দুর্গাপূজা …. এবং….
হিমাংশু নাথ, ১৯৭৭ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
আমার ছোটবেলায়, মানে স্কুলে পড়াকালীন থাকতাম বেহালার অশোকা সিনেমার পিছনে, পাড়ার নাম যদুকলোনী। যারা বাড়ির মালিক ছিলেন, তাঁদের কাছে ‘কলোনী’ শব্দটা বোধহয় কৌলিন্যে আঘাত করতো, তাই বাড়ির দরজায় নেমপ্লেট ও লেটার বক্সে যদুপার্ক কথাটা লিখতেন। আমরা যারা ভাড়াটে ছিলাম, আমাদের বিশেষ কিছু এসে যেতো না।
বিভিন্ন রকমের একতলা, দোতলা বাড়ি, এক আধটা তিনতলা। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জন সমাবেশ। টিউব ওয়েল, খোলা ড্রেন, আর সন্ধ্যা হলেই মশাদের রিজার্ভ ফরেস্ট। প্রায় সব বাড়িতেই কয়লার উনুন, শীতকালে সামান্য উঁচুতেই ধোঁয়াশার আস্তরণ। অনেক বাড়িতেই সন্ধ্যাবেলা হারমোনিয়াম বাজিয়ে কিশোরী এবং প্রায় যুবতীদের সঙ্গীতচর্চা, বিয়ের বাজারে সিভি আপগ্রেডের আন্তরিক প্রচেষ্টা। তাঁরা প্রধানত রবীন্দ্রসংগীতই চর্চা করেন। হারমোনিয়াম বাজিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বা লতা মঙ্গেশকরের গানের প্রাকটিস খুব একটা শোনা যেতো না। কেউ হয়তো আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা, এই গানটা শিখতেই ছয় মাস কাটিয়ে দিলেন।
পাড়ায় বিভিন্ন সাইজের খোলা জায়গা ছিলো, সাথে সামান্য ঘাসের আস্তরণও। আমরা সেগুলো খেলার মাঠ বানিয়ে ফেলেছিলাম। কোনো ছাঁদ ছিরিদ বিশেষ নেই, মাঠের থেকেও ঘেসো জমি বললে ঠিক হবে। মাঝেমাঝে মাঠের মধ্যে নতুন বাড়ির ভীত শুরু হলে আমাদেরও মাঠ বদল হয়ে যেতো অন্য কোনখানে। আজকের মতন মাঠ দখলের মস্তানি তখনও আসে নি।
পাড়ার মাঝে বেশ টলটলে একটা পুকুর। খুব কম বয়সেই ফুটবল খেলে গা ধুতে ধুতে অজান্তেই সবাই ঐ পুকুরেই সাঁতার শিখে নিলাম। বাবা-মারা জানতেও পারতেন না কবে আমরা সাঁতার শিখে গেছি। এই পুকুরেরই কোনাকুনি ফাঁকা মাঠে, মণিমালার ক্লাব ছিলো (মনে আছে? মৌমাছি প্রতিষ্ঠিত)। আর পাড়ার পুজোগুলিও এই মাঠেই হোতো।
আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে গ্ল্যামার ব্যাপারটা মাঝেরহাট ব্রিজ টপকিয়ে এদিকে আসে নি। মেয়েদের সালোয়ার ছিলো বেশ ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। কিন্তু স্কুলের ইউনিফর্ম ছিলো ফ্রক, তারপরেই শাড়ি। কেউ যদি বা একটা শালোয়ার কামিজ কিনেও ফেলে, অষ্টমীর দিন ছাড়া সারাবছর সেটা আলমারিতেই জমা থাকতো। এমনকি বিয়ে বাড়িতেও অচল। মা’দের প্রবল আপত্তি … মেয়েকে ওই ড্রেস পরতে দেওয়ায়। আর জিনস ফিনস তখনও ভারতে চালুই হয় নি! সেখানে দেশপ্রিয় পার্ক, বকুলবাগানের পুজোতে চোখ ঘোরালেই বৈচিত্র্য, ৭২ এর গ্ল্যামার …ছেলেদের রাজেশ স্টাইলের চুল, গুরু পাঞ্জাবি, তার কিছুদিন পরে ঋষি কাপুরের ‘হাম কিসিসে’ স্টাইলের ৩২” ঘেরের বেলবটম…
