বাহারি ঘুগনী
প্রণব কুমার মজুমদার, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
বিয়ের পর থেকে বিগত বছর দশেক ছুটি হলেই পায়ের তলায় সর্ষে লাগিয়ে নিতো সুমন আর তার স্ত্রী স্বাতী। শিক্ষকতা সুমনের পেশা ছিল বলে গরমের ছুটি, পূজোর ছুটি আর বড়দিনের ছুটি ছিল বাঁধাধরা। সংসারে সন্তানের অভাবটা পুষিয়ে নিয়েছিলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এই দশবছর ধরে ঘুরে বেড়িয়ে। সেবার দুজনে মিলে ঠিক করলো প্রচুর তো বেড়ানো হয়েছে, এবার একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বেড়ানো হোক। দিল্লীতে সুমনের দিদির বাড়ি, পূজোর সময় দিন দশেক দিল্লীতে দিদির বাড়িতে গিয়ে কাটালে দিল্লীর ধুমধাম করে দূর্গাপূজা দেখা হবে, আর চুটিয়ে ছুটিও উপভোগ করা যাবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। আগে থেকে টিকিট কেটে প্রতিপদে রওনা হয়ে দ্বিতীয়ায় সকালে ওঁরা দিল্লী পৌঁছালো। দক্ষিণ দিল্লীর মুনির্কাতে সুমনের দিদির বাড়ি। জামাইবাবু আর ভাগ্নে-ভাগ্নী ষ্টেশনে গাড়ি নিয়ে ওদের নিতে এলো। মামীকে পেয়ে ছোট্ট ভাগ্নীটার তো আনন্দ আর ধরে না। বাড়ি পৌঁছেই পূজোর যত জামাকাপড় পেয়েছিলো সব মামীকে দেখাতে দেখাতে উজার করে দিলো। মামীও সব ফেলে ননদের মেয়ের আবেগকে উৎসাহ দিতে নিজের লাগেজ খুলে এদের সবার জন্য যা যা উপহার এনেছিলো সব বের করে দেখালো।
যথাসময়ে চা-জলখাবার এলো। খেতে খেতে জামাইবাবু মুনির্কার পূজোর প্রসঙ্গে এলেন। বললেন, “আজ দ্বিতীয়া, দেবীপক্ষ চলছে। মুনির্কার পূজোর আমি এবার সাংস্কৃতিক সম্পাদক। আমাদের এখানে পঞ্চমীর বিকালে পূজোর মণ্ডপে একটা অনুষ্ঠান হয় – আনন্দমেলা। এটা একটা প্রতিযোগীতা। সব গৃহিনীরা বাড়ি থেকে বিকেলের জলখাবার খাওয়ার রকমারি খাবার বানিয়ে নিয়ে আসে। একটা মূল্য নির্ধারিত থাকে। সবাই কিনে নিয়ে খায়, খুব মজা হয়। একটা মহিলা বিচারক মণ্ডলী প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পুরষ্কার ঘোষণা করেন। তোমাদের দিদি তো করতেই চায় না। তো এবার তোমরা যখন আছো তখন তোমরা কিছু একটা করো।“ জামাইবাবু আরও জানালেন যে, প্রতি বছরই পঞ্চমীর ঐ রাতে দিল্লীর পাড়ায় পাড়ায় বহু বাঙালীর রাতের খাওয়া প্যান্ডেলেই হয়ে যায়। গৃহিণীরা নানান রকমের খাবারের স্টল দেন। আর ভোজনরসিক বাঙালী টেবিল ঘুড়ে ঘুড়ে পেটপূজো করে। আনন্দমেলার এই সিস্টেম সেই ইংরেজের আমল থেকেই চলে আসছে, যখন দিল্লিতে বেশ কিছু দূর্গাপূজা হতো।
আনন্দমেলার প্রস্তাব শুনে স্বাতী তো খুবই উৎফুল্ল। কোলকাতার পূজোয় গৃহিনীরা খাবারের স্টল দিয়ে প্রতিযোগীতা করেন, এরকম কোনও অনুষ্ঠান সে দেখেনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর বদলে এভাবেই নতুনত্বের স্বাদে পূজোটাকে পুরোপুরি উপভোগ করে নিতে চায় সে। ননদকে ধরলো একটা মজাদার কিছু তৈরী করার জন্যে। দিদি বললো, “প্রথম দিকে কয়েক বছর অনেক করেছি, এখন আর করতে ইচ্ছে করে না গো। তোমরা আছো যখন, তোমরাই কিছু করো না। কি কি লাগবে বলো, আমি জোগাড় করে দেবো।”
পরের দুদিন ধরে পুরো বাড়িতে খুব উত্তেজনা – কি বানানো হবে? জামাইবাবু, দিদি, ভাগ্নে, ভাগ্নী, সুমন এবং অবশ্যই স্বাতী – সবার প্রস্তাবে অন্ততপক্ষে শত খানেক পদের নাম উঠে এলো। আমিষ, নিরামিষ, বাঙালী, অসমীয়া, পঞ্জাবী, এমনকি চাইনিজ, থাই অনেকরকমের প্রস্তাব উঠে এলো। জামাইবাবু ভেটো দিয়ে বললেন একাধিক পদ বানাতে পারো, তবে প্রতিযোগিতায় শুধু একটাই পদ গণ্য হবে। তারপর অনেক আলোচনায় শেষ পর্যন্ত একাধিক পদ বানানো মানে খাটনি অনেক বেড়ে যাবে বলে একটাই পদ সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হলো -‘দই কচুরি’, উত্তর-ভারতের টানে বলতে হয় ‘দহি কচৌড়ি’। সবাই আগে খেয়েছে, তাই সবাই খুশি। ভাগ্নে-ভাগ্নী তো রীতিমত লাফালাফি শুরু করে দিলো।
স্বাতী পরামর্শ চাইলো, “জামাইবাবু কত প্লেট বানাবো?” জামাইবাবু জানালেন অন্ততপক্ষে পঞ্চাশ প্লেট বানাতে হবে। তার উপর আরও কয়েকটা বাড়তি প্লেট এবং বাড়ির সবার জন্য হিসাব করে মোট সত্তর প্লেট দই কচুরি বানানোর সিদ্ধান্ত হলো। স্বাতী আর সুমন মিলে কি কি উপকরণ কিনত হবে তার লিস্ট বানিয়ে চতুর্থীর দিনই সব কেনাকাটা সেরে রাখলো।
