সাহিত্যিকা

আমার যাদু চর্চা – একটি স্মৃতিচারণ।

আমার যাদু চর্চা – একটি স্মৃতিচারণ।
দীপক সেনগুপ্ত ১৯৬৫ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিই কলেজের অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক

স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি উত্তরবঙ্গের দিনহাটা হাই স্কুল থেকে। তখন ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তির এত উন্নতি হয় নি। কলকাতায় ফল বেরোলেও দিনহাটায় বসে সংবাদপত্রে খবর পেতাম প্রায় দু’দিন পরে। তখন সংবাদপত্রে রেজাল্ট ছাপা হত, প্রত্যেক রোল নম্বরের পাশে কোন বিভাগে উত্তীর্ণ সেটাও লেখা থাকত।

এখনকার মত এত বিপুল ছাত্রসংখ্যা সেদিন ছিল না, দিনগুলি যেন অনেক বেশি শান্ত ছিল। আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল দিনহাটার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। সেখানে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কলকাতার কোন চেনাশোনা লোকের মাধ্যমে সন্ধ্যার মধ্যেই শুনলাম যে সব রেজাল্ট এসে গেছে, জানতে হবে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গিয়ে। ছোট জায়গা, খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। টেলিফোন অফিসে ভিড় জমে গেল, তেমনি অনেকেই আবার ভয়ে ফল জানতেই গেল না। দিনহাটা থেকে সেবার আমাকে নিয়ে মোট তিন জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল।

পরের পর্ব কলেজে ভর্তি হওয়া। বাবা ছিলেন মহকুমা শাসক, বদলির চাকরি। বিজ্ঞান নিয়ে কোথায় পড়া যায় সেটা ঠিক করা সহজ হ’ল না। কলকাতায় আমার জেঠামশায়, কাকা ও জেঠতুতো ভাই-বোনেরা একটা ভাড়া বাড়িতে থাকত। আমি ত প্রায় গ্রামেরই ছেলে, কলকাতার রাস্তাঘাট সব অজানা, সঙ্গী হিসাবে কাউকে একজন থাকতে হবে। এইসব ঠিক করতেই বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেল। সময় সংক্ষেপ করতে কুচবিহার থেকে আকাশপথে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। যে প্লেনে করে এসেছিলাম সেটা ছিল নিতান্তই ছোট। যতদূর মনে পড়ে যাত্রী সংখ্যা ছিল সাকুল্যে ৬/৭ জন, মাল ছিল অনেক। মুলতঃ সেটা ছিল একটা cargo প্লেন। সোজাসুজি কলকাতায় না এসে প্লেনটা আসামে সম্ভবতঃ রূপসা নামে একটা জায়গায় নেমে কিছু মাল ও ২/১ জন লোক নিয়ে আবার আকাশে উড়ল।

রূপসা জায়গাটা ছিল নিতান্তই ছোট। মসৃণ ঘাসের উপর লোহার মোটা মোটা পাত পাশাপাশি ফেলে বিমান ওঠানামার পথ তৈরি হয়েছে। সেখানে আমার ১৫/১৬ বছর বয়সের একটা ছোট ঘটনা এখনও মনে আছে। নিতান্তই সাধারণ। রূপসায় প্লেন থামলে চালক নেমে প্লেনের পাশেই দাঁড়ালেন। চালক ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বিমানবন্দরের অফিস থেকে কিছুটা কম উচ্চতার একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক চালকের কাছে এসে কথা শুরু করলেন। সব কথা ইংরাজিতেই হচ্ছিল। কিছু পেশাগত কথাবার্তার পর চালক ভদ্রলোক বললেন –
– এবার কোলকাতায় একবার দক্ষিণেশ্বরে যেতে হবে। আমি কখনও যাই নি।
– কেন, কি আছে সেখানে?
– সে কি! তুমি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নাম ত শুনেছ। তিনি ঈশ্বরকে দেখেছিলেন।
– যত্ত সব! প্রমান কি?
– তিনি নিজেই বলেছেন। বিবেকানন্দকেও দেখাতে পারেন বলেছেন। আপনি বিশ্বাস করেন না? আপনি heartless.”
চালকের হাতটা ধরে সেই মোটা ভদ্রলোক নিজের বুকের বা-দিকে চেপে ধরে বললেন –“I have no heart? Feel it.” বলতেই দু’জনে সশব্দে হেসে উঠলেন। সময় হয়ে গিয়েছিল। প্লেন আবার আকাশে উড়লো।

জেঠামশায়ের বাড়িতে গিয়ে বোঝা গেল, মার্কশিট, যেটা স্কুল থেকে দেওয়া হয়েছিল, সেটা হয় তাড়াহুড়োতে আনা হয় নি, নয় ত হারিয়ে গেছে। বোর্ড অফিস থেকে একটা ডুপ্লিকেট মার্কশিট বের করে যখন ভর্তির চেষ্টা করা হ’ল, তখন প্রায় সব কলেজেই ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ছোটকাকা হন্যে হয়ে সারাদিন ঘুরছেন। শেষে একদিন জানালেন সিটি কলেজে ভর্তি হতে হবে। তখনও সেখানে ক্লাস শুরু হয় নি। ফল মোটামুটি ভালই ছিল, ভর্তি হতে অসুবিধা হ’ল না।

