সাহিত্যিকা

ওরা থাকে ওধারে

ওরা থাকে ওধারে।
মনোজ কর, ১৯৮০ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

গঞ্জের স্টেশন থেকে আরও পাঁচটা ছোট স্টেশন ছাড়িয়ে ছ’নম্বর স্টেশনটার নাম তালডাঙ্গা। আর তালডাঙ্গা স্টেশন থেকে বাঁদিকে প্রায় পাঁচমাইল গেলে মৌবনি গ্রাম। গঞ্জের থেকে যে রেললাইনটা শহরের দিকে গেছে তার ডানদিক বরাবর অনেক নতুন নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি, বাজার দোকান তৈরি হয়েছে গত কয়েকবছর ধরে। স্টেশন থেকে অটো -টোটো চেপে পনের কুড়ি মিনিটে অনায়াসেই পৌঁছে যাওয়া যায়।

বাঁদিকটা রয়ে গেছে আগের মতই। সময়ের সঙ্গে কোনও পরিবর্তন হয়নি। বাঁদিকটা বরাবর রেললাইনের ধারের আর ভিতরের গ্রামগুলোর। অটো-টোটো রিজার্ভ না করলে আসে না এদিকটায়। কেউ কেউ শহর থেকে শহরতলিতে বেড়াতে এলে সখ করে গ্রাম দেখার জন্য আসে এদিকটায়। রিজার্ভ করা অটো-টোটো বা গাড়ি চেপে যতটা আসা যায় এসে তারপর পায়ে হেঁটে গ্রাম দেখে শহরের সায়েব, মেম-সায়েবরা। মোবাইলে ফটাফট ছবি তোলে। অনেকে আবার গ্রামের লোকেদের পাশে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গী করে ছবি তোলে। গ্রামের মানুষেরা এদের কান্ড কারখানা বুঝতে পারে না। চলে গেলে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে। কেউ কেউ ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের হাতে দু-চার টাকা গুঁজে দেয়। কেউ কেউ কলসিভর্তি মৌ-রস কিনে নিয়ে যায় রাত্তিরে খাবে বলে।

এখানকার বেশিরভাগ লোকই তামার খনিতে কাজ করে। তামার খনিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গঞ্জের বাজার। আজকাল ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখে বাইরের শহরে কাজ করতে চলে যাচ্ছে। তাদের বিয়ে থা হয়ে গেলে ছেলে-বৌ ,মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি এলে সরকারি কোয়ার্টারে আর স্থান সংকুলান হয় না।

অনেকেই এখন নতুন নতুন ফ্ল্যাট কিনে কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রেললাইনের ডানদিক বরাবর সরকারি সীমানার বাইরে বেড়ে চলেছে শহরতলি। তৈরি হচ্ছে মল, মাল্টিস্ক্রিন সিনেমা হল। ফুলে ফেঁপে উঠছে খনিশহরের অর্থনীতি। লাইনের ডানদিক বরাবর যারা থাকে তারা ট্রেনে খুব একটা চাপে না। ছোট স্টেশনগুলো থেকে বেড়ে ওঠা শহরতলির নতুন আবাসনগুলোতে যাবার জন্য ভ্যানরিক্সা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। সকলে তাই গঞ্জের স্টেশন থেকেই যাতায়াত করে অটো-টোটো বা নিজেদের স্কুটার, বাইক, গাড়িতে।

তালডাঙ্গা থেকে ভ্যানরিক্সায় মৌবনি পৌঁছতে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যায়। রাস্তাও ভালো নয়। সরকারের এদিকে নজর নেই খুব একটা। সারা রাস্তা জুড়ে লাফাতে লাফাতে চলে ভ্যানরিক্সা।

এই মৌবনিরই এক ছোট্ট মাটির বাড়িতে বড়সড় সংসার লছমির। লছমির পোশাকি নাম লছমিরানি ডোম। লছমির জন্ম এই মৌবনিতেই। ওর বাবা ছিল তালডাঙ্গা শ্মশানের ডোম। এ অঞ্চলে শ্মশান বলতে ঐ একটাই। তবে গরিবগুর্বোরা গ্রামের সীমান্তে খোলা মাঠেই মৃতদেহ দাহ করে। সেই দাহকার্যতেও শিবু ডোমের মানে লছমির বাবার ডাক পড়ত। দাহকার্যই ছিল শিবুর পেশা।

