আড়াই চাল
ইন্দ্রনীল ঘোষ, ১৯৮৬ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
প্রায় একরকম হুড়মুড় করেই পাশে এসে পড়েছিল লোকটা। সত্যেশ একটু চমকে উঠে ডানপাশে ফিরতেই লোকটা একগাল হেসে বলে উঠল, “ভালো আছেন তো, স্যর?”
প্রায় নির্জন রাস্তায় একটু অন্যমনস্ক ভাবেই হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। পাশের পাড়ায় একটা বিয়ের নেমতন্ন ছিলো। বাড়ি থেকে হাঁটা পথে মিনিট দশেকের রাস্তা। খাওয়াটাও জম্পেশ হয়েছে। রাতও তেমন হয় নি। সবে পৌনে দশটা। কোলকাতা শহরে এটা কোনও রাতই নয়। তবে ছুটির দিন বলে, পথঘাট একটু জনশূন্য হয়ে এসেছে, এই যা। জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ। ঠাণ্ডা এখনও ভালই রয়েছে। আকাশে শুক্লপক্ষের দ্বাদশীর উপবৃত্তাকার চাঁদ। গলির দুপাশের সারি সারি বহুতল বাড়ির মাথার উপরে লুকোচুরি খেলছে। সাহিত্যিক মানুষ। একটু ভাবপ্রবণ। তবে কাজের চাপে, আজকাল আর ভালো প্লট তেমন মাথায় আসতে চায় না।
ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে একটা ফুরফুরে ভাব এসেছিল। হঠাৎ করে, ডানদিকের সরু গলি থেকে লোকটা আচমকাই সামনে এসে পড়লো। তাই সত্যেশের পক্ষে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াটা কিছুই অস্বাভাবিক নয়। লোকটার পরনে সাধারণ পোশাক। গায়ে একটা গোলাপি ফুলহাতা সোয়েটার। আর গলায় মাফলার। পায়ে সস্তা চামড়ার চপ্পল। একটা বাইসাইকেলের হাতল ধরে তার পাশেপাশেই হেঁটে চলতে লাগল। সাইকেলের দুই হাতল থেকে, দুটো পেল্লায় বিশাল মাপের সাদা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে। ব্যাগে কী আছে, তা বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায়ই নেই।
“আমাকে চিনতে পারছেন তো, স্যর? আমি বাজারে বসতাম। আপনি রেগুলার আমার কাছ থেকে পুজোর ফুল নিতেন।“
সত্যেশ একটু অবাকই হলেন। ফুল তিনি নেন ঠিকই। কিন্তু এর কাছে কোনওদিন নিয়েছেন, বলে তো মনে পড়ছে না। নিশ্চয় লোকটা কোনও ভুল করছে। নির্ঘাত তারই মত দেখতে, কারও সঙ্গে গুলিয়েছে। কথাটা বলতে গিয়েও ঢোঁক গিললেন সত্যেশ। কারন লোকটা তখনও একনাগাড়ে বলে চলেছে, “আমি এখন ক্যান্টনমেন্টে শিফট করেছি, স্যর। তাই আমাকে আর এই বাজারে দেখতে পান না। একসময়ে কত ফুল নিয়েছেন। সেবার পাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজোয়, আপনার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে ফুল সাপ্লাই করেছিলাম। মনে আছে স্যর?”
