শিবপুরে বিপুল-উল্লাস
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক, ১৯৮০ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
১৫ই জুলাই ১৯০৪- এলেম নতুন দেশে
খানিক আগেই শিবপুরের ব্যারাকে এসে পৌছেছি আমি, মানে বিপুলরঞ্জন। এখন দোতলার আট নম্বর ঘরের বিছানায় গা এলিয়ে বসে এই ডাইরি লেখা শুরু করলাম। এর আগে কোনোদিনই ডাইরি লিখিনি, বস্তুতঃ পড়াশুনোর প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কিছুই লিখিনি, এমনকি চিঠি লেখার প্রয়োজনও কোনোদিন হয় নি। থাকি হুগলীতে – ছোট থেকে পড়াশুনো আর খেলাধূলা এই নিয়েই ছিলাম, তাই অন্য কোনো দিকে মন দেওয়ার সুযোগ ও সময় কোনোটাই পাই নি। তাই যখন পরীক্ষায় ভালো ফলের দৌলতে শিবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারীং কলেজে পড়ার সুযোগ এসে গেলো, খানিকটা বাবার চাপে আর খানিকটা দেশের রাস্তাঘাট –রেললাইন সম্প্রসারণে নিজেকে কাজে লাগাতে পারবো ভেবে রাজী হয়ে গেলাম। অবশেষে আজ সকালেই হুগলী থেকে হাওড়া এসেছি। সে এক দীর্ঘ পথ- ট্রেনে দু ঘন্টার ওপর লাগলো। ১৮৫৪ সালে এই রেলপথ সাহেবরা চালু করলেও তার উন্নতি আর কিছু হয়নি। মনে মনে ঠিক করলাম, আমাদের মতো দেশী যুবকরা এইসব করার সুযোগ ভবিষ্যতে হাতে পেলে যেন ঠিকমতন করতে পারি।
হাওড়া থেকে শিবপুর আসাটা বেশ ঝকমারী। খোয়া বাঁধানো রাস্তায় খানিকটা ঘোড়ার গাড়ি আর বাকিটা চীনাদের আনা টানা রিকশায় চেপে আসা, তারপর খানিক হাঁটা তো আছেই। সব মিলে হাত পা টনটন করছে। সাথে বাবা ছিলেন, ম্যাকডোনেল সাহেবের কাছে নাম ধাম লিখে আর দু টাকা জমা দিয়ে ঘর পেলাম গঙ্গার কাছেই তৈরী নতুন ব্যারাকে (পাঠকদের জানাই, এর অধুনা নাম স্লেটার হল)। ভয় ছিলো যে সাহেবের ইংরাজি বুঝতে পারব কিনা, কিন্তু দেখলাম উনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে ও বুঝতে পারেন, আর যে কটা ইংরাজি বললেন, দেখলাম আমিও বেশ বুঝতে পারছি।
দোতলা ব্যারাক- আশিজন থাকতে পারে। দশটা মোট ঘর ওপর নীচ মিলিয়ে। দোতলায় আমার জায়গা মিললো আট নম্বর ঘরে। ছ জনের ছ’টা খাট- তার একটা খালি পড়ে আছে। আমি ছাড়াও আরো চারজন আছে। আমার পাশের দুটো বিছানায় পরপর আমারই মতো নতুন ছেলে- রামচন্দ্র আর সদানন্দ, যাদের সাথে এই সবে আলাপ হলো। সদানন্দ বলল, অন্য দুটো বিছানায় আছে সিনিয়ার দুই দাদা- জগদীশদা আর রাধাবল্লভদা। ওরা এখন কলেজে গেছে, ওদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে আগের সপ্তাহ থেকে।
ম্যাকডোনেল সাহেব আগেই বাবাকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলাতে জানিয়ে দিয়েছিলেন, চিন্তা নেই, এই ব্যারাকটা শুধু হিন্দু ছেলেদের জন্য, তাই খাওয়া দাওয়া- আচারবিধি সব কিছু হিন্দু নিয়ম মেনেই হবে। উনি দেখালেন পাশেই আর একটা ছোট ব্যারাক, সেটা শুধু মুসলমান ছেলেদের (পাঠক, এটার পরে নাম হয় বেবী স্লেটার)। আর যারা ইউরোপিয়ান তাদের থাকা অন্য দিকে অন্য ব্যারাকে।
আমার বাবা ব্যাবস্থাপনা দেখে খুশীই হলেন। আসলে বাবা তো কোনোদিন ভাবেন নি যে ছেলে ইঞ্জিনিয়ারীং পড়বে, আর সেটা কাদের সাথে? না সাহেব ছাড়াও বিভিন্ন অহিন্দুদের সাথে, কাজেই জাত পাত আর থাকবে না। বাবা কখনও ভাবেন নি যে গোঁড়া হিন্দু পরিবারের কায়েতের ছেলে বাইরে হোস্টেলে থাকবে। কিন্তু ঐ যে বলে, দিনকাল পালটাচ্ছে ধীরে ধীরে। হুগলীতে বড়োরা বলাবলি করতো শুনেছি যে এই বিংশ শতকের কলকাতা অঞ্চল যা দেখছি- তা অতীতের ছায়ামাত্র। আঠেরো শতকের যে কলকাতা লন্ডনকে টেক্কা দিতো আজ তার ছিটেমাত্রও নেই। কলকাতার বা আশেপাশের সে বিত্তও নেই, নেই সেই জৌলুশ। সমস্তটাই এখন অবক্ষয়ের দিকে। তার বদলে উচ্চবংশের উচ্চশিক্ষিত মানুষরা সেই জায়গা নিচ্ছেন। খানিকটা এই সব কথা ভেবেই বোধহয় বাবা আমায় এখানে পাঠিয়েছেন। বুঝেছেন বাবুগিরির দিন শেষ । এবার আসছে শিক্ষা ভাঙ্গিয়ে পেট চালানোর দিন। এমনই এক সময়ে শিবপুরের সিভিল ইনজিনিয়ারীং কলেজ রেসিডেন্সী হয়েছে ১৮৮৯ সালে, ফলে দূরদূরান্তের ছাত্রদের পড়ার বাধা হয়েছে দূর। হয়েছে আরো বিভিন্ন উন্নত মানের ব্যাবস্থা, এমনকি ১৮৯৩ সালে একটা হাসপাতালও হয়েছে। তাই মা-র অজস্র কান্না আর বাধা সত্ত্বেও বাবা বারবার উৎসাহই দিয়ে এসেছেন, বলেছেন ও ওখানে ভালোই থাকবে। দেশের ভবিষ্যত ওরাই তৈরী করবে, তাই তুমি আর সেটাকে বাধা দিও না।
