“লাল পাহাড়ির দেশে যা” একটি কবিতার পঞ্চাশ বছর
অরুণ কুমার চক্রবর্তী, ১৯৭০ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
১৯৭২ সালের এক আবেগময় মুহুর্তে একটি কবিতা লিখেছিলাম ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’।পঞ্চাশ বছর পরে আজকের ২০২২ সালে এই কবিতাটি গান ও কবিতার রূপে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে। পিছুপানে তাকিয়ে এই গানের ইতিহাস নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো।
ভুমিকায় বলি, পৃথিবীর সংস্কৃতির প্রাঙ্গণে সংগীত শ্রেষ্ঠ শিল্প, তারপরেই কবিতার স্থান, কবিতাকে আমরা বলি সূক্ষ্ম চেতনা শিল্প, আর কবিতায় সুরারোপণ হলেই সংগীত, প্রায় সাড়ে আটশো বছর আগে কবি জয়দেবের সময় থেকে গীতিকবিতার পর্ব শুরু হয়েছে। কবি কবিতা লিখতেন আর রাজা লক্ষণ সেনের রাজসভার অন্যতম কবি জয়দেব, কবিতায় সুর স্থাপন করে গাইতেন, এমনটিই ছিল তখনকার বিনোদন ব্যবস্থার রূপ। কবিতার উৎসমুখ (nucleation) ছিল রাধাকৃষ্ণের অপূর্ব লীলার অনুরাগ, বীতরাগ, অভিমান, দেহবল্লরীর নিবিড়তা, কামবিলাসের অপূর্ব মগ্ন অনুভব, লীলার গভীর ঘনত্ব, দেহ থেকে দেহাতীত অবস্থানে উত্তীর্ন হওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি শেষে মানসিক রমণের আয়োজন। নানান রাজকার্যে নিমগ্ন ক্লান্তি অবসাদ থেকে রাজা মুক্ত হয়ে আবার নব উদ্যোমে রাজকার্যে নিযুক্ত হতেন। সেই থেকে গীতিকবিতার ধারা আজও বয়ে চলেছে আমাদের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে। এ এক অপূর্ব পরম্পরা, রবিঠাকুরের গীতাঞ্জলি সেই প্রবহমান ধারার অনবদ্য শ্রেষ্ঠ উপহার, আমার মনে হয়েছে যে কোনো সৃষ্টির মূলে একটি উৎসমুখ থাকা খুবই জরুরি। সেই উৎসমুখটিকে বলতে একটি nucleation site, যেখান থেকে চিন্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়, তরপর বর্ধন বা বেড়ে ওঠা (growth), এরপর রূপান্তরিত হওয়া (transmigration) যে কোনো গঠনে, কবিতায়, গানে, ভাস্কর্যে, নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে, ছবিতে (painting) বা রম্যারচনায়। এভাবেই একটি বিজ্ঞান সব সৃষ্টির অন্তরালে কাজ করে চলেছে তিনটি phase বা অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে, 1. Nucleation,
2. Growth,
3.Transmigration
এটিই অপূর্ব বিজ্ঞান মেনে বা না -মেনে, জেনে বা না-জেনে সৃষ্টিকররা নিজ নিজ কাজটুকু করে চলেছেন,….
আমাদের শরতকালে নীল আকাশ আছে, তাতে সাদা মেঘেরা ভেসে বেড়ায়, এ এক শরতকালের চিরকালীন চিত্রপট। আমরা দেখেছি, আমাদের আগেও মানুষজনেরা দেখেছে, কিন্তু রবিঠাকুর এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে কবিতা লিখলেন ….. নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই সাদা মেঘের ভেলা…… এই লেখায় সুরারোপণ করে গান হলো, আমাদের ছেলেমেয়েরা একশো কুড়ি বছর ধরে নেচে চলেছে,….
