অকালবোধন
বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপূজার কোনো বিবরণ নেই। কিন্তু রামায়ণের পদ্যানুবাদ করার সময় কৃত্তিবাস ওঝা কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এর কাহিনি কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে সংযোজিত করেছেন। কৃত্তিবাসি রামায়ণ অনুসারে, রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। মা পার্বতী তাকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন, শিবের স্ত্রী পার্বতীকে পূজা করে তাকে তুষ্ট করতে। তাতে রাবণ বধ রামের পক্ষে সহজসাধ্য হবে। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম শরৎকালে পার্বতীর দুর্গতিনাশিনী রূপের বোধন, চণ্ডীপাঠ ও মহাপূজার আয়োজন করেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম কল্পারম্ভ করেন। তারপর সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। হনুমান তাকে ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করে দেন। মহামায়া রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। একটি পদ্ম না পেয়ে রাম পদ্মের বদলে নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলে, দেবী পার্বতী আবির্ভূত হয়ে রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন। তবে সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে যে কৃত্তিবাস ওঝা যে কাহিনী সংকলন করেছেন, তা রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনী বাল্মিকী রামায়ণে বা রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদসমূহ যেমন, তুলসীদাস রচিত হিন্দি রামচরিতমানস, তামিলভাষায় কাম্ব রামায়ণ, কন্নড় ভাষায় কুমুদেন্দু রামায়ণ, অসমিয়া ভাষায় কথা রামায়ণ, ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠি ভাষায় ভাবার্থ রামায়ণ, উর্দু ভাষায় পুথি রামায়ণ প্রভৃতিতে উল্লেখিত হয়নি। এছাড়াও যোগবাশিষ্ট রামায়ণে উক্ত হয়নি।
সনাতম ধর্মের যেকোনো পূজার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃত মন্ত্রগুলি। দুর্গা পূজার মন্ত্র গুলি সাধারণত শ্রী শ্রী চণ্ডি থেকে পাঠ করা হয়। ঢাক-ঢোল, খোল করতাল, সুগন্ধী আগর বাতি তার সাথে এই সংস্কৃত মন্ত্রগুলি এক পবিত্র পরিবেশের জন্ম দেয়।
দুর্গা পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার মন্ত্র:
ঔঁ জয়ন্তি (দেবী পার্বতীর তৃতীয় নয়ন থেকে সৃষ্টি যার) মঙ্গলা (যেই রূপে দেবী পার্বতী মঙ্গল দাত্রী) কালী (যেই রূপে দেবী পার্বতী কাল চালনা করেন), ভদ্র কালী (যেই রূপে দেবী পার্বতী সুখ দেন), দুর্গা (যেই রূপে দেবী পার্বতী দুর্গম নাশিনী) শিবা (যেই রূপে দেবী পার্বতী শিব দর্শনা) ক্ষমা (যেই রূপে দেবী পার্বতী ব্রহ্মা কে দয়া করেন) ধাত্রী (যেই রূপে দেবী পার্বতী জগৎ চলনা করেন), স্বাহা (নিজের কেশ সতী অগ্নিতে আহুতি) স্বধা (যেই রূপে দেবী পার্বতী মুক্তি দেন) নমস্তুতে। এস স্ব চন্দন পুষ্প বিল্ব পত্রাঞ্জলী নম ভগবতী দুর্গা দেবী নমহ্।”
দুর্গা প্রণাম মন্ত্র:
সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে
শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে
অর্থ: হে দেবী সর্বমঙ্গলা, শিবা (শিবের স্ত্রী), সকল কার্য সাধিকা, শরণযোগ্য, গৌরি (পার্বতী গৌর বর্ণা) ত্রিনয়ণী, নারায়নী (পার্বতী বিষ্ণুর বোন) তোমাকে নমস্কার।
মূর্তিতত্ত্ব
বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী; তার মুকুটের উপরে শিবের ছোট মুখ ,দেবীর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়। কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০ সালে এই সপরিবার দুর্গার প্রচলন করেন। তাঁরা কার্তিকেয়র রূপ দেন জমিদারপুত্রের, যা তৎপূর্ব ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে। এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গা এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষ্মী, বামে উপরে কার্তিকেয় ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষভবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথায় দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে। তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামোবিন্যাসে যতই বৈচিত্র থাকুক, বাংলায় দুর্গোৎসবে প্রায় সর্বত্রই দেবী দুর্গা সপরিবারে পূজিতা হন।
Add comment