মনদরিয়ার মাঝি
তৃণাংকুর সাহা, ১৯৮৫ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
বেশ কয়েক বছর পর আবার জামশেদপুর চলেছি। তবে এবারের ভ্রমণের উদ্দেশ্যটা একটু অন্যরকম, আগে যতবার গিয়েছি, তার তুলনায়। আমরা স্বামী স্ত্রী দুজনে চলেছি মেয়ের বাড়ি।
ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায় স্টীল এক্সপ্রেস ছাড়লো হাওড়া থেকে। তারকেশ্বর থেকে লোকাল ট্রেনে আসার ধকল সামলে নিয়ে পুশব্যাক চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। আবার সেই জামশেদপুর ……. শিল্পনগরী টাটানগর ওরফে জামশেদপুরের সঙ্গে আমার আত্মিক যোগাযোগের শুরুটা কিভাবে হয়েছিল, ভাবতে ভাবতে আর চা পান করতে করতে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি রোমন্থনে মগ্ন হয়ে পড়লাম দুজনেই, হয়ত কিছুটা খাপছাড়া ভাবে, কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই।
বছর দুই আগে দুর্গাপুর ছেড়ে এই চাঁপাডাঙার গ্রামে এসে চেম্বার খুলে বসেছি। ঠিক গ্রাম বলা যাবে না, মফস্বল শহর। অনেক দিন পরে এলে ছোটোবেলার সেই চাঁপাডাঙাকে মনের স্মৃতিতে ফিরে পেতেও বেশ সময় লাগবে, এত পরিবর্তন ! ছোটোবেলায় স্কুলে সবাই রচনা লেখে, ‘বড় হয়ে কী হতে চাই।‘ অনেকের স্বপ্ন পূরণ হয়, অনেকের হয় না। আমি কিন্তু ডাক্তার হতেই চেয়েছিলাম, সাধারণ মানুষের সেবা করার জন্য, প্রকৃত মানুষ হতে চেয়েছিলাম। এখন তো অনেকে শুধু সমাজসেবা করেই কোটি কোটি টাকা আয় করে। চারিদিকে শুধু দুর্নীতি আর কাটমানি। নতুন প্রজন্ম কী শিখছে ? ধরো, সরকারের নতুন নিয়ম নীতি যদি এরকম হয়, ডাক্তাররা ইচ্ছে মতো নিজেদের পারিশ্রমিক ধার্য করতে পারবে না, নির্ধারণ করে দেবে একটা কেন্দ্রীয় কমিটি– সব দিক বিচার বিবেচনা করে। শুধু তাই নয়, সারা দেশে প্রাইভেট হসপিটালগুলোর বিভিন্ন রেটও ঐ নিয়ন্ত্রণে থাকবে, স্বাস্থ্য বিভাগে অনেক রাজ্য সরকারেরই দুর্নীতির দিন শেষ হোক। …… আমার এই এক সমস্যা, আজকাল দেশের কথা, সাধারণ মানুষের কথা বড্ড বেশি চিন্তা করি। নেতা নেত্রীরাও অবশ্য করে, তবে শুধু ভোটের আগে ! কোলাঘাট ব্রীজ পেরোচ্ছি ঝমঝম শব্দ করে …… জানো, এখন নাকি এই রূপনারায়ণে ইলিশ আর পাওয়া যায় না, গেওখালি ও নূরপুরের দিকে মাঝে মাঝে পাওয়া যায়।
জামশেদপুরে প্রথম গিয়েছিলাম ডাক্তারী পড়ার সময় ফাইনাল ইয়ারে উঠে পুজোর ছুটিতে। আমরা তিন বন্ধুতে পুলক, রফিকুল আর আমি দেবর্ষি। পুলকের বাবা ওখানে ডিভিসিতে চাকরি করতেন, একাই থাকতেন ডিভিসির কলোনীর কোয়ার্টার্সে। সেবারও স্টীল এক্সপ্রেসেই গিয়েছিলাম। রাত প্রায় সাড়ে দশটায় আমরা পৌঁছেছিলাম পুলকের বাবার বাসায় স্টেশন থেকে লোকাল মিনিবাসে। বাসের ভিতরে ভীড় থাকায় আমরা বাসের ছাদে উঠেছিলাম। এখনও মনে আছে, একটা ছোটো টানেলে ঢোকার সময় ড্রাইভার বাস থামিয়ে দিয়েছিল। কন্ডাক্টরের কথামতো আমরা বাসের ছাদে শুয়ে পড়েছিলাম। রাত এগারোটার সময় পাশের কোয়ার্টার্সে পুলকের সঙ্গে মশারি আনতে গিয়ে প্রথম দেখা “মোহনা”র সাথে। আমাদেরই সমবয়সী, পরে জেনেছিলাম। সেবার তিন রাত্রিই কাটিয়েছিলাম পুলকের বাবার বাসায়। ঐ স্মৃতি তো কখনো ভোলা যায় না। জুবিলী পার্ক, দলমা পাহাড়, ডিমনা লেক, দোমোহনী, আর ……“মোহনা”!