ঠিক এভাবেই, সেটা ছিলো ১৯৭২ সাল, আমাদের হুগলী জেলার শ্রীরামপুর স্টেশনে একটি মহুয়া গাছকে দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, এ গাছটি এখানে কেন? বুঝতে পারলাম একটি nucleation site তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এই মহুয়া গাছ আমার খুবই প্রিয়। বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, রাঁচি, হাজারীবাগ, মধ্যপ্রদেশ, সিংরোলি, বিহার, ঝাড়খন্ড,…. আরও অনেক জায়গায় পর্যাপ্ত দেখেছি। সারা জঙ্গলমহল জুড়েই এদের অবস্থান, আর এদের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে আদিবাসী সমাজ, ওদের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, বিনোদনের ঘন উপাদান, অপূর্ব বন্ধনক্রিয়া।
আমি নিজের মনেই প্রশ্ন প্রশ্নে জর্জরিত….. লালমাটির গাছ এখানে কেন? আমাদের এই হুগলি জেলায়, এই জেলা তো ধানের দেশ, আলুর দেশ, আমের দেশ।
এরপরই আমার মগজে কবিতার জন্ম। আমি অনেক আগেই লিখেছিলাম, কইতে কহ যে, কবির জরায়ু থাকে কবির মগজে, কে বোঝে সহজে, কবির জরায়ু থাকে কবির মগজে…..
তারপর আমার এই কবিতার জন্ম, গাছটা বেমানান, এই স্টেশনে গাছটিকে এক্কেবারেই মানাচ্ছে না। যেমন আমি, ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম, হয়ে গেলাম ইঞ্জিনিয়ার। ঘন্টা হলো, একটি অসফল কারিগর, কিন্ত মগজজাত একটি সন্তান প্রসব হলো। সে এক চূড়ান্ত যন্ত্রনা, nucleation পর্যায় থেকে growth পর্যায়ে শেষ। একটি সৎ ফসলের জন্ম ঘটাতে অন্তর্লিন শক্তির বিক্রিয়া তখন কোষে কোষে ঘটাচ্ছে বিপর্য্যয়, আলোড়ন, ভ্রুণ থেকে শিশুর অবয়ব ঘটে গেছে মগজের গর্ভাধারে। সে যে আলো চায়, পৃথিবীতে আসতে চায়, গর্ভফুলের কোরকের অন্ধকার আর তাঁর ভালো লাগছে না। সে আসবেই, প্রকৃতির অনিবার্য নিয়মে সে প্রকাশিত হবেই আপন মাধুর্যে। পাথরে পাথরে বপন করে যাচ্ছে তৃষ্ণা, চাই চাই, তৃষ্ণা যে মেটানো চাই। অরণ্য ভর করেছে, বনবাসীদের নিটোল কালো মুখগুলি আমার চারপাশে, কী চায়? পাতায় পাতায় বেজে উঠছে আদিম মাদল, গান। নৃত্যমুখর পায়ে পায়ে যাচ্ছে সাতসাগরের ঢেউ। কতগুলো স্নায়ু ছিঁড়লো, আর কতো বাকী?? কষ্ট যে আর সহ্য হয় না, বড্ডো কষ্ট হে, বড্ডো কষ্ট। শব্দ চাই, শব্দের রঙ চাই, শাদা ক্যানভাস কই? হে অরণ্য, শব্দ দাও, মাদল, সুর দাও, লেখার তুলি দাও, কবিতা এবার জন্ম নাও,। কবি প্রস্তুত, হে পাঠক, তুমি?? হে প্রবহমানতা, তোমার শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের ছিঁটেফোঁটা আমাকে অর্পণ করো, শব্দের ছবিতে ওকে লালন করবো,… আমাকে মুক্তি দাও,….