বাবা বিকালে চলে গেলেন। কিভাবে এতোটা পথ ফিরবেন জানি না। এখন আকাশ মেঘলা, চারপাশে অজস্র পাখি ডানা মেলে আপনার বাসায় ফিরছে, আমি জানি না আবার কবে বাড়ি যেতে পারবো। বাবাকে চোখের জলে বিদায় দেওয়ার পর বুকটা কেমন খালি খালি লাগছিল। জগদীশদা কলেজ থেকে ফিরে এসেছিল, সান্ত্বনা দিলো, বলল, প্রথম প্রথম মন খারাপ লাগবে, পরে দেখবে ছেড়ে যেতেই কষ্ট লাগবে। আপাতত তাই ডাইরি লিখেই খানিকটা শান্তি পেলাম।
২০ নভেম্বর ১৯০৪-আমি উল্লসিত
অনেকদিন পর আবার কিছু লিখতে বসলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম অন্তত মাসে এক দুবার কিছু না কিছু লিখবোই, কিন্তু এই যে ক’মাস কেটে গেলো- রোজকার কলেজ, কাজ আর পড়া ছাড়া নতুন কিছু নেই, কাজেই কিই বা লিখবো? তাই ভেবেছি যখন সময়ই পাবো বা মন খারাপ লাগবে তখনই শুধু লিখবো। এবার এই কটা মাস কেমন কাটলো সেটা একটু সংক্ষেপে লেখা যাক। পড়াশুনোর চাপ ছিলো প্রথম দিন থেকেই। ক্লাসে সাহেবদের সাথে বা অন্যান্য ছেলেপুলেদের সাথে আলাপ পরিচয়, ভাষাগত বাধা বিপত্তি আর একলা থাকারও অজস্র কাজের চাপ। আমাদের কলেজের প্রফেসাররা অনেকেই ইউরোপীয়ান, তাঁদের কথা বোঝা বা ওনাদের পড়ানো আয়ত্ত করা প্রথম দিকে বেশ শক্ত লাগতো। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন বুঝতে পারলাম, দেখছি অনেক কিছু শিখছি, জানছি। এতোদিনে নিজেকে একটু থিতু করতে পেরেছি। সদানন্দ আর আমি রোজ কলেজ করে একটু এগিয়ে কোম্পানীর বাগান আছে- ওখানে গঙ্গার ধারে একটা নির্জন জায়গা পেয়েছি, যেখানে বসার জন্যদুটো গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা। ওখানে বসে আমরা গল্প করি- বাড়ির কথা, ভাইবোনেদের কথা আর কেউ না থাকলে চুপিচুপি দেশের কথা। আজ সেরকমই বসেছিলাম, হঠাৎ দেখি চুল উসকো-খুসকো এক আমাদেরই বয়সী যুবক উদভ্রান্তর মতো এদিকে আসছে। সে বোধ হয় আমাদের খেয়াল করেনি, কাছে এসে আচমকা আমাদের দেখে থতমত খেয়ে হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বলল, “এখানে একটু বসতে পারি? আসলে আমি আগে যখন এখানে থাকতাম, এই জায়গাটায় বসতাম রোজ বিকালে। অলসভাবে বসে গঙ্গার ঢেউ দেখা, মাঝে মধ্যে দু একটা শুশুকের উঁকি মারা, অজস্র পাখীর কলকাকলি- সব মিলে একটা ভালোলাগা তৈরী হতো মনের মাঝে। তাই- আজ এসেছি যখন, একটু বসতে পারি? অবশ্য তোমাদের আপত্তি থাকলে অন্য কথা।”
শুনে আমরা তো হাঁ হাঁ করে উঠলাম। আপত্তি কি ভাই, আমরা তো বন্ধুই বলা যায়- তা তোমার নাম কি ভাই? কোথায় থাকো?
ভারী চমৎকার মিশুকে ছেলে বটে উল্লাস- নামেও উল্লাস, আর ওর কথা বলার ধরণও উল্লসিত করে তোলে অন্যদের। হ্যাঁ, ওর নাম বললো উল্লাস- উল্লাসকর দত্ত, এখন থাকে বোম্বেতে। ওর বাবাকে চিনি- আমাদের কলেজের এগ্রিকালচারের প্রফেসার- নাম দ্বিজদাস দত্ত। শুনেছি অসাধারণ ওনার জ্ঞান আর শিক্ষা অপরিসীম। উনি প্রেসিডেন্সীতে গ্রাজুয়েট হয়ে লন্ডন ইমপেরিয়াল কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। দেশে ফিরে কিছুদিন স্কুলে, কিছুদিন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট –শেষে শিবপুরে এগ্রিকালচার বিভাগ খুলতে এখানে জয়েন করেন। এখানেই থাকেন- বিরাট থাকার জায়গা ওনার- ঐ বিরাট বাংলোটার পাশ দিয়ে অনেকবারই যাতায়াত করতে হয়। ওনার ছেলে উল্লাস! আমি অভিভূত- এতো বড়ো একজনের সন্তান আমাদের সাথে বসে!
উল্লাস বলল, তোমরা কলেজে পড়ছ, তাই না? আমি কিন্তু ভাই কলেজে পড়ি না। যদিও আগে পড়তাম, কিন্তু এখন ছেড়ে দিয়েছি।
– কেন? তুমি পড়া ছেড়ে দিলে কেন?