স্কুলের ক্লাস সিক্স সেভেন থেকেই পাড়ায় তিনটি মেয়েকে আমার খুব পছন্দের ছিলো, কিন্তু ব্যাস ঐটুকুই। দুজন ছিলো আমার সমবয়সী, আর তৃতীয়জন আমার থেকে বছর চারেকের বড়। কিন্তু ঐ চার বছরের বড়কেই আমার সবথেকে পছন্দের ছিলো। কখনো তাঁকে মনে হতো সায়রা বানু, কখনো বা লীনা চন্দ্রভারকর। আসলে সেইসময় যেসব হিন্দী সিনেমার পোস্টার পড়তো, আমারও ওঁকে সেই সিনেমার নায়িকার মতন মনে হতো। একবার তিসরি মঞ্জিলের পোস্টার দেখে ওঁকে হেলেনের আসনেও বসিয়েছিলাম। কিছুদিন বাদেই হেলেনের বায়ডাটা পড়ে নিজের ভুল বুঝতে পারি, আর তৎক্ষনাৎই ওনাকে আসনচ্যুত করে দিয়েছিলাম। চতুর্থ একজন ছিলো, তিনি একটু উচ্চকুলজাত। গাড়িতে করে স্কুলে যেতেন, ক্লাবে গিয়ে সুইমিং শিখতেন, ব্যাডমিন্টন খেলতেন। দশটা কথায় আটখানা ইংরেজি, দুটিমাত্র বাঙলায়। সে পাড়ায় মাত্র গুটিকয়েক মেয়ের সাথেই মিশতো। আর পাড়ায় যেহেতু একমাত্র আমিই কিছুটা ভালো ইংরেজি বলতাম, তাই সারা বছরে ওর সাথে আমার দু’তিনবার কথা বলার সুযোগ হতো, দুর্গাপূজা, সরস্বতীপূজা বা চাঁদা তোলার সময়। আমার অতৃপ্ত মনে এর বেশি আর কিছুই পেতাম না।
ক্লাস টেন ইলেভেনের সময় আমার মনের চেতনাগুলো ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছে। ভাসানের আগে স্কুলের ছেলেমেয়েরা সবাই বেদীতে উঠে মা সরস্বতীকে ছুঁয়ে প্রণাম করার সময় বেশ ভালোরকম ভীড় হয়ে যেতো। আর সেইসময় অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাঝেমধ্যে সামান্য ধাক্কা লেগে যেতো। সেইযুগের বেশ কিছু মধুর ধাক্কা আজও আমার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।
এরপর আমার ১৯৭২ সালটা অন্যান্য বছরের থেকে আলাদা। স্কুলের গন্ডি টপকানো এবং কলেজে প্রবেশ। আরও একটা ঘটনা এই দুটো ব্যাপার ছাড়াও আমার স্মৃতিতে অমলিন থেকে যাবে।
১৯৭২ সালে আমাদের পাড়ার পুজোর ২৫ বছরের রজত জয়ন্তী বর্ষ। পোষাকি রজত জয়ন্তী চলতো না, বলা হতো জুবিলি ইয়ার। পাড়ার জুবিলি বলে কথা, ছোটখাটো ব্যাপার নয়। আগের বছর থেকেই প্রস্তুতি ও উত্তেজনা। আগের বছর খুব অনাড়ম্বর ‘প্রাক- জুবিলি’ পুজো করে পুজো-ফান্ড বাঁচানো হয়েছিলো, যাতে জুবিলি খুব ধূমধাম করে করা যায়।