কে বসালো এই গাছ? এপ্রিল মাস, স্টেশনের ব্যস্ততা, একটু আগে বিরাট একটা ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিন কাটোয়া লোকাল টেনে নিয়ে গেছে। একটা অপূর্ব অতি চেনা গন্ধ আমাকে সচেতন করে তুললো। আনমনে খুঁজতে খুঁজতে দেখি যে আপ স্টেশনের শেষপ্রান্তে একটি পাতাহীন গাছে অজস্র ঝুমকো ঝুমকো মহুয়া ফুলের গুচ্ছ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। গাছের গোড়ায় মহুয়া ফুল ছাড়িয়ে রয়েছে, অনাবিল আনন্দে, যেমন জঙ্গলমহলে করে থাকি। স্টেশনের সেই নোংরা মাটি থেকে মহুয়া ফুল কুড়িয়ে খেতে লাগলাম। আহা, কী আনন্দ সেই ফুলের রসে রসে। হটাৎ খেয়াল হলো আমাকে ঘিরে প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন দাঁড়িয়ে পড়েছে। অবাক হয়ে দেখছে, কী সব বলাবলি করছে। হটাৎ সম্বিত ফিরতেই, সুরিন্দর চাওয়ালা, আমাকে আগে থেকেই চিনতো, বললে, সাব, ঠিক হ্যায় তো? আমি আর ফুল কুড়িয়ে না খেয়ে, পকেট থেকে রুমাল বের করে তাতে রাখতে লাগলাম। একটু লজ্জা আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল। তখন কী আর করতে পারতাম? সুরিন্দরের কাছ থেকে চা নিয়ে খেতে লাগলাম।
এইবার এই ভাবনা থেকে শুরু হলো আমার চিন্তনপ্রক্রিয়া। ওদের প্রসন্ন মুখগুলি মনে পড়লো, মনে পড়লো ওদের গান, বাই বাগিয়াম তিনা গ, সুরজমণি রাণী গ, বাই বাগিয়াম তিনা, অপূর্ব পরস্পর কোমরবন্ধনে আবদ্ধ সমবেত নাচ, মাদলি মাদল বাজাইন দাও হে, তুরুতরু তুরুতরু, কইলকাতা থেকেন আইলেন বিদ্যাসাগর গুরু…. পায়ে পায়ে ভেঙে যাচ্ছে হাজার সাগরের ঢেউ, অপূর্ব তালে ছন্দে উদাত্ত মাদলের বোলে নেচে নেচে উঠছে আকাশ বাতাস,
গুবদাগুপুং গুবদাগুপুং গুপুং
গুবদাগুপুং গুবদাগুপুং গুপুং
অপূর্ব মগ্নতায় আচ্ছন্ন তলতলে মুখ, মেয়েদের খোঁপায় ফুল, শালপাতার ঝুলর, গলায় বনফুলের মালা, অপূর্ব নিজস্ব ঢংয়ে আটোসাটো কাপড়ের শারীরিক বিন্যাস, মুখেমুখে লেগে আছে সারল্যের উদ্ভাসি আলো, মনের গভীর অন্তরালে কবিতার জন্মবীজ মগজে অঙ্কুরিত হচ্ছে …
জন্ম নিলো কবিতা…..
হে পাঠক, তোমার অধিকার বুঝে নাও এবার…..
শ্রীরামপুর ইস্টিসনে মহুয়াগাছটা
হাই দ্যাখো গ ‘, তুই ইখানে কেনে,
লাল পাহাড়ির দেশে যা,
রাঙামাটির দেশে যা
হেথাকে তুকে মানাইছে নাই গ’
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই
অ – তুই লালপাহাড়ির দেশে যা…
সিখান গেইলে মাদল পাবি
মেইয়া মরদের আদর পাবি
অ-তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা লারবি যদি ইক্কাই যেতে
লিস না কেনে তুয়ার সাথে
নইলে অ -তুই মরেই যা
ইক্কেবারেই মরেই যা
হাই দ্যাখো গ’, তুই ইখানে কেনে,
লাল পাহাড়ির দেশে যা
রাঙ্গা মাটির দেশে যা
রাঙ্গামাটির থানে যা……
অনুলেখ :—-
ঐ মহুয়াগাছ আমার মনের মধ্যে যে বিস্ফোরণ ঘটালো, অন্য কবির মধ্যেও ঐ বিস্ফোরণ অন্যভাবে ঘটাতে পারে, এ কথা অনস্বীকার্য। যে কবি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্বস্থান থেকে সত্যকার আত্মপ্রকাশ ঘটুক, সৎ রুচিশীল সাহিত্যচর্চার উদ্দেশ্য নিশ্চয় তাই…..
