খড়কে কাঠি থেকে ডেন্টাল ফ্লস
সুবীর চৌধুরী, ১৯৭১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
১৯৬০ – ১৯৬৬ সাল অবধি উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর লেনে মামার বাড়িতে স্কুলে পড়াশুনা করার সময়ে আমার মামার মুখ থেকেই খড়কে কাঠি কথাটা প্রথম শুনি।
খড়কে কাঠিকে অনেকে আবার দাঁত খড়কে বলে থাকেন। মামা আমাকে বলেছিলেন আমাদের দাদু তখন তাঁর বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি নিয়মিত দুপুর বেলায় ভাত খাওয়ার পরে এক টুকরা খড়কে কাঠি হাতে নিয়ে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে আটকানো খাবারের টুকরো গুলো পরিষ্কার করতেন। আসলে আমরা ভাত বা রুটি দিয়ে যে কোন শাকভাজা, সজনেডাটার তরকারি বা ঢেঁড়স ইত্যাদি খেলে শাকের টুকরো, সজনেডাটার খোসা বা ঢেঁড়সের কিছু অংশ দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই আটকে যায়। আর এইসব খাবারের টুকরোগুলো হাতের আঙ্গুল দিয়ে সহজে বের হতে চায় না আবার যতক্ষণ সেগুলো মুখ থেকে না বের করা হয় ততক্ষণ বেশ অস্বস্তি লাগে। আগেকার দিনে এক টুকরো খড়কে কাঠি দিয়ে সাবধানে খুঁচিয়ে সেই সব খাবারের টুকরো দাঁতের ফাকফোঁকর থেকে সহজেই বার করে আনা হতো।
সাধারণত সরু সরু নরম কাঠ থেকেই খড়কে কাঠি বানানো হয়। আগেকার দিনে যাদের বাড়িতে বয়স্ক মানুষেরা নিয়মিত খড়কেকাঠি ব্যবহার করতেন তাঁরা বাজারে দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে মাসকাবারি মশলাপাতির কেনার ফর্দতে কিছুটা খড়কে কাঠি কিনে আনার কথা উল্লেখ করতেন। এক গোছা লম্বালম্বা হলদেটে খড়কে কাঠি দোকান থেকে কিনে নিয়ে বাড়িতে আসার পরে সেগুলো রান্নাঘরে বা মুখ ধোয়ার জায়গায় দেয়ালের এক কোনে পেরেক থেকে ঝোলানো থাকতো। আর দরকার মতো গোছা থেকে এক এক টুকরো নিয়ে ব্যবহার করা হতো। অনেক সময়ে বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার শেষে পান বা পানের মশলার সঙ্গে ছোট একটা কাগজে মোড়া একপিস টুথপিক দিতে দেখেছি।
ধীরেধীরে এই খড়কে কাঠির ব্যবহার কমতে থাকে তার জায়গায় একই রকম দেখতে প্ল্যাস্টিকের বা কাঠের সরু কাঠি বা টুথপিকের ব্যবহার চালু হয়ে যায়। তবে খড়কে কাঠি বা প্ল্যাস্টিকের সরু কাঠি দিয়ে দাঁতের খাঁজ থেকে খাবারের টুকরো বার করতে গিয়ে অনেকসময়ে বিপত্তিও ঘটে যায়। অসাবধানতার ফলে টুথপিক বা প্ল্যাস্টিকের সরু কাঠির ডগাটা দাঁতের মাড়িতে লেগে অনেকের মুখে রক্তপাতও হয়। আবার যাঁদের দাঁতে ফুটো বা ডেন্টাল ক্যারিস আগে থেকেই থাকে টুথপিক দিয়ে খোঁচাখুঁচির ফলে দাঁতের ভঙ্গুর দেওয়াল ভেঙ্গে ফুটো বড় হয়ে যায় আর দাঁতে যন্ত্রণা শুরু হয়। অনেকের আবার খড়কেকাঠি বা প্ল্যাস্টিকের টুকরো ভেঙ্গে দাঁতের ফাঁকে আটকেও যায় তখন অনেক চেষ্টাকরে বাড়িতে সেই টুকরো বারকরা যায় না। সেইসময়ে তাড়াতাড়ি করে ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ডেন্টিস্টের চেম্বারে ছুটতে হয় দাঁতের ফোঁকর থেকে সেই টুথপিকের টুকরো বার করে আনার জন্য।
