উৎসবের শাড়ি – বালুচরী
নারায়ণ প্রসাদ মুখার্জী, ১৯৬৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
বছরটা ছিল ২০০২। বালুচরী শাড়ি নিয়ে একটা প্রজেক্টের কাজে তখন আমি বেশ ব্যস্ত। প্রায়ই বিষ্ণুপুর যাওয়া আসা করছি।
বালুচরী শাড়ি বাংলার প্রসিদ্ধ শাড়ি এবং শিল্পশৈলিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এক শিল্পকর্ম। আঁচলে বিবিধ পৌরাণিক ও অন্যান্য নক্সা বোনা এই শাড়ি আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে গন্য।
কিন্তু বালুচরী শাড়ির ব্যবসা তখন নিম্নমুখী। কারিগরেরা ধীরে ধীরে উৎসাহ হারাচ্ছে। কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, যে প্রযুক্তিতে শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে তাতে এক একটি শাড়ি তৈরি করতেই প্রচুর সময়, যেমন তিন থেকে চার সপ্তাহ লেগে যাচ্ছে, এবং তারফলে কারিগরদের তেমন আয় থাকছেই না। সরকারের উদ্যোগে বালুচরী হ্যান্ডলুম শাড়ি শিল্পকর্মের উন্নতির জন্য তখন CMERI এবং আই আই টি খড়গপুর – এই দুটি সংস্থাকে পৃথক ভাবে এই প্রজেক্ট টির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রজেক্টের কাজ ততদিনে অনেকটাই এগিয়েছে। একদিন সন্ধ্যেবেলায় আমি এক সাউথ ইন্ডিয়ান কলিগ মিস্টার রাও এর বাড়ি ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম।। উনি আই আই টি খড়গপুর থেকে বি টেক এবং এম টেক করে CMERI তে বহু বছর ধরে নানান প্রজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ওনারা স্বামী স্ত্রী দুজনেই বাংলা কথা বোঝেন এবং মোটামুটি বলতে পারেন।
গল্প গুজব বেশ চলছিল। সঙ্গে চা এবং পকোড়া। সেপ্টেম্বর মাস, পূজো আসন্ন। তাই পূজোতে শাড়ির কেনাকাটা নিয়ে দুই সম্ভ্রান্ত মহিলার মধ্যে স্বভাবতই আলোচনা জমে উঠেছিল। মিসেস রাও হঠাৎ বললেন, “মিস্টার মুখার্জী এবার পূজোতে মিসেস মুখার্জী কে একটা বালুচরী শাড়ি গিফট করুন। আপনি তো বালুচরী শাড়ি র প্রজেক্ট করছেন।”
“প্রজেক্ট টা সাকসেসফুল হোক তারপর অবশ্যই একটা শাড়ি গিফট করা যেতে পারে।” বললাম আমি।
“I am confident that your project will be successful, and Mrs Mukherjee will get a baluchari saree.” বললেন মিস্টার রাও।
“মিস্টার মুখার্জি আপনার প্রজেক্টের objective কি একটু বুঝিয়ে বলবেন! আপনাদের এই প্রজেক্টের ফলে শাড়ির কোয়ালিটি কি আরো ভালো হবে?” জানতে চাইলেন মিসেস রাও।
“এই প্রজেক্টের objective বালুচরী শাড়ির প্রোডাকসন বাড়ানো। Better technology ব্যবহার করে প্রোডাকসন বাড়াতে হবে। We are working on improvement of the present technology so that production increases.
“আচ্ছা এটাকে বালুচরী শাড়ি বলে কেন?” এবার আমার মিসেস জানতে চাইল।
– খুব ভালো প্রশ্ন। বালুচরী শাড়ির একটা ইতিহাস আছে।
Let us know that history. বললেন মিস্টার রাও।
আমি বলতে শুরু করলাম,
– মুর্শিদাবাদের কাছে ভাগিরথী নদীর পার্শ্ববর্তী একটা জায়গা আছে যার বর্তমান নাম জিয়াগঞ্জ। আজ থেকে মোটামুটি দুশো আড়াই’শো বছর আগে যখন মুরশিদ কুলি খান মুর্শিদাবাদের নবাব ছিলেন তখন এই জিয়াগঞ্জের নাম ছিল বালুচর। ঢাকা থেকে তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মুর্শিদাবাদে। শোনা যায় সেই সময় গুজরাতী তাঁতীদেরও আগমন হয় বালুচরে। নবাবের হুকুমে বেগমদের জন্য রেশমের শাড়ি তৈরি শুরু হয় বালুচরে। নবাব ছিলেন এই শিল্পের বড় পৃষ্ঠপোষক। পরবর্তীকালে গঙ্গার ভীষণ বন্যার ফলে শিল্পীরা বিষ্ণুপুর চলে যায় এবং সেখানে পাকাপাকি ভাবে অবস্থান করতে থাকে। মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুরে এই শিল্পের অগ্রগতি ঘটে। ঐ সময়ে নির্মিত টেরাকোটা মন্দিরের শিল্পকর্মের ছাপ পড়ে বালুচরী শিল্পে। বালুচরে প্রথম তৈরি হয়েছিল বলে এই শাড়ির নাম বালুচরী।
“আচ্ছা present process টা কি? Where do you think the present technology needs change?” আবার প্রশ্ন করলেন মিস্টার রাও।
– বালুচরী শাড়ির আঁচলে সুন্দর নক্সা থাকে। এই নক্সাগুলো আসলে রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ থেকে নেওয়া নানা গল্প রঙীন ছবির মাধ্যমে বলা। শাড়ির পাড়েতেও কল্কা এবং ঐ জাতীয় নক্সা থাকে। প্রথমে এই নক্সা একটি গ্রাফ পেপারে proportionately আঁকা হয়। এই নক্সার x-y coordinates অনুযায়ী একটা rectangular shape এর কার্ডের ওপরে holes punching করা হয়। এই কার্ড আগেকার কমপিউটার কার্ডের মতোই। One single card with number of holes on it represents one single line or row on the drawing. এই রকম হাজার হাজার কার্ড দরকার হয় একটা শাড়ির নক্সা কে পুরোপুরি punched কার্ডে convert করতে। এই কার্ডগুলো manually punch করা খুব time consuming এবং সেগুলোকে serially পর পর attach করে একটা continuous chain তৈরি করা হয়।
– তোমরা কি এই কার্ড punching অটোমেটিক মেশিনে করবে?