যা জানা গেলো ও প্রথম বিভাগে এনট্রান্স পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু ওখানে কয়েকজন সাহেব শিক্ষকের দেশীদের ওপর ঘৃণা ও বরদাস্ত করতে পারেনি। তেমনি এক শিক্ষক রাসেল সাহেবকে জুতো ছুঁড়ে মারার অপরাধে ওকে কলেজ থেকে বিতাড়িত হতে হয়।
– কেন সহ্য করবো ভাই, বলতে পারো? আমাদেরই বুকে বসে আমাদেরই রক্ত চুষবে আবার আমাদেরই গালিগালাজ করবে? এর চেয়ে না পড়া ভালো।
বুঝলাম উল্লাসের দেশভক্তি একশো ভাগ খাঁটি। কথায় কথায় প্রকাশ পেলো বারীন ঘোষের সাথে ওর যোগাযোগ আছে। বলল, মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো? সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে বারীনদার সাথে হাত মিলিয়ে ইংরেজদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করি।
– তা তুমি এখন কোথায় থাকো? স্যারের বাংলোতে তো তোমায় কখনও দেখিনি?
– আর বোলো না, প্রেসিডেন্সী থেকে তাড়ানোর পর পালিয়েছিলাম বিপিনদা মানে বিপিন পালের আশ্রয়ে। বাবা টেনে নিয়ে এলো, বলল, প্রেসিডেন্সী গেছে তো কি আছে, সিটি কলেজ আছে, ওখানে ভরতি হয়ে যাও। কিন্তু তাও আমার সহ্য হলো না। অথচ বাবাও ছাড়বেন না। তখন আমার বোম্বে পাঠালেন। বললেন, গ্রাজুয়েট হয়ে এসো, তারপর বিলেত পাঠাবো।
– তা বোম্বেতে তোমার পড়াশুনা কেমন চলছে? কি পড়ছো?
– দূর, দূর, বোম্বেতে আবার পড়াশুনো হয় নাকি? ঐ নামকে ওয়াস্তে চলছে। তাই ছুটিতে বাড়ি এসেছি, বাবাকে বোঝচ্ছি যে এসব আমার দ্বারা হবে না। তুমি বিলেত গেছো বলে আমায় কেন যেতে হবে? বিলেতের থেকে আমার নিজের দেশ-ই ভালো।
এই বলে উল্লাস একটা গান ধরলো, মনে হলো ব্রাহ্ম সঙ্গীত, কিন্তু কি তার সুর আর কি সুরেলা গলা উল্লাসের। আমরা মোহিত হয়ে আচ্ছন্নর মতো বসে থাকলাম খানিকক্ষণ। ততক্ষণে অন্ধকার নামছে, উল্লাস বলল, আমরা আজ থেকে বন্ধু হলাম, কেমন!
তিনজনে হেঁটে ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম, পথে উল্লাস বাড়ি চলে গেলো। উল্লাস যাওয়ার পর সদানন্দ বলল, এ তো সাংঘাতিক ছেলে! স্বদেশীর দলে মনে হচ্ছে। এর সাথে আমি আর যোগাযোগ রাখছি না বাবা, যদি পুলিসে ঝামেলা করে!
সদানন্দ যাই বলুক, আমার কিন্তু ভারী ভালো লাগলো। বেশ প্রাণবন্ত ছেলেটি- উল্লাস নামটাও ওর সার্থক । ওর সাথে আরো মিশতে হবে।
২৫শে জুন ১৯০৫-বছর শেষে ল্যাবের মাঝে
একটা বছর কিভাবে যেন কেটে গেলো। পড়া আর পড়া, আর বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, ল্যাবরেটারি – নাওয়া খাওয়ারই সময় পাই নি-কাজেই ডাইরিও আর লেখা হয়নি। ব্যারাকের বড়োঠাকুর শ্যামসুন্দরদার অসাধারণ রান্না ছাড়া টিকতে পারতাম না।
প্রথম বছর শেষ। বাড়ি যাবো- মাসখানেক ছুটি। সবে হোস্টেল থেকে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছি- যখন দ্বিজ স্যারের বাংলোর কাছে এসেছি, দেখি কে একজন হাত নাড়ছে। উল্লাস না! আমায় দেখে উল্লাস বাংলোর বাইরে বেরিয়ে এলো, সঙ্গে আর একটি ছেলে। উল্লাস পরিচয় করিয়ে দিলো- বলল, এ হলো নলিনী, আমরা একসাথে হিন্দু হোস্টেলে ছিলাম মানে যখন প্রেসিডেন্সীতে পড়তাম। নলিনী হাসল, বলল, উল্লাসের কীর্তিকলাপ শুনেছ তো ভাই? রাসেলের সাথে ঝামেলা?
বললাম, শুনেছি সব, তা উল্লাস, তোমার বোম্বেতে কেমন চলছে? যা পড়ছিলে শেষ হলো?
– ও বোম্বে?
– উল্লাস মুচকি হাসলো, ওদিককার পাট চুকিয়ে ফিরলাম ভাই। ওখানে আর ভালো লাগছে না, বড়ো রুক্ষ।
– রুক্ষ না, রুক্ষ না। ওখানে লীলার দেখা পাচ্ছ না বলো, নলিনী আমাদের দিকে চোখ টিপে বলল, ওটা একটা বড়ো দুর্বল জায়গা কিনা উল্লাসের!
কি যে বলিস নলিনী, উল্লাস মৃদু প্রতিবাদ করলো, তা নয় গো, আসলে ওখানে আর ভালো লাগছিল না। তার ওপর এখানে কি শুরু হতে চলেছে দেখছো তো! কার্জন তো কদিনের মধ্যেই বাংলাকে ভাগ করতে চলেছে। আসলে বাংলা থেকেই এতো বিরোধিতা কিনা, তাই বাংলাকে আরো দুর্বল করতে চায়। আগেই তো ব্যাটারা চট্টগ্রামকে আসামে জুড়ে দিয়েছে, এখন আবার বাংলার পূর্ব আর উত্তর নিয়ে আসাম আর পূর্ববঙ্গ করার মতলব। আসলে যতো পারো বাঙ্গালিদের দুর্বল করো, হিন্দুদের মনোবল ভেঙ্গে দাও- আর সেটাই ব্রিটিশদের লক্ষ্য। এ জিনিষ চুপচাপ বসে ভাই দেখতে পারলাম না, তাই চলে এলাম- কিছু একটা করতে হবে। এই কার্জন ব্যাটা এসে আমাদের শেষ করে দেবে আর আমরা ঘরে বসে দেখবো? এ হয় না।
– কিন্তু তুমি একলা কি করবে উল্লাস?
