স্বদেশ বিদেশের সরস্বতী বন্দনা
হিমাংশু পাল, ১৯৯০ কমপিউটার সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি
ছোটবেলার সরস্বতী পূজা মানেই শীতের ভোরে সূর্য ওঠার আগেই প্রাতঃস্নান সেরে ফেলা, পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া ও বিলেতি কুল খাওয়া। যে সাবজেক্ট গুলো কঠিন কিংবা খুব প্রিয় , সেই বইগুলো মা সরস্বতীর বিশেষ আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য মায়ের পদপ্রান্তে নৈবেদ্য দেওয়া হতো। আর দুদিন পড়া-লেখা বন্ধ। মা সরস্বতীর সান্নিধ্য লাভ করাই ছিল একমাত্র কাম্য।
গ্রামের স্কুলের সরস্বতী পূজা, সময়কাল ১৯৭৭ – ১৯৮৩
ছোটবেলার সেই সরস্বতী পূজার দিনগুলির সঙ্গে আমাদের অনেক ছোট-ছোট স্বপ্ন-রঙিন স্মৃতি মনের গভীরে আজও অমলিন হয়ে গেঁথে আছে। সেদিনের সেই অবুঝ শিশু ও কিশোর মনের কোমলতা, স্বপ্ন, আবেগ ও অনুভূতিতে স্মৃতিগুলো যেন জীবাশ্মের মতো আমাদের অন্তরের অন্তস্থলে কেউ সযতনে গচ্ছিত রেখেছেন। যেন বহুমূল্যের সম্পদ পুরানো সিন্দুকে তালাবদ্ধ আছে। কারণে অকারণে যখন তালা খুলে স্মৃতির অতল থেকে সেগুলো ভেসে আসে, তখন ভাবাবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, চোখে আনন্দাশ্রু চিক চিক করে! শুধু ভালো লাগা বা শুধু মনখারাপ করা নয়, হিরে মানিক জহরতে গাঁথা স্মৃতির এক-একটা বিশাল মালা! স্কুল জীবনের স্মৃতি, স্কুলে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের স্মৃতি বিশেষ করে স্কুলের সরস্বতী পূজার স্মৃতি আমাদের জীবনে এরকম এক মহামূল্যবান রত্ন হার।
ছোটবেলার একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শুরু করি। আমাদের বাড়ি হুগলী জেলার রামনগর গ্রামে, আরামবাগ থেকে চার মাইল দক্ষিণে দ্বারকেশ্বর নদীর পূর্বপাড়ে। তখন আমি খুবই ছোট, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া সবে শুরু করেছি। দাদাদের কাছে রামনগর হাই স্কুলের সরস্বতী পূজার খাওয়ার মেনু শুনে দাদাদের সঙ্গে দুপুরের খাওয়ায় গিয়েছিলাম। ফুলকো ফুলকো ডালডা ঘিয়ে ভাজা লুচি, সাথে নিজেদেরই গ্রামের মাঠের ফসল তুলে আনা যেমন বাঁধাকপি, আলু , টমেটো ও মটরশুটির সুস্বাদু তরকারি আর চাটনি। সাত আট বছরের এক শিশুর একাগ্র চিত্তে, পরম তৃপ্তিতে খাওয়ার সেই দৃশ্য এক স্কুল শিক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করেন, “বাবা, আরো লুচি নেবে?” ছেলেটি নীরবে ঘাড় নাড়ে। রোগা পাতলা একটু লম্বাটে চেহারার শিশুটিকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়ানোর সেই দৃশ্য তখন সকলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায়। ছোট ভাইয়ের কুড়ি বাইশটা লুচি খাওয়া দেখে দাদারাও খুব লজ্জিত বোধ করে। বাড়ি ফিরে বকাবকিও করে। অন্যদিকে ছেলেটি কিন্তু সকলের চেয়ে বেশি খেয়ে ফার্স্ট হওয়ার এক আত্মতৃপ্তি লাভ করে।