পঞ্চমীর দিন সকাল থেকেই দিদির রান্নাঘরে যেন উৎসব লেগে গেলো। সকালের প্রাতরাশ আর দুপুরের আহারের ব্যবস্থা কোনও রকমে তাড়াহুড়ো করেই সারা হলো। সত্তর প্লেট দই কচুরীর জন্য ময়দা মেখে তার মধ্যে ভাজা ছাতুর পুর দিয়ে লুচির থেকে একটু ছোট মাপে বেলে বেশ কড়া করে ভেজে রাখা হলো কয়েকটা আবদ্ধ পাত্রে যাতে হাওয়া লেগে নরম না হয়ে যায়। তারপর আটা আর বেসন মিশিয়ে মেখে দেড় ইঞ্চি মাপের বড়া ভেজে জলে ডুবিয়ে রাখা হলো যাতে নরম তুলতুলে থাকে। এই ভাজাভুজি করতেই প্রায় ঘন্টা চারেক লেগে গেলো। স্বাতীর কোমর ধরে গেলো। দুপুরের খাওয়া খেয়ে শুয়ে একটু বিশ্রাম নিলো।
আবার তিনটের সময় উঠে আলু সেদ্ধ করে ছোট ছোট টুকরো করে রাখলো। তেঁতুল, খেজুর, আর গুড় জলে ভিজিয়ে নরম করে চটকে তার মধ্যে সর্ষে আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে চাটনি বানালো। এবার ধনে, জিরে, শুকনো লঙ্কা ভেজে গুঁড়ো করে মিশিয়ে তারপর টক দই, নুন আর চিনি মিশিয়ে ফেটিয়ে রেখে দিলো। ধনে পাতা কুচি কুচি করে কেটে রাখলো। এসব করতে করতেই সাড়ে চারটে বেজে গেলো। ততক্ষণে দিদি বিকেলের চা এনে হাজির। চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের সাজগোজ করতে করতেই খাদ্যসামগ্রী গোছানো চালু শুরু হলো। বাড়ি থেকে দু’মিনিটের পথ, তবু জামাইবাবু বলে দিয়েছেন পাঁচটায় মণ্ডপে হাজির হয়ে টেবিল গুছিয়ে নিতেও একটু সময় লাগবে। সাড়ে পাঁচটার সময় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন। তারপর ক্রেতারা স্টলে স্টলে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো খাবার কিনে খাবে।
জিনিসপত্র সুমনই বয়ে নিয়ে গেলো দু’তিন খেপে। স্বাতী সব জায়গা মতো পর পর গুছিয়ে রাখলো যেন প্লেটের ওপর দই কচুরি বানানোর সময় সব উপকরণ হাতের কাছেই থাকে। ভাগ্নে-ভাগ্নীরাও নিজেরাই তাদের দ্বায়িত্বপূর্ণ কাজ বেছে নিলো। ছোট্ট ভাগ্নীটা নিলো মার্কেটিং, মানে টেবিলের কাছে সবাইকে ডেকে আনার দায়িত্ব। আগের কয়েকবার মায়ের সঙ্গে থেকে এই কাজটা সে রপ্ত করেছিলো। আর ভাগ্নে নিলো এঁটো প্লেট ফেলার জন্য সবাইকে নির্দিষ্ট পাত্র দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব। কারণ সুশৃঙ্খলভাবে কাজ না হলে প্রতিযোগিতায় নম্বর কাটা যাবে। দিদির ওপর দায়িত্ব পড়লো টাকাপয়সা জমা নেওয়ার। সুমন রইলো ম্যানেজমেন্টে, মানে কে ক’টা প্লেট চাইছে, সবাই সেইমতো পর পর পাচ্ছে কিনা এইসব সামলাতে। আর স্বাতী ডিস্ট্রিবিউশনে, মানে একটার পর একটা শুধু প্লেট সাজিয়ে যাবে।
ঠিক সাড়ে পাঁচটায় প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দমেলা অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হলো। মহিলাদের সমস্ত অনুষ্ঠানের সম্পাদিকা শ্রীমতী নন্দিনী বাসু একটা ছোট্ট ভাষণ দিলেন। তারপর উপস্থিত সকল লোকজন সব এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো খোঁজ নিতে যে নিজের পছন্দমতো খাবার কোন টেবিলে পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম দিকের মিনিট পাঁচ সাত স্বাতী দই কচুরি পরিবেশন করতে একেবারে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল। আগে এরকম সে কোনদিন করেনি। এক একটা প্লেট বানাতেই তো বেশ সময় লাগে। তবে ধীরে ধীরে রপ্ত করে ফেললো কায়দাটা। এক একটা প্লেট না করে একসঙ্গে পাঁচটা পাঁচটা করে দু’সারিতে দশটা প্লেট রেখে প্রথমে সবগুলোতে কচুরি রেখে মাঝখানে ফুটো করে দিলো। তারপর সবকটার ভেতরে বড়া ভরলো। এভাবে একই কাজ দশটা প্লেটে একসঙ্গে করায় সময় কম লাগলো। অন্য কোনদিকে না তাকিয়ে যেন নেশাগ্রস্তের মতো শুধু প্লেটের পর প্লেট বানিয়ে গেলো। তারপর দেড়ঘন্টার মধ্যে ষাট প্লেট দই কচুরি শেষ। স্বাতী সুমনকে খুব বাহবা দিলো যে সে উপকরণ যতটা কিনে এনেছে তাতে কোনও জিনিসটাই কম পড়েনি, আবার একগাদা করে বেঁচেও যায়নি। এক একটা দই কচুরির দাম রেখেছিল দশ টাকা। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই দাম যথেষ্ট ভালোই ছিলো। পূজোর উৎসবের আমেজে কোনও ক্রেতাই কিন্তু দাম নিয়ে আপত্তি করেননি।
