সাহিত্যিকা

মুক্তির মন্দির সোপান তলে

মুক্তির মন্দির সোপান তলে...স্বাধীনতা সংগ্রামে অজানা শহীদের রক্ত গাথা!
কিশোর শহীদ বাজি রাউত
দেবাশিস রায়, ১৯৭৭ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

প্রায় বছর ১৫ আগের কথা। ধৌলি এক্সপ্রেসএ কটক যাচ্ছিলাম একটা শিক্ষা সম্মেলনে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে অংশ নিতে। ট্রেনে সহযাত্রী হিসেবে কত বিচিত্র মানুষের সাথেই তো আলাপ হয়; কারো স্মৃতি বহুদিন থাকে, কারো আদৌ থাকে না!

এমনই একজন নরহরি মহান্তি। প্রায় ৮০ ছুঁই ছুঁই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, বর্তমানে কটক নিবাসী। কলকাতায় আত্মীয়র বাড়ি এসেছিলেন, কটক ফিরছেন। কথায় কথায় আলাপ হলো; চমৎকার মানুষ। জীবনের সায়ান্নে এসেও শৈশবের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলোর কথা ভুলতে পারেননি! আজও তার উত্তাপ বহন করেন। স্মৃতির মণিকোঠায় কত অজানা ঘটনা ধরে রেখেছেন।

“কে শুনবে সেসব কাহিনী বলুন তো! আজকের প্রজন্ম তো এসব কথা শুনতেই চায় না”। ওড়িয়ার সাথে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা মিশিয়ে কথাগুলো বলছিলেন, শুনতে বড় মিষ্টি লাগছিলো। কথা বলতে বলতে কখন যে জাজপুর রোড পেরিয়ে এসেছি খেয়াল হয়নি। হঠাৎ একটা বড় গোছের নদীর উপর দিয়ে চলছে ট্রেন, জিজ্ঞাসা করলাম এটা কোন নদী?’ ব্রাহ্মণী’!
– জানেন এই নদীতে শহীদের রক্তের ধারা মিশে আছে; বড় পবিত্র এই নদী।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহান্তি বাবু জবাব দিলেন।
প্রশ্ন করলাম, ‘শহীদের রক্ত; কোন শহীদ’?
অশ্রুসজল নয়নে তিনি বললেন- “বাজি রাউত’এর নাম শুনেছেন”?
– না শুনিনি।
– কি করে শুনবেন, স্বাধীনতার পর এদের কথা তো দেশের সরকার ভুলে গিয়েছে! অথচ এইসব অজানা অচেনা শহীদের রক্তস্নাত পথ বেয়েই স্বাধীনতা এসেছিল।
তারপর ধীরে ধীরে বললেন, শুনবেন সেই কাহিনী- আজকাল সেই সব কথা বড় একটা কেউ শুনতে চায় না। আমার জন্মভিটে তো এই অঞ্চলেই ছিল।

তিনি বলতে শুরু করলেন-‘গ্রামটির নাম নীলকণ্ঠপুর। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ব্রাহ্মণী নদী। ঢেনকানল জেলার অজানা অখ্যাত গ্রাম কি করে বিখ্যাত হয়েছিল সেই কাহিনীই তাহলে আজ শোনাই।

সেটা ছিল ১৯৩৮ সাল। পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার তীব্র আকুতি ধীরে ধীরে গণজাগরণের রূপ ধারণ করছিল। তার ঢেউ এসে পৌঁছেছিল ওড়িশা রাজ্যের এই ঢেনকানল জেলাতেও। স্বাধীনতার এই তীব্র আকাংখার সাথে সঙ্গতি রেখে গড়ে উঠেছিল এক ঐতিহাসিক প্রজাবিদ্রোহ আন্দোলন। ঢেনকানলের ‘গড়জাত’ রাজাদের নারকীয় অত্যাচারের কাহিনী তখন লোকমুখে। শোনা যায় বীভৎস অত্যাচার করার জন্য পাহাড়ের ওপর তৈরি হয়েছিল রাজার ‘অত্যাচারের প্রাসাদ’। সেই সময় অত্যাচারিত প্রজারা গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলল আন্দোলনের হাতিয়ার প্রজা মন্ডলী। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন উদারচেতা মানবতাবাদি দেশপ্রেমিক যুবক শ্রী নবকৃষ্ণ চৌধুরী (যিনি স্বাধীন ভারতে ওড়িশার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হন এবং তারই আমলে সাধারণ মানুষের উপর পুলিশের গুলি চালনার ফলে মানুষের মৃত্যুতে, গ্লানি ভরে পদত্যাগ করেন) ও বৈষ্ণব পট্টনায়েক।

প্রজা মন্ডলীর আহবানে গ্রামে গ্রামে রাজাকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয় কৃষকরা। প্রজা বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। প্রমাদ গোনেন ঢেনকানলের রাজা। এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য তিনি শরণাপন্ন হন ইংরেজ সরকারের। কটকের কালেক্টর ও পুলিশ সুপারের নির্দেশে ইংরেজ অফিসার সহ সশস্ত্র পুলিশের দল প্রজা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ‘ভুবন গ্রাম’ অভিযান করে। আন্দোলনরত নিরস্ত্র কৃষকদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় যার ফলে সরকারি হিসেবে অন্তত ৭ জনের মৃত্যু হয়!

