সাহিত্যিকা

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক) 

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক) 
সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি।। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রাকাব্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরার ইচ্ছে রইলো।
১.  জন্মদিনের উপহার 
সেবার ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পয়ঁত্রিশতম জন্মদিন। দিনটা ছিল ১৮৯৫, ২৫শে বৈশাখ [7th May], মঙ্গলবার। এই উপলক্ষে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনরা নিশ্চয় প্রচুর উপহার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু এরমধ্যে সব থেকে মূল্যবান উপহারটি আসে ইন্দিরা দেবী ও সুরেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। এঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথের ও জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ও পুত্র। ইন্দিরা দেবীর বয়স তখন ২২ বছর আর সুরেন্দ্রনাথর ২৩ বছর। তখন তাঁরা থাকতেন পুনেতে।। ইন্দিরা দেবীর বয়স তখন ২২ বছর আর সুরেন্দ্রনাথর ২৩ বছর। এই উপহার প্রসঙ্গে ইন্দিরা দেবী লিখেছেন : ‘ছেলেবেলায় আমি আর সুরেন রবিকাকার একটি বিশেষ জন্মদিনে একটি খাতায় আমাদের প্রিয় ইংরেজ কবিদের বিখ্যাত কবিতাগুলি নকল করে তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম। তার নকলের অংশটা হাতের লেখা, কিন্তু প্রত্যেক পৃষ্ঠায় যে সেয়াইকলমের নকশা করা আছে সেটি আমার দাদার হাতের কারিগরি। তাঁর প্রতি আমাদের ভাইবোনের ভক্তি ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে এই খাতাটি কৌতূহলী যাঁরা তাঁরা শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রসদনে দেখতে পারেন। সে যুগের ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তখন আমাদের নিষ্ঠা, আর শিক্ষাদানের ব্যাপারে রবিকাকার প্রবল উৎসাহের পরিচয় এতে পাওয়া যাবে, কারণ রবীন্দ্রসদনে পৌঁছবার বহু আগে খাতাখানি যখন তাঁর কাছে ছিল তখন তিনি রথীকে [রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর] দিয়ে আমাদের সংকলনের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পরবর্তী কবিদের রচনা তাতে নকল করাতে আরম্ভ করেছিলেন। বস্তুত তাঁর সাহচর্য ও সান্নিধ্যের ফলে আমরা বাড়িতে সর্বদাই একটি সাহিত্যের আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছি। সুরেনের এক জন্মদিনে তিনি হার্বাট স্পেন্সারের সমগ্র রচনাবলী তাকে উপহার দিয়েছিলেন। আমি লরেটো ইস্কুলে ফরাসী শিখতুম বলে, একবার আমার জন্মদিনে ইস্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি টেবিলের উপর এখনকার দিনের বিখ্যাত ফরাসী কবি কপ্পে, মেরিমে, ল্য কঁৎদ্লীল, লা ফঁতেন্ প্রভৃতির রচনাবলী সুন্দর করে বাঁধিয়ে সোনার জলে তাদের নাম ও আমার নাম লিখিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলেন। দেখে যে কত আনন্দ হয়েছিল বলা যায় না। এখনো সেই বইগুলি শান্তিনিকেতনের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে শোভাবর্ধন করছে।
যদিও পরবর্তীকালে খাতাটিতে আর মাত্র একটি কবিতা [Keats-এর Ode to Psyche] যুক্ত হয়। লেখকের নাম জানা নেই। ২৮০ পৃষ্ঠার এই খাতটিতে ইন্দিরা দেবী ৭২টি কবিতা হাতে লেখেন [Keats, Shelley, Browning, Tennyson, Wordsworth, Byron, Moore, Scott, Longfellow, Poe, Rossetti, Swinburne ইত্যাদি কবিদের লেখা], লিখিত পৃষ্ঠা ১৯৮, বাকি পৃষ্ঠাগুলি সাদাই থেকে গেছে। রবীন্দ্রাভবনে রক্ষিত কালো কাপড়ে মোড়া খাতাটির নাম Lyric Album. সংগ্রহণ -সংখ্যা ৩৯৯.
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথে কাছে তাঁর জন্মদিনের এই উপহারটি ছিল মহা মূল্যবান।
২. বিবাহের উপহার