খাবার পরিবেশন চলাকালীন শ্রীমতী নন্দিনী বাসু তিনজন মহিলা বিচারককে নিয়ে এসেছিলেন। জামাইবাবু কাছেই ছিলেন, একটু চোখ টিপে ইশারা করে দেওয়ায় স্বাতী নিজে ওনাদের চারজনকে চারটে প্লেটে তার দই কচুরি সাজিয়ে দিলো যাতে বানানোটাও দেখানো যায়। তারা বললেন যে সব টেবিলে গিয়েই খাওয়া টেস্ট করতে হবে, তাই সামান্য একটুই টেস্ট করবেন, পুরোটা খেতে পারবেন না। কিন্তু কার্যত দেখা গেলো বিচারকদের একজনের প্লেটে অর্ধেকটা পড়ে রইলো, কিন্তু বাকি তিনজনের প্লেট প্রায় খালি। ‘খুব ভালো হয়েছে’ বলতে বলতে ওনারা পরের টেবিলে চলে গেলেন। খানিকক্ষণ পরে নন্দিনী বাসু একা এসে মোটামুটি ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন যে স্বাতীর দই কচুরি বিচারকদের খুব পছন্দ হয়েছে, প্রথম স্থান পাচ্ছে ধরে নেওয়া যেতে পারে। স্বাতীর খুশী আর ধরে না। পরের প্লেট গুলো ভর্তি ভর্তি করে বানিয়ে দিলো।
সাতটার মধ্যেই তার দই কচুরি সব শেষ। টাকাপয়সা গোনাগুনতি করে সব মিলে গেলো। সবাই হাত লাগিয়ে টেবিল থেকে বাসনকোসন সব গুছিয়ে নিলো। স্বাতী তো ঘোষণাই করে দিলো যে যেদিন ঠাকুর দেখতে বের হবে সেদিন এই দই কচুরি বিক্রির টাকা দিয়ে সে সবাইকে খাওয়াবে। ভাগ্নে-ভাগ্নী এতক্ষণে ফুরসত হয়েছে। তারা এবার মামীর দই কচুরির প্লেট নিয়ে টেবিলেই খাওয়া শুরু করে দিলো। এর মধ্যে মামী তাদের বহুবার সেধেছে, কিন্তু তারা তাদের স্বনির্ধারিত কাজ ছেড়ে খেতে রাজি হয়নি। বড়রা সবাই বললো যে সব মিটে গেলে তারা স্বাতীর দই কচুরির স্বাদ গ্রহণ করবে।
বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হলো না। শ্রীমতী নন্দিনী বাসুর কণ্ঠ লাউডস্পিকারে শোনা গেলো – “প্রায় দেড়ঘন্টা ধরে আমরা আমাদের ‘আনন্দমেলা’ উপভোগ করলাম। আমাদের তিনজন মাননীয়া বিচারকদের বিচারে এবারের আনন্দমেলার প্রথম তিনজন স্থানাধিকারীর নাম এবার ঘোষণা করছি। তৃতীয় স্থানে আছেন শ্রীমতী বেলা সামন্ত, তিনি বানিয়েছিলেন ‘মাংসের সিঙ্গাড়া’। দ্বিতীয় স্থানে আছেন শ্রীমতী মেঘমালা ব্যানার্জি, তিনি বানিয়েছিলেন ‘চিকেন চাউমিন’। আর আমাদের এই আনন্দমেলার প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন -” এই বলে একটু রহস্য করার মতো সামান্য সময় থামতেই স্বাতীর হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি যেন লাফিয়ে বেড়ে গেলো। যদি নিজের নাম না শুনে অন্য কারও নাম শুনতে হয়? নন্দিনী বাসুর গলায় আবার কথা এলো – “হ্যাঁ, আমাদের আনন্দমেলার এবারের প্রথম স্থানাধিকারী শ্রীমতী জ্যোৎস্না তালুকদার। উনি শামী কাবাব বানিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন।”
এরপরে নন্দিনী বাসু আর কিছু বলেছেন কিনা সেটা স্বাতীর কান পর্যন্ত পৌঁছতেই পারলো না। সে শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছে যে তার নামটা উচ্চারিত হয়নি। তাহলে খানিকক্ষণ আগে নিজে থেকে এসে তাকে এমন আশ্বাসবাণী শোনানোর অর্থ কি? যদিও স্বাতী কোনও পুরস্কারের লোভে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি, শুধু চেয়েছিলো এমন একটা সুন্দর অনুষ্ঠান যেটাতে একটু খাবার বানিয়ে লোকজনকে খাওয়ানোর সুযোগ আছে সেটাকে উপভোগ করতে। অন্যমনস্কভাবে নিজের মধ্যে এইসব মন উথালি পাথালি করা ভাবনা ভাবতে ভাবতে সবার সঙ্গে সে বাড়িতে ফিরে গেলো। হঠাৎ তার মাথায় একটা ব্যাপার ঝিলিক দিয়ে গেলো – আরে, প্রথম, দ্বিতীয় আর তৃতীয় তিনটে পদই তো আমিষ, আর তার দই কচুরি তো নিরামিষ পদ। আমিষের সঙ্গে কি নিরামিষ টক্করে পারবে? নিজেই এভাবে ভেবে সমাধান বের করে স্বাতী আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো।
কিন্তু একটু পরেই পূজো মণ্ডপ থেকে জামাইবাবু ফিরে আবার নতুন এক ব্যাখ্যা শোনালেন। বিচারকরা বিভিন্ন পদের পরিবেশনা এবং স্বাদ গ্রহণ করে এসে নিরপেক্ষ বিচারে স্বাতীর দই কচুরিকেই প্রথম স্থানে রেখেছিলেন। তারা তাদের রিপোর্ট জমা দিয়ে চলে যাওয়ার পরে স্থানীয় গৃহিনীদের মধ্যে এক বিক্ষোভ সঞ্চারিত হয় – একজন অনাবাসী বাইরের মহিলা কেন পুরস্কার পাবেন? পূজোর উদ্যোক্তারা এই ব্যাপারটা আগে খেয়াল করেননি, কিন্তু বিক্ষোভ শুরু হতেই তারা চটজলদি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন যে প্রতি বছর স্থানীয় গৃহিনীদের নিয়েই তাদের পূজো করতে হবে, সুতরাং বিচারকদের বিচারকে একটু কাটছাঁট তারা সহজেই করতে পারেন। সুতরাং অনিচ্ছা থাকলেও জামাইবাবুকেও এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে, সাংস্কৃতিক সম্পাদকের স্থান থেকে।