সেই ৭২ সালেই আমার এবং আরও অনেক বন্ধুর HS JEE হয়ে যাওয়ার পরেই সকলের পড়াশুনোই শিকেয় তুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা তখন কিশোর, পাড়ায় স্ট্যাটাস কর্মী ব্রিগেড, মনে বিরাট উত্তেজনা। মুখে মুখে আচার, কাসুন্দি সহযোগে পুজোর আপডেট আসছে, স্কুপ আসছে। গল্পের গরুকে গাছে নয়, এক্কেবারে আল্পস পর্বতের চূড়ায় তুলে দেওয়া হচ্ছে। নাটকের রিহার্সাল, গানের প্র্যাকটিস, আর্টিস্টদের সঙ্গে চুক্তি, সব পুরোদমে সমান্তরালে চলছে। যেসব মেয়েরা গানের প্র্যাকটিস করছে, তাঁরা যতটা চিন্তিত, তাঁদের জন্য আমার চিন্তা আরও বেশি। একটি মেয়ে শুনতাম ভারতনাট্যম শেখে। ভারতনাট্যম সম্বন্ধে জ্ঞান ছিলো না, কিন্তু চেয়েছিলাম সে মঞ্চে একবার আত্মপ্রকাশ করুক। কিন্তু হলো না।
আমি মনঃস্থির করে ফেলেছি। আগে থেকেই মায়ের থেকে কথা আদায় করে নিয়েছি, সন্ধ্যাবেলায় ফুচকা, ঘুগনী খাওয়ার জন্য রোজ আমি আট আনা (পঞ্চাশ পয়সা) ভাতা পাবো। আর আমার পছন্দের মেয়েরা প্যান্ডেলে যখনই ফুচকা, ঘুগনী খেতে যাবে, তখন আমিও ওঁদের পাশে গিয়ে নিজের জন্য অর্ডার দেবো। তারপর কি হবে জানি না, যা হবে ঈশ্বরের ইচ্ছায় হবে।
পূজোর ব্যাপারে আসি। এক বিশেষ ‘পার্সোনাল কন্টাক্টের’ মাধ্যমে শিল্পী রমেশ পালকে এবারে আমাদের প্রতিমা বানানোর জন্য রাজী করানো হয়েছে। অন্যদিকে অনেকদিন ধরেই কারিগরেরা এসে প্যান্ডাল বানাচ্ছে। এবার আশেপাশের পাড়াদের দেখিয়ে দিতে হবে প্যান্ডেল কাকে বলে। দিনের বেলায় জুনিয়র স্কুলের বাচ্চাদের ফেরার পথে প্যান্ডেলের চারিদিকে কৌতূহলি ভীড়। আর পড়ন্ত বিকেল থেকে একটু সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা যারা লায়েক হবার পথে কিছুটা এগিয়েছি তাদের আড্ডা। সন্ধ্যা নেমে গেলে চাকরি দাদাদের জমায়েত, রিহার্সাল রুমের জানলায় উঁকিঝুকি। বিজ্ঞজনেরা পর্যালোচনা ও তদারকিতে ব্যাস্ত।
মান্না দে আগের বছরে পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন। সুতরাং শিল্পীদের তালিকায় তিনি সবার উপরে। ওনাকে আনা হবে। সঙ্গে আরেক জনপ্রিয় শিল্পী আরতি মুখার্জিকে নিয়ে বিজয়ার ফাংশনের ব্যাবস্থা চলছে। বুকিং কমপ্লিট। সন্ধ্যায় পাড়ার প্রাজ্ঞরা কিভাবে অভ্যর্থনা করবেন, তার আলোচনা, সব মিলিয়ে একটা ঢ্যাম কুড়কুড় অবস্থা। বেহালার তখন কোনো গ্ল্যামারই নেই, ফলে সুন্দরীদের দেখতে ভবানীপুর, গড়িয়াহাটই ভরসা। কিন্তু সেবার সে সবের কোনো প্ল্যানই নেই, গোটাটাই পাড়াতে বিভিন্ন একটিভিটির প্ল্যান হয়ে গেছে, (যারা ভাগ্যবান) চিঠি চালাচালি কম্পলিট।
উদ্বোধনের জন্য সেলিব্রিটিদের ডাকাডাকি তখনও খুব চালু হয় নি। ঠিক হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনের একজন সাধক পঞ্চমীর সন্ধ্যায় এসে পুজোর উদ্ঘাটন করবেন।
