সাহিত্যিকা

আমাদের বিই কলেজ ক্যাম্পাসের দুর্গা পূজা

আমাদের বিই কলেজ ক্যাম্পাসের দুর্গা পূজা
রমা সিনহা বড়াল, ১৯৭৬ আর্কিটেকচার ও টাউন প্ল্যানিং

“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন ……”, প্রতি বছর মহালয়া’র দিন ভোর চারটার সময় রেডিওতে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণের সাথে সাথেই আমার ঘুম ভেঙে যেতো। আগের দিন রাতেই মা’কে বলে রাখতাম আমাকে ডেকে দেওয়ার জন্য, কিন্তু ভোরের দিকে নিজের থেকেই ঘুমটা পাতলা হয়ে আসতো। তারপর ঘুম ভেঙে দেখতাম ইতিমধ্যেই মা, বাবা উঠে পড়েছে‌ন আর রেডিওর অনুষ্ঠান শুনছেন। আর সারা বাড়িতে ধূপের স্নিগ্ধ গন্ধ.
আমাদের বাড়ির রেডিও সেট বাবার নিজের হাতের তৈরি; ভাল্ব সেটের বড়ো রেডিও। তার আওয়াজে ভোরের নিস্তব্ধতায় সুন্দর স্তোত্রপাঠে আর গানে বাজছে “মহালয়ার” মা চন্ডীর বন্দনা। ঐ ভোরে ক্যাম্পাসের আশেপাশের আর সকলের বাড়ি থেকেও ভেসে আসতো শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠস্বর। মনে করিয়ে দিতো যে পূজোর আর মাত্র সাতদিন বাকি।

কলেজের ক্যাম্পাসের পাশেই গঙ্গা। মহালয়ার দিন দেখতাম শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডী বন্দনা শুনে, মা আর বাবা ভোরবেলা সুইমিংপুলের পাশ দিয়ে যে গেট (থার্ড গেট, যেটা বেশিরভাগ সময়েই বন্ধ থাকতো) দিয়ে গঙ্গায় যেতেন তর্পন করতে। মনে আছে, নূপুরের মাও (প্রফেসর দুর্গাদাস ব্যানার্জির স্ত্রী) বেশ কয়েকবার আমার মায়ের সাথে গঙ্গাস্নানে গেছেন।

মহালয়ার দিন থেকেই আমাদের বিই কলেজ মডেল স্কুলের ছূটি হয়ে যেতো। আমাদের স্কুলের প্রাঙ্গনে প্রচুর কাশফুল ছিলো। সেই নীল ঝকঝকে আকাশ, স্কুলের কাশ ফুল ভরা মাঠ জানান দিতো শরৎকাল এসে গেছে, এবার “মা দুর্গাও সপরিবারে” আমাদের মাঝে আসছেন। আমাদের বিই কলেজ ক্যাম্পাসে একটাই পূজো হতো, কল্যাণকাকুর (ব্যানার্জি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) প্ল্যানিং-এ করা এক্সপেরিমেন্টাল বিল্ডিঙ-এ (এখনকার নেতাজি ভবন)। যখন খুব ছোট , মনে আছে ঐখানেই ঠাকুরও গড়া হতো।

ঐ’কটা দিন আমরা ছোটরা, মানে যারা বিভিন্ন বয়সের স্কুলের মাঝারি ক্লাসের পড়ুয়া অর্থাৎ জূলীদি, বানীদি, শিখাদি, মন্জুদি, বেবীদি, নূপুর, রমু, জয়ন্তী, রুমনি (শিখরীনি), মুঙলু, শিপ্রা, রুমানা, চন্দনা, ডলি, লিলি, তিলু, পুলক, সোমনাথ, দীপু, বীথিকাদি, শিখাদি, দীপু, জোনাকি, হেলেন, বাবু, তিলক, অলক ও আরো অনেকে- সবাই মনের আনন্দে পূজোর নানারকমের কাজ করতাম। সেই আনন্দটাই ছিলো অন্যরকম। পূজোর সেই কয়েকটা দিন আমাদের জন্য ছিলো অবাধ স্বাধীনতা।