জেঠামশাইরা থাকতেন বিবেকানন্দ-কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট মোড়ের কাছে মদন মিত্র লেনে। বাড়িতে লোক ছিল বেশি, জায়গা কম। সেখানে থেকে পড়াশোনার অসুবিধা হবে ভেবে আমার থাকার ব্যবস্থা হল সিটি কলেজ সংলগ্ন রামমোহন ছাত্রাবাসে।

তখনো জানা ছিল না যে হোস্টেলে পড়াশোনা আরও কম হবে। কলেজের রসায়ন বিভগের অধ্যাপক সরোজ বসু ছিলেন হস্টেলের সুপারিন্টেনডেন্ট, তার সহকারী অধ্যাপক রঞ্জিত দাসও ছিলেন রসায়ন বিভাগের। তিনি প্রথমে বললেন হস্টেলে সিট নেই; তারপরে মার্কশিট দেখতে চাইলেন। দেখে বললেন, “ইতিহাসে এত কম নম্বর কেন? আমি ৯৮ পেয়েছিলাম।” হঠাৎ ইতিহাস কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল বুঝলাম না। বছর চারেক আগে এক শ্রাদ্ধবাসরে শোকার্ত পরিবেশে সরোজবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। পরিচয় দিতে বললেন, “এখন কি করছ?” কর্মজীবনের শেষে অবসর নিয়েছি শুনে চুপ করে রইলেন। রঞ্জিত দাসের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, বললেন – “তিনি মারা গিয়েছেন বহুদিন।” তার বিয়ের পর তিনি হোস্টেলের সবাইকে পায়েস খাইয়েছিলেন। মারা যাবার খবর শুনে কেন জানিনা হঠাৎ সেই কথাটা মনে পড়ল। কিছুদিন আগে শুনলাম সরোজবাবুও পরপারের পথিক হয়েছেন। স্বাভাবিক। বয়স নব্বই পেরিয়ে গিয়েছিল।

রামমোহন হস্টেলের দোতলার একটা ঘরে সিট পেলাম। একঘরে চার জন। আমরা দুজন ফার্স্ট ইয়ারের. বাকি দুজন সিনিয়ার। আর সে দুটি সিটের একটি প্রায় সব সময়েই ফাঁকা থাকে, অন্যজন অধিকাংশ সময় ঘুমোয়। প্রথম বর্ষের বন্ধুটির হবি ছিল রূপচর্চা। স্নান শেষ করে, পাউডার মেখে, স্নো ঘষে, বিভিন্ন ছন্দে চুল আঁচড়ে আয়না দিয়ে নানান ভঙ্গীতে ঘাড় বাঁকিয়ে গভীর ভাবে সে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করত, কিভাবে তাকে আরও ভাল দেখায়।

এরই মধ্যে আমি একদিন ট্রিগোনোমেট্রি নিয়ে বসেছি, এমন সময়ে পাশের ঘর থেকে তৃতীয় বর্ষের এক দাদা এসে গম্ভীর ভাবে বলল, “হোস্টেলে কেউ পড়াশোনা করে নাকি? নীচে মাঠে যাও, ভলিবল খেলা হবে।” আর দু’এক বার দেখে পড়ার চেষ্টা ছেড়ে দেওয়াটাই সহজ মনে হল। ক্লাসে ১৪০ জন ছেলে। সবাই যেদিন আসত, পিছনের দরজা পেরিয়ে প্রায় ঘরের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত। তবে পড়াশোনা বাদ দিলে হোস্টেলের দাদাদের সঙ্গে অন্তত আমার খুব মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বহু অবস্থায় তাদের ব্যবহার, ভালবাসা, আন্তরিকতার যে পরিচয় পেয়েছি, আজও স্মৃতিতে তা অম্লান হয়ে আছে।

পাশের ঘরেই থাকতেন হারাধনদা। হারাধন নায়ক, তৃতীয় বর্ষ বাণিজ্যের ছাত্র। বীরভূম জেলায় হেতমপুর হয়ে সুরুলে ছিল তার বাড়ি। বারান্দা দিয়ে যাতায়াতের পথে দেখতাম প্রায় সব সময়েই তার খাটের কাছে ২/৪ জন বসে আছে। একদিন আমাকে ডেকে বললেন,“তুমি ফার্স্ট ইয়ার? কোথা থেকে এসেছ? বেশী shy হ’লে হস্টেল লাইফ এনজয় করতে পারবে না।” পরে জানলাম হারাধনদা একজন ম্যাজিশিয়ান। যাদুর আকর্ষণে তার কাছে সব সময়েই কেউ না কেউ আসে। সেই বয়সে ম্যাজিক সম্বন্ধে কার না কৌতূহল থাকে? আমিও খুব সহজেই হারাধনদার বন্ধু স্থানীয় হয়ে গেলাম। তিনিও দেখলাম আমাকে একটু বেশি স্নেহ করছেন। তার কাছে অনেকেই এসে আবদার করত, কিছু একটা খেলা দেখতে চাইত। এসব ক্ষেত্রে সব চেয়ে উপযুক্ত হল এক প্যাকেট তাস। এরকম হলে হারাধনদা আমাকে ডাকতেন। খেলা তিনিই দেখাতেন, আমাকে কাছে থাকতে বলতেন। দেখতাম তার অসাধারণ আত্মপ্রত্যয়। তাকে কেউ বোকা বানাতে পারবে না, এই দৃঢ় বিশ্বাস তার নিজের উপরে ছিল। তাসের খেলা গুলি দেখে মনের মধ্যে তোলপাড় চলত, সেগুলি কি করে হচ্ছে বুঝতাম না। ঘর ফাঁকা থাকলে মাঝে মাঝে তিনি দু’একটা খেলার কৌশল আমাকে দেখিয়ে দিতেন। পড়াশোনা ত শিকেয় উঠেইছিল, যেটুকে বাকি ছিল সেখানে ঢুকে পড়ল ম্যাজিকের চিন্তা। এটা যেন একটু বেশি মাত্রায় আমাকে পেয়ে বসল। এর একটা করণ অবশ্যই ছিল হারাধনদার স্নেহসিক্ত প্রশ্রয়।