এরপর থেকে হাই স্কুলে সরস্বতী পূজা দেখতে যাওয়া একরকম বন্ধই হয়ে গেল। দাদা-দিদিরাও আর উৎসাহ দেখাতো না। আর দেখাবেই বা কি করে? লজ্জার মাথা খেয়ে এবারের খিঁচুড়ি ভোগ খাওয়ার কম্পিটিশনেও যদি ভাইটা ফার্স্ট হয়ে যায়? পেটুক কোথাকার! সত্যি বলতে কি ঠাকুরের প্রসাদী ভোগ খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোন চক্ষু লজ্জা নাই, কোনোকালেই ছিল না , আজ এই চল্লিশোর্ধ বয়সেও নেই, আর সুযোগ পেলেই দুবার করে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি। নিদেন পক্ষে দু-হাতা বেশিও চেয়ে ফেলি। বিদেশের পরিচালন কমিটির কাছেও এই ব্যাপারে আমার বেশ নাম ডাক হয়েছে।
যাই হোক, যে কথা বলছিলাম, রামনগর হাই স্কুলের সরস্বতী পূজার কথা। সময়কে কে ধরে রাখতে পারে ? কয়েক বছর পরে জামার কলার উঁচিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম রামনগর হাই স্কুলে, ক্লাস ফাইভে। তখন থেকেই দাদা-দিদিদের পরোয়া না করে বন্ধুদের সঙ্গে চলে যেতাম সরস্বতী পূজা দেখতে, দুস্টুমি করতে।
হাইস্কুলের ক্লাসে তখন অনেক ছাত্রছাত্রী, সেকশন এ ছেলেদের ক্লাস, সেকশন বি মেয়েদের। ক্লাস চলাকালীন দূরত্ত্ব বজায় থাকলেও সুযোগ পেলেই ছেলেরা দলবেঁধে মেয়েদের পিছু নিতো। অহেতুক ঝগড়া করতো, রাগাত , ক্ষ্যাপাত। ছাত্রীদের নাম ধরে আওয়াজ দিতো। আজকে বুঝতে পারি যে বিধাতার এই অনিয়ম শাশ্বত ও সর্বত্র। সুতরাং রামনগর স্কুলের একটি পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রর কিই বা দোষ করলো? পরে আমার সহপাঠিনীদের মুখেই শুনেছি যে ছেলেদের এইসব কাণ্ডজ্ঞানহীন কার্যকলাপ মেয়েদের নাকি ভালোই লাগতো, উপভোগ করতো, নীরব প্রশয়ও দিতো। অবশ্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে তার ফল ভালো হতো না। হেডমাস্টারের বেধড়ক পিটুনি, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারের দাবড়ানি। কে আর শখ করে খেতে যায়? কিন্তু হয়ে যায়। অবশ্য সরস্বতী পূজার দিনে এই ভয়টা ছিল না। মা সরস্বতীর ইচ্ছাতে বিদ্যানুরাগী ছাত্রীরা এই একটা দিন কোন কমপ্লেইন করতো না। তারা যে আজ একটু বেশি সেজে গুঁজে স্কুলে আসে, ছাত্রদের নজরে আসার জন্য। চোখ-কান খোলা রাখে , কে তাদের প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে , কে কি মন্তব্য করছে। কেউ প্রেমের হাসি হাসছে কিনা, কেউ প্রেম নিবেদন করছে কিনা। বালিকারা একে অপরের রূপসজ্জা দেখতে ও দেখাতেও ব্যস্ত। বিধাতার এই নিয়মও শাশ্বত এবং সর্বত্র।