এরপর নানান জায়গায় কবিসম্মেলনে কবিতাটি আবৃত্তি করি। ১৯৭২ সাল, কবিতাটি অনেকেই ধীরে ধীরে গ্রহণ করছে। ষাট দশকে কফি হাউসের সো কল্ড আঁতেলরা কিন্তু নেয় নি। অন্য আঞ্চলিক কবিতাগুলি, লিবে লিবে বাবুগুলা সব লিবে, লিয়ে লিয়ে মজা লুইটবেক, হাই গো জঙ্গলমহল জুড়ে শহর আইছে গো শহর আইছে, আনধার থাইকবেক নাই, কফি হাউস নেয় নি….
এরপর বিখ্যাত সংগীত সুরকার ও কম্পোজার মিস্টার ভি বালসারা মশাইয়ের আনুগত্যে আমার আর আমার অগ্রজ কবি রূপনারায়নপুরের অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের দুটো দুটো করে চারটি কবিতার প্রচলিত সুরে গান গাইলো বেলিয়াতোড়ের সুভাষ চক্রবর্তী। সেই সময়, মানে ১৯৭৯ সালে মান্না দে, শ্যামল মিত্র, তরুণ বন্দোপাধ্যায় , সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাস, নাজিম হিকমত.. কবিতার গান, আধুনিক গান গাইতো। তখন ওকে বাঁকুড়ার ভূমিপুত্র এবং আঞ্চলিক ভাষার উচ্চারণ শুনে ওকে আমার কবিতা দেখাই, এবং ও চারখানা গান তৈরি করে। আমি এরপর ওঁকে বালসারা সাহেবের কাছে নিয়ে যাই। বালসারা সাহেব INRECO কোম্পানি থেকে, তখনকার নিয়ম অনুযায়ী আমার কবিতার গান পুজো সংখ্যার গান হিসেবে প্রকাশিত হয়। বালসারা সাহেব মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টটা দেখতেন। আমি বুঝিয়ে বললাম, যে লোকসংগীতের একটা অন্যরকম চাহিদা থাকেই, অন্তত গ্রামবাংলায়। হলোও তাই। রেকর্ড বের হবার পর ত্রিপুরা, আসাম, গ্রামবাংলায় ঐ গান নিয়ে হই হই পড়ে গেলো। ঐ রেকর্ডে লাল পাহাড়ির দেশে যা, এই নাম দিয়ে লিরিক হিসেবে চিহ্নিত হলো, সংগীত পরিচালনা ও গায়ক সুভাষ,……
এরপর চূড়ান্ত জনপ্রিয় গান লাল পাহাড়ি দেশে যা, যখন বাউলদের কানে গেলো, ওরা বেশ মজা পেয়ে গাইতে গাইতে আরও জনপ্রিয় করে তুললো। নিমাই গোসাঁই বাউল গানের পাশাপাশি লাল পাহাড়ি গেয়ে ওর দর এমন বাড়তে লাগলো যে গানটি আসরে দুবার তিনবার গাইতে হলো। শেষে একদিন আমার কাছে এসে বললে, গুরু, (সে আমাকে গুরু মনে করতো), গানটো বড়ো ছোটো হইনছে, উটাকে বড়ো কইরে দ্যান, আমি তখন দুটো স্টানজা বাড়িয়ে সুর দিলাম। সেই গান আজ সারা পৃথিবী সুরে সুরে উড়ে বেড়াচ্ছে, বাউলরা গাইছে, ইন্টারন্যাশনাল আর্টিস্ট থেকে বাচ্চা বাউল গানটি গাইছে,…..