আমাদের ছোটকাকা গুজরাটের বরোদায় থাকতেন আর সেখানে এমএস ইউনিভারসিটিতে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে চাকুরি করতেন। কাকা একবার তাঁর এক সহকর্মীকে তাঁর দাঁত তোলার জন্য ডেন্টিস্টের চেম্বারে যান আর ডেন্টিস্টের দাঁত তোলার যন্ত্রপাতি, রোগীকে দাঁত তোলার জন্য হেলানো চেয়ারে আধ শুইয়ে রাখা, মাথার উপরে বড় লাইট ইত্যাদি দেখে কাকার মনে হয়েছিল দাঁত তোলা বা দাঁতের চিকিৎসা করা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। তারপর থেকেই কাকা ডেন্টিস্টদের খুবই ভয় পেতেন, আর তাঁদের থেকে সমসময়েই একশগজ দূরে থাকতেন। আর চেষ্টা করতেন তাঁকে ডেন্টিস্টের কাছে যেন কখনো যেতে না হয়। সেই আগের ধারনাটা কাকার মনে গেঁথে গিয়েছিল আর সেই থেকে কাকা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করার আগে মুখে জল নিয়ে ঘনঘন কুলকুচি করতেন। আমি একবার গুনে দেখেছিলাম এক নাগাড়ে তিনি প্রায় কুড়ি তিরিশ বার কুলকুচি করেছিলেন। এর ফলে আগের দিনে খাওয়া খাবারের কুচি যা কিছু দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকতো সেগুলো কুলকুচি করার সময়ে জলের সঙ্গে বেড়িয়ে আসতো। কাকা আমায় বলেছিলেন ঘুম থেকে উঠে সকালবেলায় আর রাতের খাওয়ার পর শুতে যাওয়ার আগে তিনি দিনে দুবার দাঁত ব্রাশ করতেন, না তিনি কোনদিন টুথপিক বা ডেল্টালফ্লস ব্যবহার করেন নি। অবশ্য সেই সময়ে ডেন্টাল ফ্লসের ব্যবহার এখনকার মতন ছিলও না।
আমাদের ছেলেবেলায় তো দাঁত খোঁচানোর জন্য টুথপিক অনেকে ব্যবহার করলেও ডেন্টাল ফ্লসের কোনরকম গপ্পোই ছিল না। তবে আমাদের মতন সত্তর বছর বয়স পার করা মানুষজনেরা মাংস খেলে বিশেষকরে ছাগলের মাংস দিয়ে কোন রান্না খেলে দাঁতের ফাঁকে মাংসের কুচি আটকে যায় আর যতক্ষণ সেগুলো বার হচ্ছে সে এক ভীষণ অস্বস্তিকর অবস্থা। সেই সময়ে অনেকেই দেখেছি টুথপিক হাতে নিয়ে মাংসের টুকরো বার করে নেন।
আমি কলকাতায় একবার আমার দাঁত দেখাতে শ্যামবাজারে এক ডেন্টিস্টের চেম্বারে গিয়েছিলাম। প্রায় আট দশ বছরের অভিজ্ঞ এক দাঁতের ডাক্তার বিডিএস করার পরে এমডিএস করেছেন আর শ্যামবাজারের মতো জায়গায় চেম্বার, ভাল পসার সেই দাঁতের ডাক্তারের। তাঁকে দেখাতে হলে বিকাল চারটের সময় রোগীর নাম লেখাতে হয় আর ডাক্তারবাবু তাঁর চেম্বারে বসবেন সন্ধ্যে ছটা নাগাদ। যে ঘরে রোগীর নাম লেখানো হচ্ছে, সেখানে এক দিদিমণি বসে আছেন। আর তিনি রোগীর নাম তাঁর খাতায় লিখে ডাক্তারবাবু রোগীকে কখন দেখবেন তার একটা সময় মুখে বলে দেন।
আমি একবার দেখেছিলাম নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই ঘণ্টা পরে আমার ডাক এলো। ডাক্তারবাবু আমার দাঁত দেখার পরে বললেন আপনার দাঁতে অনেক ময়লা জমে আছে দাঁতগুলো ক্লিন করা খুব দরকার। আমি জিজ্ঞাসা করলাম একদিনে হয়ে যাবে তো, তিনি উত্তর দিলেন একদিনে হবে না, দুটো সিটিং লাগবে।
দ্বিতীয়দিন দাঁত ক্লিন করার পরে বললেন বছরে দু বার দাঁত ক্লিন করতে আর ডেন্টাল ফ্লস নিয়মিত ব্যবহার করতে। দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা ময়লা, খাবারের টুকরো শুধু ব্রাশ দিয়ে ভাল করে পরিষ্কার হয় না। কিছু অংশ আটকেই থাকে। তাই ডেন্টাল ফ্লসের প্রয়োজন হয়। ওষুধের দোকান থেকে কিনে এনে চাকরি থেকে রিটায়ার কারার দু বছর পরে প্রায় বাষট্টি বছর বয়সে জীবনে প্রথম ডেন্টাল ফ্লস চোখে দেখলাম।