– আমি একলা নই ভাই নলিনী, সারা বাংলা আমাদের সাথে আছে। বারীনদা বলেছেন- কিছু একটা রাস্তা ঠিকই বেরুবে। কি বলো ভাই বিপুলরঞ্জন?
আমি আর কি বলবো? আমার তো একটু ভয় ভয়-ই লাগছিল- খানিকটা ভয়, খানিকটা নিজে কিছু করতে না পারার হতাশা।
এমন সময় ভিতর থেকে উল্লাসের মা-র গলা পাওয়া গেলো, “কার সাথে কথা বলছিস রে?” মাসীমা বেরিয়ে এলেন, তোমরা ভিতরে বসে গল্প করো বাবা, খামোকা বাইরে দাঁড়িয়ে রোদ লাগাচ্ছ কেন?
আমি বললাম, “বাড়ি যাচ্ছি মাসীমা, অনেক দূরের পথ, বসব না।”
– কোথায় বাড়ি তোমার বাছা?
– সেই হুগলী মাসীমা।
– আমি বলি কি, দুটো গরম ভাত খেয়ে যাও, উল্লাসরাও বেরুবে, ওরাও খাবে, দুটো খেয়ে একসাথেই বেরিয়ে যাও।
অগত্যা ভিতরে গেলাম। ভাবলাম ঠিক আছে, খেয়েই বেরুনো যাক, নলিনীকেও ভালো লাগছিল, খানিক একসাথে না হয় আরো গল্প করা যাবে।
এর আগে কোনোদিন স্যারের বাড়ি ঢুকিনি। বিরাট বাংলো, ভিতরে বৈঠকখানায় বসতে যাবো উল্লাস বলল, বাবার ল্যাবরেটারি দেখবে না? শুনেছি তোমার রসায়নে আসক্তি আছে?
– স্যারের ল্যাবরেটারিও আছে নাকি? আমি অবাক হয়ে বললাম, স্যার ওখানে কি করেন?
উল্লাস বলল, বাবা অনেকদিন থেকে নতুন ধরণের উন্নত মানের সার বানানোর চেষ্টা করছেন পটাশ, নাইট্রেট, আসিড এইসব নিয়ে, ব্রিটিশ সরকারের অনুদানও আছে এর পিছনে। আর তুমি বোধহয় জানোনা, আমিও অনাসক্ত নই রসায়নে তাই আমিও এখানে সব দেখি, মাঝে মাঝে বই পড়ে কিছু টুকটাক করার চেষ্টা করি, অবশ্য বাবা মা-র আড়ালে।
স্যারের ল্যাবরেটারি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বড় একটা ঘর ভর্তি বীকার, বিভিন্ন কেমিকালের বোতল, অজস্র টেস্ট টিউব, বকযন্ত্র, বুনসেন বার্নার- কি নেই ওখানে! সিভিল পড়লেও রসায়নকে ভুলিনি, কলেজে প্রথম বছরে রসায়ন পরীক্ষায় সাহেবেদের টেক্কা মেরে সেরা নম্বর পেয়েছি দ্বিতীয় বছরেও রসায়ন আছে। আমাদের কলেজের ল্যাবরেটারিটা অবশ্য অনেক বড়ো কিন্তু এটাকে দেখে মনে হলো ছোট হলেও স্বয়ং সম্পূর্ণ।
৩১শে জুলাই ১৯০৫-বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জের
বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বাঙলায় জোরদার আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমাদের কলেজেও তার রেশ এসে পড়েছে। ব্রিটিশ ছেলেরা একটু যেন দূরত্বই রেখে চলছে। আগে জন, কেনী, পল, হ্যারি এদের সাথে একসাথে বসতাম, এখন দেখছি ওরা যেন একটু আলাদা বসছে। ওরা কি আলাদা? আসলে টুকরো টাকরা ব্রিটিশদের ওপর হামলা চলছে, তাই ওরা যেন সন্ত্রস্ত। আমি আর সদানন্দ এইসব ভোলার জন্য পড়ায় অনেক বেশী মন দিয়েছি।
২৫শে আগষ্ট ১৯০৫-ফেনলের সন্ধানে
আজ গঙ্গার ঘাটে যাবো বলে আমি আর সদানন্দ বেরিয়েছি, দেখি উল্লাস দাঁড়িয়ে ওদের বাড়ির সামনে। আমাদের দেখে একগাল হেসে বলল, চলো আজ তোমাদের সাথে গঙ্গার ধারে বসি। সদানন্দ দেখলাম একটু ঘাবড়ে গেলো। ও আসলে উল্লাসের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। বেশ বুঝেছি ও ভয় পাচ্ছে, পাছে স্বদেশী বলে পুলিশের খপ্পরে পড়ে। আমি ওর দোষ দেখি না, আমরা সবাই কমবেশী ভয় পাই, কিন্তু কি বলবো উল্লাসকে যে আমার ভারী পছন্দ আর ওর দেশভক্তিরও আমি প্রশংসা করি। যে কাজ আমি করতে পারছি না, আমাদের সেই অসমাপ্ত কাজই তো ও করছে। তাই একটু হেসে বললাম, তা চলো না, ভালোই হলো, অনেকদিন গল্প করা হয়নি। সদানন্দ বলল, “এই রে, আমার ল্যাবরেটারির রিপোর্ট বানানো বাকি আছে, এই সবে মনে পড়লো রে, তোমরা যাও, আমি ওটা সেরে আসছি।”
সদানন্দ ভিতরে গেলো। বুঝলাম ও চায় না উল্লাসের সঙ্গ। ভয় পাচ্ছে- কিন্তু আমার যে ভালো লাগে উল্লাসকে, বললাম, চলো।
দুজনে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলাম, একথা সেকথায় উল্লাস বলল, ভাই বিপুল, আমার একটা কাজ তোমায় করে দিতে হবে। কাজ ঠিক না, একটু সাহায্য।
– কি কাজ বলো?