মেদিনীপুরের মুগবেড়িয়া গ্রামের ছেলে জয়ন্ত শাসমল ছিলেন সাহিত্যের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, বাংলা অনার্স। ম্যাজিক সম্বন্ধে তার কৌতূহল ছিল চোখে পড়ার মত। কিন্তু হারাধনদা তাকে কখনো উৎসাহ যোগান নি; তাঁকে বলতেন –“তুই পারবি না। ম্যাজিসিয়ানকে অনেক স্মার্ট হতে হয়।” একবার হাসতে হাসতে হারাধনদার কাছ থেকে কোন একটি খেলা কেড়ে নিতে চাইছিলেন। তা’ নিয়ে দু’জনের সাময়িক মনমালিন্য হয়। সে এক ছেলেমানুষি ব্যাপার। জয়ন্তদা ছিলেন খুব ভাল মানুষ। দাদা-বৌদির বাড়ি ছিল চেতলায়। জয়ন্তদার সঙ্গে আমি সেখানে বার দুয়েক গিয়েছি। জয়ন্তদাকে কিন্তু দমিয়ে রাখা যায় নি। বহু বছর বাদে, তখন তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ সম্পূর্ণ ছিন্ন, কাগজে একটা ছোট খবর পড়েছিলাম –‘যাদুকর জয়ন্ত কুমার শাসমল মুগবেড়িয়ার রাস্তায় চোখ বাঁধা অবস্থায় সাইকেল চালাচ্ছেন, কৌতূহলী জনতার ভিড় ঠেলে।’ অর্থাৎ ম্যাজিসিয়ান শেষ পর্যন্ত তিনি হয়েছিলেন। ‘অভ্যাসে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়।’

ম্যাজিকের কথাই যখন লিখতে বসেছি, তখন এটা সম্বন্ধে দু’চার কথা বলা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এ বিদ্যাটি অতি প্রাচীন। এখানে যাদুবিদ্যার ইতিহাস লেখার পরিসর নেই, তবে যদি কেউ উৎসাহী থাকেন তিনি অজিতকৃষ্ণ বসুর ‘যাদু কাহিনী’ বইটি কোন গ্রন্থাগার থেকে নিয়ে পড়ে দেখতে পারেন। বাজারে বইটি বর্তমানে অপ্রাপ্য। বর্তমানে জীবনযাত্রার ধরণ এবং শিল্প ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে পরিবর্তিত ধ্যান ধারণার জন্য যাদুবিদ্যা চর্চা হয়তো কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। আজকাল গনপতি চক্রবর্তীর নাম জানা লোক কম। পি. সি. সরকারের (প্রতুল চন্দ্র সরকার) নাম লোক মনে রেখেছে, সেটাও হয়তো অনেকটা জুনিয়ার পি. সি. সরকারের সৌজন্যে।
এক সময়ে রাজা মহারাজারাই সঙ্গীত, যাদুবিদ্যা ইত্যাদি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাদের সহায়তা নিয়েই এসব বিদ্যা চর্চিত হয়েছে, প্রসার লাভ করেছে। এখানে প্রসঙ্গতঃ সম্রাট জাহাঙ্গীরের (১৫৬৯ – ১৬২৭) শাসন কালের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কারণ এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। সম্রাটের লেখা আত্মজীবনী ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’-তে একটি পৃথক পরিচ্ছেদই লিখিত হয়েছে তার দরবারে অনুষ্ঠিত যাদুর খেলার বিষয়ে। ফারসিতে লেখা এই আত্মজীবনীটি ইংরাজিতে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদও করা হয়েছে। এর একটি সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ করেছেন ব্রাহ্মসমাজের নেতা ও সিটি কলেজের অধ্যাপক কৃষ্ণকুমার মিত্রের কন্যা কুমুদিনী মিত্র (পরে বসু) (১৮৮২ – ১৯৪৩)। ধারাবাহিকভাবে ‘সুপ্রভাত’ মাসিক পত্রে বেরোবার পর গ্রন্থাকারে এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। সম্প্রতি বইটি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীর আত্মজীবনীতে মোট ২৭টি যাদুর খেলা উল্লেখ করেছেন। এগুলি দেখে তিনি এতটাই চমৎকৃত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন, যে আত্মজীবনীতে একটা পৃথক পরিচ্ছেদই এর জন্য উদ্দিষ্ট হয়েছে। কুমুদিনীর অনুবাদ থেকে আমি এখানে ২৭টি ঘটনার মধ্যে তিনটির কথা উল্লেখ করছি। জাহাঙ্গীরের বক্তব্য হিসাবে এটি রচিত।