ডেন্টাল ফ্লস সাদা সুতো বা নরম সরু প্ল্যাস্টিকের সুতোর মতন দেখতে আরও আছে যা গোলাকার নয় চ্যাপ্টা আকারের, দেখে মনে হয় ফ্লসগুলো ওয়াক্স কোটেড যাতে সুতোর ধারে মাড়ি ছড়ে বা কেটে না যায়। আর পিপারমেন্টর হালকা গন্ধও থাকে। দাঁতের ফাঁকেফাঁকে খাবারের টুকরো জমে থাকলে সেটিতে দিনে দিনে পচন ধরে মাড়ির ক্ষতি করে আর অকালে দাঁত পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও মাড়ির রোগ যেমন মাড়ি ফুলে যাওয়া বা মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে। অনেকে আবার রাতে খাবারের পর নানারকম মাউথওয়াস ব্যবহার করেন। সোজা কথা দাঁতের সঙ্গে মাড়িরও যত্ন নেওয়া খুবই দরকার, সব ডেন্টিস্টদের একই কথা স্বাস্থ্য সচেতন সব মানুষেরই ছয়মাস অন্তর দাঁতের নিয়মিত চেক আপের দরকার হয়।
অনেক মানুষের আবার দাঁত খোটার মতো কান খোটার অভ্যাসও আছে তবে শরীরের যে কোন অঙ্গ বিনা মতলবে খোঁচাখুঁচি করাটা খুবই বদ অভ্যাস আর হানিকারক। রাস্তা দিয়ে চলাফেরার সময়ে চোখে পড়ে হকাররা ফুটপাথে প্ল্যাস্টিকের চাদর বিছিয়ে হরেক রকম টুকটাক জিনিসপত্রের সঙ্গে তামার দাঁতখোটার আর কানখোটার জন্য দুই কি আড়াই ইঞ্চি লম্বা দাঁত বা কান খোঁচানি বিক্রি করেন। অনেকেই সেইসব সাজ সারঞ্জাম কিনে এনে বাড়িতে রাখেন আর তাঁদের দরকার মতন সেগুলো ব্যবহার করেন। আমার পরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনদের এই রকম দাঁত বা কান খোঁটার শলাকা ব্যবহার কোরতে দেখেছি। তবে অকারনে এইসব অস্বাস্থ্যকর জিনিসপত্র দেহের কোমল অঙ্গে না লাগানোই ভাল। এমনকি সরু প্ল্যাস্টিকের শলাকার দুইদিকে তুলো আটকানো ইয়ারবাড দিয়ে কান পরিষ্কার করাও ঠিক নয় কপাল মন্দ হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
অনেকেই দেখি দেশলাই কাঠির বারুদের অংশটা দিয়ে দু চোখ বুজে আরামসে কানে সুশশুরি খাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বাড়ির মহিলাদের সেফটিপিন বা মাথার চুলের ক্লিপ দিয়েও অম্লান বদনে কানের ময়লা বার করছেন।
অনেক সময়ে কোন হোটেল বা রেস্তোরাঁয় খাওয়ার পরে বিল মেটানোর আগে খাবার পরিবেশনকারীদের দেখেছি সুন্দর ছোট একটা ট্রেতে মৌরি আর মিছরির দানার সঙ্গে পাতলা কভারে মোড়া টুথপিক দিয়ে থাকেন। সাধারণতঃ টুথপিকের একটা দিক ছুঁচলো হয় আবার অনেক টুথপিকের দুইদিকও ছুঁচলো হতে পারে । দাঁতের ভিতরে আটকে থাকা খাবারের কুঁচি বার করা ছাড়াও ফিঙ্গার ফুড বা ছোটছোট খাবার খেতেও টুথপিক ব্যবহার হয়। বিয়েবাড়িতে দেখেছি ডিনারের আগে ক্যাটারারের লোকজনেরা তাঁদের হাতে ট্রেতে সাজিয়ে ভেজ নন ভেজ পাকোড়া অতিথিদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোন কোন খাবার টুথপিক বিদ্ধ বা আলাদা করে টুথপিক রাখা আছে দরকার হলে টুথপিক বিদ্ধ করে পাকোড়া মুখে পোরার জন্য। অনেক সময়ে দেখেছি নানারকম বার্গারের ভিতরের ষ্টাফিং সস্থানে রাখার জন্য বার্গারের মাঝখানে একটু লম্বা সাইজের টুথপিক গুঁজে দেওয়া হয়।
আসলে মানুষের খাবার খাওয়ার পরে দাঁত পরিষ্কার করার জন্য টুথপিকের ব্যবহার প্রাচীনকাল চলে আসছে। প্রায় ১.৮ মিলিয়ান বছর আগেকার কথা , জর্জিয়ার দামানিসি (Dmanisi Municipality ,Georgia) এলাকায় মানুষের জীবাশ্ম থেকে ব্রোঞ্জের টুথপিকের ব্যবহারের কথা পুরাতত্ত্ববিদেরা জানতে পারেন। জানা যায় ১৭তম সেঞ্চুরিতে দামী গয়নাগাটির মতন সোনা বা অন্যান্য মূল্যবান ধাতু আর মহার্ঘ নানারকম পাথর বসানো টুথপিক অনেকে শখ করে ব্যবহার করতেন। তবে ১৮৬৯ সালে সর্বপ্রথম মেসিন থেকে টুথপিক তৈরি শুরু হয়। নর্থ আমেরিকার আবহাওয়ায় Birch গাছের কাঠ থেকে টুথপিক বানানো হয় যার ব্যবহার খুবই জনপ্রিয়। সাদা , হলদে আর কালো এই তিন রঙের বার্চ গাছ দেখা যায় তার মধ্যে সাদা রঙের কাঠই টুথপিক তৈরিতে কাজে লাগে ।
Add comment