পুরো পূজোটাই ছিল ক্যাম্পাস নামের একান্নবর্তী পরিবারের। প্রত্যেক বছর পূজোর একমাস আগে ক্যাম্পাসের সবাই মিলে আলোচনা করে একটা পূজা কমিটি গঠন করা হয়ে যেতো। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরা যারা একটু বড়ো হয়েছে, বয়স অনুযায়ী তাদের মধ্যেও কাজের ভাগ করে দায়িত্ব দেওয়া হতো। আর পূজার জোগাড়ের, ভোগ রান্নার দায়িত্ব দেওয়া হতো মায়েদের।

পূজো’র জন্য দৌড়ঝাঁপ আর তদারকি করতেন ভঞ্জকাকু, অমরেন্দ্রকাকু ও আরও অনেকে। আমাদের ছিলো খুবই সীমিত বাজেটের পূজো। সেই বাজেটে কিরকম মূর্তি হবে, প্যান্ডেল কিরকম হবে, ঢাকীর ব্যাবস্থা, দুপুরের সকলের জন্য ঢালাও ভোগ খাওয়ার ব্যাবস্থা, নিজেদের নাটক, গান বাজনা, সবকিছুর দ্বায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে একটা সুন্দর আনন্দময় পূজার আয়োজন হতো। তখন ঠাকুরের মন্ডপে এতো সাজানো বা আলোর বাহার ছিল না। ঠাকুরের পিছনে একরঙা একটা কাপড় টাঙানো থাকতো, আর তাতেই কাগজ কেটে পাহাড়, গাছ ইত্যাদি বানিয়ে মন্ডপ সাজানো হতো। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরাই বানিয়ে দিতো।

আমাদের ঠাকুর হতো বরাবরই একচালার। অবাক বিস্ময়ে দেখতাম কি ভাবে প্রথমে খড়ের কাঠামো বানিয়ে তার উপরে মাটির প্রলেপ দিয়ে একটু একটু করে মায়ের মূর্তি তৈরি হচ্ছে। মনে আছে, কলি (শীল) আর দীপু (পাল) তখন খুব ছোট। ওরা দুজনে কোথা থেকে একদলা মাটি নিয়ে এলো, ঠাকুর বানাবে। প্রতিমা যারা বানায়, তাঁদের কাছে টানা কয়েকদিন গিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে দেখলো। যখন জানতে পারলো যে শুধু দুর্গাপ্রতিমা নয়, সিংহও বানাতে হবে, তখন ভয়ে পিছিয়ে আসে। আমার মার কাছে এসে জানতে চেয়েছিলো সিংহ বাদ দিয়ে দুর্গাঠাকুর বানানো যায় কিনা?

প্রতিমার সবার শেষে হতো ডাকের সাজ আর রং তুলি দিয়ে মুখের আদল তৈরি। সেই সময় কলি, মিলি, রানা, বাবুয়া, ঝুম, নীতা, টুকিরা অনেক ছোট। নূপুরের একবার মনে হয়েছিলো যে দুর্গার মুখ নাকি একদম ওর মতন। আর সোমনাথকে (সিনহারায়) খুব ক্ষ্যাপানো হয়েছিলো অসুরের চেহারা নাকি একদম ওর মতন হয়েছে। সোমনাথ খুব ক্ষেপে গিয়েছিলো। এরপর ওরা যখন আরেকটু বড়ো হয়ে পূজোর দায়িত্ব নিলো, তখন কুমোরটুলি থেকে তৈরি ঠাকুর আনা হতো। তাই এরপর আমরা বিই কলেজের নিজেদের ক্যাম্পাসে ঠাকুর তৈরি আর দেখতে পাই নি।