– Obviouly. Not only we should get rid of manual card punching, we must also replace manual drawing by cad. As a result বালুচরী শাড়ি বুনতে অনেক কম সময় লাগবে।
– আচ্ছা এই chain of cards কি ভাবে কাজে লাগে, একটু বুঝিয়ে বলবেন।
মিস্টার রাওয়ের অনুরোধে তখন আমি বললাম,
– এই chain of cards আসলে coded instructions to the handloom. এই কার্ডকে জ্যাকার্ড (Jacquard) কার্ড বলে। Joseph Marie Jacquard নামে একজন French weaver and merchant এই কার্ডের জনক। এই ধরনের হ্যান্ডলুমকে জ্যাকার্ড হ্যান্ডলুম বলে। একটা লুমে কয়েক হাজার কার্ড থাকতে পারে। এই punched card এ যে ফুটো থাকে সেই ফুটো একটা link mechanism এর মাধ্যমে শাড়ির দৈর্ঘ্যের দিকের সুতো (warp) কে ওঠা নামা করায় এবং নব্বই ডিগ্রী তফাৎ এ রাখা প্রস্থ এর দিকের সুতো (weft) কে উঠে যাওয়া সুতোর নীচে দিয়ে নিয়ে যায়। প্রতি বার সাটল্ (shuttle) যাওয়া আসার সাথে এই ঘটনা ঘটে এবং এই ভাবেই শাড়ির নক্সা তৈরি হয়। ১৯৫৬ সালে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সুভো ঠাকুর বা সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখনকার বিখ্যাত কারিগর অক্ষয়কুমার দাসকে জ্যাকার্ড তাঁতের ব্যবহার শেখান৷ পরের বছর অক্ষয় দাস অজন্তা-ইলোরার মোটিফ লাগিয়ে নতুন বালুচরী বাজারে আনলে এই শিল্পের উত্থান ঘটে৷
– বালুচরী শাড়ি তৈরির ব্যাপারটা বেশ কমপ্লিকেটেড মনে হচ্ছে। The artisans must be very skilled. বললেন মিস্টার রাও।
– ঠিকই বলেছেন। নক্সা ডিজাইন থেকে শুরু করে কার্ভ পান্চিং এবং জ্যাকার্ড হ্যান্ডলুমে weaving — প্রতিটি কাজেই intricacy আছে এবং কারিগরদের বেশ দক্ষতা ও ধৈর্য্য প্রয়োজন।
“এই শিল্পে বিখ্যাত শিল্পীর নাম বলতে পারেন?” প্রশ্ন করলেন মিস্টার রাও।
– দুজন শিল্পীর নাম বলতে পারি। বালুচরের দুবরাজ দাস ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্য হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য। দুবরাজ দাস জন্মেছিলেন আনুমানিক দুশো বছর আগে। বালুচরী শিল্পের সঙ্গে এনাদের নাম অমর হয়ে আছে। নতুন নতুন রূপ ভাবনায় বালুঢরী শিল্পকে চরম উৎকর্ষতা য় পৌঁছে দিয়েছিলেন এই দুজন শিল্পী। বাহাদুরপুরে বোনা বালুচরী শাড়িই ১৯০০ সালে প্যারিসে এবং ১৯১১ সালে লন্ডনে বিশ্বমেলায় স্বর্ণপদক লাভ করে।
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। মিস্টার রাও তাড়াতাড়ি ডিনার করেন জানতাম। তাই বললাম অনেক রাত হয়ে গেল মিস্টার রাও। আপনারা ডিনার করে নিন। আমরা চলি।
– দাঁড়ান দাঁড়ান। আজ ডিনারে ধোসা আছে। আপনারাও আমাদের সঙ্গে ডিনার করে নিন।
ধোসা আমাদের দুজনের favorite. তাই আপত্তি না করে আমরা ডিনার এ জয়েন করলাম। ধোসা খেতে খেতেই আমাদের আলোচনা আবার শুরু হলো।
“আচ্ছা একটা classic বালুচরী শাড়ির কত দাম হতে পারে?” জানতে চাইল আমার মিসেস।
– পঁচিশ থেকে পয়ত্রিশ হাজার টাকা। স্বর্ণচরী শাড়ির দাম অবশ্য বালুচরী শাড়ির চেয়ে একটু বেশি।
– স্বর্ণচরী শাড়ি আর বালুচরী শাড়ির মধ্যে কি পার্থক্য?
– দুটোই রেশম এর সুতো দিয়ে বানানো। তবে স্বর্ণচরীতে সোনালী জড়ি বসানো থাকে। তাই স্বর্ণচরী শাড়ি খুব চকচকে। বালুচরী শাড়ি তে থাকে রূপালি জড়ির কাজ।
“Mrs. Mukherjee আপনি কোন শাড়ি prefer করছেন?” জিজ্ঞেস করলেন মিসেস রাও।
“I think she should go for baluchari saree. She will look better with that.” জবাব দিলাম আমি।
কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেলো। মিস্টার এবং মিসেস রাও কে শুভ রাত্রি জানিয়ে আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
Add comment