নবম শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রীদের এই দূরত্ব একটু কমতে থাকে। ছেলেমেয়েদের তখন একটাই ক্লাসরুম। ডানদিকের বেঞ্চগুলোতে ছেলেরা, আর বামদিকের মেয়েরা। বয়ঃসন্ধিক্ষণে মেয়েদের সম্পর্কে তখন আমাদের অদম্য কৌতূহল। সুযোগ পেলেই মেয়েরা কি পছন্দ করে, আমাদের মধ্যে কাকে বিশেষভাবে পছন্দ করে, এইসব। তার সাথে ওঁদের ব্যাগে কি আছে দেখা। এতে অনেক সাহসের দরকার, আমার মতো ভীতু ছেলের কম্মো নয়। তবুও ক্লাসের বিশু, সমীর রায় (নাম পরিবর্তিত) অনেক সাহস করে মেয়েদের অনুপস্থিতে ব্যাগ খুলে পাকা তেঁতুল, কাঁচা আম, নুন-লঙ্কা ও নানাবিধ টক-ঝাল-মিষ্টির সন্ধান পেয়েছে। চুরি করে ছেলেরা ভাগাভাগি করেও খেয়েছে। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় কয়েকজন বন্ধু ও বান্ধবীর মধ্যে ভালোলাগা ও ভালোবাসাবাসীও হয়েছিল। সরস্বতী পূজার দিনে সেটা একটা অন্য মাত্রা পেতো। আমরা বন্ধুরা সব একসঙ্গে ভালো জামা প্যান্ট পরে তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতাম, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম তাদের জন্য। লাল পাড় সাদা শাড়ি বান্ধবী তখন পূর্ণ যৌবনা নারীর মতো, বিশেষ দেবীর মতো দেখা দেবে। বড় পর্দা না হলেও ছোট পর্দাতে চান্স পাওয়ার মতো তো বটেই।
ওই সে আসছে! আসছে! তাঁর আগমনবার্তায় ছাত্রদের মধ্যে হঠাৎ হৈ-চৈ রব ওঠে। যার জন্য গোটা ক্লাসের ছাত্রদের এত প্রতীক্ষা, এতো উৎসাহ, এত কৌতূহল, তিনি সুবালা-বিশাখাসহ সখি পরিবেষ্টিত হয়ে বিদ্যালয়ের দিকে ধীরপদক্ষেপে আসতে থাকেন। শাড়ির মোড়কে জড়ানো কিশোরীর সেই রূপ দেখে অনেকেই মোহিত হয়। সরস্বতী পূজার দিনে এটা তাদের একটা অতিরিক্ত ও বিশেষ পাওয়া।
পড়াশোনায় স্মার্ট হলেও ছেলেটার চলনে বলনে স্মার্টনেস-এর কোন চিহ্নই ছিল না। জামা প্যান্ট ছিল খুবই মলিন, তাতে দারিদ্রের সুস্পষ্ট প্রতিফলন। খালি পায়ে স্কুলে আসতো। কোন মেয়ে এরকম একটা ছেলেকে তাঁর বিশেষ বন্ধু ভাববে? বা মনে মনে ভালোবাসবে? অথচ অন্যদিকে অনেক মেয়েকেই তাঁর ভালো লাগতো, তাদের মধ্যে একজনকে একটু বেশিই, একটু বিশেষভাবে। ক্লাসের আর কয়েকটা মেয়ের থেকে এতটা সুন্দরীও সে নয় কিন্তু সে একটু আলাদা প্রকৃতির। শান্ত-শিষ্ট-সুশ্রী সেই সহপাঠিনী-টির দিকে ছেলেটি শুধু ভ্যাবলা-কান্তের মতো চেয়ে থাকতো। নদীর ওপার থেকে কয়েকটা গ্রাম যেমন দিঘড়া, বালি, লক্ষ্মীপুর, গোয়ালসাড়া থেকে অনেক ছাত্র ছাত্রীর ভিড়ে ইস্কুলে আসতো মেয়েটি। কখনো নৌকায়, কখনো হাঁটুজল পেড়িয়ে। প্রবল বর্ষায় দ্বারকেশ্বর নদীর জলোচ্ছাস-এর সময় নৌকা পারাপার বন্ধ থাকলে সে