তাদোবা অভয়ারণ্যর বাঘ
রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার, ১৯৭২ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
কাজ ছিল বম্বেতে। এই দেখ, বকা খাব এখনি। বম্বে কি গো এখন তো মুম্বাই। ঠিক কথা। কিন্তু কি করা যাবে, মাথায় যে বম্বে এল। কি কাজ ছিল সে কথা গৌণ। কথা হল বম্বেতে বন্ধু আছে এক, যাকে এড়িয়ে বম্বেতে ঢোকাও যাবে না, বেরনোও নয়। ব্যাপারটা এমন, ওনার বাড়িতে আমার আরো অনেক বন্ধু। ওনার গিন্নি, মেয়ে, ছেলে সবাই আমাদের দুজনের বন্ধু। বন্ধু মানে আমার কাছে একটাই মানে ‘যার সাথে হিসেব না করে কথা বলা যায়’। এই তুমুল তক্কাতক্কি তো এই হি হি হাহা।
উনি বললেন চলুন তাদোবা, বাঘ দেখে আসি। আমার ঘরণীর ইচ্ছে ছিল এতদিন বাদে আবার যখন যাচ্ছি ওদিকে, চল আমাদের পুণের পুরনো ডেরাগুলো ঘুরে আসি। আবার কবে আসা হবে, বা আদৌ হবে কিনা …একটুও ঝগড়া হল না, ঠিক হয়ে গেল তাদোবা যাওয়া হবে, পুণে নয়। তবে তার আগে হাই ডেসিবেল অনেক কথা হল, ফোনে। মানেটা কি? আমরা কেউ আস্তে কথা বলি না কিনা! আমার দিকে কেউ ভুরু কুঁচকে তাকালে বলে দি ‘যাদের মনটা একদম আয়নার মত, তারা একটু জোরে জোরে কথা বলে’। বন্ধুর মেয়েটি বড় হয়েছে, চাকরি করে এখন, বলছে আস্তে আঙ্কল। বললাম
– এই কটকটি চুপ কর। বাঘেদের ফিস ফিস করে ডাকতে শুনেছিস? কেউ শুনেছে কিনা সার্চ করে দেখ। তোরা তো আবার গুগুল না বললে কিছুই বিশ্বাস করিস না।
“দাদার আমার হাজির জবাব”-আমার বন্ধু পত্নী।
তো, তাদোবা যাওয়া হচ্ছে। তারিখ?
আমাদের দুই গিন্নি জানতে চাইলেন এই তাদোবা ব্যাপারটা কি? দেখার কি আছে?
তাঁদের অবগতির জন্য জানানো হল এখানে, চন্দ্রপুর জেলায় তাদোবা আন্ধারি টাইগার পার্ক আছে।
– সে কি? আন্ধেরি তো বম্বেতে। এই দেখ, কোন চালাকি চলবে না কিন্তু। বম্বেতে চিড়িয়াখানায় নিয়ে বাঘ দেখাবে, সে সব ফাজলামো করলে কিন্তু তুলকালাম করব।
– আবার ওনাকে টানছ কেন?
– কাকে?
– আমাদের নমস্য কালাম সাহেব কে।
– কালাম বলেছি? না তুল কালাম?
– এনারা কথা বলতেই দেবে না দেখছি।
তাদোবা একটা অভয়ারণ্য, একটা জাতীয় উদ্যান মিলিয়ে মস্ত এলাকা। তিরিশ কিলোমিটার লম্বা, কুড়ি কিলোমিটার চওড়া একটা এলাকা ভাব যেখানে শুধুই বন আর জঙ্গল। থাকবে বন্য প্রাণীরা। ওখানকার আদিবাসীদের এখনও পুরো সরানো যায় নি। তবে ওনারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ভালো করে জানেন কি করে বন্য প্রাণের সাথে মিলেমিশে থাকতে হয়।
তাদোবা, উচ্চারণটা যদি তাড়োবা কর, একটু মারাঠি ঢঙ্গে তাহলে দেখবে লুকিয়ে আছে ‘তরু’ –গাছ। ওখানকার আদিবাসীদের উপাস্য। সেই থেকে তাড়োবা। আর আন্ধেরি নদী বয়ে গেছে ঐ অঞ্চল দিয়ে। এইবার ভালো লাগছে তো? তাহলে বাংলায় মানে দাঁড়ালো যাচ্ছি “জঙ্গল আর নদী”র কাছে। এই লেকের একপাশে বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্য, অন্য পাশে গাঁয়ের চাষ জমি। মাঝের তাদোবা লেক তাদের জন্য ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’…। গল্প আছে তিমুর পাহাড়ে গন্ড আদিবাসীদের রাজার নাম ছিল “তরু”। তিনি একবাঘের সাথে ভয়ঙ্কর লড়াই করে মারা যান। তাঁর বিক্রম তাঁকে দেবতা বানিয়ে দেয়। তাঁর নামে মন্দির হয়। আজো তাদোবা লেকের কাছে মস্ত এক গাছ তলায় তাঁর মন্দির আছে। পৌষ মাসে সেখানে আদিবাসীদের মেলা হয়।
– তাহলে আমরা এখন কেন যাব? যাবো না। মেলার তারিখ দেখ, ঐ সময়াই যাবো।
– কেন বলতে গেলেন এই সব গল্প? এবার আপনি সামলান, আমি নেই।
– বৌ নিজ দায়িত্বে রাখুন
এই বলে আমি প্রসঙ্গ ঘোরালাম।
– আরে বাবা, লোকে ওখানে গরমেও যায়। গরমেই বাঘ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর জায়গাটাও জানা থাকে। জলার কাছে জল খেতে ওরা আসবেই। ওখানেই থানা গেড়ে থাকতে হয়। পরে শীতে না হয় আবার যাওয়া যাবে।
আজকাল বাঘ অনেক জায়গাতেই দেখতে পার। ঘরের কাছে সুন্দরবনে যাবে খরচাপাতি করে, অথচ দেখতে পাবে কিনা কারো জানা নেই। আছে মাত্র ৯৬টা বাঘ, যেখানে সারা ভারতবর্ষে প্রায় তিনহাজার বাঘ। এখানে মানুষের সাথে, নোনা জলের সাথে লড়াই করে করে বাঘের সংখ্যা দিনকে দিন কমছে। সোদরবনের বাঘ সাঁতার কাটতে পটু। একদম নিঃসাড়ে সাঁতরে এসে নৌকোর একদম পেছনের লোকটিকে তুলে জলে ঝাঁপ দেবার পরই বিপদ মালুম হবে। এরা মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়ে গেছে। জানে খুব কম পরিশ্রমেই খাবার পাওয়া যায়।
– তাহলে আর কোথায় কোথায় বাঘ দেখা যায় সস্তায়?
– এই হল বিপদ! বাঘ দেখবে, ভয় পাবে না, সস্তাও খুঁজবে। অতসব হবে না।
– বলই না শুনি।
– কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র—আমাদের দেশে বাঘ পোষা হয়। এই দেখ উত্তরাখন্ড ভুলেই মেরে দিলাম। ওখানেই তো করবেট সাহেবের যত গল্প। তবে বাঘ, সিংহ, নেকড়ে এই সব বন্য হিংস্র পশুর রাজধানী মধ্যপ্রদেশ। এই আমরা সবে ঘুরে এলাম।
– কই আমাদের তো বললে না?