শিবুর কোনও ছেলে ছিল না। তিনটে মেয়ে। বড় আর মেজমেয়ের বিয়ে দিয়েছিল শিবু। তারা থাকে অন্য গ্রামে। মৌবনি থেকে বেশ দূরে। তালডাঙ্গা হাসপাতালের সুইপার বিষ্টু দাস ছিল শিবুর বন্ধু। বিষ্টুর ছেলে নারানের সঙ্গে প্রেম ভালোবাসা ছিল লছমির। বন্ধুর ছেলে বলেই ব্যাপারটাকে শিবু প্রশ্রয় দিত। লছমির মায়েরও খুব একটা আপত্তি ছিল না। দু’মেয়ে দূরে থাকে । ছোটটার যদি কাছেপিঠে বিয়ে হয় মন্দ কি? বুড়ো বয়সে ওদের দেখাশোনার করতে পারবে। মনে মনে বিয়ে দেবার কথা ভাবলেও নারানের সঙ্গে লছমির বিয়েটা দেখে যেতে পারেনি শিবু। পনেরদিন লিভারের অসুখে ভুগে মরে গিয়েছিল শিবু। লছমি পরে ওর মায়ের কাছে জেনেছে অসুখটা অনেকদিন থেকেই বাসা বেঁধেছিল শিবুর শরীরে। চেপে ছিল শিবু। কাউকে কিছু বলেনি। যন্ত্রণা যেদিন খুব বাড়ল সহ্য করতে না পেরে হাসপাতালে গিয়েছিল শিবু। ডাক্তারবাবু জবাব দিয়ে দিল। আর কিছু করার ছিল না।

এখন বোঝে লছমি কেন শিবু মারা যাওয়ার মাস দুয়েক আগে ডেকে তাকে বলেছিল, ‘লছমি, আমার পেশাবিদ্যে কাউকে দিয়ে যেতে পারলুম না। বাপ-ঠাকুর্দার কাছ থেকে দাহকার্যের বিদ্যে পেয়েছি আমি। আমার বড় আক্ষেপ এই বিদ্যে আমি আমার বংশের কাউকে দিয়ে যেতে পারলুম না। আমাদের পেশাবিদ্যেয় মেয়েদের কোনও অধিকার নেই। তাই এ বিদ্যে কোনও মেয়েকে কেউ দেয়নি আজ পর্যন্ত। আমি অনেক ভেবে ঠিক করেছি তোকে দিয়ে যাব এই বিদ্যে।‘ শুনে লছমি বলেছিল ,’আমার কোনও ডর নেই তাতে। কিন্তু কি লাভ হবে এই বিদ্যে শিখে? মেয়েদের কি এইকাজে ডাকবে কেউ? বাপের কাছে শেখা বিদ্যে ঘরে পচে নষ্ট হবে।‘
শিবু বলেছিল,’ তোকে পয়সা রোজগার করতে হবে না এই বিদ্যে দিয়ে। এই বিদ্যে বাঁচিয়ে রাখবি নিজের বুকের মধ্যে। তোর ছেলে যখন বড় হবে তাকে দিয়ে দিবি এই বিদ্যে। পরম্পরা বাঁচিয়ে না রাখলে জাতধর্ম রক্ষে হবে কী করে? ‘
চুপ করে শুনেছিল লছমি। মুখে মুখে সেদিন আর কথা বলতে পারেনি মুখরা লছমি। লছমিকে চুপ করে থাকতে দেখে হাসতে হাসতে বলেছিল শিবু,’ মেয়ে বলে দুঃখ করিসনি লছমি। আমি মরলে আমার মুখে আগুন দিয়ে, লাশ চিতেয় তুলে দাহ করবি তুই। বাপের শেখানো বিদ্যে দিয়ে বাপের অন্তিম কাজ তুইই করবি।‘
কাঁদতে কাঁদতে ছুটে পালিয়েছিল লছমি। গ্রামের প্রান্তে যে মাঠে মৃতদেহ দাহ করা হয় সেখানে কতক্ষণ বসেছিল কে জানে। বিকেলবেলায় শিবু এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, রাগ ভাঙ্গিয়ে ঘরে নিয়ে যায় লছমিকে। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও চোখ জলে ভেসে যায় লছমির। দাহকর্মের পদ্ধতি শিখতে শিখতে শিবুর কাছে সে এও শিখেছে এ বিদ্যে শুধুমাত্র লাশ পোড়ানোর বিদ্যে নয়। শোকতপ্ত সন্তান সন্ততি প্রিয়জনেরা তাদের পিতা, মাতা, পরমাত্মীয়ের অন্তিম সৎকারের দায়িত্ব তুলে দেয় তাদের হাতে। শ্রদ্ধায়, সম্মানে তাঁর অন্তিমযাত্রা নিশ্চিত করাই তাদের দায়িত্ব। পরম ভালোবাসায়, যত্নে, একাগ্রচিত্তে সর্বক্ষণ লক্ষ্য রাখতে হয় কোনও জ্বালা, যন্ত্রণা, ব্যথা তাঁর অন্তিম যাত্রায় তাঁকে যেন স্পর্শ করতে না পারে। তাঁর আশীর্বাদ পেলেই এই বিদ্যে সার্থক। সে আশীর্বাদ দেখা যায় না, শোনা যায় না, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হয়। সে আশীর্বাদে চিত্ত প্রশান্ত হয়। মন পবিত্র হয়। তাই এ বিদ্যে নিজের সন্তান সন্ততি যাদের শরীরে একই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তাদের ছাড়া আর কাউকে শেখানো যায় না।