“বর্তমান সময়ে বঙ্গদেশে কয়েক জন অদ্ভুতকর্ম্মা ঐন্দ্রজালিক আছে। তাহাদের অভূতপূর্ব্ব কৌশল আমাকে এত মুগ্ধ করিয়াছিল যে, এতৎ সম্বন্ধে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করিয়া পারিলাম না। একবার সাতজন বাজীকর আমার দরবারে আগমন করিয়াছিল। তাহারা বলিয়াছিল যে তাহারা মানবের বুদ্ধির অগম্য কার্যসমূহ সম্পন্ন করিতে সক্ষম। বস্তুতঃ তাহারা এমন আশ্চর্যজনক কার্য্য করিয়াছিল যে, তাহা দর্শন করিয়া আমি বিস্ময়াভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলাম। …… দ্বিতীয়ত : এক দিবস রাত্রি দু-প্রহরের সময় সমুদয় জগৎ যখন গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন এই সাত জনের মধ্যে একজন বাজিকর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি ত্যাগ করিয়া একটি চাদরে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিল। ততপরে সে এই চাদরের মধ্য হইতে একটি অত্যুজ্জ্বল আয়না বাহির করিল। এই আয়না হইতে এ প্রকার তীব্র রশ্মি নির্গত হইল যে, তদ্দারা সমুদয় আকাশ অসম্ভবরূপে আলোকিত হইয়া উঠিল। পথিকগণ বলিয়াছিল যে, এই রাত্রিতে তাহারা নভোমন্ডল এক অভূতপূর্ব্ব আলোকে পরিপ্লুত হইতে দেখিয়াছিল এবং আগ্রা হইতে যে সকল স্থানে গমন করিতে দশদিন লাগে, সেই সকল স্থানের লোকেরাও এই আলোক দেখিতে পাইয়াছিল। এই আলোক, অত্যুজ্জ্বল দিবসের আলোক অপেক্ষাও অধিক হইয়াছিল। …… পঞ্চমতঃ বাজিকরগণ আমার সম্মুখে একটি গরম জলপূর্ণ বৃহৎ কটাহ স্থাপন করিয়া তাহাতে প্রায় তিন মন চাউল ফেলিয়া দিল। তৎপরে বিনা অগ্নিতে কটাহের জল ফুটিতে আরম্ভ করিল। কিয়ৎক্ষণ পরেই তাহারা কটাহের ঢাকনি খুলিয়া তাহা হইতে ভাত বাহির করিয়া একশত থালা পূর্ণ করিল, অধিকন্তু কটাহ হইতে প্রত্যেক থালায় একটি সিদ্ধ মুরগী রাখিল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি আশ্চর্য্যাণ্বিত হইয়া গিয়াছিলাম। …… ত্রয়োবিংশ দৃশ্য : তাহারা পঞ্চাশ হাত পরিমিত দীর্ঘ এক শৃঙ্খল লইয়া আসিয়া একবার আকাশের দিকে ছুঁড়িয়া দিল। এই দিক যেন শূন্যেই, কোনো অদৃশ্য বস্তুতে আটকাইয়া রহিল। শৃঙ্খলের অপর দিক ভূমির সহিত সংযুক্ত করিয়া দেওয়া হইল। তৎপরে তাহারা একটি কুকুর আনিয়া শৃঙ্খলের নিম্নদিকে দন্ডায়মান করাইয়া দিল। কুকুর তৎক্ষণাৎ শৃঙ্খল বাহিয়া শেষ সীমায় গিয়া উপস্থিত হইল এবং সেস্থান হইতে আদৃশ্য হইয়া গেল। এই প্রকারে এক একটা শূকর, সিংহ, ব্যাঘ্র শৃঙ্খল বাহিয়া উঠিয়া উপরিভাগে গিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। তৎপরে তাহারা শৃঙ্খল নামাইয়া লইয়া উহা এক থলিয়ার মধ্যে রাখিল। জন্তুগুলি আকাশের মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হইয়া গেল তাহা কেহই বুঝিতে পারিল না। এই অভূতপূর্ব্ব ঘটনা বিশেষ আশ্চর্য্যজনক।

সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের চোখে খেলা দেখে যখন লিখে গেছেন, তখন এগুলি নিতান্তই শোনা কথা বা ঘটেনি একথা বলা চলে না। আর সম্রাটের দরবারে খেলা দেখাতে গিয়ে ব্যর্থ হলে তার পরিণতিও নিশ্চয়ই সুখকর হত না।