– তোরা তখন ব্যস্ত। আর তোদের সাথে একটা ট্রিপ করতে সব চেয়ে কম কথা খরচ হয়। বেড়াতে যাবার আগে সেটা একটা বড় ব্যাপার। ছাড় এখন। আয়, বাঘে ফিরি।
মধ্যপ্রদেশ হল বাঘ দেখার রাজধানী। ৫০টার মত বাঘের বন আছে এই রাজ্যে। আছে কানহা, বান্ধবগড়, পান্না। তবে এই মধ্যপ্রদেশেই কিন্তু গত চার বছরে সবথেকে বেশি বাঘ মারা গেছে। বড় বাচ্চা মিলিয়ে একশ’রও বেশী। বান্ধবগড়ে (খুব ছোট জায়গা, ১০০ বর্গ কিমি) গোটা ৬০ বাঘ। আর কানহায় ১৩০? ঠিক জানিনা। পান্নায় গোটা ৩৫।
এ সবই কথার কথা। আমরা যাচ্ছি মুম্বাই। হাতে দিনকয়েক সময় আছে। সব চেয়ে কাছে তাড়োবা। নাগপুর হয়ে যেতে হবে। তবে সাফারি করব বললেই তো আর হয় না। তার যোগাড়ও করতে হয়। কেমন করে যাব, খালি নাগপুর পৌঁছলেই তো আর হবে না, তাড়োবার গেট পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। হাওয়াই আড্ডা থেকে গাড়িতে ঘণ্টা তিনেক। আমরা পাঁচ জন। বড় গাড়ি চাই। সেটার যোগাড় করতে হবে। আর সব জঙ্গলেই ঢোকার অনেক দরজা। তাদের আবার গালভরা নাম আছে সব। সেখানেই ব্যবসা। ওখানে গোটা বারো গেট। “মোহরালি” সবচেয়ে পুরোন, আর সবচেয়ে বেশি আলোচিত। সব সময় প্রচারের আলোয় থাকায় ওখানে সবচেয়ে বেশি থাকার জায়গা। কারো সাথে কথা বললেই বলবে মোহরালি দিয়েই যাবে, না হলে সব মাটি।
“কুস্বান্ডা” একটু কাছে, কম গাড়ি ঢোকে।
“কোলারা” ১২০ কিমি দূরে। যেখানে মোহরালি ১৮০কিমি। নয় নয় করে আঠারোটা গাড়ি ঢোকে। এই সব দুরত্ব নাগপুর থেকে।
“নভেগাও” ১৪০ কিমি। গাড়ি ঢুকবে ছয় ছয় বারোটা।
“পাংড়ি” ২৫০ কিমি। মাত্র চারটি গাড়ি সারাদিনে।
“জারি” ১৯০ কিমি। এখানেও মাত্র চারটি গাড়ি সারা দিনে।
খবর তো সব যোগাড় হল। মাথা খাটালে “কোলারা” বা “নভেগাও”। আর লোকের কথা শুনলে “মোহরালি”। আমরা ভাবলাম এই প্রচণ্ড গরমে কে আর যাবে! অন লাইন বুকিং করতে গিয়ে দেখা গেল দেশটা আমাদের মত পাগলে ভরা। তিন চার দিন একসাথে ছুটি। আম্বেদকারের জন্মদিন, ১৪ই এপ্রিল, ১৫ গুড ফ্রাইডে, তার পর শনিবার, রবিবার। ব্যস। আমরাও কম পাগল নই। বুড়ো বুড়ির দল ৭০ এর আশেপাশে তিনজন, একজন ষাট ধরবে বলছে, একটি মাত্র কচি খুকি ২৪। তার চাকরি, ছুটি এইসব মাথায় রেখে আমরাও ঐ ভিড়ের সময়ের টিকিট করে ফেললাম কোন কিছু ঠিক না করেই। সকালের প্লেনে বম্বে থেকে নাগপুর। দু’রাত থাকব ভেবে ১৭ই ফেরার টিকিটও করে ফেলা হল। মনে মনে ভাবলাম বেকার হবে না তো। বাকি কিছুই তো ঠিক নেই।
– এটা সত্যি কথা, ভালো লোকেদের ভালো ভালো বন্ধু থাকে। আমার বন্ধু বলেছে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– ওঃ, এই ফাঁকে নিজেকে ভালো লোক প্রমাণ করার চেষ্টা। বেশ মেনে নিলাম। কিন্তু যদি ঠিক ঠাক না হয় সব…??
– তোমরা বম্বের লোক, কি যেন পান সুপারি দাও, সেই রকম সুপারি দিয়ে দাও। বম্বে ছাড়ার আগে যেন আমাকে নিকেশ করে দেয়।
সকাল সাড়ে সাতটায় আমরা নাগপুরে নামলাম। এই ভোরবেলার ফ্লাইট ধরা কিন্তু বেশ চাপের। সেই ভদ্রলোককে জোড় হাতে সাধা, সাড়া না দিলে মুশকিল। আমাদের বলা ছিল এয়ারপোর্টেই ফ্রেশ হয়ে বেরতে। এই ‘ফ্রেশ হাওয়া’ শব্দবন্ধটি দারুণ। দুটি মাত্র শব্দ খরচ করে কত কথা বলা হয়ে যায়।
কাজের কাজ একটা হয়েছিল, এই তিন দিন একটা ইনোভা আমাদের সাথে থাকবে। প্লেন থেকে নামাবে, আবার প্লেনেই তুলে দেবে। ভারি দন্ড তার। তবু নিশ্চিন্তি। কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়? থাকব কোথায়? কিচ্ছু জানি না। পুরো ফিল্মি কায়দায় খবর আসছে। ড্রাইভার জানে সব, ঠিক নিয়ে যাবে। যাব্বাবা, এমন করে বেড়াই নি এর আগে। প্রশ্ন করা যাবে না। মেসেজ এল, “ভরসা রাখো”।
পরে জানলাম, আমরা মোহরালি বলেছিলাম। সেখানে হয় নি। ওখানের হোটেল মালিকেরা সব সাফারি বুক করে রেখেছে। যারা ওদের হোটেলে থাকবে তাদেরই প্যাকেজ দেবে। কি দাম!! একটা ঘর একরাতের দুজনের দশ হাজার, তিনজনের পনের। জিপ সাফারি দশ। আমরা নাকচ করে দিয়েছিলাম।
দশ মিনিট আগেই নামিয়ে দিল। আমরা ঠিক করেছিলাম সব ব্যাগ হাতে করে নিয়ে যাব। তা একজন চেক ইন করায় সবাই ঝাড়া হাত পা করলাম। ভরসা রেখে কোন ক্ষতি হয় নি। ফোন এসে গেল, গাড়ি হাজির।
অনেক সকাল, তবু ফোন করলাম। কোথায় যাচ্ছি? ‘ড্রাইভার সব জানে, ও নিয়ে যাবে। আপনারা আরাম করুন। ফ্রেশ হয়ে নিয়েছেন তো। আপনাদের যাত্রাপথ কিন্তু তিন ঘন্টার। আর, ব্রেকফাস্ট করে নেবেন’। গাড়ি ছাড়ার আগে। রাস্তায় খাবার পাবেন না।
আমাদের সঙ্গেই খাবার ছিল। গড়ানো রুটি। বোঝা গেল না বুঝি? রোল, রোল। ভেতরে কিমা কারি। বেড়ে বানিয়েছে মেয়ে আমার। মিষ্টি আছে। আছে কেক, জল। আমাদের উপাস ভঙ্গ চলছে, চলছে গাড়িও। আমরা হোটেলে না খাওয়াতে ড্রাইভার বেচারার খাওয়া হল না হয়ত। সে কিন্তু ভাগ নিতে চাইল না। ব্যস্ত।
বর্ণনাতীত পথ। আমরা নাগপুর শহরের বাইরে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। না গাছপালা, না বাড়িঘর। আমরা কথা বলছি তাই। মুখ চলছে। আর আমি প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার হচ্ছি। যাচ্ছি কোথায় আমরা? কেমন হোটেল? এটা কোন গেট? আমাদের সাফারি বুকিং আছে তো?