আমাদের পূজো ছিলো একেবারেই ঘরোয়া, জাঁকজমক একদমই ছিলো না ,তবে প্রাণের টান ছিল খুবই। পূজোর চারটে দিন আমাদের সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল ভোরবেলা সুর্য উঠার আগেই সবাই মিলে লুকিয়ে সবার বাগান থেকে ফুল চুরি করে ঠাকুরের কাছে ফুল জমা করা ও তারপর মালা গাঁথা। পূজো মানেই শিউলি ফুলের সময়। আমরা মশার কামড়, শুয়াপোকা অগ্রাহ্য করে যে যত পারতাম শিউলি ফুল কুড়োতাম। আবার ঠাকুরের কাছে হাতজোড় করে বলেও রাখতাম “পাপ দিও না ঠাকুর, ফুল চুরি আসলে চুরি নয়, পূজোর জন্য, তাই দোষ নিও না”। ছোটবেলাটা যে কতো সরল ছিল। এখন সেটা ভাবলেই হাসি পায়। এ ব্যাপারে মনে আছে এখন যেখানে এলামনি গেস্টহাউস সেখানে প্রফেসর এ কে সান্যাল জেঠুর বাড়ি ছিল। তিনি ছিলেন সেখানে ড্রইঙ-এর মাস্টারমশাই। ওনার বাগানে খুব ভালো ফুল হতো। কিন্তু চুরি করতে গেলেই জেঠু টের পেয়ে যেতেন আর আমাদের তাড়া করতেন। পাশেই কবরখানা, অনেকবার পালাতে গিয়ে সেখানে পড়ে গিয়ে চোট বা ছোটখাটো জখমও হয়ে যেতো।

সন্ধ্যাবেলায় নানান রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। ছোটদের বড়দের গান-বাজনা, নাটক, রবি ঠাকুরের নৃত্যনাট্য, অনেক হয়েছে। নাটক হলেই সবার আগে নাম আসতো ভঞ্জকাকু আর যাদবকাকুর (চক্রবর্তী)। আর ছিলেন অনিলকাকু (চৌধুরী)। যাদবকাকু আর অনিলকাকুর ছিল নায়কচিত চেহারা। কাকীমাদের জোর করে পার্ট দেওয়া হতো। ছোটদেরও নানান রকমের অনুষ্ঠান হতো মনে আছে। আমি নিজে একবার অনেক রিহার্সাল দিয়ে দু’টো নজরুলগীতি গেয়েছিলাম। গানদুটো ছিল রুমঝুম রুমঝুম আর মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে নেচে যায়। এই গানটার সাথে নূপুর আর তিলু (তিলোত্তমা, চৌধুরী) খুব সুন্দর নেচেছিলো। তিলুকে সেদিন সত্যি মোমের পুতুল মনে হচ্ছিলো। নূপুর আর তিলুকে নাচটা শিখিয়েছিলো আমার দিদি বাণী।

আমাদের পারিবারিক প্রথায় ষষ্ঠীর দিনে সকাল সকাল দুধের সর, ময়দা, বেসন সব মিশিয়ে মেখে গায়ে ঘষে শরীরের ময়লা তুলে, আর মাথায় রিঠা দিয়ে স্নানকরে নতুন জামা, জুতো পরে দলবেঁধে ঠাকুর দেখতে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে যেতাম। অনেক সময় বাবার সাথে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাতাইতলা বা শিবপুর বাজার অবধিও ঠাকুর দেখতে চলে যেতাম। হাতের আঙুলে গুনতাম, কতোগুলো ঠাকুর দেখলাম। গুনতে গুনতে বেশির ভাগ সময়েই গুলিয়ে যেতো, এইরে ভুলে গেছি কতগুলো ঠাকুর দেখলাম। কিন্তু তাতেই কি কম আনন্দ পেতাম? ৫৫নম্বর বাসে করে ফিরে আসতাম। আর নতুন জুতোয় ফোস্কা পরলেও বাড়িতে জানাতাম না। তবে আমার হাঁটা দেখেই বাবা বুঝতে পারতেন।

সপ্তমী দিন ভোরবেলায়, কলা বৌ স্নান করাতে ঠাকুর মশাই যখন ঢাক ও কাঁসর বাজিয়ে গঙ্গাতে যেতেন, তার আগেই ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে আমরাও তৈরি হয়ে যেতাম। ক্যাম্পাসের কচিকাঁচা বন্ধুরা সবাই মিলে সেই পূজোর জায়গায় পৌঁছে যেতাম।