শিবু মারা যাবার পর তার ইচ্ছের অমর্যাদা করেনি লছমি। মুখাগ্নি করে বাপের শরীর চিতেয় উঠিয়েছিল সে। পরম শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, যত্নে শিবুর অন্তিম সৎকার করেছিল সে। গ্রামের মানুষ কেউ কোনও কথা বলেনি। সেই রাত্রে ধূম জ্বর এসেছিল লছমির। প্রায় সাতদিন বেহুঁশ ছিল সে। এ গল্প আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে মৌবনিতে।

তিন তিনটে ছেলে লছমির। ভরা সংসার। নারানের বাপ নেই , মা আছে। তিন পিঠোপিঠি ছেলের দেখাশুনা করে লছমির শাশুড়ি। নারানের একার রোজগারে সংসার চলে না। লছমি কাজ করে গঞ্জে কোম্পানির কোয়ার্টারে বাবুদের বাড়ি। সকালবেলা মৌবনি থেকে লছমি ছাড়া আরও অনেকেই যায় গঞ্জে বাবুদের বাড়ি কাজ করতে। বেশিরভাগই গ্রামের বাগদিপাড়ার বৌয়েরা। সাবিত্রী, রঞ্জা, মনসা, হেমা এমনি আরও অনেকে। ওরা সবাই মিলে ভ্যানরিক্সায় তালডাঙ্গা এসে সকালে ৭টা ১০ এর ট্রেন ধরে। সারাটা রাস্তা সুখ দুঃখের গল্প করে গঞ্জের স্টেশনে নেমে যে যার কাজে চলে যায়। আবার একসঙ্গে ফেরে সন্ধ্যের ট্রেনে। তারপর ভ্যানরিক্সায়। এদের মধ্যে সাবিত্রী খুব ভাল বন্ধু লছমির। ছোটবেলার বন্ধু। ওদের দুজনেরই বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি এই মৌবনিতেই। সাবিত্রীর বর রতন এই গ্রামেরই লোক। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। রতনের সবই ভাল, দোষের মধ্যে বড্ডবেশি মদ গেলে। সন্ধ্যের পর আর হুঁশ থাকে না রতনের। প্রায়দিনই মদ গিলে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে। কখনও কখনও গাঁয়ের লোকেরা বাড়ি দিয়ে যায়। মুখঝামটা শুনতে হয় সাবিত্রীকে। মদ ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেছে সাবিত্রী। বুঝিয়ে সুঝিয়ে , মাদুলি তাবিজ পরিয়ে, পুজো-আচ্চা করিয়েও কিছুতেই কিছু হয়নি। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে সাবিত্রী। কপালে যা থাকে হবে। রোজগারের অর্ধেক টাকা মদের খরচায় চলে যায়। ছেলেমেয়ে , রতনের মা, নিজের মা আর নিজেরা দুজন মিলে ছ’টা পেট সংসারে। খরচ যে হারে বেড়েছে আরও দু’বাড়ি কাজ নিয়েছে সাবিত্রী। মাঝে মাঝে তাই ফিরতে দেরি হয় সাবিত্রীর। লছমি ওর জন্যে গঞ্জের স্টেশনে অপেক্ষা করে। দেরি হলেও একসঙ্গে ফেরে। বাকিরা সবাই চলে যায়। নারানও যে একটু আধটু গেলে না তা নয়। তবে লছমিকে ভয় পায় খুব। লছমি এমনিতে ভালমানুষ হলে কি হবে মাথা গরম হয়ে গেলে ওকে সামলানো দায়। মুখে শুধু যা আসে তাই বলে না, হাত-পাও চালিয়ে দেয় মাঝেমাঝে। গ্রামের কেউ লছমিকে ঘাঁটাতে সাহস করে না। দিনের শেষে নিজেদের প্রাণের কথা উজাড় করে না দিলে রাত্তিরে ঘুম হয়না দুই সখীর। গত তিনমাস দেখাসাক্ষাৎ হয়না ওদের। যা কিছু কথা ফোনেই হয়। গঞ্জের বৌদিমনিরা নিজেদের সুবিধের জন্য বাবুদের বলে কয়ে ওদের ফোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সস্তার ফোন। কথা বলা ছাড়া কিছু করা যায় না। তাই নিয়ে মনে মনে আফশোস আছে দু”জনেরই। কিন্তু টানাটানির সংসারে ভালো ফোন আর কেনা হয়ে ওঠেনি ওদের।