আমিও জানি না। তবে একদম ফিল্মি ইস্টাইলে বলছি “ভরসা রাখ”।
পথ বলছে আমরা বনের দিকে চলছি। শুনশান রাস্তা। রাস্তাই শুধু। দুপাশে রুখু মাঠ পড়ে আছে যতদূর চোখ যায়। গাড়ির গতি কমে গেছে। আমার মন বলছে আমাদের চালক রাস্তা হারিয়েছেন। একজন লোক পাওয়া গেল। কথোপকথন যে ভাষায় হল বুঝলাম না। তবে এটা বুঝলাম আমরা ঠিক রাস্তায় নেই। গাড়ি ঘুরল। জানলাম ভাষাটা মারাঠি। এখানকারই কোন বাচনভঙ্গি। বেশ, এটাও একটা পাওয়া। ভরসা একটু টলে গেল বইকি। বলল যে ড্রাইভার সব জানে! চেনে না তো দেখছি। সব ঠিকঠাক যাবে তো?
গাড়ি এবার বাঁ দিকে ঘুরল। কাঁচা রাস্তা। বোঝা যাচ্ছে কোন ব্যক্তিগত জমি জায়গিরে ঢুকছি। ঠিক তাই। আর একটা বাঁকের পরই থামল গাড়ি। সেখানে আরো তিনটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ডান পাশে ঢোকার মুখে মস্ত মালসায় জলে ফুল। সামান্য ফুল পাতা। তাতেই ভালো লেগে গেল। সামনে বেশ বড় ডোবা। তাতে শাপলা। দু একটি ফুল ফুটে আছে। জল কম। খরা। সেই ফুলভরা মালসা পাশ কাটিয়ে একটা একচালা বাড়ির হাতা। ছিমছাম। এখানে অনেক গাছ।
গাড়ি থেকে নামতেই বুঝলাম বাইরে কি তাপ। দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। বাইরের বারান্দায় চেয়ার টেবিল পেতে ম্যানেজার বসে। রবি বাবু। না বাঙালি নন। নাম রবি, আমাদের কাছে রবিবাবু হয়ে গেলেন। আমরা বাঙালি তো।
খবর ভালো নয়। আমরা আগে এসে পড়েছি। এখন এগারোটা, বারোটার আগে ঘর পাওয়া যাবে না।
– কেন ভাই, চেক আউট কখন?
– যারা সকালের সাফারিতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসেছেন। ফ্রেশ হয়ে তবে না বেরবেন। আধ ঘন্টা তো লাগবেই। কাল আপনারাও একঘন্টা বেশি পাবেন। বসুন না, চা খান’।
আমাদের হাতে তখন হিম শীতল তোয়ালে। ঠিক যেমনটা আগে প্লেনে দিত। এখন তো সে সব দূর অতীত। ভারি আরাম হল কিন্তু। বাইরে যা তাপ। ভেতরে মস্ত ঘর। পাখা চলছে। চকচকে ভাব নেই। দেওয়াল ভরা ছবি। সব বাঘ মামার। নানা দৃপ্ত ভঙ্গি তার। সঙ্গে পাতা উলটে মগ্ন হয়ে যাবার মত এ্যালবাম। সব বন্য প্রাণের ছবি।
– আঙ্কেল, আমরা কিন্তু মর্নিং নাইট দুটোতেই যাব। কিন্তু আমাদের আড়াইটের সাফারি একদম ফিট তো?
– দাঁড়া বাবা। একটাই হল না তো তিনটে!!
ডাইনিঙে ঢুকে পড়লাম। আমার ‘চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে’—দেশলাই, দেশলাই চাই, যে করেই হোক’। একটি ছেলের সাথে ভাব করলাম, দেশলাই পেলাম। সুযোগ পেতেই একশো টাকা টিপ দিয়ে দিলাম। আমাদের ছোট বেলায় ট্যুর করার সময় শিখিয়েছিল, টিপ করলে একেবারে প্রথমে। তাতে কাজ হয়। ধরা পড়ে গেলাম।
– একশো টাকা! কত দাম পড়বে ধোঁয়া গেলার?
এসব কথার জবাব দিতে নেই। আমিও দিলাম না। চা এসে গেছে। বাইরে এসে আবার ফোন লাগালাম ভরসার জায়গায়। খবর এলো রবি সব জানে। ওখানে শুক্লা আসবে, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ভরসা রাখো। ঘরেই ঢুকতে পারলাম না তো ভরসা!
জানা গেল, শুক্লা আসবে না। সে নাকি ছুটিতে! বোঝ। এবার কিন্তু আমারও টেনশন হচ্ছে। নালিশ ঠুকে দিলাম আমার বন্ধুর কাছে। উনিও বললেন হবেই হবে। আপনারা নাগপুরে এসে খালি হাতে ফিরবেন না। ঘর পাওয়া গেল। তখন সময় সাড়ে বারোটা প্রায়। খবর এসেছে, দেড়টায় বেরিয়ে পড়ে দুটোর আগে পৌঁছোতে হবে কলোরা গেটে।
বিয়ন্ড স্টে—বেশ নাম। খাওয়াও বেশ ভালো। টেবিলে সার দিয়ে নিরামিষ সাজানো আছে। একপাশে একপদ আমিষ। বাড়ি বানানোর কায়দায় ভেতরটা বেশ মনোরম। ঘর থেকে হেঁটে এখানে আসতেই জ্বলে গেল গা, এখানে ভেতরে ঠান্ডা। পাখা চলছে শুধু। জলা আর ফুলের কুন্ড দিয়ে স্বাগত, তারপর খাওয়ার জায়গা—জনা তিরিশ একসাথে খেতে পারবে। তারপর মাঠ। সেখানে বেশ হুল্লোড় করে পার্টি হতে পারে। তারপর কুটির। ঐ কুটিরে কারা থেকে? জানা গেল অনেক পাগল আছে। তারা ক্যামেরা কাঁধে আসে। তাদের অন্য প্রয়োজন খুব কম। সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। রাতে যে শুতে আসবে তার কোন ঠিক নেই। ওরা বেশি ভাড়া দিয়ে থাকতে পারে না। ওখানে থাকে এক দু মাস।
দারুণ থাকার জায়গা। চারপাশে গাছ, গাছ, গাছ। নিম, বাঁশ কাঠগোলাপ এগুলো চিনতে পেরেছি। অনেক নিম গাছ। পুরো পরিবেশটাকেই ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। একটু আগে ধোঁয়া নিতে বেরিয়েছিলাম বারান্দার হাতার বাইরে। যেন চুল্লিতে ঢুকলাম। চন্দ্রপুর জেলায় ৪৯/৫০ পর্যন্ত তাপ ওঠে। এখন কত? এইজন্যই বোধহয় ছোট বাহারি গাছ নেই, ফুল নেই।
আমরা দোতলায় পাশাপাশি দুটি ঘর পেয়েছি। সব আছে। তবে দেখভালের অবস্থাটা ভালো নয়। ছেলেগুলো আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই একদল ঘর ছেড়ে গেছে, সব পালটে ঘর তৈরি করার আগেই আমরা হামলা করছি। টিপটা কাজে দিল। আমাদের ঘর তৈরি। বন্ধুবরের ঘরও তৈরি হল, তবে একটু পরে। ওখানে তিনজন তো! তাতে কিন্তু আমাদের হাসিহল্লার কোন কমতি নেই।
একা আমার মনটাই খচখচ করছে। হবে তো?
আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। একদম শেষ সময়ে খবর এল, গেটে গিয়ে ফরেস্ট অফিসারের খোঁজ করতে হবে। কি নাম? দরকার নেই। উনি ওখানেই থাকেন। বন্দোবস্ত করা আছে। কি আতান্তর বাবা। এই রকম সাস্পেন্স আর টেনশনে আগে পড়িনি। মুখ চোখ স্বাবাভিক রাখার চেষ্টা করছি। গাড়ি দু’কদম এগোনর পরই ফোন। একটু পরে বেরলেও চলবে। বললাম বেরিয়ে পড়েছি। ভাষণ এলো
– চলো, বেরিয়েই যখন পড়েছ ওখানে গিয়ে অপেক্ষা কর। বড় বড় গাছ আছে, গাছতলায় ভালোই লাগবে। হ্যাঁ, ক্যামেরা ভাড়া করে নাও। ওখানে মোবাইল চলবে না। আগে চলত। এখন বন্ধ করে দিয়েছে। চোরা শিকারিরা যাতে জানতে না পারে বাঘ কোথায় দেখা গেল।
তা বেশ করেছে। আমাদের কি হবে? ক্যামেরা ভাড়া না পাওয়া গেলে?
– দেখেছেন তো কিছুই ঠিক ঠাক যাচ্ছে না। আপনি কি আমার নামে সুপারি দিয়ে দিয়েছেন?
– ভাবছেন কেন? দেখবেন সব ঠিক ঠাক যাবে। আপনি না থাকলে ঝগড়া হবে কার সাথে?
তা আমরা পৌঁছেও গেলাম। গাছতলাও পাওয়া গেল। কোথায় সেই জঙ্গলের রাজা? যিনি আমাদের অনুমতি দেবেন? সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করছে। ওদিকে আমার কটকটি আর তার বাবা ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলার মক শো করছে। মানে ক্যামেরার সাথে ভাবসাব করছে আর কি। কটকটিকে যা লাগছে না!! একটা হাফ প্যান্ট পরেছে, আর জামার ঝুল তার থেকে অনেক বেশি। এদিকে চাপ, কি হচ্ছেটা কি? আমাদের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই, জঙ্গলের অফিসার নেই। এরা বলছে আমাদের কাছে কোন খবর নেই।
আবার ফোন করলাম ভরসার কেন্দ্রে। জবাব এল, ভরসা রাখো।অপেক্ষা কর।
টেনশন থেকে বেরতে ক্যামেরার পেছনে লুকনো কটকটির পেছনে লাগলাম।
– এই কাঠবেড়ালি, আমার একটা ছবি তোল দেখি।
– আমি আবার কাঠবেড়ালি হলাম কি করে? আমি তো কটকটি।
মেয়েটা কটকট করে কথা বলে, মিষ্টি একটা প্রবাসী টান আছে। কিন্তু ও বুঝবে কি?
– তুই বুঝবি না, তোর বাবা মা আন্টি আমি সবাই জানি।
– বল, বল।
– কাঠবেড়ালি কাঠবেড়ালি পেয়ারা তুমি খাও? গুড়, মুড়ি তাও—এমা, তুমি ন্যাংটা পুদো।
– মোটেও না, এই দেখ, আমি প্যান্ট পড়েছি।
– তোমার মুখে কি কিছু আটকায় না, না? এতো বড় মেয়েটাকে এমন কথা?
খবর এলো। হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে। কোথায়? এখনই সোয়া দুটো। “আপলোগ, নভেগাও গেট চলে যাও”
– ও কাহাঁ, কিতনা দূর?
– ড্রাইভার কো বুলাও।
বুলালাম।
এদিকে আমরা চলে যাচ্ছি বলে ক্যামেরা ভাড়া দেওয়া ছোট ছেলেটি নাছোড়বান্দা, ওরটাই ভাড়া নিতে হবে। ওর সাথে গল্প করে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল যে! ও হচ্ছে সেই সব আদিবাসী পরিবারের ছেলে যাদের বাঘেদের জন্য জমি ছেড়ে দিতে হয়েছে। এখন এখানে দোকান করে ক্যামেরা, বাইনোকুলার ভাড়া দেয়। বেশ চলে যায় বলছিল। বলে কি ‘আপ লে যাও ক্যামেরা, যাতে সময় ওয়াপ্স কর। ভাগ্যিস করিনি তেমন কাজ। কি আতান্তরেই না পড়তাম!
আমরা ঝট পট বসে পড়লাম। গাড়ি চলল। কতক্ষণ লাগবে?