আমিষ আর নিরামিষের দ্বন্দ্ব সাজিয়ে স্বাতী নিজের মনে সমাধান সূত্র বের করে নিজেকে দিব্যি শান্ত করে নিচ্ছিলো। কিন্তু নন্দাইয়ের মুখে এই ব্যাখ্যা শুনে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। এরা যা করে করুক তাতে তার কিছু যায় আসে না, কিন্তু আগে থেকে আশার বাণী শুনিয়ে পুরস্কার কেড়ে নেওয়া তো রীতিমত দণ্ডনীয় অপরাধ। সে বকবক করেই চললো – আমি বলে কিছু বলছি না, কিন্তু দুর্বল প্রকৃতির মহিলা হলে তো এই পুরস্কার না পাওয়ার শোকে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত সমস্ত অপরাধের বোঝা জামাইবাবুর ওপর চাপিয়ে অবশেষে সেই রাতে স্বাতী শান্তিতে ঘুমাতে পারলো। আরও একসপ্তাহ দিল্লির পূজো দেখে, আনন্দ করে দিব্যি কাটিয়ে দিলো। জামাইবাবু গাড়িতে করে সবাইকে নিয়ে অষ্টমীর দিন সারারাত দিল্লির বিভিন্ন পূজো মণ্ডপে গিয়ে ঠাকুর দর্শন করালো। জামাইবাবুকে প্রায় সব পূজো মণ্ডপেই চেনে বলে খাতিরটাও ভালোই পেলো।
এর পর প্রায় দশটা মাস কোথা দিয়ে যে কেটে গেলো কেউ বুঝতেই পারলো না। পরের বছর পূজোর প্রায় তিন মাস আগে থাকতেই জামাইবাবু সুমনকে অনুরোধ করলেন দিল্লি আসার জন্য, পূজোর ছুটিতে। সঙ্গে এটাও জুড়ে দিলেন যে আগের বছর ঐ আনন্দমেলা নিয়ে সুরটা কেটে গেছিলো বলে তিনি লজ্জিত, তাই এবার দশমীর পরে একসপ্তাহের জন্য বেড়াতে যাওয়া হবে সিমলা-কুলু-মানালী। পুরো বেড়ানোটা জামাইবাবু স্পনসর করবেন। জামাইবাবুর কাছ থেকে এরকম বেড়াতে যাওয়ার অফার পেয়ে সুমন উল্টে আরও লজ্জিত হয়ে পড়লো। পরপর দুবার পূজোর সময় দিল্লি যাওয়াটা একটু বিসদৃশ মনে হলেও জামাইবাবুর এহেন প্রস্তাবে সায় দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। কিন্তু স্বাতী বেঁকে বসলো, দিল্লি গেলেও মুনির্কার ঐ পূজো মণ্ডপে সে আর যাবে না। এই সব নিয়ে জামাইবাবুর সঙ্গে সুমনের অনেক কথোপকথন চললো, ফোনে। শেষ পর্যন্ত দিল্লি যাওয়া সাব্যস্ত হলো, ট্রেনের টিকিট কাটা হলো। তবে এবার স্বাতীর কথা রাখতে দ্বিতীয়ার পরিবর্তে চতুর্থীর দিন গিয়ে পৌঁছনো ঠিক হলো। সাতদিন দিল্লি কাটিয়ে পরের সাতদিন জামাইবাবুর ঐ সিমলা প্যাকেজ। তারপর ব্যাক ট্যু কলকাতা।
এবারেও ভাগ্নে-ভাগ্নীদের নিয়ে জামাইবাবু সুমন-স্বাতীদের নিউদিল্লি স্টেশন থেকে বাড়ি নিয়ে এলো। বাড়িতে এসে খুব গল্পগুজব আর সিমলা, কুলু, মানালী ভ্রমণের উত্তেজনার আলোচনাতেই সারাদিন কেটে গেলো। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর জামাইবাবুই কথাটা পাড়লেন। বললেন, “আমার খুব খারাপ লাগছে কথাটা পাড়তে, কারণ গতবছরের পূজোয় আনন্দমেলা অনুষ্ঠান নিয়ে স্বাতীর সঙ্গে একটা খুব বাজে ব্যাপার হয়ে গেছিলো। স্বাতীকে যদি নন্দিনী বাসু আগে থেকে না বলতেন তাহলে ব্যাপারটা এরকম হতোই না। উনিও বুঝতে পারেননি যে ব্যাপারটা ঐদিকে গড়িয়ে যাবে। তারপরে আমাদের নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। স্বাতীর উদাহরণ নিয়েই অনেক কথা হয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ও মুনির্কার বাসিন্দা নয়। কিন্তু মুনির্কার বাসিন্দার আত্মীয়া হিসাবেই তো সে আনন্দমেলা অনুষ্ঠানে যোগদান করেছে। সে একটা ভালো জলখাবার বানাতে পারে, সবাই খেয়ে প্রশংসা করেছে আর সেই সূত্রে ধরে বিচারকরা তাকে যদি প্রথম স্থানাধিকারী স্থির করেই থাকেন তো সেটা তো তার প্রতিভারই স্বীকৃতি। এখন সে এখানকার বাসিন্দা নয় বলে সেই স্বীকৃতিটা তার থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে এটা তো উপযুক্ত বিচার হলো না। ধরা যাক, স্বাতী যদি নিজের নামে যোগদান না করে তার ননদের নামে যোগদান করতো তাহলে কি হতো। বিচারকরা তো কে বাসিন্দা আর কে নয় সেই অনুযায়ী বিচার করেননি। তাদের বিচারে স্বাতীর ননদই পুরস্কারের স্বীকৃতি পেতো। কিন্তু সেটা কি সঠিক হতো। আর এটা স্বাতী আমার আত্মীয় বলে বলছি না। এটা তো আমাদের মুনির্কার বাসিন্দাদের যে কারও ক্ষেত্রেই হতে পারতো।”
একটানা এতক্ষণ বলে জামাইবাবু একটু থামলেন। একটু জল খেলেন। তারপর বললেন, “আমার এই যুক্তি কেউ খণ্ডাতে পারেনি। তাই এবার আর গতবছরের মত সমস্যা হবে না। আমি জানি স্বাতী যে তুমি আমার ওপর খুব রেগে আছো। তবু অনুরোধ করছি এবারের আনন্দমেলাতেও যোগদান করো। তোমাদের দিদি তো কয়েক বছর মেলাতে যোগ দিচ্ছে না। এবার আমাকে আবার পুরো পূজোর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে আমার পরিবার থেকে এই আনন্দমেলাতে যোগদান না থাকলে তো আমাকে অস্বস্তিতে পড়তে হবে। একটু ভেবে দেখো। আজ বিশ্রাম নাও, ঘুমিয়ে নাও। কাল সকালে উঠে সিদ্ধান্ত নিও।”