এবার নিজের অসমাপ্ত কাহিনীতে ফিরে আসি। ইতিমধ্যেই হারাধনদার কাছ থেকে কয়েকটা খেলা দেখে নিয়েছি। তিনি নিজেই আমাকে কৌশলটা শিখিয়েছেন। এমন কি একবার বাড়ি যাবার আগে নিজের বাক্সের চাবিটাও আমাকে দিয়ে বলেছিলেন –“যদি সেরকম কেউ আসে ও ম্যাজিক দেখতে চায় তবে বাক্সটা খুললে কিছু জিনিসপত্র পাবে।” দিন তিন চারেক বাদে তিনি বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিলেন। বাক্স খুলবার দরকার হয় নি। তাস ছাড়া প্রথম যে খেলা তিনটি আমি শিখেছিলাম অর্থাৎ কৌশলটা দেখেছিলাম তার প্রথমটা হল খুব পাতলা কয়েকটা রঙিন কাগজ (ঘুড়ির কাগজের মত) ছিঁড়ে উপরে ছুঁড়ে দিলে সেটা একটা বড় ফুলের তোড়া হয়ে নেমে আসে। এর অনেক রূপান্তর পরবর্তী সময়ে দেখেছি, সেগুলি সবই তখন বিদেশ থেকে আসত। এ ধরণের খেলা প্রথম দেখেছিলাম এ. কে. দাস নামে এক ম্যাজিসিয়ানের কাজে। তিনি মঞ্চে একটি রুমাল নিয়ে এসে ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ সেটা একটা বড় লাঠিতে পরিণত করলেন। এর উল্টোটাও দেখেছি। একটি লম্বা লাঠি হঠাৎ দু’টি সুদৃশ্য রুমালে পরিণত হয়। যাই হোক, দ্বিতীয় যে খেলাটি শিখেছিলাম সেটি ছিল Dice Box-এর। দুটি পাশাপাশি একই সঙ্গে জোড়া দুটি কাঠের বাক্সের একটিতে একটা বড় মাপের Dice (লুডো খেলার মত) রাখলে সেটা কাঠের দেয়াল ভেদ করে পাশের ঘরটিতে চলে আসে। এর পর দুটি ঘরই ফাঁকা দেখান হয় এবং Dice আবার ফিরে আসে। তৃতীয় খেলাটির নাম ছিল Magic Arrow. এক প্যাকেট তাস থেকে দর্শককে একটি পছন্দ করতে বলা হয়, সেটি দেখে তিনি প্যাকেটে সেটি ভাল করে মিশিয়ে দেন। পরে তিনি প্যাকেটের সব তাস আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেন। তাসগুলি যখন হাওয়ায় ভেসে ভেসে নীচে নেমে আসছে, সেই সময়ে যাদুকর তীর ধনুক দিয়ে সেই বিশেষ তাসটিকে গেঁথে ফেলেন। এরই উন্নততর ও জমকালো রূপ ছিল Television Frame. এটি আমি পরে কিনেছিলাম এবং বার কয়েক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখিয়েওছি। তবে এসব খেলা দু’শো আড়াই শো লোকের সামনে ভালই চলে। দর্শক সংখ্যা খুব বেশী হলে যন্ত্রপাতি নিয়ে বড় মাপের খেলা দেখানই ভাল। না হ’লে পিছনের দর্শকেরা উপভোগ করতে পারবেন না। এসব অবশ্য হারাধনদার ছিল না। থাকার প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, তিনি ত পেশায় যাদুকর ছিলেন না ; শুধুই শখে পড়ে শেখা।

আরও একটি খেলা আমার খুব ভাল লেগেছিল, সেটি ছিল Multiplying Billiard Ball-এর খেলা। বিলিয়ার্ড বল বলা হলেও এটি দেখানো হত টেবিল টেনিসের মত পিঙ পঙ বল দিয়ে। খেলাটি হল – যাদুকর খালি হাতে মঞ্চে এসে ‘হাওয়া থেকে’ একটা বল ধরবেন। তার পর সেটা ক্রমশঃ সংখ্যায় বেড়ে পাঁচ আঙুলের ফাঁকে চারটি বল হবে। এর পরে কমতে কমতে একটি বল-এ এসে দাঁড়াবে এবং পরে সেটাও অদৃশ্য হয়ে যাবে। এক একটা বল যখন শূণ্য থেকে এসে লাফিয়ে দু’আঙুলের ফাঁকে ঢুকে যায় অথবা সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, বাইরে থেকে দেখতে খুবই আকর্ষনীয় লাগে। খেলাটির ট্রিক বা কৌশলের অংশটি তেমন কিছু নয়, কিন্তু প্রচন্ড অনুশীলনের প্রয়োজন। মঞ্চে উঠে হাত থেকে বল পড়ে যাওয়াটা কাজের কথা নয়। অত নিরন্তর অভ্যাস আমার পক্ষে কি করে সম্ভব! সব সময়েই কেউ না কেউ ঘরে রয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একমাত্র দুটি সময় কিছুটা অনুকূল ছিল। সেটা হল, রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে এবং সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে। কিন্তু সবাই যখন ঘুমোতে যায় তখন আমারও অসম্ভব ঘুম পায়। শেষে ঘুম কাতুরে বাঙালির সকালে ঘুম না ভাঙার স্বভাবটাই আমাকে অভ্যাসের সুযোগ করে দিয়েছিল। শীতকালে এ সুযোগটা আরো বেশি করে পেয়েছিলাম। শেষে অনেক চেষ্টায় খেলার প্রথম ও শেষ অংশটি ছাড়া অর্থাৎ হাওয়া থেকে বল ধরে একেবারে শেষে হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়া বাদ দিয়ে, একটা থেকে চারটা এবং চারটা থেকে একটা মোটামুটি আয়ত্ব হল।

সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে হোস্টেল সংলগ্ন ভিতরের মাঠে প্রতি বছরই একটা জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হত। থাকত আবৃত্তি, গান, মূকাভিনয়। সেবার সুপারিন্টেনডেন্ট সরোজ বসু মহাশয় অনুরোধ করলেন – হারাধনের ম্যাজিক শো চাই, সেই সঙ্গে আমারও। হারাধনদার তেমন কিছু হেলদোল দেখলাম না কিন্তু শোনার পর থেকেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হবার যোগাড়। হারাধনদা আমাকে বললেন –“কি কি দেখানো যায় বল তো?” সময় ধার্য ছিল আধ ঘন্টা। আয়োজকরা ঠিক করলেন, শুরুই হবে ম্যাজিক শো দিয়ে। ঠিক হল, হারাধনদা দেখাবেন কাগজ ছিঁড়ে ফুল, ডাইস বক্স, জাম্বো তাস এবং চোখ বেঁধে ব্ল্যাক বোর্ডে লেখার খেলা (যেটা X-Ray Eye নামে বিখ্যাত ছিল)। প্রথম খেলাটি দেখাবার পরে থাকবে আমার বিলিয়ার্ড বলের খেলা এবং তার পরে বাকিগুলি আবার ওনার। জাম্বো তাসের খেলা হ’ল – একটা বিশাল আকৃতির তাস তাতে রুইতন-এর (diamond) নানা ফোঁটা থাকবে। কথা বলতে বলতে তাসটা হাতে করে উপর থেকে নীচে ঘুরিয়ে ক্রমাগত এপিঠ ওপিঠ করে গেলে তাসের ফোটার পরিবর্তন হতে থাকবে। রুইতন নেওয়া হয় এই জন্য যে এতে, উলটো করে দেখলেও জ্যামিতিক আকারের কোনো পরিবর্তন হয় না। এ খেলাটি তখন কিছুদিন হয় বাজারে এসেছে। এটি দেখাতে গেলে একটি বিশেষ ভাবে তৈরি তাস দরকার। যারা ম্যাজিকের যন্ত্রপাতি তৈরি করেন, তারাই পারেন এটি দক্ষ হাতে ত্রুটিহীন ভাবে তৈরি করতে। এরকম দুয়েকটি জায়গা ছিল যেখান থেকে তৈরি করানো যায়। আমরা ভেবে চিনতে যাদুকর শঙ্কর দাশের কাছে গেলাম। বহু বছর উনি যাদুসম্রাট পি. সি. সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। বেলেঘাটায় আলোছায়া সিনেমা হলের (অধুনা লুপ্ত) কিছু দূরে একটা গলি দিয়ে ঢুকে একফালি পুকুর পেরিয়ে ছিল ওনার বাড়ি। পরে আমি একাও তার বাড়িতে বার কয়েক গিয়েছি। উনি বাড়িতেই ছিলেন, শুনে বললেন –“ পেয়ে যাবেন। কবে চাই ?” দাম জিজ্ঞাসা করাতে বললেন –“দশ টাকা।” এখন শুনে হাসি পেতে পারে ; কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেটা ছিল গত শতকের পাঁচের দশকের শেষের দিক।

দু’এক দিন পরে শঙ্কর দাশের বাড়িতে গিয়ে জাম্বো তাস নিয়ে এলাম। হাতে নিয়ে দেখলাম কি অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে সূক্ষ্ম জিনিসগুলি নিঁখুত ভাবে তৈরি করা হয়েছে। শঙ্কর দাশের হাতের কাজ ছিল খুবই উঁচু দরের। কিন্তু শুধু জিনিস হাতে পেলে ত হবে না, অভ্যাসও করতে হবে। হাতে আর মাত্র দু’মাস সময়। এবার যেহেতু নিজেদের হোস্টেলের অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সূচীর তালিকা আনুষ্ঠানিক ভাবেই তৈরি হয়েছে, তাই হারাধনদা অনুরোধ করলেন যে বিকেলে ঘন্টা খানেকের জন্য ওনার ঘরে কেউ থাকবে না, উনি আর আমি ছাড়া।

যাই হোক, যতদূর সম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে নির্দ্দিষ্ট দিনে মঞ্চে উঠলাম। হারাধনদার কাগজ ছিঁড়ে ফুল ভালই উৎরালো। এবার আমার পালা। মঞ্চে উঠলাম। কখনো ভাবিনি যে কৌতূহল এবং আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকা এতগুলি লোকের সামনে আমাকে একদিন দাঁড়াতে হবে। সামান্য একটু এদিক ওদিক হলেই সমূহ বিপদ। মঞ্চে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু ভয় অনেকটাই কেটে গেল। প্রত্যয়ী মনোভাব নিয়ে কোনো রকমে সে যাত্রা উৎরে গেলাম। হাততালিও পড়ল। কে একজন যেন একটা ছবি তুলেছিল। কয়েক দশক অ্যালবামেই পড়ে ছিল সেটা, কখনো কাজে আসবে ভাবি নি। একটা থেকে চারটে হওয়া পিঙ পঙ বল আঙুলের ফাঁকে নিয়ে মঞ্চে দাঁড়ানো সে ছবিটাই এই নিবন্ধের সঙ্গে জুড়ে দিলাম।