– আধা ঘন্টা
জাতে মিস্ত্রি। মাথায় ঘোরে নকশা। কথাবার্তায় যা বুঝলাম নকশাটা হল মাঝে ঝিল, তাড়োবা লেক। সেটাকে যদি সাগর ভাবি তাহলে রাস্তাগুলো নদীর মত এসে মিশেছে পরিধিতে। মানে আমাদের এখন বেরিয়ে প্রথমে হাইওয়েতে পরতে হবে, তারপর চক্কর মেরে এগিয়ে গিয়ে নভেগাওএর রাস্তা ধরতে হবে।
– ভগবান, আড়াইটে তো বাজতে চলল।
– এই, ভাবখানা এমন করছিস যেন বাঘেরা ঠিক আড়াইটেয় এসে তোকে বলবে প্রেজেন্ট প্লিজ।
তখন দ্যাখোরে নয়ন মেলে রাস্তার বাহার। তবে তেমন বাহার আর কোথায়? রাস্তা ভালো, সরসরিয়ে চলছে গাড়ি। একি? থেমে পড়লে যে। দেখুন, দেখুন রাস্তা ওয়ান ওয়ে হয়ে গেছে। যাহ, যাও আশা ছিল, গেল। আমাদের ডান পাশে মেলা বসেছে রাস্তা জুড়ে। না, না নাগরদোলা নেই। মামুলি গ্রামের মেলা। বিকিকিনির আসর। বাঘের তাড়া না থাকলে এখানে আমি থামতামই একঘন্টা। কিছু কিনি আর না কিনি ঘুরে ঘুরে দেখতাম, দরদাম করতাম। আমার ফুটিফাটা মারাঠি বলে ওদের আনন্দ দিতাম। দেখেছি পৃথিবীতে যেখানেই যাও, নিজের ভাষা আগন্তুকের মুখে শুনলে দপ করে একটা আগুন জ্বলে ওঠে চোখে। ওঠেই। বাঙ্গালিদের দেখেছি সেই আগুন লুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করে হিন্দি অথবা ইংরিজিতে জবাব দিতে। দেখেছি, অনেকবার। নিজেকে মাথায় চটাস করে একটা চাটি মেরে ফিরে এলাম রাস্তায়। আমরা জ্যামটা পেরিয়ে আবার ছুটছি। এতো সহজে ছুটকারা পাবো ভাবিনি। রাস্তার দুপাশে প্রাণের পরশ দেখা যাচ্ছে, সবুজ।
তাড়োবায় কিন্তু গাছের বৈচিত্র কম নয়। এত বিস্তীর্ণ জঙ্গলে টিক, বাঁশ, মহুয়া, বিজা, ধাউবা, সালাই আরো কি কি নাম বলেছিল সব মনে নেই। চেনার মধ্যে ঐ প্রথম তিনটে। আর একটা দুটো যে চোখ টাণে নি তা নয়। তার একটা হল কুমির ছাল। পোষাকি নাম “আইন”। গাছের বাকলটা একদম কুমিরের পিঠের ছালের মতন। এর কাঠের অনেক গুণ। আগুন লাগে না জানলাম। আসবাবপত্র বানানো হয়। আর যে দুটো জানলাম সেও মজার। নৌকো বানানো হয় আর গিটার। বেশ মজার না? কোথায় নৌকো আর কোথায় গিটার! অবশ্য আমাদের চোখে যা পড়ল, সে সব গাছের গুঁড়ি অত মোটা নয়। এ ছাড়া হরেক রকমের ওষধি গাছ আর লতা গুল্ম এখানে পাওয়া যায়। তাদোবা ওয়াইল্ড লাইফ লজে সব যত্ন করে পালন করা হচ্ছে, যাতে পাখি ফুল ফিরে আসে। পাখি কমই চোখে পড়ল। খুব ভালো হত যদি একজন কেউ গাছগুলোকেও চিনিয়ে দিত। বাঘকে তো আর চেনাতে হয় না, কুমির নেকড়েকেও নয়। গাছ, ফুলের কথা শোনার লোক নেই যে।
– ঠিক, ঠিক।
অবশেষে আমরা সত্যি পৌঁছে গেলাম। গাছের গায়ে লাগানো নোটিস বলে দিল আমরা নভেগাও গেটে। পৌনে তিনটে। আমি একছুটে কাউন্টারে গেলাম।
– আমি ঘোষ দস্তিদার, আমাদের নামে কোন জিপ বুক করা আছে কি?
– হ্যাঁ, আছে তো। আপনারা কোথায় ছিলেন? আপনাদের ভিআইপি বুকিং। স্যর, ৫০০০ টাকা জমা করতে হবে যে।
টাকা জমা করা হল। আমাদের মনে আরো বেশি টাকা ধরা ছিল, তাই মনে হল কি সস্তা গো। জীবন কেমন আপেক্ষিক ধারণায় চলে। তাই না?
আমাদের মেয়েটি কিন্ত ঠিক আর একটা ক্যামেরা জুটিয়ে নিয়েছে। আমরা দুদ্দার করে বসে পড়লাম জিপে। দেরি হয়ে গেছে না, বাঘ যদি এসে ফিরে যায়!! মাথায় টুপি উঠেছে। আমাদের বলাই ছিল, টুপি রাখবেন, আর সঙ্গে গামছা, তোয়ালে বা চাদর।
– সে কি এই গরমে?
– একসঙ্গে দুই কাজ হবে সাহেব, রোদে রঙ পুড়বে না, ধুলো থেকেও মুক্তি।
আমাদের সাথে দুইই আছে। খোলা জিপ তো বটেই। পেছনে আমরা দুই বুড়ো, সামনে দুই বুড়ি আর বুড়ি খুকি। তার গলায় ঝুলছে ছবি শিকারি বন্দুক। তার সামনে ড্রাইভার আর গাইড। মানে বোঝা গেল দল ছয় জনের বেশি হলে চলবে না একটা জীপে। আমাদের সেলফোন নিয়ে নেওয়া হল। সামনে ড্রাইভার আর গাইডের মাঝে ছোট্ট একটা এলুমিনিয়ামের বাক্সে রেখে দেওয়া হল।
– সেল ফোন নেবার কারণটা কি?
– সবার তো আর ওই রকম কামান, বন্দুক থাকে না!
– যা শুনেছি, সেলফোনে সব খবর চলে যেত। চোরা শিকারিরা সেই খবর কাজে লাগাত। তাই ব্যবস্থা।
– অন্যান্য জঙ্গলে কি হয়? এই রকমই?
– জানিনা, তবে জঙ্গলে যে নানান রকম বেআইনি কারবার চলে সেটা জানো তো ?
– ছাড় না, আমাদের সাথে বন্দুকও আছে, আছে শিকারীও।
আমরাই বোধহয় শেষ গাড়ি ঢুকলাম। আমাদের বাঁ দিকে প্রথম জানোয়ার দেখা গেল। গাড়ি থামল। মিশমিশে কালো মস্ত এক গউর।
আমাদের দিকে পেছন ফিরে সে খাওয়ায় ব্যস্ত, ক্যামেরা চলছে, ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক। বিশাল চেহারা। টণ খানেক ওজন হবে। গাইড সায় দিল। নীচু গলায় জানাল এই মস্ত জন্তুটিকে বাঘেরাও কিন্তু এড়িয়ে চলে। বাগে পেলে এরা বাঘকেও মেরে ফেলতে পারে। বাঘ এদের বাচ্চাদের পাকড়াও করতে চায়। চাইলেই কি হবে? মায়েরা দল বেঁধে ঘিরে রাখে বাচ্চাদের।
এই দেখ, দেখ। সামান্য সৌজন্য নেই? এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুলছি, একবার ঘুরে মুখটাও দেখালে না, এখন পটি ? ছ্যা, ছ্যা, ছ্যা।
– তাই তোল, ভিডিও কর একদম। বাঘ দেখতে না পেলে এটাই দেখাবি।
– উনি মানহানির মামলা করলে তোর বাবা সামলাবে, আমি নেই।
হাসির রোল উঠল। গাইড বাবাজি বললেন ‘আস্তে, আস্তে’।
এখানে বাঘ ছাড়াও নেকড়ে, হায়না, বুনো কুকুর, চিতল, চিঙ্কারা, জল হরিণও দেখা যায়। গৌর — নাকি ভারতীয় বাইসন! নীলগাই, গন্ধগোকুল, বুনো শুয়োর, স্লথ ভালুক। হাতি আছে মাত্র দুটি। তারা পোষা, পাহারাদারদের গাড়ি। হয়ত আরো কথা শোনা যেত, বেচারা গাইড! আমাদের কথা শুনে চুপ করে গেল। আমাদেরও বলল “চুপ, চুপ। আস্তে কথা বলতে হবে কিন্তু”।
আমি একটু দমে গেলাম তাহলে গাছ চিনব কি করে?