বিশেষ আকর্ষণ ছিল অষ্টমী পূজোর দিন। ঐ দিনেই সবাই এসে অঞ্জলি দিতেন। বাবারাও দিতেন। বেশ কয়েক ব্যাচে অঞ্জলি হতো। মায়েরা লাল পাড় গরদের শাড়ি পড়ে, আলতা পায়ে, পূজোর ডালি নিয়ে মন্ডপে আসতেন। ফুল, ফল, শাড়ি, আলতা, সিঁদুর দিয়ে নিজের মনের মতন করে সাজিয়ে পূজো দিতেন। সন্ধ্যাবেলায় কলাপাতার উপর সার সার একশ আট’টা সলতে ও তেল দিয়ে প্রদীপ সাজানো হতো। সন্ধিপূজোর সন্ধিক্ষণে সবাই মিলে প্রদীপ জ্বালাতাম। একশ আট লাল পদ্ম দিয়ে সপরিবারে দুর্গা মায়ের পূজো করা হতো।

মনে আছে, একবার অস্টমীর দিনে হঠাত দেখি সুব্রত আমাদের প্যান্ডেলে। সুব্রত বিই কলেজেই পড়ে। আমার জুনিয়র, আমার সাথে অল্পবিস্তর পরিচয়ও ছিলো। ওভালে ওকে ফুটবল খেলতে দেখি। জানি না সে কোথায় থাকে, তবে সে ক্যাম্পাসের কোন স্টাফের ছেলে নয়। আমাদের পূজোয় প্যান্ডেলে এসেছে, স্বভাবতই আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার, কলেজ বন্ধ, হস্টেল বন্ধ, এখানে আমাদের প্যান্ডেলে? সুব্রত চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, রমুদি, তুলি কোথায়? (নামটা পাল্টে দিলাম) আমি বললাম, এই ব্যাপার? সুব্রত তখন এদিক ওদিক চাইছে। বলে, আজ অস্টমীর দিনে তুলি কিরকম সেজেছে, সেটাই দেখতে এসেছে। আমি কিন্তু সুব্রতর এই হঠাৎ আগমনে একদমই আশ্চর্য হই নি। এবং এই তুলির জন্যই আরেকজন ছাত্র উত্তমও একবার পূজোর সময় এসেছিলো। আমার ক্যাম্পাস লাইফে দুর্গাপূজার সময় এই সুব্রত বা উত্তমের মতন কত ছেলেকে দেখেছি, আমাদের প্যান্ডেলে ওদের পছন্দের মেয়েদের দেখতে আসতো।

একবার অস্টমীর রাতে তিলোত্তমা (চৌধুরী, যাকে সবাই তিলু নামেই চেনে) খুব সুন্দর একটা ঢাকাই জামদানী শাড়ি পড়ে এসেছিলো। তাঁর সাথে মেখেছিলো খুব সুন্দর একটা পারফিউম। তিলু তখন বোধহয় মডেল স্কুলেই ক্লাস টুয়েলভে পড়ে, অথবা বিই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার বা সেকেন্ড ইয়ার হবে। মানে সে তখন কিশোরী। সেদিন সত্যি তিলুকে অপরূপ লাগছিলো। আমি গিয়ে পিছনে লাগলাম। হ্যাঁরে, যেমন সুন্দর সেজেছিস, তেমনি কি সুন্দর গন্ধ গায়ে মেখে এসেছিস। আজ যদি এখানে কোন রাজপুত্তুর থাকতো, তোকে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়িয়ে হরণ করে নিয়ে যেতো। আরও বললাম, তুই যদি এই অবস্থায় কলেজের কোনো রি-ইউনিয়নের ফাংশনে যাস, তাহলে যেসব সদ্য পাশ করে যাওয়া ছেলেরা এসেছে, তাঁরা কেউ আর ফাংশন দেখবে না। সবাই তাঁদের প্রফেসর চৌধুরীর বাড়িতে এসে জানতে চাইবে, স্যার প্রণাম নেবেন, কেমন আছেন? তিলু বললো ওর বাবা, মানে আমাদের অনিলকাকু নিজে ঐ শাড়ি পছন্দ করে নিয়ে এসেছেন। আসলে শৌখীন পোষাকের জন্য ক্যাম্পাসে অনিলকাকুর খুব খ্যাতি ছিলো। নিজে সবসময় ফিটফাট পোষাকে থাকতেন। তিলুও সেটা বাবার থেকেই পেয়েছিলো। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, তিলু সাজতে খুব ভালোবাসতো। এখন তো সে এয়ারপোর্ট অথরিটির একজন হোমরা চোমড়া অথরিটি। আর কিছুদিন পরেই রিটায়ার করবে, কিন্তু নিজের সাজের দিকে এখনো তাঁর যথেষ্ট খেয়াল থাকে।