স্কুলে আসতে পারতো না, ছেলেটির মন খারাপ লাগতো। কিন্তু শুধু ওই পর্যন্তই। ভাব করা দূর-অস্ত, কথা বলার সাহস পর্যন্ত ছিল না। তাই সরস্বতী পূজার দিন অন্য সব ছেলেরা যখন অন্য সব তথাকথিত সুন্দরী মেয়েদের পিছনে ঘুর-ঘুর করতো ছেলেটির মন তখন পড়ে থাকতো তার ভালোলাগার স্বপনচারিনীর দিকে। ”তারে বুঝিতে পারি নি। দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে॥” আমি যখন কলেজে তখনই একজন সুখী গৃহবধূ হয়ে নিজের সংসার ধর্ম পালন করছেন। সরস্বতী পূজার এই পবিত্র দিনে বিশ্বকবির ভাবনার সঙ্গে ছেলেটার ভাবনা অদ্ভুতভাবে মিল খুঁজে পায়:
“শুভক্ষণে কাছে ডাকিলে, লজ্জা আমার ঢাকিলে গো,
তোমারে সহজে পেরেছি বুঝিতে॥”
সরস্বতী পূজার তুরীয় আনন্দ দশম শ্রেণীতে। পরিচালনা কমিটির সমস্ত দায়িত্ব আমাদের। চাঁদা, ডোনেশন সংগ্রহ করা থেকে প্রতিমা বিসর্জনের তদারকি, ইংরেজিতে যাকে বলে এ টু জেড। আমাদের মধ্যে কেউ ম্যানেজার, কেউ ক্যাশিয়ার, কেউ বাজার সরকার, কেউ চাঁদা তোলা বা ভোগের ব্যাবস্থার দায়িত্বে। কিছু ছাত্র প্রতিমা আনবে। সব খুঁটি-নাটি দায়িত্ব আমরা দশম শ্রেণীর ছাত্ররা সুসম্পন্ন করেছিলাম কোন অভিজ্ঞাতা ছাড়াই। পুরাতন দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা তখন বিশেষ অতিথি, সামনেই তাঁদের মাধ্যমিক পরীক্ষা। তাদেরও সাদরে নিমন্ত্রণ করা হয়।
১৯৮২র ফেব্রুয়ারী মাসের সরস্বতী পূজার স্মৃতি আজও অমলিন। কিছু বিশেষ ঘটনার উল্লেখ না করলে স্কুলের সরস্বতীপূজার বিবরণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা এক’ডজন ছেলে পূজার আগের দিন স্কুলেই রাত্রিবাস করি। মূলত স্কুল পাহারা আর স্কুল জীবনের শেষে একটু বন্ধুদের সঙ্গে নির্ভেজাল আমোদ-ফুর্তি করা। এটা ছাত্রজীবনের এক চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। কয়েকটা উঠতি বয়সের ছেলেছোকরারা একসাথে অভিভাবকহীন রাত কাটালে যা হয়। শুধু অবিভাবক নয়, স্কুল শিক্ষকদের শাসনও অনুপস্থিত। একটু আড্ডা, একটু ফচকিমি, তারপর নানারকম উদ্ভট কথাবার্তা, শালীন-অশালীন আলোচনা। বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া উঠেছিল কিনা মনে নাই। আমাদের ব্যাচটা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো। দু-একটা আইসোলেট ঘটনা ছাড়া ব্যাচটার বেশ সুনাম। তবে লাগামহীন পরিবেশে এতজন ছাত্র একসাথে থাকলে অনেক সৃজনশীল চিন্তার উদ্ভব হয়। রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর, সারা গ্রাম গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তখন রামনগর অবিনাশ উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকটা উজ্জ্বল তারকার বিভাবরী জাগরণের পরিণতি কি হতে পারে? কয়েকজন প্রস্তাব দেয় , “চল একটু চুরি ডাকাতি করা যাক।” যেই বলা সেই কাজ।