আমাদের পুজোর স্যুভেনির হবে বেশ মোটা, চকচকে সুন্দর, থাকবে পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ। পাড়াতে জনাকয়েক প্রভাবশালী ছিলেন। একজন PTI এর খুবই হোমরাচোমরা ছিলেন, ওনার দাক্ষিন্যে স্যুভেনির তৈরি হয়েছিলো। (ভদ্রলোক ছেলের বিয়েতে ছাদে প্যান্ডেল করে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এসেছিলেন)। আমি শেলীর একটা ইংরেজি কবিতা নিজের নামে চালিয়ে সম্পাদকের কাছে জমা দিয়ে এলাম। উনি জানতেন আমি ইংরেজিতে ভালো, তাই সরল মনে আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, কিন্তু সেই ছাপানো কবিতা পড়ে আমার পিতৃদেব বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেরা পাওনা ছিলো, সেই সুইমিং করা, ব্যাডমিন্টন খেলা মেয়েটির বাবা আমার কবিতার তারিফ করেছিলেন। আমাদের সেই স্যুভেনিরে সুনীল গাঙ্গুলী, রমাপদ চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরও লেখা ছিলো – যেরকম ছোটো খাটো পুজো ম্যাগাজিনে থাকে। এগুলো হয়েছিলো আনন্দবাজারে একজনের বদান্যতায়। আবাসিক ছিলেন। মোটকথা হাতে হাত মিলিয়ে সবাই একটা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
তৃতীয়ার বিকালে হঠাৎই জোর হৈ চৈ। চারিদিকে ‘আগুন’, ‘আগুন’ চিৎকার। বাড়ির বাইরে আসতেই দেখি অনেক লোক, এমনকি মহিলারাও দৌড়চ্ছেন পুজোর মাঠের দিকে। আকাশে ঘন কালো ধোঁয়া ও ফুলকি নীচের থেকে উঠছে। ওই অবস্থায় দৌড়ালাম। আমাদের বাড়ির পাশেই পুজোর মাঠ। ১/২ মিনিটের মধ্যেই আমরা প্যান্ডেলের সামনে।
বেশি নাটকীয়তা বৃদ্ধি করে লাভ নেই। গোটা প্যান্ডেল মাটিতে। চারিদিকে কালো কাপড়, বাঁশ, কাঠের স্তুপ। বেশকিছু লোক, আমার বন্ধুরাও ছিলো, বালতি করে পুকুরের জল তুলে তখন আগুন নেভাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই প্রথমে দমকল, পরে পুলিশের গাড়ি এলো। দমকলের দেরীতে আসার জন্য উত্তেজনা। কেউই বুঝতে চাইছে না, সর্ট সার্কিটের আগুনে এরকমই হবে, দমকল যখনই আসুক না কেনো! একটু পরে এম্বাসাডার গাড়িতে আনন্দবাজারের মিডিয়া রিপোর্টার গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এলেন। ফটাফট ধ্বংসস্তুপের ছবি তুললেন। কিছু লোকের সঙ্গে কথা বললেন। PTI দাদাকে আশ্বস্ত করে বললেন, কাল কাগজে অবশ্যই থাকবে। পরের দিন চতুর্থীতে প্রথম পাতায় ‘মন্ডপে অগ্নিকান্ড’ নামে ঘটনাটি ছাপা হয়েছিলো।
সবাই চেলে গেলে দেখলাম মাঠ ভর্তি জল, কাদা, আবর্জনা। আমরা পোড়া সামগ্রী কোদাল, ঝুড়ি দিয়ে পরিষ্কার করছি। কারোরই উৎসাহ নেই। কথাও নেই। চারিদিকে কান্নাকাটি, বিলাপ, বুক চাপড়ানো, হতাশা ও আশাভঙ্গের ছাপ। সারা পাড়া শোকস্তব্ধ। এমন সময় পাড়ার কেষ্ট বিষ্টুরা লাইব্রেরি ঘরে মিটিং এ বসলেন দরজা বন্ধ করে। আমরা কিশোরবাহিনী বন্ধুদের দল একেবারেই চুপ মেরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি, প্যান্ডেলের পাশে রোয়াকে, পাঁচিলে। রাত তখন প্রায় ১২ টা।