তবে এই গানকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ছাপা কবিতা, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থে অরণ্য হত্যার শব্দে সংকলনে মুদ্রিত, রেকর্ডে আমার নাম মুদ্রিত, তবুও কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন যে এটা তাঁদের গান। একটা ভুল আমার দিক থেকে হয়েছে যে, আমি গানটির কোনো কপি রাইট করিনি। আসলে কপি রাইট যে করতে হয় সেটা আমি জানতামই না। মুদ্রিত রেকর্ডে আমার আরও একটি গান, যা হবার তা হবেক গো,… আমার তিনখান কবিতা পাঞ্চ করে ভূমি নামক একটি ব্যান্ড ওদের নিজেদের গান বলে চালিয়ে প্রচুর ব্যবসা করলো। অনুমতি নেয় নি। কোনো সিডি বা ক্যাসেট দেয়নি, গানটির মধ্যে নাগর বলে একটি শব্দ যোগ করে ওদের গান বলে চালিয়ে গেলো। পরে, কবিতাটির চল্লিশ বছর উদযাপন করার সময়, আয়োজক সহাজিয়া ব্যান্ড, রবীন্দ্রসদনে, কলকাতা, সৌমিত্র ব্যান্ডের গায়ক পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দিই। প্রথমদিকে অনেকেই দাবী করেছে যে তাদের গান তাঁদের সুর , কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে নি। আর কি করেই বা দেখাবে,……
হটাৎ একদিন দিল্লি থেকে OVER DOZE প্রোডাকশন হাউসের ডিরেক্টর স্পন্দন ব্যানার্জি এলেন। লাল পাহাড়ি গান নিয়ে তিনি ডকুমেন্ট করলেন। অনেক আগে থেকেই অনেকে নানান সুরে গানটি গাওয়ার চেষ্টা করেছিল। পবন দাস দাবী করলো সুরটি নাকি তার, যদিও তার অনেক আগেই প্রচলিত কোম্পানি থেকে সুরে গানটি রেকর্ড হয়ে গেছে। গানটি কোনো এক সিনেমায় নাকি ব্যবহার করেছেন নাম দেয় নি, অনুমতি নেয়নি, লেখক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার পূর্ব পশ্চিম উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন, অনুমতি নেন নি, নামও দেন নি। অন্যদিকে শ্রদ্ধেয় উষা উথুপ, আমাকে কাছে ডেকে অনুমতি নিয়ে গানটি গেয়ে শুনিয়ে টাকা দিয়ে, কিছু উপহার দিয়ে আমাকে সম্মানিত করেছিলেন। দিল্লির ছেলেরা যে ফিল্মটি বানিয়েছিলো, Ytube এ আছে, you don’t belong, নিউ ইয়র্কে প্রিমিয়ার হয়েছে। অন্যান্য বিদেশে, দেশেও হয়েছে। দিল্লিতে হয়েছে, গানটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। কেরল সরকার ফিল্মটিকে পুরাস্কৃত করেছেন। কয়েক বছর আগে সহজমা অর্থ সম্মান দিয়ে সম্মানিত করেছেন,……
এখনও কিছু ছেলেমেয়ে কবিতাটি বলে, কেউ কেউ গান গেয়ে প্রাইজ দেখাতে আসে,…..
কয়েক মাস আগে শান্তিনিকেতনে একটি দল ওখানে বেড়াতে এসে, আমাকে মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রেখে, প্রায় তিরিশ জন ঘুরে ঘুরে লাল পাহাড়ি গান গেয়ে নেচে দেখালো। তারপর একজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে খুব খুশি হয়ে বললেন, দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো, দেখলাম, সবাই খুশি। পরে বললেন, আমি দিদিমা, এই আমার মেয়ে, এই আমার নাতনি। তার মানে তিন তিনটি প্রজন্ম গানে গানে মজে আছে। সবাই ভুলভাল গাইছে। যে যেমন খুশি ইম্প্রোভাইস করছে।
অনেকেই জানিয়েছেন ঠিক গানটি চাই, সেটি এখানেই থাক, পাঠক, গায়ক ও আবৃত্তিকাররা খুঁজে নিক। তবে একটা কথা ঠিক, আমি তো ছোটো কবিতা লিখেছিলাম, সেটি গান হয়ে সারা পৃথিবী ছড়িয়ে গেল, বাংলা কবিতার জয় হোক, বাংলা গানের জয় হোক…….
