দুর্গাপূজার কয়েকটি কথা
সুকান্ত রায়, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিওকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
দুর্গাপূজার ইতিহাস সুদীর্ঘকালের, তবে এর শুরুর সঠিক ইতিহাস আজও অজানা। হিন্দু পুরাণে দুর্গাপূজার বিভিন্ন কাহিনী পাওয়া যায়। কথিত আছে, পুরাকালে রাজা সুরথ তার হারিয়ে যাওয়া রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য বসন্ত কালে দেবী দুর্গার পূজা করেন। সেজন্য এই পূজাকে বাসন্তী পূজাও বলা হয়।
অন্যদিকে কৃত্তিবাসী রামায়ণে পাই শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে সীতা উদ্ধারকল্পে লঙ্কাধিপতি রাবণের সাথে যুদ্ধের সময় ১০৮টি নীলপদ্ম সহযোগে দেবী দুর্গার পূজার আয়োজন করেছিলেন। শরৎকাল দেবতাদের নিদ্রাকালীন পর্ব, তাই শ্রীরামচন্দ্রের এই পূজাকে অকালবোধন বলা হয়। তাছাড়া এই পূজাটি সম্পর্কে হিন্দুদের দেবীভাগবত পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, দেবীমাহাত্ম্যম্ ইত্যাদি স্থানে নানা প্রকার কাহিনীর উল্লেখ আছে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে বহু প্রাচীনকাল থেকেই দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপে আরাধনা হয়। আর বাঙালিরা মূলত কৃত্তিবাসী রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনকেই নিজেদের শারদোৎসব হিসেবে বেছে নিয়েছে। বাঙালির সেই দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটে আশ্বিন মাসের প্রথম দিনে, অর্থাৎ মহালয়ার শুভদিনে। সাধারণতঃ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত দূর্গাপূজার এই উৎসব উদযাপন হয়। শরৎকালে এই উৎসব হয় বলে এটি শারদোৎসব নামেও পরিচিত।
বাঙালীর জীবনে দুর্গাপূজার ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম ও প্রাণের শারদীয় উৎসব। বাঙালি চিরকালীন উৎসবপ্রেমী জাতি। “বাংলার মানুষের বারো মাসে তেরো পার্বণ” প্রবাদটি যথার্থ। সারাটি বছর তাই বাঙালির জীবন উৎসবের আনন্দে মুখর। আর এত উৎসবের মধ্যে শরৎকালের দুর্গোৎসবটি বাঙালির সবথেকে প্রাণের উৎসব, অন্তরের উৎসব।
বাঙালীদের দুর্গা আমাদের মতনই ঘর-সংসার, স্বামীসন্তান নিয়ে থাকেন। তিনি সপরিবারে তাঁর লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশকে নিয়ে কৈলাশ থেকে হিমালয়ে বাপের বাড়ি আসেন। বাঙালির মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার মতোই আনন্দ। তাই বাঙালি দুর্গাপূজাকে যেভাবে জীবনের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করেছে, তেমন আর কেউই করতে পারেনি। দুর্গা শুধুমাত্র মাতৃরূপে বা শক্তিরূপে নয়, কন্যারূপেও উমা বাঙালির সংসারের একজন। কথিত আছে, গিরিরাজ হিমালয় ও তাঁর স্ত্রী মেনকা কন্যা উমা বা পার্বতীকে বিয়ের পর কৈলাসে শিবের ঘরে পাঠিয়েছিলেন। বৎসারান্তরে সেই কন্যাকে দেখার জন্য মা মেনকার ব্যাকুল প্রার্থনা বাংলার বহু কাব্য আর সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে আমাদের আদরের মেয়ে আসবে মাত্র চার দিনের জন্য। আর আমরা সাধ্যমতন নিজেদের আনন্দের পসরা সাজাযই, নতুন জামা কাপড় ধারণ করি। একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সামাজিক উৎসবে পরিণত এইরকম দ্বিতীয় উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। মা দুর্গাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বাঙালির আগমনী সংগীত আমাদের একান্তই নিজস্ব। এর অনুভুতি সকল ধর্মীয় বিশ্বাসের বৃত্তের বাইরে।
