা ছাড়া আর কে বুঝবে? ঠিক বয়সে পাত্রস্থ করতে না পারার জ্বালা, আপনস্বজনের বিঁধিয়ে কথা শোনার অপমান, পর প্রতিবেশীর কটু বাক্য, তখন মেয়েকে মনে হয় জন্মের শত্রু, আঁতুরে নুন দিয়ে মেরে ফেললে ভাল ছিল। কোন রকমে ঘাড় থেকে নামলে বাঁচি।

ফিরে যাত্রার লগ্ন এসে গেল। নিজের হাতে উমাকে সাজাতে বসেছেন মেনকা রানী, অশ্রুর ভারে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি বারবার, হাত কেঁপে যাচ্ছে। কপালে অলকা তিলকার আলপনায় খুঁত থেকে গেল, কাজলের রেখা গেল বেঁকে, চন্দ্রহারের ফাঁসকল বারবার আলগা হয়ে খুলে পড়ে যাচ্ছে। কনকাঞ্জলির থালায় দুমুঠো চাল আর একটা সাদামাটা লাল পাড় শাড়ি মেয়ের হাতে তুলে দিল মা। মেয়ে চোখের জল চোখে আটকে হাতের থালার সামগ্রী পিছনে ছুঁড়ে দেয়, ভাত কাপড়ের ঋণ শোধ হল তার! পানপাতা, ধানভরা কুনকে, পঞ্চপ্রদীপে বিদায় আরতি করেন উমার, নিজের হাতের অঞ্জলিতে প্রদীপের তাপ সংগ্রহ করে স্পর্শ করেন মেয়ের বুকে, গলায়, দুই গালে, কপালে – যেন কোন বিপদের আঁচ না আসে। মেয়ের কানে কানে বলেন “এবারে তেমন আদরযত্ন করতে পারলুম না মা, সময় ভাল যাচ্ছে না, আসছে বছর আবার এসো কিন্তু, তখন … অশ্রুতে গলা বুঁজে যায়। কান্নায় ভাঙচুর মেয়ের মুখে সন্দেশ আর হাতে খয়ের কেয়া দিয়ে সাজা পান তুলে দিয়ে ভারী গলায় বলেন – “সংসারে জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্না হয়ে থেকো মা, কল্যাণময়ী সদানন্দা রূপে থেকো। “
মেয়ে ভাঙা গলায় বলে – “মা এবার যাই তবে।“
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে মেনকার “কতবার বলেছি হৈম, যাবার সময় যাই বলে না, আসি বলতে হয়। এখন ছোট নেই, গিন্নি বান্নি হয়েছ, এসব কথা মনে করিয়ে দিতে হয়! সংসারে কল্যাণ অকল্যাণ বোঝো না?”

এতক্ষণ আটকে রাখা কান্না উথলে ওঠে, আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত চলে যান ঘরে, মেয়ের যাত্রার সময় মাকে থাকতে নেই শাস্ত্রে বলে। উমা চেয়ে থাকে মায়ের দিকে, যতক্ষণ দেখা যায়। বাঁশি বেজে ওঠে করুণ সুরে “এস মা এস মা উমা /বোলো না বোলো না যাই
মায়ের কাছে হৈমবতী ও কথা মা বলতে নাই

বারমহলে আওয়াজ ওঠে, “ওরে মা যাত্রা করছেন, বিসর্জনের বাজনা বাজা।“
ঢাকে বোল ওঠে, “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন “
কাহারদল ধ্বনি তোলে “ বলো দুর্গা মাঈকি” – ত্রিভুবন কেঁপে ওঠে গর্জনে “ জয়”।

ছোট্ট উমার বেশ ফেলে জগন্ময়ী, দুর্গতিনাশিনী দশায়ূধা সেজে সিংহ এর পিঠে উঠে দাঁড়ান জগন্মাতা। নীলকণ্ঠ পাখীর মুখে বার্তা গেছে শিবের কাছে, শিবানী গৃহে ফিরছেন। পাগলা ভোলা কোথায় কোন শ্মশানে মশানে ভাঙ খেয়ে অচেতন পড়ে আছেন, খবর পেয়ে তড়িঘড়ি ছুটে আসবেন, নিজে সন্ন্যাসী হলে কি হবে, ভুবনমোহিনী আনন্দময়ী মহামায়ার গৃহিণীপণা দেখতে বড় ভালবাসেন ঠাকুর।

দশমীর সন্ধ্যায় মেনকার হাহাকার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে – “পুনরাগমনায়চ”

Sahityika Admin

Add comment