সাহিত্যিকা

সুবিচার

সুবিচার
উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, ১৯৭০ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

সুমিত্রার ঘুমটা আবার ভেঙে গেলো, মাঝরাতে। এখনই যে এ রকম হলো, তা নয়। মিতালি চলে যাবার পর থেকে প্রায়ই এই ঘটনা ঘটছে। মিতালি নিজে থেকে চলে যায়নি, ওকে কতগুলো জানোয়ার চলে যেতে বাধ্য করেছে, ওকে খুন করা হয়েছে, প্রায় জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, ছিঁড়ে খুঁড়ে শেষ করে দেওয়ার পর। দিন পাঁচেক আগের সেই অসহনীয় ভয়াবহ সন্ধ্যা আর রাত সুমিত্রার মন থেকে কোনদিনও মুছে যাওয়ার নয়, যেতে পারে না।

সুমিত্রার স্বামী নরেন চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বেশীদিন আর জীবনটাকে উপভোগ, মানে আর কি অবসর জীবনের স্বাদটা নিতে পারেনি। চাকরির শেষের দিকে বেশ কয়েক বছর নানা রকম আধিব্যাধিতে ভুগে ভুগে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওপারের ডাকে সাড়া দিতে হলো। ঠিক তখনই মিতালি গ্র‍্যাজুয়েশনের পর একটা কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়েছে চাকরির জন্য।

নরেন কাজ করতো একটা প্রাইভেট অফিসে, ফলে অবসরের পর মাসিক আয় এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গিয়েছিলো। সংসারে খুব বেশী না হলেও আর্থিক টানাটানির একটা আঁচ এসে পড়েছিলো। আর সে চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কপালগুণে মিতালি নতুন চাকরিটা পেয়ে গেলো। সুমিত্রাদের একটিই মেয়ে, আর কোন সন্তান নেই। মায়ে-মেয়েতে দিন কেটে যাচ্ছিলো ঠিকঠাক। ইদানীং সুমিত্রা মেয়ের বিয়ে নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছিলো। মিতালির কাছে জানতে চেয়েছিলো, ওর পছন্দের কেউ আছে কি না। দিনকাল যতই পালটাচ্ছে, আচার-ব্যবহার নিয়ম-কানুনও পালটে যাচ্ছে। তাই এই জিজ্ঞাসা। মিতালি জানিয়েছিলো সমীরের কথা, ওদেরই অফিসের একজন সিনিয়র, যদিও বয়সের ফারাক খুব বেশী নয়। একই সাথে সবাই কাজ করছে।

একদিন অফিসফেরত সমীরকে নিয়ে মিতালি বাড়ী এসেছিলো, মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। সুমিত্রার মনে মনে সমীরকে পছন্দ হলেও বেশী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি, একটা মাত্রা রেখে দু’জনের সঙ্গে নিজের আলাপটা চালিয়ে গিয়েছিলো।

কিন্তু এসব চিন্তার থেকেও একটা বড় দুশ্চিন্তা সুমিত্রার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে বেশ ক’দিন ধরে। সুমিত্রা কম বয়সে যথেষ্ট সুন্দরী ছিলো, ডানাকাটা পরী না হলেও, একবার কেউ তাকে দেখলে দ্বিতীয় বারও ফিরে তাকাতো। আর এই ব্যাপারটায় ঈশ্বর মিতালির বেলাতেও কোন কার্পণ্য করেননি। সুমিত্রা আতঙ্কিত এই ভেবে যে, মেয়েটা একা একা যাতায়াত করে, কখনো কাজের চাপে ফিরতে রাত হয়ে যায়। মিতালি বলে, কিচ্ছু ভেবো না মা, আমার মতো কত মেয়েই তো রোজ যাওয়া-আসা করছে, কোন ভয় নেই।

মায়ের মন, একমাত্র সন্তান, কখনোই মানে না। এর মধ্যে হয়েছে কি, গত কয়েকদিন ধরে মিতালির বাড়ী ফিরতে রাত হয়ে যাচ্ছে। একটা নতুন আর আর্জেন্ট প্রজেক্টে সেও টিমের একজন, আর এই ধরণের কাজে সে প্রচুর উদ্যমের সাথে খেটে চলেছে। বলেছে এ রকম সুযোগ সব সময় পাওয়া যায় না।

সেই সর্বনাশী রাতের কথা আবার সুমিত্রার বুকে হাহাকার তুলে দিলো। মোটামুটি যে রকম সময়ে, দেরী করে হলেও, মিতালির ফেরার কথা, সে সময় পেরিয়ে গেলো। নিজের মোবাইল থেকে, অন্যান্য দিনের মতো মিতালির মোবাইলে ফোন করলো, স্যুইচড অফ। মিতালি সমীরের মোবাইল নম্বরটা মাকে দিয়ে রেখেছিলো, যদি কোন সময়ে দরকার হয়। সমীরকে ফোন করে কোন সুবিধে হলো না, বেশ কয়েকবার করার পরেও, ফোন এনগেজড। পাশের বাড়ীর ভদ্রলোকের কাছে সুমিত্রা দৌড়ে গেলো। তিনি বললেন, থানায় যাওয়া যাক। থানা বললো, এ তো রোজের ব্যাপার, ঘন্টাখানেক দেখা যাক, তখনো না ফিরলে আমরা দেখছি কি করা যায়।