চুরি ,ডাকাতি ও গোপীনাথবাবুর বাড়িতে হামলা।
মা কালীর তমোগুণী ভক্ত ডাকাতদের মতো, মা সরস্বতীর শুদ্ধ -সত্ত্ব কিশোর পড়ুয়াদের তখন রক্তে রজোগুণ টগবগ করছে। “আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত, আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।” ঠিক হলো অভিযান — “এসিসট্যান্ট হেডমাস্টার গোপীনাথবাবুর বাড়ি”। সরস্বতী মাকে প্রণাম করে, ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বাজারের ব্যাগ, থলে নিয়ে বের হলাম। একটু যেতেই স্কুলের কাছে রাস্তার উপর স্কুলের ক্লারিক্যাল অফিসার জগন্নাথবাবুর (মন্ডল) বাড়ি। বামার প্রস্তাবে উঁকি দিতেই অনেক ফসলে ভরা জগন্নাথবাবুর সাধের বাগান চোখে পড়লো। কাল বিলম্ব না করে হৃষ্ট-পুষ্ট বিলাতি বেগুন তুলে ব্যাগ ভর্তি করলাম। এরকম চুরি ডাকাতির অভিজ্ঞতা এই প্রথম। আবার শুরু হলো নৈশচারীর মতো আমাদের পরবর্তী পথ চলা। গোপীনাথবাবুর বাড়ি কাছাকাছি এসে সবাই একটু বেশি সতর্ক হলাম। চেনা জায়গা, কিন্তু বাগানে তেমন কিছুই চোখে পড়লো না। ইতি উতি দু-একটা ছড়ানো ছিটানো ছোট ছোট গাছের চারা ছাড়া আর কিছু নেই। একটু হতাশ, একটু বিমর্ষই হলাম। আর তখন হা-রে-রে-রে বলে ছোট ছোট গাছ গুলো উপড়ে ফেলে চোঁ চোঁ দৌড়। দূর থেকে যেন স্যারের গলা শুনলাম। আমাদের আর পায় কে! স্কুলে পৌঁছে তবে নিশ্চিন্ত। সবার বুক তখনও ধুক পুক করছে। স্কুলের স্পোর্টস কম্পিটিশনে আমরা অনেকেই কেউ একশো মিটার, কেউ পাঁচশো মিটার পর্যন্ত দৌড়েছি, কিন্তু এভাবে রাতের অন্ধকারে পড়ি মরি করে দৌড়ানো এই প্রথম। একটু থিতু হওয়ার পর চিন্তা হল, প্রথম উপার্জনের ফসল দিয়ে কি করা যায়? ফেলে দেওয়া ঠিক হবে না আবার সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করাও নিরাপদ নয়। ঠিক হলো রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমাদের স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির সর্বক্ষণের কর্মী সকলের প্রিয় জহর-দা কে তুলে আনতে হবে। এই রাতে বেগুনি ভাজা মন্দ হবে না। রাতজাগা ছাত্রদের জন্য এমনিতেই চা বেগুনির ব্যাবস্থা থাকত। কিন্তু চুরি করা বেগুনের উত্তেজনাই আলাদা। পূজার স্টক থেকে খানিকটা তেল আর বেসন নিয়ে সেই খোলা বেগুনি ভাজা হয়েছে কি না হয়েছে, তার গন্ধ শুঁকে শুঁকে জগন্নাথবাবু সেই শেষরাতের অন্ধকারেই স্কুলে এসে হাজির। এসেই প্রথম প্রশ্ন এত ভালো বেগুন তোরা কোথায় পেলি ? আমরা তোতলাতে থাকি, বলি বালির হাট থেকে এসেছে। তাতে আরো উত্তেজিত হয়ে উনি গলা চড়িয়ে