পথচলতি
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়, ১৯৮৬ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
এক সময় কর্মসূত্রে বেহার উত্তরপ্রদেশের বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল। সপ্তাহের পর সপ্তাহ পায়ের ওপর দিয়ে ইঁদুর লাফানো গেস্টহাউস বা মফস্বলী হোটেলে কোনওমতে মাথা গুঁজে রাত কাটিয়েছি। সকাল হতেই ড্রাইভার রামগোলামের জিপে চড়ে দেহাত সফর। তখন একবার এক প্রাজ্ঞ বড়সাহেব দার্শনিকের মতো মুখ করে বলেছিলেন, এই তো সময়, মজা লুটে নাও। আমার মতো নখদন্তহীন বৃদ্ধ হয়ে গেলে তো আর পারবে না। তাঁর সামনে তখন সিগারেট-রঞ্জিত দাঁত বের করে হেঁ-হেঁ করেছিলাম বটে কিন্তু আড়ালে তাঁকে নির্বাচিত কাঁচা খিস্তি দিতে ছাড়িনি। শালা, মজাই বটে! আজ কিন্তু সেই সব দিনগুলো সত্যিই মিস করি। অবসরে যেমন লোকে পুরনো অ্যালবাম খুলে বসে, ইচ্ছা হল, সেই সব তামাদি হয়ে যাওয়া সাদাকালো গল্প শেয়ার করি।
(যথারীতি জনস্বার্থে চরিত্র বা দুশ্চরিত্রগুলির নাম-ধাম পরিবর্তিত।)
শুয়োরের কল্যাণে চন্দ্রোদয়
আমরা একটা যন্ত্র বানিয়েছিলাম, ভূগর্ভস্থ তেলের পাইপের স্বাস্থ্য নিরীক্ষার জন্য। যন্ত্রটিকে পাম্পিং ষ্টেশনে পাইপে ঢুকিয়ে দিতে হয়। তেলের তাড়নায় সে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে চলে। তাই তার আদরের নাম শুয়োর। সে চলে মাটির নিচে দিয়ে আর আমরা জিপ-রাস্তায়, তাকে ধাওয়া করে। দেড়শ কিলোমিটার লম্বা পাইপলাইনের মধ্যে সে মক্কেল কোথাও ফেঁসে গেলে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যাবে।
মুঘলসরাই থেকে যাত্রা। চূনার, মীর্জাপুর হয়ে, বিন্ধ্যাচল পেরিয়ে চলেছি। টোনস নদীর ভাল্ভে পৌঁছোতে সন্ধে ঘুরে গেল। পাড়ের থেকে অনেক নিচে টোনসের জল চিকচিক করছে। দু’-একটা উট্কো নৌকা এদিক-ওদিক বাঁধা। উত্তরপ্রদেশের দেহাতি এলাকা। ফসল কাটা আদিগন্ত মাঠ খাঁ-খাঁ পড়ে আছে। অন্ধকার বাড়ছে। রিসিভিং অ্যান্টেনার বিপ শোনার জন্য কান ক্লান্ত। সেই শুয়োরের বাচ্চার দেখা নেই।
রাত বেশ হল। তারায় ঝকঝক করছে দূষণহীন আকাশ। পেটে ইঁদুর-নাচ শুরু হয়েছে। জিপের ড্রাইভার, কাছের গ্রামে গিয়ে রুটি আর ডিমের তরকারি নিয়ে এল। মুখে ছুঁইয়ে দেখলাম যা ঝাল খেলে টোনসের ধারেই দেহ রাখতে হবে। জলে ভিজিয়ে শুকনো রুটি খেলাম। যতক্ষণ না সেই যন্ত্র-শুয়োর আসে, বসে থাকতে হবে। হয়তো ফ্লো কমে গেছে। না এলে আর এক কেলেঙ্কারি। কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে, খুঁজতে হবে। শরীর আর দিচ্ছে না।
এমন সময় টোনসের ওপারে, ধূ-ধূ মাঠের প্রান্তে চন্দ্রোদয় হল। বিশাল থালার মত, ইট রঙের চাঁদ লাফিয়ে উঠে এল আম-জাম-জামরুলের মাথার ওপর। মুহূর্তে এক মায়াবী আলোয় সমস্ত চরাচর ভেসে গেল । সেই অপার্থিব চাঁদের দিকে তাকিয়ে সারা দিনের খিদে, ক্লান্তি, উৎকণ্ঠা সব কিছু তুচ্ছ হয়ে গেল। আমি বেভ্ভুল, নির্নিমেশ, চলচ্ছক্তিহীন হাঁদার মত বসে রইলাম।
হঠাৎ রিসিভিং অ্যান্টেনার বিপ বেজে উঠল। শুয়োরের বাচ্চা মাটির নিচে দিয়ে যেতে যেতে মুচকি হেসে বলল, “কেমন দেখলি?”