পরদিন সকালে উঠে চা খেয়ে সুমন দেখলো জামাইবাবু বাজারে চলে গেছেন। সুমন তাঁর দিদি আর বৌকে আনন্দমেলায় যোগদানের ব্যাপারে অনুরোধ করলো। দিদি তো সাফ বলেই দিলো যে সে সব রকম সাহায্য করে দেবে, কিন্তু ঐ অনুষ্ঠানে নাম সে দেবে না। আর স্বাতীর তো গতবারের ঐ হেনস্থা আবার মাথার মধ্যে চাগিয়ে উঠলো। সুমন অনেক করে বোঝালো যে দেখো আমরা এবার যে এসেছি তার একটা কারণ জামাইবাবু আমাদের পূজোর পরে বেড়াতে নিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে জামাইবাবুর এটুকু অনুরোধ যদি আমরা এখন না রাখি সেটা খুবই দৃষ্টিকটু হয়ে যাচ্ছে না? আর জামাইবাবুর কথাটাও তো ভাববার। সত্যিই তো, উনি সাধারণ সম্পাদক, পূজোর হত্তাকত্তা, অথচ তার পরিবার যদি পূজোর ব্যাপারে জড়িত না থাকে তো কিরকম বিসদৃশ হয় না ব্যাপারটা? আমরা যখন আছি তখন যতটা পারি আমাদের তো এগোনো উচিত। এই বোঝানোতে কাজ হলো। স্বাতী নিমরাজি হলো। তবে আর একটা ফ্যাকড়া তুললো – সে গোঁজামিল দেওয়া একটা জলখাবার বানিয়ে দেবে। ঘুগনী বানিয়ে দেবে, পাতি ঘুগনী – গোটা মটর সেদ্ধ করে একটু মশলা দিয়ে নেড়েচেড়ে মোটামুটি খাওয়ার মতো একটা কিছু বানিয়ে দেবে।
সুমনের মাথা থেকে একটা দুশ্চিন্তার বোঝা নেমে গেলো। যাক, স্বাতী যে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়েছে এটাই অনেক। আগে সে লাগুক ঘুগনী বানানোর কাজে, তারপর একটু একটু করে গুছিয়ে তোলা যাবে। স্বাতীর সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারলো যে প্রায় সত্তর প্লেট ঘুগনী বানাতে আড়াই কেজি মটর লাগবে। সুমন ছুটে বেরিয়ে গেল মটর কিনতে। মটর কিনে বিভিন্ন পাত্রে ভিজিয়ে রাখা হলো। ঘন্টা চারেক ভেজাতে পারলে ভালো, অর্থাৎ প্রায় বারোটা পর্যন্ত ভিজবে। তারপর তাকে প্রেশারে সেদ্ধ করতে হবে। একবারে একটা প্রেশার কুকারে হবে না, দু’বারে সেদ্ধ করতে হবে। তার মানে একটা দেড়টা বাজবে। তারপর স্নান খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে তিনটে নাগাদ যদি ঘুগনী রান্না শুরু করে তাহলেই দুই খেপে করলেও সাড়ে চারটের মধ্যে শেষ করা যাবে বলে স্বাতী আশ্বস্ত করলো। মানে একেবারে গরম গরম ঘুগনী পরিবেশন করা যাবে, যদি সাড়ে পাঁচটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়।
এবার সুমনের মাথায় অন্য চিন্তা পাক খেতে শুরু করলো। ঘুগনী একটু ট্যালটেলে হয় বলে ঠিক করলো পরিবেশন করা হবে বাটিতে। আর একটা প্লেট থাকবে যার ওপর বাটিতে ঘুগনী দেওয়া হবে। পাতলা ঘুগনী বলে খাওয়ার সময় যেন নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়, এদিক সেদিক যাতে গড়িয়ে পড়ে না যায় তাই প্লেটটা থাকবে। হাতে ধরতেও সুবিধা হবে প্লেটটা। তাছাড়া সুমনের মাথায় আর একটা বুদ্ধি কাজ করলো। বাটিতে শুধু ঘুগনী না দিয়ে ঘুগনীর ওপরে যদি রকমারি টুকিটাকি খাদ্যবস্তুও সাজিয়ে দেওয়া যায় তো কেমন হয়? যেমন উপরে পটেটো চিপস, ঝুরি ভাজা ইত্যাদির একটা স্তর রইলো। এর সঙ্গে একটু পাঁপড় ভাজাও টুকরো করে দেওয়া যায়। তার ওপর একটা খেজুর, গুড় আর তেঁতুলের মিশ্রণের চাটনিও বেশ ঘন করে দেওয়া যায়। চাটনির ওপরে ধনে, জিরে, শুকনো লঙ্কা ভেজে গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপরে একটু পেঁয়াজ কুচি, ধনেপাতা কুচি আর প্রয়োজন মতো কাঁচালঙ্কা কুচি ছড়িয়ে ওপরে একটু বিটনুন গুঁড়ো এক চিমটে দিয়ে দিলে ব্যাপারটা দেখতে দারুণ হবেই, আর খেতেও তো যাকে বলে হবে একেবারে জমে ক্ষীর। এতক্ষণ স্বাতী গালে হাত দিয়ে শুনছিলো। এবার মুখ খুললো, “তা ক্ষীর তো সাদাটে রঙের হয়। তাই চাটনির ওপরে একটু টক দই ফেটিয়ে দিয়ে দিলে ঐ রংটাও ফুটে উঠবে আর তোমার ঐ সাজসজ্জার ষোলোকলাও পূর্ণ হবে। গুণে দেখো দিকি, যা লিস্টি বানিয়েছো তাতে সব মিলিয়ে ঐ ষোলো রকম উপাদানই বোধহয় লাগছে। তা এই হ্যাঙ্গামাটা পোয়াবে কে? আমি কিন্তু ওসব কিচ্ছু করতে পারবো না। আর তুমি যে ফিরিস্তি দিয়ে সাজালে সেটাকে গারনিশিং বলে, বুঝেছো মাস্টারমশাই?”