দুর্গাপূজার এই পাঁচ দিন দুর্গা ষষ্ঠী নামে পরিচিত। আমরা বলি দেবীপক্ষ। পিতৃপক্ষের অবসানে অমাবস্যায় মহালয়ার মধ্যে দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা ঘটে। মহালয়ার এই দিনে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের স্মরণ করে তর্পণ করি। আর এই দেবীপক্ষের সমাপ্তি কোজাগরী পূর্ণিমায় দেবী লক্ষ্মীর পূজায়।
বিদেশে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড এবং ইদানিং সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শহরেই বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালীদের দুর্গাপূজা এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার শীর্ষে থাকে।
যতদূর জানা যায় কলকাতা শহরে সর্বপ্রথম দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। সুপ্রাচীন এই প্রথাটি এখনও রায়চৌধুরী পরিবারের সাতটি শাখার বিভিন্ন বাড়িতে পূজিত হয়। মহারাজ রাধাকান্ত দেবও কলকাতায় শোভাবাজারের নিজের রাজবাড়ীতে দূর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।
এর কিছুকাল পর থেকেই কলকাতা ও বিভিন্ন বাঙালী অধুষ্যিত শহর ও গ্রামাঞ্চলের জমিদার ও বনেদী পরিবারে দুর্গাপূজার শুরু হয়। এই পূজাগুলিতে আচার ও আনন্দের থেকেও মূখ্য ছিলো নিজেদের প্রতিপত্তি ও বিত্তের প্রদর্শন। এই প্রবণতায় ক্ষুব্ধ হয়ে রানী রাসমণি তাঁর জানবাজারের বাড়িতে সাধারণ মানুষের প্রবেশযোগ্য দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এরপর বিভিন্ন স্বচ্ছল পরিবারে ধীরে ধীরে পারিবারিক দুর্গোৎসবের উৎসাহ দেখা যায়।
এখনের দুর্গাপুজা মূলত সার্বজনীন। ধনী, দরিদ্র বা ধর্মীয় ভেদাভেদ দূরে সরিয়ে সবাই মিলেমিশে এই উৎসবের আয়োজন করেন। এই উৎসবে ধর্মীয় আবেগ খুবই কম। থাকে সম্প্রীতির মিলন। তাই জাত, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে আসেন, আর এখানেই বাঙালির দুর্গাপূজার সার্থকতা।
হিন্দু শাস্ত্রমতে প্রতি বছর উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ন এই দুটি ভাগে বিভক্ত। মাঘ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত উত্তরায়ণ এবং শ্রাবণ থেকে পৌষ পর্যন্ত সময়কাল দক্ষিণায়ন। উত্তরায়ণে দেবদেবীগণের জাগ্রতকাল এবং দক্ষিণায়ন দেবদেবীর নিদ্রাকাল। রামচন্দ্র যুদ্ধের প্রয়োজনে অকালে দেবীকে স্তব-স্তুতির মাধ্যমে দুর্গাপূজোর বোধন করেছিলেন। এই কারণে শারদীয় দুর্গাপূজাক অকালবোধন। বেলগাছতলায় মহাদেবের অনুমতি নিয়ে দেবীকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে বোধন পালন করা হয়।
পুঁথিতে দুর্গার উল্লেখ আছে বৌধায়ন এবং সাংখ্যায়নের সূত্রে। আমাদের মহাকাব্যেও দেবীশক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু সিংহবাহিনী যুদ্ধরতা দশভুজা দেবীর বিশেষ উল্লেখ নেই। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে অর্জুন দুর্গার পূজা করছেন। স্কন্দ-কার্তিকের মহিষাসুর নিধনের কথাও আছে।