পরপর তিন তিনটে ছেলের জন্ম দেওয়ার পর প্রায় তিন বছর কেটে গেছে। একদিন গাজনের মেলা দেখতে গিয়েছিল লছমি আর নারান। বাচ্চাগুলো ছিল ওদের ঠাকুরমার কাছে। সন্ধ্যেবেলা ফেরার পথে নারান বলল,’ লছমি, একটা কথা বলব? রাগারাগি করবি না বল?’ মেলা দেখে লছমির মেজাজ ছিল ফুরফুরে। বলল,’ ন্যাকামি না করে কী বলবি বল।‘ নারান বলল,’ তোকে আগে বলিনি আমার বড় সাধ ছিল একটা মেয়ে হবে আমাদের। তিন তিনবার ছেলেই হল। মেয়ের সাধ আমার মিটল না।‘ লছমি অবাক হয়ে গিয়েছিল নারানের কথা শুনে। যে গাঁয়ে মেয়ে হলে কান্নার রোল ওঠে, অলক্ষী বৌকে বাড়ি থেকে দূর করে দেয় লোকে সেই গাঁয়ের ছেলে হয়ে নারান তিন তিনটে ছেলের পরেও মেয়ের বাপ হতে চায়।

নিজের শৈশব মনে পড়ে লছমির। তিন তিনটে মেয়ের জন্ম দিয়েছিল বলে কী না কী শুনতে হত ওর মাকে। ওর বাপ, শিবু বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল ওর মাকে আর ওদের তিনজনকে। মাকে বলেছিল, ’তুই কিছু কানে নিস না। মেয়েরা আমার লক্ষী। ওদের কেউ কিছু বললে জ্যান্ত পুঁতে দেব শ্মশানের মাঠে।‘ নারানের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে লছমি। ওর মুখে দেখতে পায় শিবুর ছায়া। মনে মনে বলে,’ আমার ভালোবাসার মানুষ চিনতে ভুল হয়নি। নারানের মত সোয়ামী পাওয়া অনেক ভাগ্যের কথা।‘ মুখে বলে, ’মেয়ে হলে খাওয়াবি কী? আমার মত কাজ করতে পাঠাবি লোকের বাড়ি? জন্ম দিয়ে কেন কষ্ট দিতে চাস বাকি জীবন মেয়েটাকে?‘ নারান বলে, ’তোকে কথা দিচ্ছি ,বুক দিয়ে আগলাবো তোকে আর তোর মেয়েকে। ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করব আমি। মেয়ে না হলে ঘর আলো হয় না। তুই রাজি হয়ে যা লছমি।‘ আলোআঁধারির সেই সন্ধ্যার নির্জন রাস্তায় নারানের বুকে মাথা রাখে লছমি। তার চোখ বুজে আসে, গড়িয়ে আসে আনন্দাশ্রু।