আমরা আর অপেক্ষা না করে এগোলাম। একটা জলায় আটকে গেলাম। এখানে পাহাড় জঙ্গল জল নদী খাদ সব আছে। দিগন্তে পাহাড়ের আকাশরেখা দেখছি। আমরা দেখতে যাবো না। তিনটি ছোট ছোট টিলা আছে। আর উঁচু নীচু তো থাকবেই। প্রকৃতিরর নিয়ম মেনে খাদও আছে। জল বয়ে যায় ঝরনা হয়ে। সেই জল জমে লেক। এই সবই দরকার বন্য প্রাণের সংরক্ষণের জন্য। তিনটি লেক আছে, আছে তিনটি পাহাড়, সমতল, জলধারা আর তার আশে পাশে সবুজ মাঠ। আমরা কিন্তু সবুজ কম দেখেছি, কম দেখেছি জলও। এখন যা তাপ! জানোয়ারদের তো আর বোতলের জলের দোকান নেই। জলার ধারে আসবেই জীবনের জল খেতে, আর এখানেই বধ্যভূমি।
একদম জলের মাঝে জল হরিণ মা আর ছানা। কি মিষ্টি দৃশ্য। এ হরিণের শিং নেই। কান দুটো গোল গোল। তিন কানেরও নাকি দেখা যায়। সে কি স্বাভাবিক? মানুষদের দেখে শিম্পাঞ্জিরা বই লিখলে বলতেই পারে মানুষের হাতে ছয় আঙ্গুলও দেখা যায়। আমি কিন্তু ওদের নিশ্চিন্তি দেখে এদিক ওদিক দেখছি কোথা থেকে হিংস্র কেউ ঝাঁপিয়ে পরবে না তো? ওদের হাত নেড়ে ভালো থাকিস, নিরাপদ থাকিস বলে এগোলাম আমরা।
শুধু কি বাঘ? এ জঙ্গলে নেকড়ে আছে, হায়েনা আছে। তাদের থেকেও নির্মম ঢোল আছে। এই ঢোলরা হল বুনো কুকুর। এরা দল বেঁধে ঘোরে, ঘিরে ধরে। এমনকি গউররাও ঢোলদের এড়িয়ে চলে। কত বিপদ জীবনে ঐ হরিণ শিশুটির!
এগোলাম আমরা। রাস্তার বাঁ পাশে বেশ ভিড়। গোটা চার পাঁচ জিপ যেমন তেমন করে পার্ক করা। দাঁড়িয়ে পড়েছে লোকজন। গাড়িতেই। এখানে গাড়ি থেকে নামা বারণ। এমনকি ড্রাইভার গাইডও নামে না। চাপা উত্তেজনা। লোকে রাস্তার বাঁ দিকে তাকিয়ে একমনে। কিছু একটা দেখছে মন দিয়ে। এখান থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমরা দেরি করে ঢুকেছি ক্লাসে, পেছনের বেঞ্চ বরাদ্দ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বললাম চল। গাড়ি এগোল।
গাইড নীচু স্বরে বলল টুপি চাদর গায়েই রাখবেন। সামনে দেখুন মৌমাছির চাক। এখানে অনেক মৌমাছির চাক। দু’একটা মৌমাছি কাছে এসে পড়তে পারে। সত্যিই তো গাছে অনেক বড় বড় চাক। আমি অবাক হলাম। এত্তো বড় বড় চাক! ফুল কোথায়? ফুল গাছ চোখে পড়ছে না তো। মহুয়া গাছ আছে। আর একটা গাছ চোখে পড়েছে বার বার। কোন আলাদা রঙ নেই। সবুজ। বেশ বড় গাছে মৌরি ফুলের মত—তার থেকে অনেক বড় বড় থোকা। কি নাম জানি না।
এই মুখপোড়ারা জানিস মৌমাছিরা কোন ফুলের মধু নিয়ে চাক বাঁধে? তারা শুধু নির্বাকই নয় নিঃস্পৃহ। নানান জনের নানা ভঙ্গি। মনে হল এরা ভাবছে ‘এই এল, কতক্ষণ জ্বালাবে কে জানে? কাজ নেই এদের। আসবে, ক্লিক ক্লিক করবে, নীচু স্বরে কথা বলবে, চলে যাবে। একটু শান্তি নেই বাপু’। মুখপোড়া বাঁদরের দল শান্ত হয়ে বসে আমাদের ছবি তোলার সুযোগ করে দিল।
আমাদের রাস্তা জুড়ে নীলগাই। আজব জীব। দেখতে ঘোড়ার মত। অথচ নাম নীলগাই। রঙটাও নীল নয়। আমরা যাকে বলি ষ্টীল গ্রে, অনেকটা সেই রকম হাল্কা। চকচকে গা। ভরপুর স্বাস্থ্য। আমাদের আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘোরাল। লম্বা গলা, একদম যাকে বলে স্লিম পা। ক্যাটওয়াকের ফিগার। ঘোড়ার মত না হলেও কেশর আছে, ছোট। অনেকটা ছোট করে ছাঁটা যেন। দেমাকি রূপসীর মত গুটিকয় পোজ দিয়ে দাঁড়াল। গরুর মত লেজটা, ঘোড়ার মত নয়। পায়ে যেন মোজা পড়ানো। কালো মোজা। গরুর থেকে অনেকটা লম্বা, ফুট পাঁচেক হবে। এদের শিং হয়, গরুর থেকে ছোট। গরুর থেকে অনেক ভারি শরীর। যখন ওরা নিশ্চিত হল যে অনেক ছবি উঠেছে, হাল্কা পায়ে এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে।
কটা বাজে জানিনা। এটা কিন্তু বেশ মজার লাগছে। আমাদের জীবনের বুলি এটা। হয় কেউ ঘড়ি দেখছে, না হয় সেলফোন। মুখে কেউ বলে না দেড়টা, আড়াইটে। সে সব উঠে গেছে। এখন আমাদের বুলিও ডিজিটাল—একটা সাতচল্লিশ বা টু টোএন্টিনাইন। এই জঙ্গলে ঢোকার আগে পর্যন্ত কতবার ঘড়ি দেখলাম। গাইড বলল চারটের আগে জলার কাছে পৌঁছতে হবে। ঘড়ি দেখলাম পৌনে চারটে। বুঝতেই পারিনি কোথা দিয়ে ঘণ্টা দেড়েক কেটে গেছে।
আরে আরে থামো। আমাদের রাস্তা জুড়ে চিঙ্গারি হরিণ। জানি না নামটা ঠিক বললাম কিনা। সে আমাদের দিকেই দেখছে। চেনা উৎপাত। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখেই মা বা বাবাকে কিছু একটা বলল। তারপর যা দেখলাম না! উফ! বেশ বড় শরীরটাকে প্রায় ৬/৭ ফুট ওপরে তুলে নিল সে। তারপর ঐ রকম লাফে লাফে চলল জঙ্গলের দিকে। ছোট ছোট টিলার ওপারে। চেয়ে রইলাম। জানিনা এই গা শির শির করা ছবিটা আর কোন দিন দেখতে পাবো কিনা। আর ছোটু আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন মুচকি হাসল। আমার বাবা এখানকার ট্রিপল জাম্প চ্যাম্প। নেহাত বাইরে যায় না, না হলে বিশ্বসেরা বুঝলে?