আমার পালা শেষ হয়ে গেছে। মনে তখন প্রবল সাহস। মঞ্চের পাশে পর্দার আড়ালে হারাধনদার জন্য অপেক্ষা করলাম। বলা বাহুল্য, উনি যথেষ্টই প্রসংশিত হলেন। দু’জনে দোতলার ঘরে উঠে এলাম। মনে হল যেন জীবনের এক বিরাট কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছি। তখন উৎপলা সেনের গান হচ্ছে। বারান্দায় কে যেন চেঁচিয়ে বলল –“উৎপলা জমিয়েছে।”

এরপর অনেক ম্যাজিসিয়ানের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউর পাশে প্রভাত সিনেমা হলে (এখনও আছে কিনা জানি না) একবার All India Magicians’ Conference হয়েছিল। প্রত্যেক রাজ্য থেকে আগত একজন দু’জন করে যাদুকরকে খেলা দেখাবার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে আবেদনের ভিত্তিতেই মনোনয়ন করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দু’জন সুযোগ পেয়েছিল, একজন হারাধন নায়ক, অন্যজনের নাম মনে নেই। অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদেরই বোধ হয় সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, না হলে এ রাজ্যে তখন বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠ যাদুকর ছিলেন।

কোন রাজ্য থেকে কে এসেছিলেন এখন আর মনে নেই, তবে মাইকে একটা ঘোষণা এখনও কানে লেগে আছে – “Om Prakash, from East Punjab”. এই ওম প্রকাশের খেলা আর কোথাও কখনো দেখিনি; স্বাভাবিক, তিনি থাকেন পাঞ্জাবে। যাই হোক, সেদিন দীর্ঘ চার ঘন্টা ধরে বহু যাদুকরের খেলা দেখার সুযোগ হয়েছিল। অনেকে বহু নতুন খেলা দেখালেন, যেসব অন্যদের মধ্যে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল। সকলেই চাইছিলেন কে সেগুলি আগে রপ্ত করে মঞ্চে প্রদর্শন করবেন। শঙ্কর দাশের মত যারা ম্যাজিকের যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন, তাদের কাছে ভিড় লেগে গেল। Diminishing Milk, Increasing Milk, Milk Vanishing, Rising Card ইত্যাদি খেলা আমি সেখানে প্রথমবার দেখলাম। হারাধনদাও জানালো আগে কখনো এগুলো দেখেনি। একটা কথা মনে রাখতে হবে, যাদুর জগতে আমরা ছিলাম নিতান্তই আনকোরা। অনেকের কথাই মনে পড়ছে তবে সেগুলি বলতে গেলে রচনার কলেবর বৃদ্ধি পাবে। একটা প্রদর্শনীর কথা শুধু বলব। ড: শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্তর ম্যাজিক শো, হয়েছিল নিউ এম্পায়ারে। ড: দাশগুপ্ত ছিলেন একজন চিকিৎসক। সেবার টি. বি. রোগীদের সাহায্যার্থে প্রদর্শনীটি হয়েছিল। ড: দাশগুপ্তর সঙ্গে ছিলেন তার কন্যা উমা দাশগুপ্ত। পরে আমি উমা দাশগুপ্তর একক প্রদর্শনীও দেখেছি। পরিচ্ছন্ন সেই খেলা, মার্জিত কথাবার্তা, আকর্ষণীয় উপস্থাপনা।

শঙ্কর দাশের কাছে মাঝে মাঝে গিয়েছি, হারাধনদা কয়েকবার সঙ্গে ছিলেন, কয়েকবার আম একা। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। একজনের নাম মনে আছে, সুনীল দাস। কোন্নগর বা বৈদ্যবাটি কোথাও একটা থাকতেন। উনি আমাকে একটা ছাপানো কার্ড দিয়েছিলেন, তাতে লেখা ছিল – Specialist in modern magic and sleight of hand. হস্তকৌশল প্রদর্শনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও সাবলীল। কৌশল জানা থাকা সত্বেও চার পাঁচ ফুট দূরে বসে দেখেও বোঝা শক্ত ছিলো কখন কিভাবে তিনি সেটা প্রয়োগ করছেন। আর এ ধরণের খেলাই ছিল আমার বেশি পছন্দ। বিশাল যন্ত্রপাতি নিয়ে সুবেশা তরুণীদের সাহচর্যে চোখ ধাঁধানো জমকালো অনুষ্ঠান কখনই আমাকে তেমন আকর্ষণ করে নি। আসানসোলে রাস্তার পাশে বসা বেদেনীদের কাছে cup and ball-এর খেলাও অনেক দেখেছি। মুখ থেকে বান্ডিল বান্ডিল ছুঁচ বার করাও দেখেছি। ফুটপাথে লোক চারপাশে ঘিরে রয়েছে; তারই মধ্যে তাঁরা অনায়াস দক্ষতায় খেলা দেখিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে হাসছে (হয় ত সবাইকে বোকা বানিয়ে)। বেঁচে থাকার জন্য সামান্য কিছু পয়সা রোজগার করতে দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরে কি পরিমাণ অনুশীলন এদের করতে হয়েছে ভাবতে অবাক হতে হয়। তবে ম্যাজিক দেখাবার একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হ’ল প্রদর্শনভঙ্গী বা showmanship, অতি সাধারণ খেলাও দেখাবার গুণে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