গুলিবর্ষণের ঘটনা বিদ্যুৎ বেগে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে; ক্ষোভে ঘৃণায় ফেটে পড়ে ঢেনকানল জেলার কৃষক সমাজ। সমস্ত ভয় কে উপেক্ষা করে হাজারে হাজারে মানুষ ভুবনগ্রামে সমবেত হন। জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের সামনে পিছু হটে পালাতে থাকে ওই ইংরেজের পুলিশ বাহিনী! প্রজা মন্ডলী সিদ্ধান্ত নেয় ওই হত্যাকারী পুলিশ বাহিনীকে ঢেনকানল ফিরতে দেওয়া হবে না। ভুবন গ্রাম থেকে ফেরার একমাত্র রাস্তা নীলকন্ঠপুর ঘাট। নীলকন্ঠপুরের প্রজামন্ডলীও শপথ নেয় পুলিশদের খেয়া পার হতে দেওয়া যাবে না। সেইমতো একটি নৌকা বাদে সমস্ত নৌকা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হল। এই গ্রামেরই ১২ বছরের দামাল কিশোর বাজি রাউত, মাঝির ছেলে। বাবার অবর্তমানে মাঝে মাঝে নৌকা চালায়। সেও জানল ‘প্রজা মন্ডলী’র সিদ্ধান্তের কথা। মনে-মনে শপথ নিল- ‘জান থাকতে ইংরেজের পুলিশ বাহিনীকে নদী পার হতে দেবে না’!

তারপর শুধু অপেক্ষা, কখন আসবে সেই ঘাতক পুলিশ বাহিনী। পালাক্রমে পাহারা দেবার ব্যবস্থা হল। মাঝরাতের পর চাঁদ যখন অস্ত যাবে যাবে করছে, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে; বাজিরাউত এর বাবা নৈশ আহার ও বিশ্রামের জন্য ঘরে গেছে, নিস্পলক চোখে জেগে রয়েছে বাজি রাউত। এভাবেই কেটে গেল আরো একটা দুটো ঘন্টা। জানা গেল পুলিশ বাহিনী পালাতে পালাতে নীলকন্ঠপুর এসে পৌঁছেছে; একটু পরেই তারা ঘাটে এসে যাবে! খবরটা শুনে বাজি রাউত নৌকা বাইতে বাইতে প্রায় মাঝ দরিয়ায় পৌঁছে গেল। আশ্বিনের ভরা নদীর জল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঘাটে আছড়ে পড়ছে। পুলিশ এসে দেখল ঘাটে কোন নৌকা নেই, মাঝ দরিয়ায় এক বালক নৌকা নিয়ে দাঁড়িয়ে! পুলিশ অফিসার বালক ভেবে প্রথমে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করলেন, তাতে কাজ না হওয়াতে ভয় দেখানো শুরু হল, কোন কিছুতেই সে রাজি না হওয়াতে তিনি ঘোষণা করলেন; “এই ঘাটে নৌকো না ফেরালে গুলি করে হত্যা করা হবে”। বাজি বুক চিতিয়ে চিৎকার করে বলল, “প্রজা মন্ডলীর নির্দেশ-জান থাকতে ইংরেজের পুলিশদের খেয়া পার করা যাবে না”! নিমেষে চলল গুলি! লুটিয়ে পরল দামাল কিশোর নৌকোর পাটাতনের ওপর; ফিনকি দিয়ে তাজা রক্ত ছড়িয়ে গেল ব্রাহ্মণীর জলে। পূবের আকাশে তখন রক্তাভা দেখা দিচ্ছে, ব্রাহ্মণী’র জলে যেন তারই প্রতিচ্ছবি।

পরদিন প্রখ্যাত কবি শচীনন্দন রাউত রায়ের নেতৃত্বে গো’শকটে তার মৃতদেহ বহন করে হাজার হাজার শোকার্ত মানুষ শোভাযাত্রা সহকারে কটকের শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করল! কবি তার উদ্দেশ্যে নিবেদন করলেন বিখ্যাত কবিতা, ‘বাজি রাউত’।
“না, বন্ধু না, এ নয় চিতা……
তমসাবৃত এ দেশে
সে আনবে মুক্তির আলোক বর্তিকা”…….!
সেদিনটা ছিল ১১ ই অক্টোবর ১৯৩৮ সাল!…..

(তথ্য সংগ্রহ ও লেখনীতে দেবাশিস রায়)

Sahityika Admin

Add comment