শুধু মোহনার জন্যই পরের বছর মার্চের শুরুতে আবার জামশেদপুর গেলাম, এবারে শুধু পুলক আর আমি। এবারেও পুলকের বাবার বাসাতেই উঠেছিলাম। টাটা কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজী টাটার জন্মদিন ৩রা মার্চ, ঐ দিন সমস্ত টাটা প্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকে। এই সময়ে জুবিলী পার্কের আলোকসজ্জার খ্যাতি অনেকেরই অজানা নয়, সাত দিন ব্যাপী উৎসব চলে। জামশেদপুরে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা দোমোহনী। সোনারীর শেষ প্রান্তে, যেখানে খরকাই নদী এসে মিশেছে সুবর্ণরেখায়। এই দোমোহনী জুড়েই অনেক স্মৃতি ! কয়েক বছর আগেই তো আমরা জামশেদপুর বেড়াতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, আগের সেই দোমোহনীর সবুজ প্রকৃতি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, খুব খারাপ লেগেছিল । চারিদিকে শুধু কংক্রীটের জঙ্গল, হাই ওয়ে দিয়ে গাড়ীর দাপাদাপি। আধুনিক সভ্যতার নির্মমতা গ্রাস করেছে প্রকৃতির নির্জনতা আর সৌন্দর্যকে। ঠিক যেভাবে ধ্বংস হয়ে চলেছে দীঘা, মন্দারমনি কিংবা সুন্দরবন। দোষারোপ, তর্ক বিতর্ক চলতেই থাকে, কিন্তু সমাধান কোথায় ? সভ্যতা বাঁচবে কিভাবে ? আমরা বড় বেশি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি। অবরোধ, ভাংচুর, আগুন, বিপুল জনসংখ্যা …… কোন দিকে চলেছি আমরা ? দেখো, আবার কোথায় চলে যাচ্ছি, সবেতেই রাজনীতির ছোঁয়া ! দেশের ভালোর জন্য চিন্তা করলে বোধ হয় এরকমই হয়। ঐ দুই নদীর সঙ্গমস্থলে নৌকা করে নদী পারাপার করা যেত, ওপারের গ্রামে যাতায়াত করার জন্য। খরকাই এর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে একটা শিবমন্দির ছিলো। এক শীতের বিকেলে মোহনাকে নিয়ে ঐ শিব মন্দিরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একসঙ্গে অবশ্য আরও বেড়িয়েছি। কিন্তু শেষ পরিণতি এরকম হবে, তখন কি জানতাম ! আজকাল বাংলাদেশের টিভি নাটক তো খুব দেখি। অধিকাংশ নাটকই খুব সুন্দর। এরকম একটা কাহিনী নিয়ে, অপূর্ব – জাকিয়া বারি মমো কিংবা চঞ্চল চৌধুরী – শবনম ফারিয়ার একটা নাটক তৈরি হতে পারে। এই প্রসঙ্গেই আরও বললাম, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশ যে কতটা উন্নত, সেই ধারণা হয়ত অনেকেরই নেই। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ওখানে যে চর্চা, যে আবেগ – আমাদের কাছে দস্তুর মতো ঈর্ষনীয়। আমাদের অনেক বাঙালী শিল্পী ওখানে যে সম্মান, আতিথেয়তা পেয়েছেন, আমরা কল্পনা করতে পারি না – একথা স্বয়ং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছেই শুনেছিলাম, তুমিও শুনেছো। আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। কিন্তু এই কৃষ্টি, সংস্কৃতি চিরকাল বেঁচে থাকে। আমার এইসব মন্তব্যে আমার অর্ধাঙ্গিনী পুরোপুরি সহমত।