“কাকু ধরতে পারলাম না যে।” মেয়ের মুখ চুন।
– মন খারাপ করিস না মা। তারচেয়ে বেশ স্মার্ট একটা ছেলে ধর দেখি। সেই ছুটবে তোর সোনার হরিনের পেছনে।
– আমি বলছি আমার বাঘ দেখার দরকার নেই, আমার জঙ্গল সাফারি সার্থক।
– না কাকু, সে হবে না। দরকার হলে তিনবার যাব, বাঘ দেখতেই হবে।
চলছিল গাড়ি। হঠাৎ একদম হামাগুড়ি চাল? কিছু কি ঘটতে চলেছে? আমাদের অনেক সামনের গাড়ি থামতে ইশারা করছে। আমরা দূরত্ব বজায় রেখে গড়াচ্ছি। গাইড ঠোঁটে আঙ্গুল ছুঁইয়ে জানিয়ে দিল চুপ, একদম চুপ।
– বাঁ দিকে নালার কাছে ঝরনি আছে তার তিন বাচ্চা নিয়ে।
কোথায়, কোথায়? ঘাড় ঘরালাম। সে নীচু গলায় বলে যাচ্ছে
– ঐ দিকে, নালার পাশে, ঐ ডালটার নীচে দেখুন। ঐ তো, ঐতো।
ধুস। ওরা বলছে হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি কেন কিছু দেখতে পাচ্ছি না? আমার বোর লাগছে। বাঁদরেরা হুপ হাপ করতে করতে এ ডাল ও ডাল করছে। আবহাওয়ায় একটা চাপা উত্তেজনা।
খবর চলে যায়। আমাদের পেছনে আরো তিন চারটে গাড়ি এসে গেছে। ওদেরকে ঈশারায় বলা হচ্ছে গ্যাপ রাখ, গ্যাপ রাখ। শুনছে কোথায়? তারা এগিয়েই আসছে। আওয়াজ বাড়ছে। গাইড বলছে—শরীর দিয়ে বলছে ‘সব গেল’।
ময়ুর ডেকে উঠল। গাইড শরীরি ভাষায় বলে দিল ‘গেল সব গেল’।
বিরক্ত হয়ে বলল “চল ভাই। ঝরনি এই রাস্তা পেরিয়েই বাচ্চাদের নিয়ে ওপারে যেত। আর যাবে না”।
– তিনটে বাচ্চাকে যেন স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
– দেখলে তোমরা?
আমি বললাম এক রাশ বিরক্তি নিয়ে। খুব বিরক্ত হয়ে বললাম চল, চল। একটু আরো গভীর জঙ্গলে নিয়ে চল দেখি।
আমরা এলোমেলো ঘুরছি। সামনে হঠাৎ হঠাৎই জন্তু জানোয়াররা আসছে। এবার বুনো শুয়োর। এরা দেখলাম ভীতু। অন্যেরা দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে, পোজ দিচ্ছে, ছবি তুলতে দিচ্ছে। এরা দৌড়চ্ছে দল বেঁধে। আবার একবার ওনাদের দেখা পেলাম। সেই যে গোলকান হরিণ দেখেছিলাম না, তার তুতো ভাই। দেখতে একইরকম তবে কিনা কান তেমন মিষ্টি গোল নয়। একটু যেন ছুঁচলো। তারপরই দেখতে পেলাম শিঙের মুকুট পরা হরিণ। হরিণ দেখব, সিং থাকবে না, কেমন যেন একটু অপূর্ণতা থেকে যায়। সেটা থাকল না। আবার আবার আবার নীল গাই, দেখলে, দেখলে? এবার যেন আরো পরিষ্কার পেলাম। ঠিক তার আগেই কিন্তু ময়ুর আমাদের দেখা দিয়ে গেল। ময়ুর দেখলেই কেউ না কেউ বলবেই ‘ ইস পেখম মেলা দেখলাম না’। আমাদের এই ছোট্ট সংসারেও দুজন একসাথে বলে উঠল। ইস…
ঢুকলাম আমরা গভীর জঙ্গলে। এখানে রাস্তা নেই। গাড়ির চাকার দাগ ধরে এগিয়ে যাওয়া। আমরা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছি। গভীর জঙ্গল বলতে গাছে গাছে ঢাকা আকাশ আর পথ নয় কিন্তু। এখানে এমনিতেই গাছ কম। যে পথে আমরা এসেছি, সেখানে তো রুখু, হাল্কা পাতা হীন গাছের সমাবেশ দেখেছি। এখানে গাছে পাতা আছে। মনে পড়ে গেল সেই গউর বাবাজির কসরত। নীচের ডালের পাতা সব শেষ। একটু ওপরের ডালের পাতা খাবার জন্য শিং দিয়ে ডালটাকে নোয়াচ্ছে, তারপর মুখে যেই ধরতে যাচ্ছে, পালিয়ে যাচ্ছে ডালটা। আমরা অনেকক্ষণ দেখেছি সে খেলা।
আমাদের যাত্রাপথ কেমন যেন থম মেরে আছে। হাওয়া নেই,পাখি নেই, নড়াচড়া নেই। আওয়াজ বলতে আমাদের গাড়ির আওয়াজ। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। থম মেরে আছে চারদিক।
এই গাড়ি ঘোরাও। ঘুরল গাড়ি। আফশোস। আজকে অনেক দিনের ঝুলে থাকা প্রশ্নটার একটা মীমাংসা হতে পারত। বাঘিনীকে জিজ্ঞেস করা যেত ছানারা বাঘের দুধ খায় তো? জানা হল না। আঁধার নামছে। আকাশে সাদা মেঘ হাল্কা। সুজ্জিদেব ডিউটি শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছেন মেঘে। এবার বাড়ি ফেরার বাস ধরবেন।
আমরা হতাশ, ক্লান্ত।
– এরপর কেউ যদি বম্বে বা কলকাতায় খারাপ রাস্তার অনুযোগ করে, এখানে ছেড়ে দিয়ে যাব।
– সত্যি বাবা ঝাঁকুনির একটা সীমা থাকা উচিৎ।
এইসব কথা এতক্ষণ হয় নি। তখন মন ছিল অন্য দিকে। এখন আমরা ফিরছি। ফেরার পথে দূর থেকেই ভিড় দেখে চিনতে পারলাম। সকালের সেই মামার বেডরুমের কাছে আবার জটলা। গাড়ির সংখ্যা যেন বেড়ে গেছে। সমতল জায়গাটা ফুট বিশেক লম্বায়, চওড়ায় ফুট আষ্টেক। সেখানে এলোমেলো জীপের আলপনা। যে যেমন পেরেছে ঢুকিয়ে দিয়েছে গাড়ি। কোন গাড়ি যে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে যাবে, তেমন সম্ভাবনা নেই। আমরাও আর ব্যাক না করে সোজা ঢুকিয়ে দিলাম প্রথম সুযোগেই। ঝুলে থাকা গাছের একটা ডাল মাথায় গোত্তা মারতে আসছিল, মাথাটা নামিয়ে নিলাম। যেখানে থামলাম, আমাদের জীপের পাশে ফুট তিন চার জায়গা। তারপর আমাদের গাড়ির দিকে মুখ করে দুটি গাড়ি। এটুকুই জায়গা আছে, যাতে আগুপিছু করে করে বেরতে পারে গাড়ি।