যদিও আমাদের ছিলো কচিকাঁচাদের দল, তবুও মনের পুলক অনেকের মধ্যেই ছিলো। দুজনের কথা খুব মনে হয়, অলক (দত্ত) আর টুকি (পাল)। ছোটবেলা থেকেই তাঁদের প্রেম। আজ তাঁরা দুজনেই সুখে সংসার করছে। মাঝেমাঝেই পুরনো স্মৃতিগুলো আমার মনে আসে, পূজোর সময় কি সুন্দর তাঁরা ঘন্টার পর ঘন্টা প্যান্ডেলে গল্প করে কাটিয়ে দিতো।

নবমীর পূজো, হোম, অঞ্জলি হয়ে গেলে, সন্ধ্যাবেলা আরতি হয়ে যাবার পর থেকেই মনটা খারাপ লাগতে শুরু হতো। সেদিন আমাদের সকলের জন্য খিচুড়ি ভোগ হতো। আর পান্ডিয়া হলে আমরা সবাই মিলে খিচুড়ি ভোগ খেতাম। আমরা ছোটরাই অনেকসময় পরিবেশন করতাম। কে কি পরিবেশন করবে তাই নিয়েই কাড়াকাড়ি হতো। একদম ছোটরা দিতো লেবু আর নুন। আর সামান্য একটু বড় হলে জল। একবার পরিবেশনের সময় ঝুমি (ভঞ্জ) আর সোমনাথের (সিনহারয়) কি ঝগড়া! ঝুমি বয়সে বড়, সোমনাথকে বলেছে শুধু লেবু আর জল দিতে। আর সোমনাথ বয়সে ছোট হয়েও ঝুমির আদেশ অমান্য করে সন্দেশ পরিবেশন করতে গিয়ে হাতের বাক্স থেকে কয়েকটা সন্দেশ মাটিতে ফেলে দিয়েছে। আর ঝুমির তখন সে কি বকা সোমনাথকে।

তিলকের মধ্যে একটা নিস্পাপ শিশুসুলভ নেতা নেতা হাবভাব ছিলো। ওর সবথেকে চোখে পড়ার মতন বৈশিষ্ট হলে ওঁর হাঁটার স্টাইল। যেন একটা যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসছে। অথবা এসে জানতে চাইছে, এখানের সব খবর ভালো তো? কোন অসুবিধে থাকলে বলো। খুব কাজের ছেলে ছিলো। পূজো বা আমাদের ক্যাম্পাসের কোনো অনুষ্ঠানের কিছু দায়িত্ব দিলে নিষ্ঠার সাথে সব পালন করতো। আমি কিন্তু ওঁর ঐ হাঁটার স্টাইলটাই সবথেকে পছন্দ করতাম, একটা নতুনত্ব ছিলো।

বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডঃ অসীমা চ্যাটার্জী অষ্টমীর দিন খালি পায়ে পূজোর ডালি নিয়ে এসে পূজো দিতেন। অঞ্জলি দিতেন। রাতে সন্ধিপূজো দেখে ফিরতেন। উনি ছিলেন প্রফেসর ডঃ বরদা চ্যাটার্জির স্ত্রী। প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারের একতলায় থাকতেন। বেলুড় মঠের ভরত মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। রাজ্যসভার সদস্যা ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে নাম ধরে ডাকতেন। অতো বিশ্বজোড়া নাম, কিন্তু কখনো কোন অহংকার আমরা দেখিনি। আমাদের কাছে স্নেহশীলা জেঠিমাই ছিলেন। উনি আর ওনার মেয়ে জুলিদি, আমাদের মায়ের সঙ্গে একসাথে ঠাকুর দেখতে যেতাম।

ছোটবেলা থেকেই সাহেব পাড়া আর মুচি পাড়া শুনে আসছি, যদিও এ নামকরন কেন হয়েছিল জানি না। সে যে পাড়াই হোক, ক্যাম্পাসের সব মাসী, কাকী, জেঠিরা ও বডো দিদিরা প্যান্ডেলে একজোট হয়ে ফল কাটতেন ও মালা গাঁথার কাজ করতেন। আমরা যতোদিন ছোট ছিলাম ওদের ফাই ফরমাশ খাটতাম। আর তাতেই ছিল আমাদের আনন্দ।

পরের দিন দশমী ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যেতো। ঢাক, কাঁসরের আওয়াজের মাঝেই দশমী পূজার শেষ হতো। আর দর্পণ বিসর্জন মনটাকে আরও ভারী করে তুলতো। দুপুর বেলা মায়েরা কাঁসার থালায় মিষ্টি, ছেঁচা পান, মশলা দিয়ে গড়া পান, গোটা পানপাতা, আলতা, সিঁদুর, কাঁসার গ্লাসে জল নিয়ে বরণ করতে যেতো। আমরাও বই খাতা বগলদাবা করে সব ঠাকুরের পায়ে ছোঁয়াতে নিয়ে যেতাম। ছোটরা বিশেষ করে নিয়ে যেতো অঙ্ক, ইংরেজি, এসব বই। সরস্বতীর পায়ে তো বই খাতা ছোঁয়াতেই হবে। বই খাতা ঠাকুরের পায়ে ছোঁয়ানোর সাথে সাথে তাদের বাহনদের পায়েও ছোঁয়াতে হতো। কারণ পরীক্ষার রেজাল্ট-এর ভয় আমাদের সব সময় ছিল। আমাদের বিশ্বাস ছিলো যে শুধু ঠাকুরকে নয়, তাঁদের বাহনদেরও খুশী রাখতে হবে।

বরণের পালা শেষ হলে বরণ হয়ে গেলে শুরু হতো মায়েদের সিঁদুর খেলা। ঠাকুর লরীতে তোলার প্রস্তুতি নেওয়া হতো। সব হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ক্যাম্পাসের ছোট, বড় সবাই লরীর সাথে হেঁটে পুরো ক্যাম্পাস পরিক্রমা করতাম। একদম ছোটদের, মানে যারা বেশীক্ষণ হাঁটতে পারবে না, তাঁদের লরিতে বসিয়ে দেওয়া হতো। মনে পড়ে ঢাক কাঁসরের আওয়াজে বোল উঠতো “ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন”. আমাদেরও চোখে জল এসে যেতো। লরীতে থাকতো জোরালো আলো। সেই আলোর ফোকাসে মনে হতো মাদুর্গার চোখেও যেন জল। “দূর্গা মাঈ কি জয়, আসছে বছর আবার হবে” ধ্বনি দিতে দিতে সবাই দলবেঁধে যেতাম গঙ্গার ঘাটে। চোখের জলে সপরিবারে মা দুর্গাকে বিসর্জন দিয়ে ফিরে আসতাম শূন্য মন্ডপে।

মন্ডপে ঠাকুর মশাই সবাইকে শান্তি জল দেন। দধিকর্মা মাখা হয় ও সবাইকে দেওয়া হয়। শুরু হয় শুভ বিজয়ার কোলাকুলি, প্রণাম পর্ব ও মিষ্টি মুখ।

আবার আর এক বছরের প্রতীক্ষা।

Sahityika Admin

Add comment