পাড়াতে যেমন বেশিরভাগই সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরে বা মামুলি দোকানদার, বা ব্যাবসায়ী ছিলেন, সেরকম হাতে গোনা কিছু অতি সমৃদ্ধশালী ব্যাবসায়ী ( সিভিল কন্ট্রাক্টর), একজন পসারওলা উকিল, বেশ নামী শিশু চিকিৎসক, এছাড়া তখন বেহালার বিধায়ক ইন্দ্রজিৎ মজুমদার, এনারা আমাদের পাড়াতেই থাকতেন। আর ছিলেন রাজ্য পুলিশ বিভাগের, ও ফিল্মের লাইনের কয়েকজন। একজন ছিলেন তপন সিনহার সহকারী, কিন্তু একেবারেই কায়দা বিহীন।
সেন পদবীর দু ভাই এর পৈতৃক সিভিল কন্ট্রাক্টরের ব্যাবসা ছিলো। পাড়াতেই দুটো আলাদা বড়ো বাড়িতে থাকতেন। বড়ো ভাইয়ের ছেলে আমাদের দু’ব্যাচ আগের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ছোটো ভাই নিঃসন্তান, আরো বৈভব বেশি। রেস কোর্সের একটা ঘোড়ার মালিক ছিলেন। সরস্বতী পুজোর সময় মোটা অংকের চাঁদা দিতেন৷। মনে আছে ক্লাস সিক্স সেভেনে, চাঁদা চাইতে গেলে বাড়ির লোকেদের দিয়ে যে চাঁদা পাঠাতেন তারপরে আমাদের আলোকসজ্জা, আর ভোগের মেনুটাই পাল্টে যেতো। ছোটো ভাই ১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিক দেখতে গেছিলেন। এতসব বর্ননা দিলাম, পরবর্তী পর্যায়ে একটা যোগাযোগ আছে বলে।
রাতে মিটিং শেষ হলে লাইব্রেরি রুমের দরজা খুলে গেলো। আমরা কয়েকজন রোয়াক থেকে উঠে এগিয়ে গেলাম। একটা উঁচু মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে পাড়ার এক করিতকর্মা দাদা প্রথমেই বললেন, প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছে পুজো হবে। কিভাবে হবে স্পষ্ট নয়, তবে ঘটপুজো হবে না, প্রতিমার পুজোই হবে। পাড়ার সবাইকে যার যার সাধ্যমতো সাহায্যের আবেদনও করা হলো।
একটা হাল্কা হাততালি। এর বেশি আর কি হবে? বলা হলো, কয়েক জায়গায় ফোন করা হয়েছে। সবাই সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু কি হবে কিভাবে হবে, সেটা আগামীকাল সকাল ১০ টা নাগাদই বোঝা যাবে। আমাদের কিশোর ব্রিগেডকে বলা হোলো, বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিতে (আমরা কেউই দুপুরের পরে খাই নি!) এবং সকালে ১০ টার সময়ে চলে আসতে।
সকাল ১০ টার আগেই সবাই হাজির। আবার দরজা বন্ধ করে মিটিং। এবার মিটিংএ পাড়ার সব কেষ্টবিষ্টুরাই হাজির। একটু পরে আবার বুলেটিন এলো, কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। বলা হলো আমরা ইন্দ্রপুরী স্টুডিও তে যোগাযোগ করেছি। তাদের টিম আজ বিকেলেই জিনিসপত্র নিয়ে আসছে। পাড়ার লোকেদের ভাগ ভাগ করে তাঁদের খাওয়া দাওয়া, বাথরুম, বিশ্রামের ব্যাবস্থা করতে হবে। আর আমাদের সারারাত ওনাদের সঙ্গে থাকতে হবে।