বাবা-কা-ধাবা
“বাবা-কা-ধাবা”র সামনে কাতা দড়ির খাটিয়ায় উল্টে পড়ে আছি। চূনারের একটু আগে রামগোলামের জিপ থেমেছে। বাবা সিং বাঁ হাতে জটপড়া দাড়ি থেকে উকুন বাছছে আর ডান হাতে লোহার চিমটেতে করে ঝিঁকওলা বিশাল উনুনে রুটি ওল্টাচ্ছে। পাশের খাটিয়া থেকে শর্মাজী হেঁকে বললেন, “তড়কেমে পিঁয়াজ থোড়া জ্বালা দেনা।”
শর্মাজী মথুরার বনেদী খাইয়ে। যৌবনে দাবড়ে রাবড়ি খাওয়া মানুষ। ইদানীং মধুমেহতে বিপর্যস্ত। ঘরে তরুণী ভার্যার তত্ত্বাবধানে খাওয়া-দাওয়া মেপেজুপে। ভাবীজী অফিসেও ডাব্বা ভরে খাবার পাঠিয়ে দেন। তবে শর্মাজী অফিস আসার পথে গাড়ী থামিয়ে মাঝেমধ্যে কচুরি-টচুরি যে মারেন না এমন নয়। আর কীভাবে না জানি অবধারিত ভাবে সে সব খবর ভাবীজীর কানে পৌঁছে যায়। শর্মাজীর ধারণা আমাদের মধ্যেই কেউ ভাবীজীর পালিত গুপ্তচর।
অফিসের ট্যুরে এসে শর্মাজী কতকটা বাঁধন-ছাড়া হয়ে যান। বারণ করা সত্ত্বেও মাটির ভাঁড়ে বিয়ার নিয়ে বসেছেন। পকেট থেকে বের করে চানা খাচ্ছেন একটা একটা করে, আর এক চুমুক করে বিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে নিচু গলায় মোবাইলে ভাবীজীর খবরাখবর নিচ্ছেন।
খাবার তৈরি হতে সময় লাগছিল। আমাদের মধ্যে শর্মাজীকে দেখে মাতব্বর বলে মনে হয়। বাবা সিং-এর এক চ্যালা দু’খানা রসসিক্ত তাগড়াই জিলিপি একটা প্লেটে সাজিয়ে শর্মাজীর সামনে এনে ধরল। দেখলাম শর্মাজীর চোখ চক চক করে উঠল, বলে উঠলেন, “জেলেবি…!”