সত্যেশ এখন নিশ্চিত। লোকটা ভুল করেছে। পাড়ায় বারোয়ারী জগদ্ধাত্রী পুজো হয় ঠিকই, কিন্তু তিনি কোনদিনই তার দায়িত্বে থাকেন নি। ফলে ফুল সাপ্লাইয়ের কন্ট্রাক্ট করারও কোনও প্রশ্নই নেই। নাহ, লোকটা যে ভুল করেছে, সেটা এবার ওকে বলা উচিত। কিন্তু বলবেন কাকে? ওপক্ষে তো থামার কোনও লক্ষণই নেই। নিজের মনে বলেই চলেছে
– ভাইয়েরা কেউ দেখল না। তাই মাকে নিয়ে এসে ক্যান্টনমেন্টে নিজের কাছে রেখেছি। পঁচাশি বছর বয়স। সব দেখাশোনা আমাকেই করতে হয়। ভাইয়েরা পারলো, কিন্তু আমি ফেলে দিতে পারলাম না, স্যর।
করুণ মুখখানা দেখে, এবার একটু মায়াই হল সত্যেশের। নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। এটা তার নিজের কাছেও বেশ সন্তুষ্টির বিষয়। তাঁকেও কখনই মায়ের কাছ-ছাড়া হতে হয় নি।
মনে মনে ভাবলেন, যাক গে, তিনি যে একে আদৌ চিনতে পারেন নি, সেটা আর নাই বা প্রকাশ করলেন। তাছাড়া প্রায় এসেও পড়েছেন। ওই তো, সামনের বাঁক থেকে ডান দিকে দু মিনিট গেলেই তার বাড়ি।
– তুমি তো ভাগ্যবান হে। না হলে, মায়ের সেবা করার সুযোগ সকলের ভাগ্যে জোটে না। সেটা মনে রেখো।
এই এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেলেন সত্যেশ।
– সবই আপনাদের আশীর্বাদ, স্যর। এদিকে আর বিশেষ আসা হয় না আজকাল। শুধু ওই রজতদা আর ঝর্ণাদির সঙ্গে একটু দরকার ছিল, তাই আসা আর কি।
“কে এই রজতদা, আর ঝর্ণাদিটাই বা কে?” আর একটু হলেই মুখ ফস্কে প্রায় বলে ফেলেছিলেন সত্যেশ। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন। নইলে নির্ঘাত লোকটা তাঁকে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে বসতো, “সেকি? এই পাড়ায় থাকেন, আর এঁদের চেনেন না?”
সত্যিই তিনি খুব একটা মিশুকে নন। তাছাড়া গত কয়েক বছরে, পুরনো বাড়িগুলো ভেঙ্গে মালটি-স্টোরিড হয়ে গিয়ে, পাড়ায় কত যে নতুন মুখ আজকাল।
অত বড় বড় ব্যাগসহ সাইকেলটাকে সামলে, এমনভাবে গা ঘেঁষে হাঁটছিল লোকটা, যে সত্যেশের নিজের স্বাভাবিক হাঁটার ছন্দ ব্যাহত হচ্ছিল।
“আচ্ছা, আজ আসি তবে। ভালো থাকবেন।“ এই বলে সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে, চড়ার উপক্রম করল লোকটা। সত্যেশও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
কিন্তু একি? আবার কি হল রে, বাবা? লোকটা আবার প্যাডেল থেকে পা নামিয়ে, সাইকেলের সীটটা কোমরে ঠেসান দিয়ে, এমন ভাবে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়ল, যে সত্যেশও হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। লোকটা তখন ব্যাগের মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে, যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমনভাবে বলে উঠল, “একটু দাঁড়ান স্যর, আপনার জন্য একটা জিনিস আছে। আপনার ভাগ্যটা ভালো, এই একটা সেট-ই ছিল।“
সত্যেশের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই, লোকটা তাঁর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল। আর কি আশ্চর্য। তিনিও যন্ত্রচালিতের মত সেটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলেন। এবার নজর করে দেখলেন, সেটা আর কিছুই নয়। চারটে ধূপকাঠির প্যাকেট একসাথে গার্ডার দিয়ে বাঁধা।
– নিয়ে যান স্যর, খুব ভালো জিনিস। জ্বালিয়ে দেখবেন, আর বৌদিকেও বলবেন আমি দিয়েছি।
লোকটা নির্ঘাত যাদু জানে। না হলে তাঁর মত একজন শিক্ষিত মানী গুণী ভদ্রলোক, একজন অজানা অচেনা প্রাক্তন ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে, এরকম অযাচিত উপহার (?) নিতে গেলেন কেন? কিন্তু তখন ফেরার আর উপায় নেই। অগত্যা পরিস্থিতি কিছুটা শোধরানোর আশায় বলে উঠলেন, “ইয়ে, মানে, ঠিক আছে। কিন্তু তুমি কিছু পয়সা নাও, এমনি এমনি দেবে কেন?”