– তোমায় চুপিচুপি বলি, শুধু তোমার আর আমার মধ্যে কথাটা রেখো।
– তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারো ভাই।
– দেখো বিপুল, বারীনদা আমায় এক বিরাট দায়িত্ব দিয়েছেন, আর সেটা হলো বোমা বানানোর। বারীনদা বলেছেন, বোমার মতো শক্তিশালী অস্ত্র না থাকলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই অসম্ভব।
– বোমা বলতে তুমি ঠিক কি বোঝাচ্ছে বলো তো? সে তো পাহাড় টাহাড় ফাটাতে লাগে, সে কি ঘরে বানানো যায় নাকি?
উল্লাসের সাথে কথাবার্তায় বুঝলাম যে বোমা এক শক্তিশালী বিস্ফোরকের উৎস, যেটা ফাটলে অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্ফোরণ হয়। বোমা জিনিষটা অনেকটা দূরত্ব রেখে ছোঁড়া যায়, ফলে যে ছুঁড়ছে সে নিরাপদ। তাতে পালানোর অনেক সুবিধা। বারীনদা বলেছেন, আমাদের হাতে যদি বোমা থাকে তাহলে ব্রিটিশদের সাথে লড়তে অনেক সুবিধা হবে। উল্লাসের রসায়নে প্রবল আসক্তি দেখে বারীনদা ওকে দায়িত্ব দিয়েছেন বোমা বানানোর পদ্ধতি শিখে বোমা বানানোর। উল্লাসের বাবার কাছে বিভিন্ন বই ছিল, সেগুলো পড়ে ও আমাদের কলেজ লাইব্রেরীর রসায়নের ওপর বেশ কিছু বই পড়ে ওর একটা মোটামুটি ধারণা হয়েছে। এবারে চাই মাল মশলা আর সেগুলো বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষা। ও বলল, বোমা তৈরির প্রধান মশলা হচ্ছে ক্লোরেট অফ পটাশ আর পিকরিক আসিড। তা ক্লোরেট অফ পটাশ, সেটা ওর বাবার পরীক্ষাগার থেকে চুপিচুপি পরীক্ষামূলক ভাবে তৈরি করছে ব্লিচিং পাউডার আর পটাশ থেকে, কিন্তু ও আটকে যাচ্ছে পিকরিক এ্যাসিডে। ও জেনেছে সালফিউরিক এ্যাসিডের সাথে ফেনল ও নাইট্রিক আসিড মিশিয়ে এটা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ও ফেনল কোথাও পাচ্ছে না। কাজেই সেটা চুরি করা ছাড়া ওর পক্ষে কোনো রাস্তা নেই। আর সে জন্য আমার সাহায্য ওর প্রয়োজন।
– আমি? অবাক হয়ে বললাম, আমি কিভাবে তোমায় সাহায্য করবো বলো? আমি তো জানিই না কোথায় ফেনল পাবো।
উল্লাস ওর পরিকল্পনা জানালো, শুনে আমি অবাক। ও বলল, আমাদের কলেজ ল্যাবে নিশ্চয় ফেনল থাকবে আর আছেও-ও খবর নিয়েছে। কাজেই আমাদের যেদিন আর যখন রসায়ন ল্যাবরেটারি থাকবে, তখন ও ছাত্র সেজে আমার পিছন পিছন ঢুকবে। যদি কেউ ধরে ফেলে তো বলবে বিপুলের খোঁজে এসেছি, ওর বাবা এসেছেন কি জরুরী কারণে দেখা করতে চান ওর সাথে, তাই ডাকতে এসেছি। আর কেউ খেয়াল না করলে ও ওখানেই কোথায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে। সন্ধ্যা হলে ল্যাবরেটারিতে তালা মেরে সবাই চলে গেলে ও অপেক্ষা করবে রাত গভীর হবার। তারপর সুযোগ বুঝে ফেনল কোথায় আছে দেখে ফেনলের জারটা দড়ি বেঁধে নামিয়ে দেবে নীচে।
– আর তুমি? জার না হয় নীচে নামলো, তুমি বেরুবে কি করে?
– আমি কদিন ধরেই দেখে রেখেছি আর পালাবার ছকও করে ফেলেছি। আমি জানলা খুলে কার্নিশ বেয়ে চলে যাবো বিল্ডিঙের পিছন দিকে। ওখানে একটা গাছ আছে, তার একটা ডাল কার্নিশ ঘেঁসে গেছে, ওটা ধরে আমি গাছ বেয়ে আস্তে আস্তে নেমে যাবো, কাকপক্ষীতেও টের পাবে না। তারপর ফেনলের জারটা নিয়ে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখবো।
– সে তো বুঝলাম, কিন্তু রসায়ন পরীক্ষাগার তো কলেজের তিনতলায়-অনেকটা ওপরে। মাঝরাতে কার্নিশ বেয়ে অতোটা হেঁটে তুমি পারবে অন্ধকারে ঐ গাছ বেয়ে নামতে? যদি পড়ে যাও?
– পারতে আমায় হবেই ভাই বিপুলরঞ্জন, বারীনদা অনেক আশা নিয়ে এই গুরুদায়িত্ব আমায় দিয়েছেন, কাজেই পারতেই হবে।
দেখলাম উল্লাসের চোখে মুখে যেন আলো জ্বলছে। বুঝলাম বোমা তৈরীর উৎসাহে ও দেশমাতৃকাকে ইংরেজদের শাষণ থেকে মুক্ত করতে ও বদ্ধপরিকর। এই তেজ, এই সাহস, এর যদি কণামাত্রও আমি পেতাম!