বেতার-সঞ্চারে ঠিক কী রাগে সেতার বেজেছিল জানি না। শর্মাজী হাতের বিয়ারের ভাঁড়টা ঠক করে পাশের বেঞ্চে নামিয়ে রাখলেন। ভাবীজীকে বোঝাবার একটা অক্ষম প্রচেষ্টা করলেন, “আরে নেহি নেহি…ম্যায়নে নেহি মাঙ্গোআয়া।”
কিন্তু ততক্ষণে কেলেঙ্কারি যা হবার হয়ে গেছে। মোবাইল নামিয়ে শর্মাজী রক্তচক্ষু তুলে তাকালেন, “জেলেবি খিলানেকা অওর কোই টাইম নেহি মিলা ক্যা? যা ভাগ।”
ছেলেটা কী অপরাধ করল না বুঝতে পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়েই ছিল। “ইধার লাও,” ড্রাইভার রামগোলাম পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে জিলিপির প্লেটটা টেনে নিল।
ব্লাডি মেরী
মুঘলসরাই এসেছি। রোজ প্ল্যান্টে যাই আর ফিরে আসি। অ্যালেজ, প্রোডাক্ট ইত্যাদি আপাত সম্পর্কহীন হাজারো এন্টিটির সুসমন্বয় না হলে কাজ শুরু হবে না। তার ওপর মারকেটিং-এরও ছাড়পত্র চাই। শর্মাজীর অসুবিধে নেই। সারাদিন ভাবীজীর সঙ্গে মোবাইলে খোসগল্প চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বউয়েরা দু’-মিনিট কথা বলেই ‘ওই দ্যাখো, বাবুন অ্যা করে ফেলেছে। পরে কথা বলব,’ বলে ফোন কেটে দেয়। মুঘলসরাই অত্যন্ত নিরেস যায়গা। আমরা রেলব্রীজের যে দিকে থাকি সে দিকে একটি মাত্র সিনেমা হল। তাতে ‘চামেলীকি শাদী’ বা ‘ডাকু রাণি চম্পাবাই’ টাইপের সিনেমা চলে। দু’দিন নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকার পর তাপস বলল, “সিধুদা চল ওই ডাকু রাণি চম্পাবাইকেই দেখে আসি।”
কিন্তু আমরা সেই সিনেমা হলে গিয়ে কাউন্টার খুঁজে পেলুম না। গ্রীলের সামনে একটা দারওয়ান বসে ছিল। আমাদের ঘুরঘুর করতে দেখে সে সন্দেহের চোখে তাকাতে লাগল। আমরা ঝামেলা না বাড়িয়ে ফিরে এলাম।
হোটেলে ফেরার পর শর্মাজী জানালেন সন্ধেবেলা বড়সাহেব পার্টি রেখেছেন। বড়সাহেব বেনারসে বড় হোটেলে উঠেছেন। ভাবলাম যাক আজকের সন্ধেটা ভাল কাটবে। শর্মাজী একটু দোনামনা করে বললেন, বেনারস যাচ্ছিই যখন, একটু আগেভাগে বেরিয়ে মুজরো দেখে গেলে হত না?
তাপস ভেংচি কেটে বলল, “মু-মে দাঁত নেহি হ্যায় মুজরো দেখনে চলে…”
শর্মাজী বেজায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। দাঁতের সঙ্গে মুজরোর কী সম্পর্ক সেটা আর জিজ্ঞেস করতে পারলাম না তাপসকে। রামগোলামের জিপ টহনত্ ছিলই। আমি তাপস আর শর্মাজী বিকেল-বিকেল বেনারস রওনা দিলাম। ঘন্টা খানেকের পথ।
বড়সাহেব মেজাজি মানুষ। আমাদের আপ্যায়নের কোন ত্রুটি নেই। ইলাহি খাওয়ার আয়োজন হোটেলের ডাইনিং হলে। সঙ্গে লাইভ গজল প্রোগ্রাম। বন্দোবস্ত দেখে শর্মাজীর মুখে হাসি ফুটল। দাওয়াত শুরু হল সাহেবের ফেভারিট ককটেল ব্লাডি মেরী দিয়ে। এক চুমুক দিতে না দিতেই পোডিয়ামে অত্যন্ত ফর্সা এক মহিলা মারাত্মক সরু গলায় গজল ধরলেন। ঝাড়বাতির আলো তাঁর নাকের নথে ঠিকরোতে লাগল। কথায় বার্তায় পার্টি জমে উঠল।