ম্যাজিক তো হলো, কিন্তু আর দু’মাস বাদেই I.Sc পরীক্ষা; সেখানে তো যাদুর কোন কৌশলই কাজে আসবে না। মনঃসংযোগ করতে গেলেই নানা খেলার কথা মনে পড়ে। নেশা যে কি জিনিস সেটা তখন টের পেলাম। সেবার কোনরকমে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এর কয়েক মাস আগেই বাবা বদলী হয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তাই হস্টেল ছেড়ে কলেজের কাছেই বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীটে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠে এলাম। বাঙ্গুর অ্যাভেনিউতে একটা জমি কিনে সেখানেই আমাদের বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। নানা সমস্যার মধ্যে আমি পুরানো কলেজে আর যেতেই পারি নি। হারাধনদা বা অন্যান্য সতীর্থ ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও আর যোগাযোগ করতে পারি নি। চিরদিনের জন্যই তারা হারিয়ে গেছে। স্মৃতিতে যেটুকে ধরা ছিল সেটুকু আশ্রয় করেই এই স্মৃতিচারণ।

এরপর দুবার আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে মঞ্চে উঠতে হয়েছে। প্রথমবার ১৯৬২/৬৩ সালে বি. ই. কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়বার সময়ে। একবার ১০নং হোস্টেলের (এখন বোধ হ্য ড: শীল হল) বার্ষিক অনুষ্ঠানে হস্টেলের পাশের জমিটা ঠিকঠাক করে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। আবৃত্তি গান ইত্যাদি তো ছিলই, তবে প্রথমে ম্যাজিক দিয়েই শুরু। মঞ্চে উঠে দেখি সামনে প্রিন্সিপাল এ. সি. রায় বসে আছেন। আর আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন বিভাগের প্রধান ড: এস. এস. বড়াল। আমি তো পেশাদার নই, মঞ্চভীতি পুরোমাত্রাতেই ছিল, বিশেষ করে গণ্যমান্যদের সামনে। আমি সবে milk vanishing দেখিয়েছি, সেটি ছিল একটা বড় জাগের দুধ কাগজের ঠোঙায় ঢেলে অদৃশ্য করে ফেলা, এমন সময় ড: বড়াল ছোট ছেলেদের মত বেশ জোরেই বলে উঠলেন, -“এটা খুব সোজা, এটা আমি জানি।” এরকম একটা মন্তব্য শুনে আমি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। বহু বছর পরে শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে যখন প্রসঙ্গক্রমে ঘটনাটি বলেছিলাম, উনি প্রাণভরে হেসেছিলেন। অনুষ্ঠানের পরে রাত্রিবেলা ডাইনিং টেবিলে বসে যখন খাচ্ছি হঠাৎ ফাইনাল ইয়ার ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র সঞ্জীত বর্ধন (বহু বছর ধরে আমেরিকাবাসী) খাবার ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল –“কি হে! খুব ভালই তো দেখিয়েছ।” বলে রান্নাঘরে গিয়ে একবাটি অতিরিক্ত মাংস নিয়ে এসে আমার পাতের কাছে রাখলেন। আমার পুরস্কার, সামান্য একবাটি মাংস, কিন্তু আমার ম্যাজিকের স্বীকৃতির সেইদিনের মূহুর্তটি আজও মনে গেঁথে আছে।

আমার শেষ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ১৯৬৮ কি ’৬৯ সালে। তখন আমি শিক্ষক হিসাবে কলেজের সঙ্গে যুক্ত। কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই পান্ডিয়া হলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে নবীন শিক্ষকদের সঙ্গে তখন স্নাতোকত্তর ও গবেষক ছাত্ররাও থাকত। সেবার সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে বেশ বড় করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের লেকচারার অমিতাভ ঘোষ নিজে উদ্যোগী হয়ে চাঁদা তুললেন। আমার আপত্তি নাকচ করে ঠিক হল ম্যাজিক দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু হবে। নিতান্তই ঘরোয়া অনুষ্ঠান, শ’খানেক লোক হবে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভাগীয় প্রধান বৌদি ও দুই মেয়েকে নিয়ে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। সেবার টেলিভিশন ফ্রেম-এর খেলা দেখিয়ে খুব প্রশংসা পেয়েছিলাম, ভয়ও করছিল, যদি যন্ত্রটি সঠিক মুহূর্তে কাজ না করে! খেলার শেষে চোখ গোল গোল করে ছোট একটা মেয়ের জিজ্ঞাসা –“এটা কি করে হ’ল বলুন না।”

সেই আমার শেষ ম্যাজিক শো। শত অনুরোধেও আর আমি ম্যাজিকের পথে পা বাড়াই নি।

সংযুক্ত ছবি : সিটি কলেজের রামমোহন ছাত্রাবাসের অনুষ্ঠানে আমার মাল্টিপ্লায়িং বিলিয়ার্ড বলের খেলা দেখানো।
(রচনাটি ‘অবসর’ নামক ওয়েব ম্যাগাজিনে পূর্ব প্রকাশিত)

Sahityika Admin

Add comment