প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন : “প্রথমেই একটা জিজ্ঞাসা মনে জাগে, রবীন্দ্রনাথ কী ভরসা (আর্থিক) নিয়ে শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠায় নেমেছিলেন ? তাঁর ধারণা হয়েছিল, ব্রহ্মাচর্যাশ্রম  নাম শুনলেই দেশের ধনীদের টাকার থলি আলগা হবে। তার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। বরঞ্চ থলিগুলোর মুখ আরো চেপে বাঁধা হলো।” সালটা ১৯০১, মহর্ষি জীবিত। পিতার কাছ থেকে মাসিক ২০০ টাকা সাহায্য আর জমিদারী তত্ত্বাবধানের পারিশ্রমিক হিসাবে ১০০ টাকা অর্থৎ কুল্লে নগদ ৩০০ টাকা মাসিক আয়। তপোবনের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে প্রথম দিকে শিক্ষা ও খাওয়া-থাকার জন্য ছাত্রদের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেওয়া হতো না। অসম্ভব অর্থাভাবের মুখে পড়তে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। পুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের [মৃণালিনী দেবী] সন্বন্ধে লিখেছেন : “যখনই বিশেষ প্রয়োজন হয়েছে, নিজের অলংকার একে একে বিক্রি করে বাবাকে টাকা দিয়েছেন। শেষপর্যন্ত হাতে সামান্য কয়েকগাছা চুড়ি ও গলার একটি চেন ছাড়া তাঁর কোনো গয়না অবশিষ্ট ছিল না। মা পেয়েছিলেন প্রচুর, বিবাহের যৌতুক ছাড়াও শাশুড়ির পুরানো আমলের ভারী গয়না ছিল অনেক। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ জোগাতে সব অন্তর্ধান হল। বাবার নিজের যা-কিছু মূল্যবান সম্পত্তি ছিল তা আগেই তিনি বেচে দিয়েছিলেন।”
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ [রবীন্দ্রনাথের দাদা – জ্যোতিদাদা] তাঁর ডায়ারিতে লেখেন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অর্থাভাবের জন্য রবীন্দ্রনাথ  ‘একে একে জিনিসপত্র সব, মায় নিজের বইয়ের লাইব্রেরি’ বিভিন্ন  ব্যক্তিকে বিক্রি করে দেন। তাঁর বিয়ের যৌতুক-পাওয়া সোনার পকেট-ঘড়ি – ‘দুদিকে তার ডালা, একটি বোতাম টিপলে টুক করে ডালা খুলে যেত। ডালার ভিতরপিঠে R.T খোদাই করা ‘ – কিনেছিলেন ‘লাহোরিণী’ অর্থাৎ শরৎকুমারী চৌধুরানী (১৮৬১-১৯২০) [প্রচার-বিমুখ, অসামান্যা এক বাঙালি লেখিকা যাঁর লেখা রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করে; লাহোরে  জন্ম ও শিক্ষালাভ করেন বলে তাঁকে ‘লাহোরিণী’ বলা হতো। খ্যাতনামা কবি অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীর (১৮৫০-১৮৯৮) সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় । কবি পরিবারের সঙ্গে এঁদের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল।]
এবার আসি রথীন্দ্রনাথের বিবাহের দিন (২৭শে জুন, ১৯১০)। রবীন্দ্রনাথ এই তারিখে তাঁর গোরা উপন্যাস পুত্রকে উৎসর্গ করেন। রথীন্দ্রনাথ লিখছেন ” আমার বিয়ের সময় তিনি [শরৎকুমারী চৌধুরানী] আমাকে যৌতুক হিসাবে হাতে একটি বাক্স দিলেন, তার ডালা খুলে অবাক হয়ে দেখলাম বাবার সেই ঘড়ি তার ভিতর রয়েছে। কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। ঘড়িটি এখন রবীন্দ্রসদনে। “
বলা বাহুল্য, শান্তিনিকেতনের জন্য, রবীন্দ্রনাথকে সারা জীবন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল। কিন্তু এই আর্থিক অনটনের মধ্যেও শান্তিনিকেতনের ভবিষ্যৎ সন্বন্ধে কখনো তিনি হতাশ হন নি। পরবর্তীকালে নোবেল প্রাইজের টাকা তিনি শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের নামে তাঁর তৈরি পতিসর (এখন বাংলাদেশে) কৃষি-ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন। তার থেকে স্থায়ী আয়ের একটি ব্যবস্থা হয়েছিল।  শান্তিনিকেতনের জন্য মহাত্মা গান্ধীও কিছু অর্থের ব্যবস্থা করেছিলেন।
তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১. পুরানো সেই দিনের কথা – প্রমথনাথ বিশী, পৃষ্ঠা ১৫ ও ১৬, প্রকাশক : মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।
২. রবিজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল পঞ্চম খন্ড – পৃষ্ঠা ৪৪, ৩১৪ এবং ষষ্ঠ খন্ড – পৃষ্ঠা ১২৩, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ৬৪, প্রকাশক : আনন্দ  পাবলিশার্স। 
৩ রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ – পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৯, প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।     
৪. পিতৃস্মৃতি – রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃষ্ঠা – ৪৩,  জিজ্ঞসা, কলিকাতা।
৫. রবীন্দ্রস্মৃতি – ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী । পৃষ্ঠা ৪৫, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়

Sahityika Admin

Add comment