নিমেষে পট পরিবর্তন। রাতে যেটা চটপটি হাততালি ছিলো, সেটা এবার জোরালো, দীর্ঘ হলো। সঙ্গে সিটি, কোমর দোলানো …. ভাসানের নৃত্যের একটা ছোটো সংস্করণ। আমি কালবিলম্ব না করে আমার পছন্দের সেই তিনটে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে এলাম, “কাকীমা, পুজো হবে।“
– ওঃ মা, তাই। খুব ভালো খবর দিলি রে হিমাই।
কি হবে, কিভাবে হবে নিজের মতন ভার্সন করেই বললাম। আর আমার কেন জানি না, হঠাৎই জল তেস্টা পেলো। সেদিন ঐ আধ ঘন্টা বা মিনিট চল্লিশের মধ্যে যতজন কাকীমার বাড়িতে খবরটা দিতে গিয়েছিলাম, সবকটা বাড়িতেই আমার ভীষণ জলতেস্টা পেয়েছিলো।
বিকেলেই দেখলাম বেশকিছু লোক গাড়ি, লরি করে জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। ১০ মিনিটে সব জিনিস সবাই মিলে নামালাম। ১৫ মিনিটের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেলো। শুনলাম জমিদার বাড়ির সেট হবে। ইতিমধ্যে ফ্লাড লাইট লাগানো হয়ে গেছে। সারা রাত কাজ করার প্রস্তুতি। আর কয়েক ঘন্টা পরেই পঞ্চমী। সিনেমার সেট কি ভাবে হয় সেটা সেদিন চোখের সামনে দেখেছিলাম। ডিটেইল বলা অর্থহীন।
আগে হতো বাঁশের খুঁটিতে রঙিন কাপড় বেঁধে ডেকরেশন। এবার দেখলাম খুঁটির চারিদিকে যেরকম building column casting হয়, সেরকম কাঠের কেসিং দিয়ে ঘেরা হলো। তারপরে একতাড়া কাগজ, শুনলাম কাগজগুলির নাম মার্বেল পেপার। ঐ কাগজগুলো আঠার জলে গুলে, যেভাবে সিনেমার পোস্টার দেওয়ালে সাঁটায় সেভাবে ওই কাঠের বাক্সে সাঁটিয়ে দেওয়া হলো। বোধহয় ৩০ মিনিটের মধ্যেই গোটা প্যান্ডেলের ভিতরটা জমিদার বাড়ির নাট মন্দিরের আদল নিলো।
গোটা ব্যাপারটা হয়েছিলো একজন আর্ট ডিরেক্টরের নির্দেশে। শুনেছিলাম উনি তপন সিনহার আর্ট ডিরেক্টর। টিপিকাল ফিল্মি ডায়রেক্টর এপিয়ারেন্স। মাথার টুপি উল্টো কায়দায় পরেন। চেয়ারে বসার কায়দাও উল্টো করে। চেয়ারের ব্যাক রেস্ট সামনের দিকে রেখে ঝুঁকে পরে সব দেখছিলেন। আমাদের দিয়েও ছোটখাটো কাজ করাচ্ছিলেন, উৎসাহ সব সময়েই চলছিলো। কোনো চেঁচামিচি নেই। একজন প্রজেক্ট ম্যানেজারের কি কি গুন থাকা উচিৎ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পাড়ার তিনজন বেশ ভালো আঁকিয়ে শিল্পীকেও কিছু কাজ বুঝিয়ে দিলেন। আমরা বেশিরভাগই লেবার ক্যাটাগরিতে ছিলাম। তবে যাঁদের মনের কোনে একটুও আকাঙ্খা ছিলো রূপালী পর্দায় আত্মপ্রকাশ করার, তাঁরা কারণে অকারণে বিভিন্ন ভাবে ঐ আর্ট ডিরেক্টরের পাশাপাশি ঘুরঘুর করেছিলো।
আরেক সুখবর। রমেশ পালের একটি প্রতিমা কোনো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে অবিক্রিত। উনি বিনামূল্যে ওই প্রতিমা আমাদের দেবেন। তবে রঙ করা বাকি আছে। পঞ্চমীর রাতে সেই প্রতিমা লরি করে এলো। দেখি নাকে নোলকের সঙ্গে ছোটো ধুনুচি। কেনো? না, রঙ শুখনো করার জন্য, ধুনুচিতে কাঠকয়লা!