২রা সেপ্টেম্বর ১৯০৫-কাজ হাসিল
ভয়ে আতঙ্কে সাররাত ঘুম হয়নি। কেননা আজকেই সেই রাত। আমাদের রসায়ন ল্যাবরেটারি ক্লাস ছিল দুপুর দুটোয়। আগেই খবর নিয়েছিলাম আজ আর অন্য কারুর ল্যাবরেটারি নেই, আমরাই শেষ। দুটো বাজার সাথে সাথে ল্যাবে ঢুকলাম, আমি ইচ্ছা করেই পায়ে পায়ে সবার শেষে। আর যখন খানিকটা ভিতরে ঢুকেছি, দেখলাম উল্লাস সট করে ঢুকে গেলো, তারপরই গায়েব- ঝট করে কোথায় লুকিয়ে ফেললো নিজেকে। ল্যাবের ভিতর আরো কয়েকটি ছোট ছোট ঘর আছে-বাথরুম আছে- লুকিয়ে থাকতে চাইলে তার অভাব নেই। তারপর আর জানিনা।
সারারাত ধরে চিন্তাভাবনা নিজের মধ্যে রেখে ভোর হবো হবো হতেই বেরিয়ে পড়লাম উল্লাসের বাড়ির দিকে। তখন রাতের অন্ধকার কেটে সবে আলো ফুটছে। দেখি আমাদেরই প্রফেসার হিটন সাহেব। হিটন সাহেব আমায় দেখে বললেন- “গুড মর্নিং, মর্নিং ওয়াক ইজ দি বেষ্ট মেডিসিন ফর ইয়োর হেলথ”- বুঝলাম সাহেব রোজকার মতো আজও মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন আর আমাকেও ভেবেছেন মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছি।
যখন প্রফেসার দত্তর বাড়ির সামনে এলাম, উল্লাসকে দেখি মুখে নিমের দাঁতন নিয়ে। আমায় দেখে বলল, “কি চিন্তা হচ্ছিলো নাকি? কাজ নির্বিঘ্নে হাসিল হয়েছে, কাকপক্ষীতেও টের পায় নি। বলেছিলাম না- এটা কিছুই না”- বলে এমন একটা স্বর্গীয় হাসি হাসলো, বুঝলাম এ ছেলের ভয়ডর বলে কিছুই নেই। ভারত’মার আদর্শ সন্তান, নিজেকে বড়ো ছোট ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে ওরা পাশে।
১৫ই মার্চ ১৯০৬- সঠিক অনুপাতের খোঁজে
পড়ার চাপে উল্লাসের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম ডাইরি লেখার কথাও। উল্লাসের সাথে সেই সেপ্টেম্বরে কথা বলার পর ওকে আর দেখিও নি। ছেলেটা যে কি করে, কোথায় থাকে কিছুই বুঝতে পারি না। মাঝে একবার নলিনীর সাথে দেখা হয়েছিল। ও এসেছিল প্রফেসর দত্তর কাছে। একথা সেকথায় জানলাম, উল্লাসের অধিকাংশ সময় কাটে বারীনদার আখড়ায়। ওখানেই কোনো এক বাগানবাড়ির আউটহাউসে ও একটা পরীক্ষাগার বানিয়েছে। আর সেখানে বোমা তৈরীর চেষ্টা করছে। দু দুবার বোমা বানানোর সময়তেই নাকি ফেটে গেছে, নেহাত পরিমানে অত্যন্ত কম বলে ওর কিছু হয় নি। উল্লাস নাকি বলেছে ভাগটা কিছুতেই ঠিক দাঁড়াচ্ছে না। তবে সব কিছু মশলার পরিমান ঠিকমতো দাঁড় করানোর পথে ও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আশা করছে আর দু এক মাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাবে। ওকে নিয়ে ওর বাড়িতেও প্রবল অশান্তি চলছে, এখন প্রায়ই ও রাতে বাড়িতে আসে না।
বাংলাদেশে বঙ্গভঙ্গ রোধের আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসছে। তবুও মনে হয় কোথায় যেন একটা চাপা আগুন ধিকধিক করে জ্বলছে। কলেজে ম্যাকডোনেল সাহেব খুব কড়া নজর রেখেছেন ছেলেদের প্রতি। একদিন আমাদের প্রত্যেকের ঘরে এসে বলে গেছেন, আমরা এখানে পড়াশুনো করতে এসেছি আর সেটাই যেন করে যাই। দেশের জন্য কাজ করার এটাও একটা বিরাট সুযোগ এটা যেন ভুলে না যাই।
১৬ই নভেম্বর ১৯০৬-আচমকা বিস্ফোরণ
সকালবেলা, ঘরে বসে কয়েকটা স্ট্রাকচারালের দুরুহ অঙ্ক নিয়ে আমি আর সদানন্দ হিমশিম খাচ্ছি। জগদীশদাকেও ডেকে এনেছি যদি দাদা কিছু সমাধান করে দিতে পারেন। এমন সময় দড়াম করে প্রচন্ড জোর একটা আওয়াজ –আমাদের ঘরের কাঁচের দরজাগুলো থরথর করে কেঁপে উঠলো। কি ব্যাপার? আমরা অঙ্ক ছেড়ে ব্যারাকের বারান্দায় এলাম- দূরে মানে যেখানে উল্লাসদের বাড়ি, ওর পিছন দিকে বিরাট ধোঁয়া মতো উঠছে আর ওখানে অজস্র পাখি আর কাক আকাশে রীতিমতো চিৎকার জুড়েছে। জগদীশদা বলল, কি হয়েছে বলতো? চল গিয়ে দেখে আসা যাক। ঠান্ডা হাওয়ায় মাথাটাও খুলবে, এসে অঙ্কগুলো আবার চেষ্টা করা যাবে ’খন।
আমরা তিনজনে গায়ে বেশ করে চাদর জড়িয়ে জোর হেঁটে ওখানে এলাম। দেখি আরো দুজন দাঁড়িয়ে, তার মধ্যে একজন চাষী, মনে হয় সামনের মাঠে চাষ করছিল। এ ছাড়া দেখি ওখানে মুখ কাঁচুমাচু করে উল্লাসের ভাই সুখসাগর দাঁড়িয়ে। কি ব্যাপার ভাই সুখসাগর? দেখলাম ও ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, আমাদের একটু দূরে টেনে নিয়ে গেলো, বলল, “দাদা, কি যে হলো ঠিক বুঝতে পারলাম না।” জগদীশদা বললেন, “কি ব্যাপার বলো তো?” সুখসাগর যা বলল, দোতলায় ওর দাদার ঘরে কি একটা বই খুঁজছিল। তা এদিক ওদিকে না পেয়ে খাটের তলাটা দেখতে গিয়ে দেখে, ওখানে বিছানার তলায় পুরানো কাপড়চোপড়ের মধ্যে একটা ভারী বল, দড়ি দিয়ে বাঁধা। সুখসাগর বলল, “আমি ভাবলাম কোনো ফাটা বল টল হবে তাই ওটাকে জানালা দিয়ে বাইরে দূরে ছুঁড়ে দিলাম। তারপর কি বলব দাদা, প্রচন্ড জোর আওয়াজ আর ধোঁয়া- কি হলো জানিনা”- সুখসাগর তখনও কাঁপছে।