সারা রাত কেটে গেলো, মিতালি ফিরলো না। সকালে ফিরে এলেন সেই ভদ্রলোক, সঙ্গে থানার সিপাই। মিতালির অর্ধদগ্ধ শরীরটা পাওয়া গেছে ভোরবেলা একটা কালভার্টের নীচে, যে রাস্তা দিয়ে মিতালি রোজ আসা-যাওয়া করতো, তার মাঝামাঝি। আরও খবর পাওয়া গেলো, পুলিশ দ্রুত তদন্ত শুরু করেছে, কিছু লীড পাওয়া গেছে রাস্তার ধারে আর মিতালির অফিসের আশপাশের বেশ কিছু সিসিটিভি ক্যামেরার থেকে। সুমিত্রা যেন বজ্রাহত, কোন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই, এ কি হলো! পড়শী ভদ্রলোককে পুলিশ বলে গেলো, সুমিত্রা একটু সামলে নিলে যেন থানায় যায়, সনাক্ত করতে।

থানার লোক ফিরে গেছে, বেলা বাড়ছে। এমন সময়ে উদভ্রান্তের মতো সমীর এলো, উস্কোখুস্কো চুল, চোখদুটো লাল হয়ে আছে। মুখের উপর একটা কালচে ভাব। সমীর জানালো, ওদের অফিসে থানা থেকে লোক এসেছিলো, তখনই সে জানতে পারলো এ ব্যাপারে। থানায় ছুটে গিয়েছিলো, যদি ভালো কিছু করা যায়। কিন্তু, সব শেষ।

কে কাকে সান্ত্বনা দেবে, দুজনেই শোকে পাগল। ঘন্টাখানেক পরে সুমিত্রা একটু ধাতস্থ হলো, সমীরকে নিয়ে থানার দিকে রওনা হলো। থানার মর্গে গিয়ে মিতালির দেহটা মাকেই সনাক্ত করতে হলো। কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য! সমীর কিছুতেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না, ছুট্টে বেরিয়ে গেলো। এর পর সমীরকে আর কোথাও দেখা গেলো না।

থানা থেকে সুমিত্রাকে সেদিন পুলিশই বাড়ী পৌঁছে দিয়েছিলো। তারপর দু’ দিন কেটে গেছে, সমীর একবারও এ বাড়ীতে আসেনি। তিনদিন পরে জানা গেলো, সমীর দু’দিন আগেই আত্মহত্যা করেছে, ঐ কালভার্টের কাছেই। মেয়েকে হারিয়ে সুমিত্রা পাথর হয়ে গিয়েছে, তবু্ও সমীরের জন্য তার দুঃখ হলো। এই ঘটনাতে ওদের দুজনের ভাব-ভালোবাসা কত গভীর ছিলো, এটা সুমিত্রা এখন বুঝতে পারছে।

এই ক’দিন ধরে গোয়েন্দারা দিনরাত এক করে চারজন কালপ্রিটকে ধরে ফেলেছে বিভিন্ন সিসিটিভির ফুটেজ দেখে, সব ক’টার বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে। চারজনেই দূরপাল্লার ট্রাকের ড্রাইভার আর খালাসী। পুলিশের জেরায় সকলে নিজেদের দুষ্কর্ম স্বীকার করে নিয়েছে। মামলা চালু হয়ে গিয়েছে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে, সব ক’টা জেল হাজতে।

অন্যান্য রাতের মতই, সুমিত্রার আর ঘুম আসে না। ভালো-মন্দ কোন বোধই নেই। দূর সম্পর্কের এক মাসী থাকে কাছাকাছি, সেই এসে সুমিত্রার কাছে এ ক’দিন রয়েছে, এখন সে অন্য ঘরে শুয়ে পড়েছে।

ডাক্তার ঘুমের কিছু ওষুধ দিয়েছিলো, কিন্তু সুমিত্রা খায়নি এ পর্যন্ত। আজ অল্প ডোজে সেই ওষুধ খেয়েছিলো, তাতে একটা ঝিমুনির ভাব এসেছিলো। আর, এতদিন পর সে ঘুমিয়েও পড়লো।

রাত তখন প্রায় দু’টো হবে, হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাতাসের শিরশিরানিতে সুমিত্রার ঘুমটা ভেঙে গেলো। কারা যেন মা মা বলে ডাকছে। চোখ দুটো ভালো করে কচলে নিয়ে দেখে, সামনে মিতালি আর সমীর দাঁড়িয়ে। দু’ জনের চার হাতে চারটে রক্তাক্ত মুণ্ডু ঝুলছে। দু’ জনেই একসাথে বলে উঠলো, মা, নির্ভয়া কাণ্ড ভুলে যাও, সেই অপরাধীদের আজও সাজা হয়নি। কিন্তু এবারে আমরা কোন ভুল করিনি। এই পশুগুলো কোনমতেই আর ছাড়া পেলো না। আমরাই এদের চরম শাস্তি দিয়ে গেলাম।

সুমিত্রা অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে দেখতে পেয়েছিলো, মিতালি আর সমীর ঐ মাথাগুলো নিয়ে যেমন হঠাৎ এসেছিলো, তেমনই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলো।

পরের দিন সকালে সারা শহরে একটা চাঞ্চল্যকর খবর ছড়িয়ে পড়লো, জেল হাজতে ঐ চার অভিযুক্তের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু সকলেই মুণ্ডহীন !!

Sahityika Admin

Add comment