পুজোর খরচের সিংহভাগ পাড়ার সব বৈভবশালিরাই দিয়েছিলেন। ওনাদের কথা আগেই লিখেছি। সেনভাইদের ছোটোজন শুনেছিলাম ইন্দ্রপুরীর গোটা খরচটাই দিয়েছিলেন। আর শুনেছিলাম নামমাত্র মূল্যেই কাজ হয়েছিলো। ওই বয়সে কে আর এসব খোঁজ রাখে? তবে গোটা ব্যাপারটা একটা সংঘবদ্ধতার ছবি এঁকেছিলো, সেটাই মনে রয়ে গেছে। সবেতেই ‘খুঁত ধরা’ এক কাকু পর্যন্ত ষষ্ঠীর দিন বলে গেলেন – নাঃ তোমরা ময়দানবকেও হার মানালে!
ষষ্ঠীর সকালে মন্ডপ, প্রতিমা রেডি। ঠিক ৩৬ ঘন্টায়। ইলেকট্রিকের কাজ চলছিলো, সেটাও বিকেলের মধ্যে শেষ। ষষ্ঠীর সকালে কলাবৌ স্নানে বোধন শুরু। কেউ না জানলে বুঝতেই পারবেনা কোনো পরিবর্তন।
অষ্টমীর দিনে সায়রা বানু দিদিকে লুকিয়ে খিচুড়ি, বেগুনভাজা, আর পায়েস ভোগ খাওয়ালাম। আর অন্যদের দিলাম আপেল, কলা, বোঁদে। পরে শুনলাম সুইমিং শেখা ব্যাডমিন্টন প্লেয়ারও এসেছিলো। দুর্ভাগ্য আমি তখন প্যান্ডেলে ছিলাম না। নইলে ওঁকেও খিচুড়ি পায়েস দিতাম। ওদিকে প্রতি সন্ধ্যাবেলায় পকেটে পঞ্চাশ পয়সা নিয়ে চুলে গন্ধ তেল মেখে টেরি কেটে তৈরি থাকতাম। কিন্তু কিস্যুই হলো না। কেউ ফুচকা ঘুগনী খেতে এলো না। ঐ দেড় টাকা অনেকদিন আমার কাছেই পড়ে ছিলো।
পুজোর পরে ফাংশনও হলো। মান্না দে জমিয়ে গাইলেন। আরতি মুখার্জিও জমজমাট … কিন্তু স্টেজ কাঁপালো এক অচেনা শিল্পী … আমাদেরই বয়সী। অল্প কিছু হ্যান্ডস নিয়ে। বলা হয়েছিলো কিশোর কুমারের সুযোগ্য পুত্র। নাম – অমিত কুমার। সেই প্রথম শুনেছিলাম। তখন মুম্বাই নয়, বালিগঞ্জ প্লেসে রুমাদেবীর সঙ্গে থাকেন। বোধহয় পাঠভবন থেকে আমাদের ব্যাচেই HS দিয়েছিলেন।
মাত্র ৩৬ ঘন্টায় একটা বেদনা দায়ক ঘটনা থেকে অন্যতম খুশির দিনে পরিবর্তন।
সেই পঞ্চাশ বছর আগের পুরনো স্মৃতি … পুরোনো ঘি এর মত… যত পুরোনো তত দামী..
Add comment