ট্রেণ ঝাড়গ্রাম ছাড়লো। পনীর পকোড়া, চা খেতে খেতে পরের পর্বে ফিরলাম, যে কাহিনীর অনেক অংশই আমার সহধর্মিনীর অজানা নয়।
কয়েক বছর আগে আমার চেম্বারে পেশেন্ট হিসাবে এসেছিল অর্ণব, পেটের সমস্যার জন্য। ও তখন ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তো শিবপুর বি ই কলেজে, থার্ড ইয়ারে। পুজোর ছুটিতে দুর্গাপুরে বাড়িতে এসেছে। ওকে এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘অর্ণব শব্দের অর্থ কী’ ? আমি নিজেই জানতাম না। ও বললো, “সমুদ্র। আমার এই নাম রেখেছিল আমার মা। মা চেয়েছিল, আমার ব্যাপ্তি হোক সাগরের মতো। আমার মায়ের খুবই প্রিয় গান, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া — ‘হে সাগর,যখনই তোমায় দেখি, তোমার অন্ত নাহি পাই, দু চোখে জল নিয়ে ভাবি, আমিও সাগর হয়ে যাই।‘ নদী তো মোহনাতে গিয়েই সাগরে পড়ে, সেটাই নদীর স্বার্থকতা। আমার মায়ের নাম তো মোহনা।“ চমকে উঠেছিলাম, নিশ্চিৎ হওয়ার জন্য ওর মায়ের নামটা আরেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, সঙ্গে ওর দাদুর নামও। ‘মোহনা’ নামটা বুকের ভিতর আবার দোলা দিয়েছিল, অত দিন পরেও। খুবই খারাপ লেগেছিল, যখন অর্ণবের কাছে শুনলাম, ওর যখন ছয় মাস বয়স, ওর বাবার মৃ্ত্যু হয় বাইক দুর্ঘটনায়। ওর বাবা দুর্গাপুরেই একটা কারখানায় ইঞ্জনীয়ার ছিলেন। মোহনার বাবা, মুখার্জিকাকু তখন দুর্গাপুরে কর্মরত। অর্ণবের বাবার মৃ্ত্যুর পর ওরা ওর দাদুর কাছেই চলে গিয়েছিল। কয়েক বছর পরে মোহনা অনেক চেষ্টায় একটা গার্লস স্কুলে চাকরি পেয়েছিল। ছেলেকে মানুষ করার জন্য মোহনা নিশ্চয় অনেক কষ্ট করেছে। আচ্ছা, এরকমও তো হতে পারে, দেশের সরকার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিধবা মহিলাদের চাকরি সুনিশ্চিৎ, সরকারি কিংবা বেসরকারি – সব ক্ষেত্রেই। শুধু ১০০০ টাকা বিধবা ভাতা কিংবা ৫০০ টাকার লক্ষ্মী ভাণ্ডার ভাতা দিয়ে মেয়েদের দমিয়ে রাখার দিন শেষ হয়েছে। বিধবা মহিলাদের আর্থিক নিরাপত্তা অগ্রাধিকার পাচ্ছে ! আমাদের দেশের এত সমস্যা …… মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য আমাকেই সমাজ সংস্কারকের দায়িত্ব নিতে হবে। সেদিন রাত্রেই মোহনা ফোন করেছিল, ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য।
পরের দিনই সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম মোহনাদের বাড়িতে, একাই, তুমিও জানো। একটা প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় ছিলাম এত দিন, হঠাৎ করে মোহনা কেন হারিয়ে গিয়েছিল আমার জীবন থেকে। আমি কলকাতায় এম ডি করার সময়ও যোগাযোগ ছিল, জামশেদপুরে আমার যাতায়াতও ছিল। কিন্তু তারপরই হঠাৎ করে মোহনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, সমুদ্রের উপর মাঝ আকাশে উড়োজাহাজ হারিয়ে যাওয়ার