কবিতা : লাল পাহাড়ির দেশে যা
কথা ও সুর অরুণ কুমার চক্রবর্তী
হাই দ্যাখ গো, তুই ইখানে কেনে,
ও তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা রাঙামাটির দেশে যা
হেথাকে তুকে মানাইছে নাই রে
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে
লাল পাহাড়ির দেশে যাবি
হাঁড়িয়া আর মাদল পাবি
মেইয়া মরদের আদর পাবি
হেথাকে তুকে মানাইছে নার রে
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে
নদীর ধারে শিমুলের গাছ
নানা পাখির বাসা রে
নানা পাখির বাসা
কাল সকালে ফুইটবে ফুল
মনে কতো আশা রে
মনে কতো আশা
সেথাকে যাবি প্রাণ জুড়াবি
মেইয়া মরদের আদর পাবি
হেথাক তুকে মানাইছে নাই রে
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে
ভাদর-অ আশ্বিন-অ মাসে
ভাদু পূজার ঘটা রে
ভাদু পূজার ঘটা
তু আমায় ভালোবেসে পালিয়ে গেলি
কেমন বাপের বেটা রে
কেমন বাপের বেটা
মরবি তো মরেই যা
ইক্কেবারেই মরেই যা
হেথাক তুকে মানাইছে নাই রে
ইক্কেবারেই মানাইছে নাই রে…
(Photo Credit – Amiya Naskar (EIPC))
বাউল সঙ্গীত আর লোকসঙ্গীতের ফারাক অনেক। মূলত: দেহতত্ত্ব নিয়েই বাউল এসেছে। লালন ফকির যেমন প্রশ্ন আনলেন তাঁর বাউলসুরে “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।” বিজ্ঞান বলবে সবটাই ক্রোমোজোমের খেলা। জিন থাকলেই জীবন আছে। কিন্তু তার সৃষ্টি কিভাবে? বিজ্ঞান কিন্তু এই জীবনের উৎপত্তির ব্যাখ্যা করলেও প্রক্রিয়া সৃষ্টি কীভাবে জানে না। আবার ‘গীতগোবিন্দ’তে কবি জয়দেব ব্যাখ্যা দেন রাধাকৃষ্ণের মিলনপর্ব। রাধা কৃষ্ণের যে আকর্ষণকে ‘আ সিক্রেট ডিভাইন পর্ণোগ্রাফি’ মনে করি। কারণ সে তো কোনো দৈহিক মিলন নয়। এক দৈবমিলনের ইচ্ছা তাড়া করে দু’জনকে। রাধাকে তাই আমরা কখনও ‘মা’ হতে দেখিনি। চিরকালীন প্রেমিকা তিনি। এই যে দেহ থেকে দেহাতীত স্থানে যাওয়ার বাসনা সেখান থেকেই বাউলের সৃষ্টি। বাউল গানের আবেদন দেহের গভীরের একরকম গবেষণা। আর লোকসঙ্গীত হল লোকসংগ্রাম। সাধারণ ভাষায় প্রকৃতির নদী, মাঠ, ঘাট, ফসল, ফুলের ব্যাখ্যাই রয়েছে লোকসঙ্গীতে। যেমন ভাটিয়ালীতে মাঝির সাথে মানুষের কথোপকথন চলে। আবার ঝুমুরে নারী পুরুষের সংসার, ভালোবাসার ছাপ। ওদিকে টুসুতে ফসল সংক্রান্ত নানা তথ্য, শস্যের সৃষ্টি। এমন ধামাই, ভাদু অনেক ভাগ রয়েছে লোকসঙ্গীতে।
– অরুণ কুমার চক্রবর্তী
Add comment