আবার গর্ভবতী হয় লছমি। তালডাঙ্গার ডাক্তারদিদি তাকে দেখে নিয়মিত। বড় ভাল ডাক্তারদিদি। বেশিদিন আসেনি এখানে। শহরের মেয়ে। ডাক্তারি পাস করে এক বছর হল তালডাঙ্গার ছোট হাসপাতালে পোস্টিং হয়েছে। এখানেই থাকে কোয়ার্টারে। রাত বিরেতে গাঁয়ের লোকেদের বিপদ আপদ হলে হাসিমুখে তাদের পাশে দাঁড়ায়। ডাক্তারদিদি নিশ্চিন্ত ভরসার জায়গা লছমির। তিনটে ছেলে আছে শুনে প্রথমবার দেখাবার সময় খুব বকাবকি করেছিল লছমিকে আর নারানকে। পরে লছমির মুখে সব গল্প শুনে রাগ জল হয়ে গিয়েছিল ডাক্তারদিদির। খুব ভালোবাসে ওদের দু’জনকে এখন। রোজ খবর নেয় নারানের কাছে। খাওয়া দাওয়া ওষুধপত্রের কোনও ত্রুটি হলে ফোন করে বকাবকি করে। দিনেরাতে যে কোনও সময় ডাক্তারদিদিকে ফোন করতে পারে লছমি। ডাক্তারদিদি নিজেই বলেছে তাকে। খুব সাবধানে থাকার সময় এটা। ওঠাবসা, হাঁটাচলা যেটুকু দরকার তার বেশি একটুও করা বারণ। যতটা সম্ভব শুয়ে বসে থাকতে হবে। ডাক্তারদিদির কড়া নির্দেশ। যে কোনও দিনই কিছু হতে পারে এখন। সেই অপেক্ষায় দিন কাটে লছমি, নারান আর ডাক্তারদিদির।

আজ অমাবস্যার রাত। গরমের সন্ধ্যে। বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে দক্ষিণ দিক থেকে। চৌকিতে আধশোয়া হয়ে বসে আছে লছমি। আজকাল রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না নারানের মা। ছেলে তিনটে দাওয়ায় বসে নিজেদের মত খেলা করছে। এমন সময় ঘরে ঢুকল নারান। আজকাল একটু বেশি টেনশনে থাকে নারান। সেই টেনশনে মদ গেলাটাও একটু বেড়েছে। সবই বুঝতে পারে লছমি কিন্তু চেঁচামেচি করতে আর শরীর দেয় না তার। অনেকবার বলেছে,’ মদ গেলাটা একটু কমা। রাতবিরেতে কখন কী হবে, দৌড়তে হবে তখন।‘ পাড়ার একটা ভ্যান রিক্সাওলার থেকে ভ্যানটা চেয়ে নিয়ে এসে রাত্রে নিজের কাছে রাখে নারান। রাত্রে কিছু হলে নিজেই চালিয়ে নিয়ে যাবে। ভ্যানওয়ালারা সারাদিন ভ্যান টেনে মদ গিলে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোয় রাত্রে। ওদের ডেকে তোলা শিবের অসাধ্যি। তার চেয়ে নিজে টেনে নিয়ে যাওয়া অনেক সুবিধে, সময়ও বাঁচবে।
লছমি বলে,’ আবার গুচ্ছের গিলেছিস? তাহলে রিক্সা রেখেছিস কেন কাছে? ঘুমই তো ভাঙ্গবে না তোর? তোর নেশার মুখে নুড়ো জ্বেলে দোব আমি।‘
নারান বলে,’ ভরসা রাখ আমার ওপর। ভয় হয় সর্বক্ষণ। তাই ভয় কাটাতে খেয়েচি। ঠ্যালা দিবি , ঠিক উঠে পড়ব।‘
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে নারান। তারপর বলে, ’আচ্ছা তুই লিচ্চয় করে কী করে বলছিস মেয়ে হবে? ডাক্তারদিদি ছবি তুলে দেখে তোকে বলেছে?’
এবার রেগে ওঠে লছমি, ’ভগবান যাকে পাঠিয়েছে সেই আসবে আমার কোলে। সে ছেলে না মেয়ে তুই আমি ঠিক করার কে? ডাক্তারদিদি যদি জেনেও থাকে বলবে কেন আমাকে? অনেক নিয়ম কানুন আছে এসব ব্যাপারে।‘
নারানের মুখটা ছোট হয়ে যায়। বলে,’ তবে তুই যে বললি…’
লছমি বলে,’ বলেছি না এবার মেয়ে হবে আমার। আমি জানি।‘
নারান বলে,’ কী করে জানলি তুই?’
লছমি বলে,’ তবে শোন। আমার বাপ মরা মানুষের সঙ্গে কথা বলার বিদ্যে শিখিয়েছে আমায়। মরা মানুষের চোখ মুখ কপালের দিকে তাকিয়ে তার পাপ-পুণ্য, সুখ-দুঃখের সবকথা জেনে নেওয়ার অদ্ভুত বিদ্যে জানা ছিল আমার বাপের। আর তার মেয়ে হয়ে পেটের ভেতরের একটা জ্যান্ত বাচ্চার শরীলের স্পশ্য, লড়াচড়া, পাশ ফেরা চোখ বুঝে সর্বক্ষণ দেখে বুঝতে পারবুনি আমি ওটা ছেলে না মেয়ে? গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। তোর মেয়েই বাড়ছে আমার পেটের ভেতর।‘ নারানের মাথা ভোঁভোঁ করতে থাকে। পাগল হল নাকি লছমি? ওর কথার কোনও মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না নারান।