ঘুগনীকে সাজিয়ে পরিবেশনের পরিকল্পনাটা প্রকারান্তরে স্বাতীর অনুমোদন পেয়েছে এটা সুমন বুঝে গেলো, যদিও সে বলছে নিজে কোনরকম ঝক্কিঝামেলা সামলাতে পারবে না। ভেবে দেখলো তার প্লেটের ওপরে বাটি রেখে পরিবেশন করার ভাবনা যে শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, ঐ গারনিশিং করার প্রয়োজনেও লাগবে। স্বাতীর সঙ্গে পরামর্শ করে মটর বাদে অন্যান্য কোন উপকরণ কতটা লাগবে তাড়াতাড়ি তার একটা হিসাব করে নিলো। স্বাতী কিন্তু এই হিসাব করার ফাঁকে ফাঁকে বারবার সুমনকে মনে করিয়ে দিলো যে সে কিন্তু শুধু ঘুগনীটা বানিয়ে দেবে, আর কিছুই সে করবে না। সুমন বেরিয়ে পড়লো দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনতে।
লিস্ট মিলিয়ে জিনিসপত্র সব কিনে এনে দিদির পুরো ডাইনিং টেবিলটাই সে দখল করে নিলো। সব উপকরণ সাজিয়ে রেখেছে। বেশ খানিকটা লেটুস পাতাও কিনে এনেছে। বললো, “স্বাতী, একবার তোমার কাছে শুনেছিলাম গারনিশিং করতে লেটুস পাতা লাগে। তাই লেটুস পাতাও কিনে নিয়ে এলাম। প্লেটের ওপরে এক টুকরো লেটুস পাতা রেখে তার ওপরে ঘুগনীর বাটিটা সাজালে পুরো ব্যাপারটাই বেশ ঘ্যামারকম জীবন্ত হয়ে উঠবে।” এইবার দিদি মুখ খুললো, “হ্যাঁরে ভাই, তুই যে এই এলাহি কাণ্ড কারবার ফেঁদে বসেছিস এসব সামলাবি কিভাবে? কে করবে এতো কায়দার পরিবেশন?” সুমন কথা না বলে ঐ সব জিনিস গোছাতে গোছাতে চোখের ইশারায় স্বাতীর দিকে ইঙ্গিত করে দিদিকে বুঝিয়ে দিলো, ‘পরিবেশনের দায়িত্ব নেবেন তিনি, রান্না করবেন যিনি।’
সুমন দিদিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “এই সব সামগ্রী পরিবেশনের সময় টেবিলে সাজিয়ে রাখার জন্য বেশ কিছু পাত্র দরকার রে, দিদি। একটু কায়দা করা, দেখতে সুন্দর হলে ভালো হয়।” সকাল থেকে এতো আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে মনমরা হয়ে বসেছিলো সুমনের ছোট্ট ভাগ্নীটা। ঐ ঘুগনী খাদ্যটা তার একদম পছন্দের নয়, মামী এসব কি আজেবাজে খাবার বানাচ্ছে? এর থেকে গতবছরের দই কচুরি কি সুন্দর একটা খাবার ছিল। সবাইকে দিব্যি ডেকে এনে খাওয়াতে খুব মজাও পাচ্ছিলো। এবার ভাগ্নীটা লাফিয়ে উঠে বললো, “মামা, তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি দিচ্ছি তোমাকে।” বলে তার মায়ের শোকেস খুলে সত্যিই প্রায় দশ বারোটা নানা মাপের কাঁচের আর চীনামাটির বিভিন্ন মাপের বাটি এনে ঐ টেবিলে রাখলো। সুমন হা হা করে উঠলো, “তপু, এসব কি করছিস? তোর মা এতো যত্ন করে সব সাজিয়ে রেখেছে। ওখানে নিয়ে গেলে যদি কোনটা ভেঙ্গে যায় তো সেটা তো আর পাওয়া যাবে না।” দিদি আশ্বস্ত করলো, “তোকে এতো ভাবতে হবে না। এগুলো তো শুধু সাজানোই থাকতো। লোকজনের মাঝে একটা কাজে লাগলে তবু তো ওগুলোর একটু ব্যবহার হবে।”
আর বেশী কথা বাড়ালো না সুমন। সব ক্রকারিস ধুয়ে মুছে টেবিলে সাজিয়ে রাখলো। এদিকে ঘড়ির কাঁটাও টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ সুমনের মাথায় একটা প্ল্যান এলো। ভাগ্নেকে ডাকলো, “চিন্টু, বাড়িতে কোনও পুরোনো ফেলে দেওয়া পিসবোর্ডের বাক্স আছে? অথবা ধর প্রায় ফুট দুয়েক লম্বা, দেড় ফুট চওড়া মোটামুটি শক্ত পিসবোর্ড আছে?”
এ যেন পাগলকে সাঁকো দেখানো। ভাগ্নেটাও এতক্ষণ ঐ ঘুগনীর টেকনিক্যাল প্রসেসের ব্যাপারের মধ্যে ভিড়তে পারছিলো না, এবার একটা মনের মতো কাজ পেলো। একটু পরে বাবার ঘরের জিনিসপত্র রাখার লফ্ট থেকে একটা বাক্স আনলো আর নিজের ভাঁড়ার থেকে একেবারে মাপ মতো একটা পিসবোর্ড নিয়ে এলো। সুমন পিসবোর্ডটা রেখে বাক্সটা নিজেই জায়গা মতো রেখে দিয়ে এলো। চিন্টুকে বললো, “ওস্তাদ, এবার তোমার জলরঙের টিউবগুলো আর তুলি নিয়ে এসো। আর তোমার বইয়ের তাকে একটা মিকি মাউসের বই আছে, সেটাও নিয়ে এসো।” সুমনের কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চিন্টু তার রং আর বই এনে হাজির। জিজ্ঞেস করলো, “মামা, কি আঁকবে গো?” সুমন একবার ভাবলো একটু রহস্য করবে। তারপর ভাবলো, থাক বাচ্চা ছেলে, উৎকণ্ঠায় রাখার দরকারটা কি? বললো, “মামু, তোমার পিসবোর্ডে আমি একটা মিকি মাউসের ছবি আঁকবো। তারপর সেটাকে খুব উজ্জ্বল রং করবো, যেন দূর থেকে চট করে চোখে পড়ে। তারপর পিসবোর্ডটাকে মিকি মাউসের মাপে কেটে একটা লাঠি দিয়ে পেছনে ঠেকনা দিয়ে মণ্ডপে ঘুগনীর টেবিলে দাঁড় করিয়ে রাখবো। মিকির বাঁহাতে থাকবে আমাদের ঐ প্লেটের ওপরে বাটিতে সাজানো ঘুগনী আর ডান হাতটা যেন সামনের কাউকে ডাকছে এরকম ভঙ্গীতে থাকবে। আর মাথায় একটা ইয়া ঢাউস টুপি থাকবে আর টুপির গায়ে লেখা থাকবে – ‘বাহারি ঘুগনী’। স্বাতী প্রেশার কুকার হাতের কাছে গুছিয়ে রাখছিল। সুমনের কথা শুনতে শুনতে বললো, “তার মানে এই ঘুগনীর নাম হবে – বাহারি ঘুগনী?”