আমরা এগিয়ে গিয়ে দেখলাম যেখানে সুখসাগর বলটা ফেলেছে বলছে, সেখানে একটা গাছের তলার দিকের সব পাতা ঝলসে গেছে। বেশ কয়েকটা ডাল উড়ে গেছে আর গাছের ছালও উড়ে গেছে। বুঝলাম, এই তাহলে উল্লাসের বোমা, ও তাহলে সফল হয়েছে। জগদীশদাও ব্যাপারটা খানিক আঁচ করেছিল, বলল, “তুমি বাড়ি যাও আর কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, তাহলে তোমরাই বিপদে পড়বে।” ওকে সাথে নিয়ে আমরা বাড়ি পৌছে দিলাম। মাসীমা উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেখে বিলাপ শুরু করছিলেন “কি ছেলে পেটে ধরলাম, ঘরে কি সব রাখছে…… ” ইত্যাদি। আমরা “মাসীমা চুপ করুন, বাইরে কাঁদবেন না, জানাজানি হলে সবার বিপদ” বলে ওনাকে কোনোরকমে ভেতরে পাঠালাম।
২৪শে ফেব্রুয়ারী ১৯০৭- কড়া নজরে আমরা
দেখতে দেখতে আমার কলেজের তৃতীয় বর্ষ প্রায় শেষ হতে চলল। দেশ এখন উত্তাল, ফলে পুলিশি তৎপরতাও অনেক বেশি। আমাদের ওপর বেশ কড়া নজর রেখেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ আর আমরাও ওদিকে নজর না দিয়ে পড়াশুনোয় পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছি। উপায় নেই, দেশের কাজে নামার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও সে সাহস নেই। জগদীশদা বলেছে, আমরা যেভাবে পারবো, সেভাবেই এসো দেশের সেবা করি।। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের কাজ করার সুযোগ অনেক পাবো, ব্রিজ বানানো বা নতুন নতুন রাস্তাঘাট – দেশসেবার সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
উল্লাসের আর কোনো খবর পাই নি। গতবছর সেই যে আচমকা উল্লাসের বানানো বোমা বিস্ফোরণ হয়েছিল সেটা কিভাবে যেন জানাজানি হয়ে যায়। পুলিশও আসে, তদন্তও চালায় যদিও কিছু প্রমাণ হয়নি কিন্তু উল্লাস তারপর থেকে এখানে আর আসেনি। শুনেছি মুরারীপুকুরে কোথায় থাকে, এখন পুরোদমে স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত আর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বোমা বানানোর সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করার। শুনেছি আমাদের কলেজ থেকে এগ্রিকালচার উঠে যাবে পরের বছর, চলে যাবে পুসা ইম্পেরিয়াল ইন্সটিটউটে। এও শুনছি যে উল্লাসের বাবা মানে প্রফেসর দত্ত শীঘ্র রিটায়ার করবেন, তবে সেটা এগ্রিকালচার বন্ধ হবার জন্য নাকি পুলিশি তৎপরতার জন্য কলেজের চাপ তা জানিনা। মাসীমার সাথে একদিন দেখা হতে উনি বলছিলেন যে খুব শীঘ্রই নাকি ওনারা চলে যাবেন। আমায় একদিন আসতে বললেন যাওয়ার আগে। দেখা যাক, সময় করে একদিন যাবো ভেবেছি।
১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯০৮- সফল সাধনা? অসফল নিরাপত্তা
অনেকদিন পর আজ আবার লিখতে বসলাম। গত একবছর ধরে প্রবল চাপ যাচ্ছে পড়াশুনোর। কংক্রীট টেকনোলজি বা সলিড মেকানিক্স জাতীয় দুরুহ বিষয় আয়ত্ত করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। তাও ভাগ্যি রহিম ছিল। ও থাকে পাশের ব্যারাকে- অত্যন্ত মেধাবী ছেলে, ওর সাথে একসাথে পড়াশুনো করি এখন আমি আর সদানন্দ। জগদীশদা পাশ করে বেরিয়ে এখন পি ডব্লু ডি-তে চাকরি করছেন। এখন আমাদের বাংলা উত্তাল– দেশ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ছে। এখন কলেজ ক্যাম্পাস আর কোম্পানীর বাগান ছাড়া কোথাও আর বেরুই না।