পেটে প্রথম মোচড়টা টের পেলাম ফেরার পথে। সাংঘাতিক জ্যাম রাস্তায়। তবে রামগোলাম ওস্তাদ ড্রাইভার। আমাদের ঘুর পথে নিয়ে এল, গঙ্গার ওপর পনটুন ব্রীজ পার হয়ে। যাঁরা পনটুন ব্রীজ কী বস্তু জানেন তাঁরা আমার সেদিনের অবস্থা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন। এই গল্পটা যাকেই বলেছি সেই আমায় ছি-ছি করেছে। ব্লাডি মেরীর এই দুর্নাম কেউ সহ্য করে না। আমি যতই বোঝাবার চেষ্টা করি, আহা শুধু তো ব্লাডি মেরি না, সঙ্গে সরু গলায় গজল… নাকের নথে আলোর ঝলকানি… পনটুন ব্রীজ… কেউ মানতেই চায় না।
পারমার কাট্টা
মুঘলসরাই ষ্টেশন কম্পাউণ্ডের ফটকের উল্টোদিকেই বাজার, পারমার কাট্টা। সকাল-সকাল শর্মাজী আমায় বগলদাবা করে ডাক্তারখানা নিয়ে চলেছেন। পারমার কাট্টার একটা সরু গলির মধ্যে ডাক্তারখানা। দু’দিন আগেই শর্মাজী নিজের জন্যে দাওয়া নিয়ে গেছেন। সকাল ন’টাতেই পারমার কাট্টা বেচাকেনার চহল-বহলে সরগরম হয়ে আছে । ষাঁড় আর মানুষের গুঁতো খেতে খেতে কোনওমতে ডাক্তারখানায় পৌঁছে শুনলাম, বসতে হবে। ডাক্তারবাবু একটু বেরিয়েছেন।
মিনিট পনেরো পর দেখলাম এক টাক মাথা ভদ্রলোক দু’-হাতে দু’টি বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে ফিরলেন। ব্যাগ নামিয়ে কাঠের চেয়ারে এসে বসতে বসতে শর্মাজীকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপকা তবিয়ত আভি ক্যায়সি হ্যায়?”
শর্মাজী ঘাড় নেড়ে জানালেন, একদম তন্দুরস্ত। তারপর আমার দিকে দেখিয়ে বললেন, “ইসকা ভি ও-হি হাল হ্যায়। একদম লুজ। কাল রাতসে আনা-যানা চালু হ্যায়। কমসে কম বিশ বার হো চুকা।”
ডাক্তারবাবু আমার অবস্থা দেখে একটু শঙ্কিতই হলেন, মনে হল। বললেন, “এ তো বড়া মুসিবত হ্যায়। আপ-বালা মেডিসিন-হি দে দেঁ?” শেষ প্রশ্নটা শর্মাজীর উদ্দেশ্যে। মনে হল তাঁর নিজের ডাক্তারি বিদ্যার থেকে শর্মাজীর মতামতের ওপরই তাঁর বেশি ভরসা।
পরের দিন থেকেই মাঠে-ঘাটে দৌড়োতে হবে। ডাক্তারখানার বাইরেই ওষুধের দোকান। ওষুধ কিনে রাস্তায় পা দিতেই শর্মাজী গম্ভীর ভাবে বললেন, “বেকারকা দাওয়া হ্যায়। ফেক দো। ইয়ে তো ম্যায়নে খায়াহি নেহি।”
আমি নিতান্ত আশ্চর্য হয়ে বললাম, “মত্লব?”
শর্মাজী বললেন, “চল্ মেরে সাথ।”
আমাকে নিয়ে বাজার ছাড়িয়ে ডান দিকে একটা পাথর বাঁধানো রাস্তায় ঢুকলেন। একটা একানে চালার নিচে একজন বেনিয়ান গায়ে কয়লার উনুনে দুধ জ্বাল দিচ্ছে। তার সামনে কাঠের বেঞ্চে বসে অর্ডার করলেন “দো রাবড়ি লাও।”
হাফ কিলোর মাটির ভাঁড়ে রাবড়ি এল, মালাই মারকে। থকথকে, দইয়ের মত জমা। একটু ভয়ে ভয়েই মুখে তুললাম। আহা কী অপূর্ব তার স্বাদ! মনে হল জিভ থেকে শুরু করে পুরো ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ঘুম ভেঙ্গে নড়ে-চড়ে বসল।
শর্মাজীর দাওয়া যে এমন ম্যাজিকের মত কাজ করবে তা ভাবতে পারিনি। বিকেলের মধ্যেই শরীর ঝরঝরে হয়ে গেল। পেটে চনচনে খিদে। শর্মাজী চোখ মটকে বললেন, “তেরি ভাবীকো মত বাতানা।”
Add comment