এই সব পিসবোর্ড, রং আনা আর কথাবার্তা বলার ফাঁকে কেউ খেয়ালই করেনি যে জামাইবাবু কখন বাইরের কাজ সেরে ঘরে এসে দাঁড়িয়ে সুমনের আর স্বাতীর কথা শুনছিলেন। স্বাতীর কথার পিঠে বলে উঠলেন, “বাহ! দারুণ নাম হয়েছে – বাহারি ঘুগনী। এ যেন সমতল ভূমির ঘুগনীকে ‘বাহারি’ বিশেষণে চাপিয়ে একেবারে এভারেস্টের মাথায় তুলে দিলে। আমার বাড়ি থেকে এত কাণ্ড করে এবার আনন্দমেলাতে শুধু যোগদানের আনন্দে আছি তাই নয়, এমন একটা চমৎকার খাবার পরিবেশন হবে সেটার আনন্দও তার সাথে যোগ হচ্ছে। আর স্বাতী, তোমার মন খারাপের কোনও কারণ নেই, এবার আর গতবছরের মতো কোনও সমস্যা হবে না। আমরা সবাই আলোচনা করে ঠিক করে নিয়েছি।”
দুপুরের স্নান খাওয়ার আগে সুমন মিকি মাউসের কাটআউটটা রং করে কেটে কুটে দাঁড় করিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে ফেললো। চিন্টুর উৎসাহ দানে মিকি মাউসকে দেখতেও দারুণ লাগছিলো। মিকিকে দেখে স্বাতীর মুখটাও বেশ হাসিখুশি হয়ে উঠলো। চটপট নিজেই ঠিক করে ফেললো কোন উপকরণটা কোন পাত্রে রাখবে। পাত্র থেকে ভেজানো মটরগুলো তুলে প্রেশার কুকারে সেদ্ধ করে নিলো। এরপর সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রামের পর বিকেল তিনটের সময় স্বাতী আর সুমন উঠে ঘুগনী রান্না শুরু করলো। জামাইবাবু বেরিয়ে গেলেন মণ্ডপের উদ্দেশ্যে।
ঘুগনী রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে স্বাতী সুমনকে নির্দেশ দিতে থাকলো মণ্ডপে টেবিলের ওপরে কোন পাত্রে কোন জিনিসটা রাখা থাকবে। আরও একটা ব্যাপার সুমন লক্ষ্য করলো যে অমন নিস্তেজ অবস্থা থেকে স্বাতীর এনার্জি লেভেল অনেকটাই উপরে উঠে গেছে। পুরো দায়িত্বটা যেন সে নিজের হাতেই তুলে নিয়েছে। জামাইবাবুর এবারের আশ্বাসে, নাকি ‘বাহারি ঘুগনী’ নামকরণের ফলে অথবা ঐ ঝকমকে মিকি মাউসের উপস্থিতি এর কারণ সেটা ঠিক বুঝতে পারলো না। দরকারও নেই। আসলে একটা কাজ করার পেছনে যদি কোনও নির্দিষ্ট ফল প্রাপ্তির আশা না রেখে শুধুমাত্র আনন্দ পাওয়াটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয় তবে কাজটাকে মনপ্রাণ ঢেলে নিখুঁত ভাবে করারও একটা আগ্রহ জন্মায়।
ঘুগনী রান্না এবং আনুষঙ্গিক গোছগাছ শেষ করে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই সবাই মণ্ডপে পৌঁছে গেলো। আগের বছরের মতোই সবাই যে যার কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। ভাগ্নী তপু নিলো অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব, ভাগ্নে চিন্টুর রইলো অতিথি বিদায়ের কাজ। সাড়ে পাঁচটায় ঘোষণা করে প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করলেন শ্রীমতী নন্দিনী বাসু। এবারেও তিনি মহিলাদের অনুষ্ঠানের সম্পাদিকা।
কাজে লেগে পড়লো সুমন আর স্বাতী। স্বাতী একটার পর একটা বাহারি ঘুগনীর প্লেট সাজিয়ে চললো আর সুমন সেগুলো অর্ডার অনুযায়ী লোকজনের হাতে হাতে তুলে দিতে থাকলো। টেবিলের ওপরে দণ্ডায়মান মিকি মাউস আর ঘুগনীর বাটি ঢেকে দেওয়া রকমারি উপকরণ সাজানোটা টেবিলের সামনে একটু ভিড় বাড়িয়ে তুলেছিলো, অন্যান্য টেবিলগুলোর তুলনায়। সেই ভিড়কে মিষ্টি কথায় হাল্কা করতে ভাগ্নে-ভাগ্নীকে একটু বেশী চাপ নিতে হচ্ছিলো। বাহারি ঘুগনীর দাম প্রথমে ভাবা হয়েছিলো পাঁচ টাকা, কারণ রাস্তার ধারে ঐ দামেই ডেকচিতে করে ঘুগনী বিক্রী হয়। কিন্তু আনন্দমেলা উৎসবে ঐ দামে এই ঘুগনী বিক্রী হওয়াটা একটু যেন খেলো হয়ে যায়। তাছাড়া ঘুগনীর ওপরে এত কিছু উপকরণ জমা পড়েছে, তাদের ঠিক ভাবে সাজানোর একটা পরিশ্রম এবং সর্বোপরি মিকি মাউসের উপস্থিতি – এই সব মিলিয়ে সবাই মিলে দাম নির্ধারণ করেছিলো দশ টাকা প্রতি প্লেট। খাদ্যপ্রেমীরা সচ্ছন্দে এই মূল্য স্বীকার করে নিয়েছিলো।