যে কথা বলছিলাম- আজ জগদীশদা ব্যারাকে এসেছিলেন– দাদার কিছু কাজ ছিল এদিকে, তাই পুরানো জায়গায় একবার ঢুঁ মেরে গেল। দাদা একটা খবর শোনাল, আড়ালে ডেকে বলল, “বিপুলরঞ্জন শোনো, খবর শুনেছো উল্লাসের?” “না তো কি হয়েছে?” জগদীশদা বলল, ওর ভাই হিন্দু হোস্টেলে থাকে, সেখানে ও দেখা করতে গিয়ে শুনেছে বিরাট কান্ড ঘটে গেছে। উল্লাস নাকি হেমচন্দ্র দাসের সহায়তায় বেশ শক্তিশালী বোমা তৈরি করতে পেরেছিল, কিন্তু সে বোমা কতোটা শক্তিশালী তা কোথায় পরীক্ষা করা যায়? এখানে তা সম্ভব নয়। তাই বারীনদা, উল্লাস, প্রফুল্ল চক্রবর্তী , বিভূতি সরকার ও নলিনী ঐ বোমা নিয়ে গিয়েছিল দেওঘরের ওখানে এক নিরিবিলি জায়গা দিঘিরিয়া পাহাড়ে। ওখানে একটা পাথরের আড়াল থেকে বোমাটা ছোঁড়া হবে,এই ছিল প্ল্যান। কতোটা শক্তিশালী বোমা সেটা জানা নেই, তাই বারীনদার হুকুমে সবাই অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে- শুধু উল্লাস আর প্রফুল্ল ছিল সামনে এক বিরাট পাথরের আড়ালে। বোমাটা ছোঁড়া হয় দূরে নিক্ষেপ করার জন্য, কিন্তু বোধহয় মশলার অনুপাত ঠিক ছিল না ফলে বোমাটা শুন্যেই ফেটে যায়। সামনে ছিল প্রফুল্ল- সে নাকি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় আর উল্লাসও বিরাট চোট পেয়েছে। তবে চোট সত্ত্বেও উল্লাস নাকি বলেছে যাক, তাহলে সফলতার দোরগোড়ায় আসতে পেরেছি।
জগদীশদাকে বললাম, “প্রফুল্ল মারা গেলো, তা জানাজানি হয় নি?” জগদীশদা বলল, “শুনেছি ওরা সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল, পরে ফিরে এসে মৃতদেহ কোথায় চাপা দিয়ে লুকিয়ে ফেলে- ফলে এটা কেউ জানে না। শুধু যে দু একজন হিন্দু হোস্টেলে স্বাধীনতার আন্দোলনের সাথে যুক্ত তারাই খবরটা জানে।”
২০ ই জুন ১৯০৮- আজ দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে চলে
আজ কলেজ থেকে চলে যাচ্ছি। আমার অধ্যবসায় সফল। দীর্ঘ চারবছর ধরে প্রচুর পড়াশুনোয় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলাম, আজ তা সফল। আমার পড়া শেষ, সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছি – আজ আমি গর্বিত যে আমি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার- দেশের সেবায় এবারে নিজেকে উৎসর্গ করার পালা। কুড়ি টাকা মাইনের এক চাকরিও পেয়েছি রেলেতে– এটা হবে আমার দেশের হয়ে প্রথম কাজ। বলা যায়, এটা হবে দেশকে আমার প্রথম উপহার।
যাওয়ার আগে প্রফেসার দত্তর পুরানো বাংলোটা দেখি আর মনে পড়ে উল্লাসের কথা। কি প্রাণোচ্ছল ছেলেই না ছিল! দেশের জন্য নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়েছে। শুনেছি কিংসফোর্ডকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম যে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন, সেটা উল্লাসেরই বানানো। সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করতে পেরেছে তাহলে- সাবাশ উল্লাস। কিন্তু এর পরিণতি দেখে কষ্ট লাগছে, কেননা ক্ষুদিরামের বোমা ভুল টার্গেটে গিয়ে বিফলে তো গেলোই, ধরাও পড়লো, আর তার জের হিসাবে উল্লাসরাও ধরা পড়লো দোসরা মে ঐ মুরারীপুকুরের বাড়ি থেকেই। এখন ওদের বিচার চলছে, হয়তো বা আজ বাদে কাল হয় ফাঁসি না হয় যাবজ্জীবন আর তার সাথে শেষ হয়ে যাবে দেশের হয়ে ওদের কাজ। কিন্তু মনে পড়ে উল্লাসের গঙ্গার ঘাটে বলা সেই কথা, “আমার দেশসেবা হয়ত বা অল্প কদিনেই শেষ হয়ে যাবে, ধরা তো পড়বোই একদিন না একদিন, কিন্তু বিপুলরঞ্জন, তুমি কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ মাতৃকার সেবা করার সুযোগ সারাজীবনই পাবে,আর সেটাকে ঠিকভাবে কাজে লাগিও।
তাই পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে- ব্যারাক আর কলেজকে পিছনে ফেলে, শুরু হলো আমার নতুন জীবন।
(বিপুলরঞ্জন মল্লিকের ডাইরির কটা পাতা পাঠকের হাতে তুলে দিলাম-এ লেখার কিছুটা কল্পনা, কিছুটা বাস্তব আর কিছুটা ইতিহাস, এখানে সব মিলেমিশে একাকার।
দুই যুবক যাদের মনে অনেক অনেক স্বপ্ন দেশের হয়ে কাজ করার, কিন্তু পথ আলাদা, তাদের মিলন ঘটেছে শিবপুর সিভিল ইঞ্জিনায়ারিং কলেজে। তাই এই লেখা আমি উৎসর্গ করলাম সবাইকে, বিশেষতঃ যারা দেশের হয়ে কাজ করে চলেছেন বা করছেন। এই লেখার সময় আমি যথাসম্ভব সাবধানতা নিয়েছি ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহে, তবু কিছু ভুল ভ্রান্তি থাকলে মার্জনা প্রার্থনীয়।)
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
আমি রাসবিহারীকে দেখেছি-নারায়ন সান্যাল
https://en.wikipedia.org/wiki/Ullaskar_Dutta
https://historyflame.com/ullaskar-dutta/
https://knowledgeneed.com/ullaskar-dutta/
https://banglaamarpran567383012.wpcomstaging.com/tag/ullaskar-dutta/
Bengal defence facebook page
(আলিপুর সেন্ট্রাল জেল)
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার আলিপুর সেন্ট্রাল জেল)
Add comment