সদর্পে কনফিডেন্স নিয়ে বলেন – “দেখ বামা, এ-তল্লাটে এরকম বেগুন আমার বাগান ছাড়া কোথাও পাবি না।” গন্ডগোলের মাঝে কখন গোপীনাথবাবুও এসে উপস্থিত হয়েছেন, কেউ টের পায় নি। স্যারের গলা শুনে সবাই চমকে উঠি। আসন্ন বিপদের জন্য প্রস্তুতি নিই। না, তেমন কিছু ঘটলো না। আমাদের বকা-বকি না করে উনি জগন্নাথবাবুকে সান্তনা দেন, “বুঝলি জগন্নাথ , ওরা তোর বাগান থেকে শুধুমাত্র দুটি বেগুন তুলে নিয়ে এসেছে, কিন্তু আমাদের বাগানের সব গাছ উপড়ে দিয়েছে। লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে এসেছে! ছেলেমানুষ, আজ তো ওদের-ই দিন। একটু দায়িত্ব জ্ঞানহীনের কাজ করে ফেলেছে।”
এরপরেও সরস্বতী পূজার সমস্ত কাজ আমরা সবাই মিলে দায়িত্ব সহকারে সুসম্পন্ন করেছিলাম। দেবীর আশীর্বাদও পেয়েছিলাম।
“সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে …“
এবার এগিয়ে আসি, ১৯৮৫ – ২০০৫ সালে।
সেদিন ১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ সাল। বসন্ত পঞ্চমী। কলকাতার বৈদিক আদর্শে পরিচালিত এক বিদ্যার্থী আশ্রম Calcutta Students’ Home এ আজ সরস্বতী পূজা। আশ্রমের বিদ্যার্থীরা আজ অনেক ব্যস্ততায় তাদের আরাধ্য দেবীর আরাধনার প্রস্তুতিতে নিজ নিজ দায়িত্বে নিয়োজিত। দেশবিদেশ থেকে প্রাক্তনীরাও আসতে শুরু করেছেন। কেউ বা আবার সপরিবারে। অর্ক এসেছে সুদূর সান ফ্রান্সিস্কো থেকে। মা ও বাবার সঙ্গে , হাতে খড়ি দিতে। বাবা এই ছাত্রাবাসেরই প্রাক্তনী। মা ও বাবার বিশেষ ইচ্ছা অর্ক শিক্ষা জীবনের শুরুটা যেন মা সরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য হয়ে দেবীর আসনতলে বসে পবিত্র পরিবেশে এই মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে এই বিদ্যার্থী আশ্রমের চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর কি হতে পারে? যেখানে অস্তি-ভাতি-প্রিয় , যেখানে উৎসবের মাঝে ডিভাইন মাতা বীণাপাণির উপাসনা হচ্ছে, সেকালে এই সুযোগ সবার ভাগ্যে হয় না।
তখন বেশ কয়েকজনের হাতে খড়ি দেওয়া হয়ে গেছে। বাবা হন্তদন্ত হয়ে স্থানীয় মনোহারি দোকান থেকে স্লেট পেন্সিল নিয়ে এসেছে। মায়ের কাছে বসে অর্ক পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছে। সামনে মা সরস্বতী নানান অলংকারে সুসজ্জিতা হয়ে শোভা পাচ্ছেন। কয়েক ডজন শিশু, উজ্জ্বল তারকার মতো উড্ডীয়মান ভবিষ্যৎ শিক্ষাবিদ, তাদের মা-বাবা, দাদা-দিদির সঙ্গে এসে জড়ো হয়েছেন এই বিদ্যার্থী আশ্রমে, বাড়ির ছোটজনের হাতে খড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তাদের আধো আধো কথা, দুষ্টু মিষ্টি চঞ্চলতা পরিবেশকে আরো বেশি উৎসব মুখর করে তুলছে। অপরিচিত স্থান, অজানা পরিবেশ অর্কর বেশ ভালোই লাগছে। বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী কচিকাচাদের আশীর্বাদ করার জন্যেই যেন আজ সাক্ষাৎ আবির্ভূতা হয়েছেন।