– এই জন্যেই, আপনাদের এতো সম্মান করি, স্যর। ঘোষালদাও একটু আগেই, ঠিক আপনার মত, জোর করে আমার হাতে টাকা ধরিয়ে দিলেন।
সত্যেশের মনে যথারীতি “কে ঘোষালদা?” জাতীয় একটা প্রশ্ন, ক্ষণিকের জন্য উঁকি মেরেও, আবার লুকিয়ে পড়ল। নিজেই নিজেকে বিদ্রূপ করলেন। যেন এই পাড়ায় থেকে, ঘোষালদাকে না চেনাটা যে সমূহ লজ্জার বিষয়, সেটাও কি বলে দিতে হবে? বিশেষ করে, তিনি যখন এমনই একজন স্বনামধন্য ‘ঘোষালদা’, যাকে কিনা একজন ফুলওয়ালাও চেনে!
ব্লেজারের ভিতর পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে, এবার একটু সমস্যায় পড়লেন সত্যেশ। দেখলেন দশ টাকার নোট মোটে একটি, তবে একশো রয়েছে গোটা চারেক। বাধ্য হয়ে একটা একশোর নোটই বাড়িয়ে দিলেন। মনে মনে ভাবলেন, লোকটি তাঁকে নিশ্চয় বাকি টাকাটা ফেরত দেবে। কিন্তু ‘ধন্য আশা কুহকিনী’। লোকটা অম্লান বদনে, নোটটা পকেটস্থ করে, আবার সাইকেলের প্যাডেলে পা দিল।
সত্যেশ নিজের মনে ভাবলেন, প্রতি প্যাকেট দশ টাকা হিসেবে চারটে প্যাকেটের দাম চল্লিশ টাকার বেশি হবার কথা নয়। কিন্তু যে লোক তাঁকে কয়েক মুহূর্ত আগেই সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে জিনিসটা দিতে যাচ্ছিল, তার সঙ্গে দর কষাকষি করবেন, এমন রুচি তো তাঁর নয়। হাজার হোক, তিনি একজন তথাকথিত ভদ্রলোক বলে কথা।
লোকটা ততক্ষণে “ভাল থাকবেন স্যর” বলে, একটা হাঁক দিয়ে, হঠাৎ অসম্ভব দ্রুততায় সাইকেল চালিয়ে, যে দিক থেকে এসেছিল, সেই দিকেই উধাও হয়ে গিয়েছে।
হতবাক ভাবটা কেটে যেতেই, হাতের ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখলেন সত্যেশ। নটা বেজে আটচল্লিশ মিনিট হয়ে পঁচিশ সেকেন্ড। তার মানে, সাড়ে তিন মিনিটের থেকেও কম সময়ে ঘটে গেল গোটা ব্যাপারটা।
বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে শুতে যাবার আগে, ঠাণ্ডা মাথায় গোটা ব্যাপারটা একবার গোড়া থেকে ভাবতে ভাবতে, পরিস্কার বুঝতে পারলেন, তিনি বোকা বনেছেন। পুরো ঘটনাটাই একটা পরিকল্পিত ছক এবং তিনি সরল বিশ্বাসে বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন। ইস্স, একজন অল্পশিক্ষিত লোক, তারই পাড়ায় দাঁড়িয়ে, তাঁকে এভাবে বুদ্ধু বানিয়ে গেল?
কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল সূক্ষ্ম হাসির রেখা। সাধে কি আর কবিগুরু বলেছেন “জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা”?
একশো টাকায় কি হয় আজকাল? মুগডালের দামই তো দুশো টাকা কিলো। কিন্তু শুকনো মস্তিষ্কে, বহুদিন পর যে এমন সুন্দর একটা গল্পের প্লট, এমন অযাচিত ভাবে এসে পড়ল, এর মূল্য অবশ্যই তার চেয়ে কিছু বেশি বই কম নয়। একথা হলফ করে বলা যায়।
Add comment