এবার টেবিলের সামনে এত ভিড় হচ্ছিলো যে সময় কোথা দিয়ে কেটে গেছে কেউ খেয়ালই রাখতে পারেনি। ষাট পঁয়ষট্টি প্লেট ঘুগনী তার পরিবেশনের প্লেটের ওপর রকমারি বাহার দেখিয়ে সাতটার আগেই নিঃশেষ হয়ে গেলো। এরই মধ্যে শ্রীমতী নন্দিনী বাসু তার আমন্ত্রিত বিচারকদের নিয়ে স্বাতীর বাহারি ঘুগনীর স্বাদ চেখে গেছেন। তবে এবার তার পরে এসে সৌজন্য সাক্ষাৎ আর করে যাননি। এদিকে উৎসবের আমেজ ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে। স্বাতীর ভাঁড়ার শূন্য হয়ে গেছে বলে টেবিল থেকে জিনিসপত্র বেঁধে ছেদে গুছিয়ে নিলো। দিদি টাকাপয়সা গুণে গেঁথে স্বাতীর হাতে তুলে দিলো। চিন্টু আর তপু পরিশ্রান্ত হয়ে দুটো চেয়ারে দুজনে গা এলিয়ে দিলো। এদিকে শ্রীমতী নন্দিনী বাসুর কণ্ঠস্বর লাউডস্পিকারে ভেসে এলো। এক এক করে পুরস্কার বিজেতাদের নাম উচ্চারিত হয়ে চললো। স্বাতী উদাসভাবে খানিকটা শুনে, কিছুটা না শুনে টেবিলের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছিলো। হঠাৎই নিজের নামটা কানে আসতেই ধড়মড় করে উঠলো। নন্দিনী বাসু ঘোষণা করছেন, “আর সর্বোপরি এবারের আনন্দমেলা উৎসবের সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য পরিবেশনের কৃতিত্ব অর্জন করেছেন শ্রীমতী স্বাতী রায় তাঁর বাহারি ঘুগনী আমাদের সামনে উপস্থিত করে। কোনও খাদ্যবস্তু শুধুমাত্র খাদ্যগুণ সম্পন্ন এবং সুস্বাদু হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, তাকে যথাযথভাবে পরিবেশন করাটাও একটা রীতিমতো শিল্পকলা। একটা মিকি মাউসের কাটআউট যে মাত্রায় তার ঐ বাহারি ঘুগনীকে তুলে নিয়ে গেছে আমাদের বিচারকরা সেটা দেখে অভিভূত। এবারের প্রথম স্থানাধিকারী স্বাতী দেবীর কাছে উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে আমি অনুরোধ করছি যে তার ঐ ‘বাহারি ঘুগনী’ লেখা মিকি মাউসের কাটআউটটা আমাদের এই পূজো মণ্ডপে পূজোর কয়েকটা দিন যেন রাখার অনুমতি দেন, আর দশমীর দিন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ওনার পুরস্কারও গ্রহণ করেন।”
ঘোষণা শুনে স্বাতী বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে শুধু জানে এবারের এই পুরষ্কারের পূর্ণ কৃতিত্ব সুমনের। ভাষায় সেটা প্রকাশ করতে না পেরে অথবা লজ্জার কারণে পাশে দাঁড়ানো সুমনের বাহুমূলে একটা জোরে চিমটি কেটে তার আনন্দের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো। সুমন ভাবলো গতবছর স্বাতী এত উৎসাহ নিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করে কত চমৎকার একটা সুখাদ্য বানালো যেটা যথেষ্ট প্রশংসিত হলেও তার উপযুক্ত সম্মান লাভ করেনি। অথচ এবার অতি অল্প আয়াসে একটা বহু প্রচলিত খাবার শুধুমাত্র পরিবেশনার গুণে সবার যে শুধুমাত্র প্রশংসাই পেলো তা নয়, উপযুক্ত সম্মানও সে আদায় করে নিলো। আসলে ভালো কাজের স্বীকৃতি অনেক সময় বিভিন্ন পাকেচক্রে পড়ে অবহেলিত হয়ে যায়। জামাইবাবু এবার আলাদা করে শুধু সুমনকে বলেছিলেন যে গতবছরের প্রথম স্থানাধিকারীর শামীকাবাব নাকি বাইরের দোকান থেকে বানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিলো। ওনার স্বামী পূজো কমিটির একজন হর্তাকর্তা, প্রচুর বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দেন। তাই নন্দিনী বাসু অনেকটা বাধ্য হয়েই ওনাকে প্রথম পুরস্কার প্রাপক হিসাবে ঘোষণা করেন। এই সব চালাকি চলে বলে দিদি আর নাম দেয় না এই উৎসবে। এবার অনেক আঁটঘাট বেঁধে আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো যে সঠিক বিচারকেই স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
স্বাতীর চিমটিটা আবেগের বশে একটু জোরেই হয়ে গেছিলো। ‘উফ’ আওয়াজ সুমনের মুখ দিয়ে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আপনা আপনিই বেরিয়ে এলো। সবাই ওর দিকে তাকালো। ব্যাপারটা এড়ানোর জন্য সুমন তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, “আরে, আনন্দমেলা তো শেষ হলো, যাকে বলে মধুরেণ সমাপয়েৎ। তা বাড়ি যেতে হবে তো? পা’দুটো তো টনটন করছে।” এই বলে জামাইবাবুর জিম্মায় মিকি মাউসকে রেখে পোঁটলা পুঁটলি কাঁধে চাপিয়ে রওনা দিলো। জামাইবাবু রাস্তা আটকালেন, “আরে এত তাড়া কিসের শালাবাবু। বৌ এবার দিল্লি মাতিয়ে দিয়েছে, তো একটু সেলিব্রেট তো করতেই হবে। এখন বাজে সাড়ে সাতটা। দেড় ঘণ্টা বিশ্রাম নাও। ঘরের রান্না যেমন আছে থাক। আমি একটু পূজোর এখানে থাকছি। ন’টার সময়ে সেন্ট্রাল মার্কেটের মুনির্কা প্যাভিলিয়ন রেস্টুরেন্টে দেখা হবে। আমার তরফ থেকে বাহারি ঘুগনীর সম্মানে বাহিরি খানা।”
চার পাঁচজনের মিলিত কণ্ঠের একটা প্রচণ্ড খুশীর হোওওও আওয়াজ মণ্ডপ থেকে রাস্তার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো।।
Add comment