ভাবছি আবার অনন্ত অপেক্ষা করে উঁকি ঝুকি মেরে ঘুমন্ত বাঘের লেজ দেখব। একটা যে সিগারেট ধরাব তার উপায় নেই। আমি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলাম খাদের দিকে গোটা কুড়ি পাইপগান, কামান তাক করা। কেউ কেউ আবার তোয়ালে জড়িয়ে ক্যামেরার স্ট্যান্ড করেছে। একদম আমাদের দিকে মুখ করা পড়শি গাড়িতে বেশ ওজনদার এক দম্পতি। তাদের ক্যামেরার ওজন বোধহয় তাদের থেকেও বেশি হবে। একবার ধরে দেখতে পারলে হত। আমি অলস চোখে ইতি উতি দেখছি। মানুষ দেখছি। দেখছি আর কে কে কি কি করছে।
হঠাত বোমা পড়ার মত চমক দিয়ে ভারী একটা নৈশব্দ। ব্যাপার কি? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি উনি একটা পা তুলেছেন। আমার আট দশ ফুট দূরে ঘটছে ব্যাপারটা। বোঝাই যাচ্ছে উনি বেরবেন। হ্যাঁ, তাইতো! মুহূর্তমধ্যে মস্ত এক মাথা বাইরে এল। ফুটবলের চেয়েও বড় একটা মাথা। কটকটিকে খোঁচা মারলাম। দেখলাম ও ক্যামেরার পেছন থেকেই দেখছে। শাটার পড়ছে। চারপাশেই শাটার পড়ছে ,পড়ছেই।
স্যর, একটা হাই তুলুন অন্তত। এতক্ষণ ঘুমোনোর পরে লোকে হাই তোলে। ওনার ভ্রুক্ষেপ নেই। পুরো শরীর বেরিয়ে এসেছে। একদম আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে হেঁটে যাচ্ছেন উনি। মস্ত চেহারা। শরীরটা ফুট পাঁচ, না না সাড়ে পাঁচ হবে। সামনের বাঁ পায়ে কি ব্যাথা? আমাদের গিন্নি দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছেন। ওনাদের একদম সামনে যে! উনি কিন্তু কোন দিকেই দেখলেন না। মেয়েদের দিকেও দেখেন না? সোজা হেঁটে চললেন রাস্তার দিকে। আমাদের গাড়ির ফুট তিন চার দূর দিয়ে যাচ্ছেন। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখুন প্লিজ। কতদূর থেকে আমরা এসেছি আপনার দর্শন পাব বলে। উনি আমাদের মাছির থেকেও কম আমল দিলেন। ল্যাজটাও তো নাড়লেন না একবার! উনি রাস্তা পেরিয়ে ওপাশের জঙ্গলে ঢুকে গেলেন।
“মংলি”। আমাদের গাইড বলল।
“এখানকার সবচেয়ে বড় বাঘ। কাল ঝরনি কো লেকে দুসরা টাইগারকে সাথ লড়াই হুয়া থা। লাগতা হ্যায় পাএর মে থোরা চোট হ্যায়”।
– কত বড়”?
– সাড়ে আট নও ফুট হোগা’।
– আপলোগ ক্যায়সে নাপ্তে হ্যায়”?
– টাইগার কো নাক সে টেল তক নাপা যাতা হ্যায়। মরনে কে বাদ। আভি তো সব আন্দাজ হোতা হ্যায়।
আমার আশ্চরজি এখনও কাটেনি। চারদিকে অনেক কথা হচ্ছে। গাড়িগুলো সব বেরবার চেষ্টা করছে। আমি ভাবছি ভদ্রলোক আমাদের মানুষই ভাবলেন না? কি ভাবলেন তাহলে? এত অবজ্ঞা? কারো দিকেই মুখ ঘুরিয়ে দেখেন নি। মানুষ, গাড়ি, ক্যামেরা দেখে দেখে এত্তো বোর হয়ে গেছেন? আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। নাহ, চলে গেছেন। আচ্ছা, কোন গন্ধ পেলাম নাতো! তাহলে কি আপনিও ডিও মাখছেন স্যর?
পর পর গাড়ি চলছে। সব ঘর মুখো। সন্ধ্যা নামছে। সাড়ে ছটা হবে। আমরা গেটে আসতেই আমাদের ড্রাইভার বলল ‘থোরা পহলে আনা থা। আভি গায়া এক স্লথ বীয়ার’।
– তাই? কিস তরফ?
– হ্যাঁ, যেন দাঁড়িয়ে আছে তোমার জন্য। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখ। তোমাদের দেখলেই আসবে ছবি তুলতে।
ওদিকে ভীষণ জরুরি কাজ হচ্ছে। ক্যামেরা থেকে ছবি ফোনে আসছে। ওখানেই এডিট হচ্ছে। এত ছবি তো নেওয়া যাবে না। ভাগ্যিস সেই ছোকরার আবদার মানিনি আমরা। তাহলে এখন ফেরত যেতে হত ঐ গেটে। ঘুট ঘুটি অন্ধকার হয়ে যাবে হোটেলে ফিরতে ফিরতে।
– কি রে? শখ মিটলো?
– আঙ্কল, আমরা নাইট সাফারিতে আসব না?
– তাহলে গাড়ি ঘোরাতে বল। এখনই তো নাইট।
– আচ্ছা, আচ্ছা, তাহলে মর্নিং?
তখনও জানি না আমাদের এই অনিশ্চিত ট্যুরে আর কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
ঘরে ঢুকে একটু এলিয়ে পড়েছি। ম্যাডাম বাঁ পাশের দেওয়াল জোড়া জানালার পর্দা সরিয়ে দিতে দেখলাম সামনে অন্ধকার বিস্তার। এই এখান থেকে চুইয়ে পড়া আলোয় দেখা গেল মস্ত এক দেওয়াল একতলাটা প্রায় ঢেকে রেখেছে। পাঁচিলের পাশেই জঙ্গল।
– দেখ, দেখ সকালে আমরা এদিকে চেয়ে দেখিনি। আমাদের ঘর থেকেই তো বেশ দেখা যেত জঙ্গল আর বাঘ।
১৫ই এপ্রিল ২০২২
Add comment