আশ্বিন-কার্তিকের দুর্গাপূজা কৃষিপ্রধান গ্রামবাংলার জীবনের সাথে জড়িত। এখানে আমন ধান আসার অনেক আগে থেকে আউশ ধানের প্রচলন ছিল, সেই ধান পাকার সময়েই এই পূজা। মহিষের সম্পর্কে অনেকের প্রচলিত মত এই যে এই প্রাণীটি নিচু জমিতে বাস করে, আর সেই অঞ্চলে চাষের প্রসারের জন্য কৃষিজীবী মানুষ মোষ তাড়িয়ে কৃষিজমি দখল করে। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার আরাধনা হয়তো এই মহিষ নির্মূল অভিযানকে একটা ধর্মীয় বৈধতা দেওয়ার কৌশল ছিল, বিশেষ করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বা কংসনারায়ণের মতো জমিদারদের পক্ষে, যাঁদের সমৃদ্ধির মূলে ছিল কৃষির প্রসার।
সূত্রে পাওয়া যায়, রমাপ্রসাদ চন্দ এবং প্রবোধচন্দ্র বাগচী বলছেন, সিংহবাহিনী দুর্গাকে গুপ্তযুগের পরে বাংলায় বাইরে থেকে আমদানি করা হয়, কিন্তু অন্যদের মতে এই অঞ্চলেই তাঁর উৎপত্তি। এক অর্থে দুটো মতই ঠিক, কারণ এই দুর্গার স্থানীয় বৈশিষ্ট্য আছে, আবার বহিরাগত উপকরণও আছে। কিছু কিছু দুর্গামূর্তিতে দেখা যায়, সিংহের বদলে দুর্গার বাহন হলো গোধিকা বা গোসাপের মতো একটি প্রাণী, কালকেতুর কাহিনিতে যার কথা আছে। লক্ষণীয়, গোসাপ অনেক বেশি প্রাকৃত, সিংহ সে তুলনায় সংস্কৃত প্রাণী। উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলার পটুয়া ও চিত্রকররা সিংহকে জীবনে এই প্রাণীটিকে দেখেননি। উত্তর ভারতে আবার দেবী এখনও রয়াল বেঙ্গল টাইগারের পিঠে, ‘শেরাবালি’। সুতরাং দুর্গার রূপ নিয়েও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক মতভেদ আছে।
ইন্দোনেশিয়ায় বোরোবুদুর, সুরাবায়া, বান্দুং-এর মতো কিছু জায়গায় ছয় বা আট হাত বিশিষ্ট দুর্গার দেখা মেলে। জাভার একটি লিপিতে দেখা যায় এক রাজা যুদ্ধের আগে এই দেবীর পূজা করেছিলেন। জাভায় পনেরো ও ষোলো শতকে দুর্গাকে রক্ষয়িত্রী হিসেবে আরাধনার প্রবল প্রচলন হয়।
দুর্গার সন্তানদের নিয়েও মতভেদ আছে। কুমিল্লার দক্ষিণ মুহম্মদপুরে পাওয়া একটি দ্বাদশ শতকের মূর্তিতে দুর্গার সঙ্গে গণেশ ও কার্তিক আছেন, মেয়েরা নেই। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সরসীকুমার সরস্বতী এবং এনামুল হকের মতো ইতিহাসবিদরা অনেক চেষ্টা করেও চার ছেলেমেয়ে সংবলিত দুর্গার একটিও প্রাচীন ভাস্কর্য খুঁজে পাননি। দুর্গা বাপের বাড়ি আসার সময়, শুধু নিজের চার সন্তানদেরই নয়, যুদ্ধক্ষেত্র হতে রক্তাক্ত মহিষাসুরকেও সঙ্গে নিয়ে এলেন। দাশরথি রায় এবং রসিকচন্দ্র রায়ের মতো কবিরা সেই দৃশ্যের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।
আমাদের দুর্গার অনেক নাম। শরৎঋতুতে আবাহন, তাই শারদীয়া। এছাড়া মহিষাসুরমর্দিণী, কাত্যায়নী, শিবানী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চণ্ডী, শতাক্ষী, দুর্গা, ঊমা, গৌরী, সতী, রুদ্রাণী, কল্যাণী, অম্বিকা, অদ্রিজা এমনই অনেক নামে তিনি পরিচিতা।
সবার উপরে, মা দুর্গা আমাদের সকল অশুভ শক্তির বিনাশ করেন।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার – ইন্টারনেট)
Add comment