মতো। তখন তো মোবাইল ফোন আসে নি, ভরসা ছিল ল্যান্ড ফোন আর চিঠি। প্রায় তিরিশ বছর পর মোহনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। হঠাৎ কোথাও দেখা হলেও হয়ত চিনতে অসুবিধা হতো না। মুখার্জিকাকু অর্থাৎ মোহনার বাবা জামশেদপুর থেকে দুর্গাপুরে বদলি হয়েছিলেন। তখন থেকেই আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মোহনা তো ওনাদের একমাত্র সন্তান, অর্ণবের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা মায়ের সঙ্গেই থাকতো বেনাচিতির ঐ বাড়িতে, আগেই বলেছি । মুখার্জিকাকু অবসর নেওয়ার আগেই এই বাড়িটা করেছিলেন। ঘটনাচক্রে সাত বছর ধরে আমিও দুর্গাপুরে ছিলাম। কিন্তু, কেউ কিছুই জানতাম না। মোহনারা যখন জামশেদপুরে ছিলো, ওর ঠাকুর্দা – ঠাকুর্মা বেঁচে ছিলেন। এই ফ্যামিলি যে এতটা গোঁড়া, বিশেষ করে বিয়ের ব্যাপারে ব্রাহ্মণ – অব্রাহ্মণ ভেদাভেদ আঁকড়ে থাকবেন, আগে কোনোদিন বুঝতে পারিনি। মোহনাও সেই গণ্ডী ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি, আমার দুর্ভাগ্য। পরে মনে হয়েছিল, অন্য কারণও থাকতে পারে। সেটা কিন্তু এত দিন পরেও আমার কাছে অজানা। মোহনা বলতে চায় নি, হয়ত কোনোদিনই বলবে না।
কয়েক বছর হলো, অর্ণব পাশ করে সেই জামশেদপুরেই টিসকোতে চাকরি করছে। মোহনার একমাত্র ছেলের সঙ্গে আমাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব মোহনাই দিয়েছিল। আমরাও মেনে নিয়েছিলাম, এটাই বোধ হয় ভবিতব্য ছিলো। না, ব্রাহ্মণ – অব্রাহ্মণের প্রাচীর এবারে আর অন্তরায় হয় নি। এবছরই ওদের বিয়ে হলো। ওরা থাকে সোনারীতে দোমোহনীর কাছেই। যেহেতু মোহনা এখন আমার আত্মীয়, বলা যেতেই পারে, চল্লিশ বছর আগে জামশেদপুরের সঙ্গে আমার একটা আত্মিক যোগাযোগের সূত্রপাত হয়েছিল। মোহনা আজ জামশেদপুরেই, আমাদের অভ্যর্থনা করার অপেক্ষায়। মেয়ের বিয়ের পর এই প্রথম আমি আবার জামশেদপুর। নটা চল্লিশ, স্টীল এক্সপ্রেস জামশেদপুরের প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়েছে ।
পুনশ্চঃ
আমাদের সকলের জীবনেই অনেক পাওয়া, না পাওয়ার কাহিনী আছে। অনেক কিছু যেমন পাই, তেমনই অনেক কিছু না পাওয়ারও আক্ষেপ, বেদনা থাকে। জীবনে অনেক কিছুই ঘটে, যা হয়ত অনভিপ্রেত। আমাদের জীবনে ইচ্ছাপূরণ কিংবা প্রাপ্তির দায় তো শুধু নিজেদের উপর নির্ভর করে না, অনেকাংশেই ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল। অনেক গল্প, কাহিনী তৈরি হয়, যা কল্পনা ও বাস্তবের মেলবন্ধনে সৃষ্টি। তবে অনেক কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে সাধারণ মানুষ ও দেশের পক্ষে মঙ্গল হবে বলেই বিশ্বাস। এই কারণেই লেখার কোনো কোনো অংশে কল্পনার মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রবেশ, সাধারণ মানুষের কথা ভেবে, একান্তই নিরপেক্ষভাবে।
Add comment