রাত তখন আড়াইটে হবে। ঝনঝন করে বেজে উঠল লছমির ফোন। ওপাশ থেকে গোঙানির আওয়াজ। গলার আওয়াজ সাবিত্রীর মনে হচ্ছে না?
‘কী হয়েছে সাবিত্রী?‘ চিৎকার করে ওঠে লছমি। ওপাশে শুধুই কান্না।
‘কী হল, চুপ করে আছিস কেন? কথা বল।‘ লছমির গলায় স্পষ্ট উদ্বেগ । ‘
‘যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি আমি।‘ কাঁদতে কাঁদতে বলে সাবিত্রী।
‘কেন কী হয়েছে? বল আমায়।‘ জিগ্যেস করে লছমি।
‘কুকুরে কামড়েছে আমায়।‘ উত্তর দেয় সাবিত্রী।
‘কখন? কোথায়? কী করে কামড়াল?’ ব্যস্ত হয়ে ওঠে লছমি।
গোঙাতে গোঙাতে যা বলল সাবিত্রী তা হল আজ সন্ধ্যেবেলা কাজ থেকে ফিরতে দেরি হয়েছিল সাবিত্রীর। ফিরে এসে দেখে রতন কাজের থেকে বাড়ি ফেরেনি। রাত অবধি অপেক্ষা করে দশটা নাগাদ ওকে খুঁজতে বেরোয় সাবিত্রী। অন্ধকার রাস্তায় খেয়াল না করে শুয়ে থাকা কুকুরের গায়ে পা তুলে দেয় সাবিত্রী। ভয় পেয়ে কুকুরটা প্রাণপণে কামড়ে ধরে সাবিত্রীর পা। তিন চারটে জায়গায় দাঁত বসিয়ে দেয়। রক্ত বেরিয়েছে অনেকটা। কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রক্ত বন্ধ হয়েছে কিন্তু অস্বাভাবিক জ্বালা করছে ক্ষতস্থানগুলো। রাত্তির বারোটা নাগাদ দুটো লোক মদে বেহুঁশ রতনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। সে এখন মড়ার মত বেহুঁশ। কাল সকালের আগে তার হুঁশ ফিরবে বলে মনে হয় না। রোজ রোজ এই একই জ্বালা। তার ওপর আজ এই কান্ড। তখন থেকে জ্বালা যন্ত্রণা চেপে অপেক্ষা করছিল সাবিত্রী। ভেবেছিল সকাল হলে যাবে হাসপাতালে। ততক্ষণে রতনের মাতলামি কেটে যাবে। কিন্তু আর সহ্য করতে পারছে না সাবিত্রী। মনে হচ্ছে মরে যাবে এক্ষুণি। আর কথা বলতে পারে না সাবিত্রী। গোঙাতে গোঙাতে ফোনের অপরপ্রান্তে চুপ করে যায় সাবিত্রী।

ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় লছমি। চিৎকার করে ডাকতে থাকে নারানকে। ঘুম ভেঙ্গে যায় ঘরশুদ্ধু সবার। শুধু ঘুম ভাঙ্গে না দরজার বাইরে দাওয়ায় ঘুমিয়ে থাকা নারানের। নারানের মা ভাবে ব্যথা উঠেছে লছমির। উঠে এসে বলে,’ তুই বস এখানে। আমি দেখছি।‘
ঝাঁঝিয়ে ওঠে লছমি,’তুই পারবি ওকে তুলতে? মদ গিলে শুয়েছে কাল।‘
চিৎকার করে ওঠে লছমি,’ মরে গেলি নাকিরে নারান? কী করে ঘুমোচ্ছিস এখনও?’
নারানের মা বলে, ’কী সব অলক্ষুণে কথা বলছিস লছমি, কতদিন তোকে বলেছি নারানকে নাম ধরবি না তুই।‘
‘তুই চুপ কর বুড়ী! নাম ধরে ডাকব না তো কী হারামি বলে ডাকব?’ চেঁচিয়ে ওঠে লছমি।
নারানের মা সরে যায়। বিড়বিড় করে বলে,’ কে তোর নাম লছমি রেখেছিল কে জানে? কে বলবে কথা তোর সঙ্গে? যা প্রাণ চায় কর।‘
চিৎকার ,চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে নারানের। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ‘কী হয়েছে? এত চিল্লামেল্লি কিসের?’ জিগ্যেস করে নারান। লছমি বলে,’ ভ্যানরিক্সা বের কর। হাসপাতালে যেতে হবে এক্ষুণি।‘ ‘কেন? তুই তো ঠিকই আছিস দেখে ঠাহর হচ্ছে। তাইলে এতরাত্তিরে হাসপাতাল যাবি কেন?’ মাথা চুলকোয় নারান।
‘সাবিত্রীকে কুকুরে কামড়েছে। রাবিশের বিষ মাথায় ওঠার আগে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ওকে।‘
– কেন রতন ঘরে নেই? এ অবস্থায় তুই কী করে যাবি? তোকে না লরতে চরতে বারণ করেছে ডাক্তারদিদি?
– ডাক্তারদিদিকে ফোন করে সব বলেছি আমি। এখনই না নিয়ে গেলে বাঁচানো মুস্কিল হবে সাবিত্রীকে। রতন মদ খেয়ে বেহুঁশ। মরে আছে না বেঁচে আছে বলা মুস্কিল। দেরি না করে চল তাড়াতাড়ি। সাবিত্রীকে আগে নিতে হবে তারপর হাসপাতাল। অনেক পথ।
– যেতে পারবুনি আমি। রাস্তা খারাপ, এবড়ো খেবড়ো। তোর যদি ভাল-মন্দ কিছু হয়ে যায়। পেটের মেয়েটা…
– তা বলে চোখের সামনে মরে যাবে সাবিত্রী। আমি বেঁচে থাকতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওকে মরতে দেখব। তুই মরদ না রাক্ষস ,নারান?
– ঠিক আছে। তুই থাক বাড়িতে। আমি একাই যাচ্ছি।
– তোর বুদ্ধিশুদ্ধি কবে হবে, নারান? একটা মেয়েমানুষকে একা সামলাতে পারবি তুই? রাতবিরেতে তাকে নিয়ে একা যাবি কী করে? মান ইজ্জতেরও দিকটা ভাববিনি একবার। তাই কি কখনো হয়? যেতে আমাকে হবেই।
– তোকে নিয়ে চিন্তা আমার। আরও বেশি চিন্তা যে আসছে তাকে নিয়ে। তোদের কিছু হয়ে গেলে সব্বনাশ হয়ে যাবে। আমার মাথা কাজ করছেনে। হাত-পা চলছেনে।
– অত সহজে আমার আর তোর মেয়ের কিচ্ছু হবে না। পুণ্যবান শিবু ডোমের মেয়ে আমি। কোনও পাপ করিনি এ জীবনে। ভরসা রাখ, নারান। উঠে দাঁড়া। তোর মেয়ের দিব্যি! সাবিত্রীকে বাঁচাতেই হবে। হাসপাতাল অবধি পৌঁছে গেলে আর কিসের চিন্তা? ডাক্তারদিদিকে বলা আছে সব। সেরকম কিছু হলে ডাক্তারদিদি আছে তো।

মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ায় নারান। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে লছমির দিকে। হাসিমুখে নিজের আর গর্ভস্থ কন্যার জীবন তুচ্ছ করে বান্ধবীকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর প্রতিজ্ঞায় স্থির তার দুই চোখ, কঠিন তার চোয়াল। লছমির এমন রূপ সে আগে দেখেনি। সেই রূপের সামনে মাথা তুলে কথা বলার সাহস নেই নারানের। মাথা নিচু করে ভ্যানরিক্সা টেনে বের করে নারান। নারান অনুভব করতে পারে লছমির তেজ ক্রমশ সংক্রমিত হচ্ছে তার শরীরে। পেশীগুলো ফুলে উঠছে যেন। সহস্র মানুষের শক্তি ভর করছে তাকে। ভয় সরে যাচ্ছে তার মন থেকে। অপেক্ষমান মৃত্যুর হাত থেকে তিন তিনটে জীবনকে রক্ষা করার ভার তার ওপর। সাহস, শক্তি আর সংকল্পের আলোকধারায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নারান। লছমি উঠে বসে ভ্যানরিক্সায়। নারানের মার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ’ছেলেগুলানকে লক্ষ্য রাখিস। আর তোর ভগমানের কাছে বল ঘুমিয়ে না থেকে আমাদের দিকে একটু দেখতে।‘

অমাবস্যার অন্ধকার চিরে এগিয়ে চলে জীবনরথ। সে রথের সারথি এক জ্যোতির্ময় পুরুষ। সেই রথের সিংহাসনে আসীনা এক নারী যার অনূভুতি ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে আসছে তার গর্ভস্থ সন্ততির পৃথিবীর আলো দেখার অস্থির ব্যাকুলতায়। সেই ব্যাকুলতা তার শরীরকে দীর্ণ বিদীর্ণ করে দিচ্ছে এক অপার্থিব যন্ত্রণায়। পথিমধ্যে এই জীবনরথের পথ চেয়ে অপেক্ষা করে আছে এক একাকিনী মৃত্যুপথযাত্রী রমণী। গন্তব্যে জীবনের বরণডালা সাজিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ব্যাকুল প্রতীক্ষায় বসে আছেন জীবধাত্রী।

তোমাদের দেখছি সমস্ত রুদ্ধ অন্ধকারের পরপার থেকে। ওরা যারা নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ধরে রেখেছে, পাছে আর কেউ সেখানে প্রবেশ করে বলে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে সেই অন্ধকারের ওপার থেকে তোমাদের দেখছি। নিখিল মানব সেই অন্ধকার থেকে ফিরে ফিরে যায়, সূর্য চন্দ্র সেখানে দৃষ্টিপাত করে না। সেখানে জ্ঞানের স্থানে শাস্ত্রবাক্য, ভক্তির স্থানে পূজাপদ্ধতি, কর্মের স্থানে অভ্যস্ত আচার। যেখানে ওরা কান বন্ধ করতে বলে যাতে মন্ত্র তোমার কানে যায়, সরে বসতে বলে পাছে তোমার স্পর্শ ওদের কলুষিত করে, দরজা বন্ধ রাখে পাছে তোমার অশুভ দৃষ্টি ওদের অমঙ্গল ডেকে আনে সেখানে বিরাজ করে অনন্ত অমানিশা। সেই অতলান্ত তমসার পরপার থেকে তোমাদের দেখছি।

সেই অমাবস্যার রাত্রিশেষে শুক্লপক্ষের প্রথম প্রভাতে লছমি জন্ম দিয়েছিল এক শিশুকন্যার। আর বিপদমুক্ত হয়ে রতনের হাত ধরে বাড়ি ফিরেছিল সাবিত্রী। ডাক্তারদিদির কথামতো পরের ভ্যাকসিনগুলো রতনের সঙ্গে গিয়ে গঞ্জের হাসপাতাল থেকে নিয়ে সম্পূর্ণ সেরে উঠেছিল সাবিত্রী। সেদিন সকালে ডাক্তারদিদির সামনে মদ ছেড়ে দেবার প্রতিজ্ঞা করেছিল রতন আর নারান। এই দিব্যধামে কেবলই জীবনের জয়গান।

সেই প্রভাতের মন্ত্র উদয়শিখরের উপরে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল যে একসূর্য উদয় হচ্ছেন, এবার ছোট ছোট প্রদীপ নেভাও। রেললাইনের ওপারের লোকেরা তোমরাও শোন, তোমরাও জাগ্রত হও। তমসঃ পরস্তাৎ , অন্ধকারের পরপার থেকে আমি জানতে পারছি। নিশাবসানের আকাশ উদয়োন্মুখ আদিত্যের আসন্ন আবির্ভাবকে যেমন করে জানতে পারে তেমনি করে।

২১শে জানুয়ারি, ২০২২।
*এই গল্পে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।

Sahityika Admin

Add comment