আশ্রমের সেক্রেটারি স্বামীজী তখন একের পর এক শিশুর হাতে পেন্সিল দিয়ে দীক্ষা দিচ্ছেন “অ লেখো, আ লেখো — বর্ণ পরিচয় করানোর পর ১, ২, ৩ থেকে ১০ পর্যন্ত সংখ্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। অনুষ্ঠানটা অর্কর বেশ লাগছে, সম বয়সের শিশুদের যেন মেলা বসেছে। অপেক্ষা করছে কখন ওর ডাক পড়বে। অপেক্ষার অবসান কয়েক মিনিটের মধ্যেই, যখন স্বামীজী অর্ককে কাছে ডেকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন – “এবার এক আমেরিকান স্টুডেন্টের হাতে খড়ি দেওয়া হবে।” অর্কর দুই হাতে দুটো সচন্দন গন্ধ পুষ্প দিয়ে দেবী প্রতিমার পায়ে নিবেদন করতে বলেন। অর্কর কপালে দেওয়া হল চন্দনের ফোঁটা। বাবার আনা স্লেট পেন্সিল মন্ত্র শুদ্ধি করে প্রতিমার পাদস্পর্শ্যে পুণ্য করার পর অর্ককে প্রণাম করতে বলেন।
প্রথাগতভাবে A B C D , 1 2 3 4 লেখানোর পর মহারাজ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকতার সঙ্গে আলফা, বিটা, ডেল্টা ও গামা চিহ্নের সঙ্গে পরিচয় করালেন। উৎসাহী জনতার মনোযোগ আকর্ষণ করে স্বামীজী যখন অর্কর হাতে ধরে ORACLE , SAN FRANCISCO ও অন্য সব ইংরেজি শব্দ-প্রতিশব্দ লেখাতে শুরু করেন তখন উপস্থিত দর্শনার্থী ও সমবেত বিদ্যার্থীদের মধ্যে হাসির রোল পরে যায়। হাতে খড়ির এই অভিনব পদ্ধতি সকলেই উপভোগ করেন। সকলে আরো একটা জিনিস লক্ষ্য করে যে অর্ক লেখার জন্য বাম হাতে পেন্সিল তুলে নেয়। মহারাজের সম্মতিতে সে বাম হাতেই হাতে খড়ি দেয়। তখন থেকেই বাঁ হাতে লিখতে লিখতে অর্ক আজ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি অবধি পৌঁছে গেছে। লেফটি হওয়া নাকি আমেরিকান লিডারশিপের সুলক্ষণ।
ছাত্রাবাসের এই সরস্বতী পূজা অর্কর বাবাকে স্মৃতির জালে টানতে টানতে টাইম মেশিনের মত কয়েক দশক অতীতে ফিরে নিয়ে যায়। চিত্রপট একই , সেই ছাত্রাবাসেরই সরস্বতী পূজা, ১৯৮৫ সাল। বাবা তখন নিজে বিদ্যার্থী, সাদা ধুতি, গেঞ্জি ও সাদা চাদরের মতো গায়ে উড়নি জড়ানো নিরীহ এক ছাত্র। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার্থী। মনে পড়ে যায় আশ্রমের পূজার রীতি, সব নীতিই। পুজোর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই কর্মযোগের লিস্ট বেরিয়েছে। কার কি দায়িত্ব সব ডিটেইলসে নোটিশ বোর্ডে টাঙানো হয়েছে। প্রায় এক’শো জনের মতো আশ্রমিক ছাত্রের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন নিখুঁত ভাবে করা হয়। জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ সব কাজ ছাত্রদেরকেই করতে হয়। ভোরে উঠে স্নান সেরে কারো দায়িত্ব ফুল তোলা , কারো কারো দায়িত্ব মালা গাঁথা, বা মঞ্চ সাজানো, প্রতিমা সাজানো, পূজার জোগাড়, পূজার কাজে সাহায্য করা, পূজা করা, ভোগের ব্যবস্থা করা, ভোগারতির পর নৈবেদ্য সামগ্রী মন্দিরে বহে নিয়ে যাওয়া, প্রসাদ ও লাঞ্চ পরিবেশন করা। আবার কিছু কিছু কাজ পূজার আগের দিন সেরে ফেলা, যেমন পূজার বাসন মাজা, মন্দির মোছা, রাঁধুনি ঠাকুরদের হাতে হাত মিলিয়ে কুটনো কাটা, রান্নার কাজে সহায়তা করা ও আরো অনেক অনেক কাজের দায়িত্ব ছাত্ররা পালন করে। কয়েক হাজার ছাত্র, প্রাক্তনী ও স্থানীয় দর্শনার্থীর জন্য খিঁচুড়ি ভোগের ব্যবস্থা করা হয়।
কবির কথায় “প্রসাদ লাগি কত লোকে আসে ধেয়ে।”
এবার আসি মার্কিন দেশে। সময় ১৯৯৭ সাল।
লোককথা অনুযায়ী আমেরিকার ম্যাডিশন শহরের মা সরস্বতী খুবই জাগ্রত দেবী। আমেরিকার উইসকনসিন স্টেটের একটা ছোট্ট ও সুদৃশ্য শহর এই ম্যাডিশন, ইউনিভার্সিটি টাউন নামেই বিশ্ববিখ্যাত। মা সরস্বতীর বরপুত্র ও আশীর্বাদধন্যা কন্যা-রত্নারা নিরলস সাধনায় এখানে সরস্বতী বন্দনা করেন। ল্যাবরেটরিতে নিরন্তর গবেষণা করে নিত্যনতুন আবিষ্কার করে চলেছেন। ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিনের বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন ফর্মুলা ও মেডিসিনের যুগান্তকারী পেটেণ্ট বের করে মানবজাতিকে সমৃদ্ধ করছেন। মা সরস্বতীর আশীর্বাদ এখানে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহমান।
এখানে বাঙালী বিজ্ঞানীদের অবদানও কম নয়। বিজ্ঞানী হরগোবিন্দ খুরানা এই ল্যাবরেটরিতে কাজ করেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। আজ তার চারপাশের ল্যাবরেটরিতে কাজ করে রণজিৎ-দা, জলি-দি ও হীরক বসু, শাস্বতী ও আরো অনেক নবীন ও প্রবীণ বিজ্ঞানী উচ্চমার্গের গবেষণা করছেন। এরকম প্রায় কুড়ি-পঁচিশটি বাঙালী পরিবারের একাত্মা সরস্বতী বন্দনায় মা স্বাভাবিক ভাবেই জাগ্রত থাকেন।
শিক্ষার পাশাপাশি ম্যাডিসনের উচ্চশিক্ষিত স্মৃতি ও ধৃতিমান বাঙালীরা সাহিত্য ও সংগীতে অনেকেই খুব পারদর্শী। বিবাহের পর নববধূকে নিয়ে আমাদের গার্হস্থ জীবনের শুরু এই ইউনিভার্সিটি শহর ম্যাডিসন সিটিতেই। কোন এক সূত্রে গবেষক অভিজিৎ দা ও সোনালী বৌদির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ওনারাই সঙ্গে করে আমাদের বাঙালী কমিউনিটিতে নিয়ে যান। অর্ধ শিক্ষিত (যেখানে সবাই ডক্টরেট কিংবা পোস্ট ডক্টরেট) এই নব দম্পতিকে সকলেই বিশেষ স্নেহ করতে শুরু করেন। দূর্গা পূজা ও অন্যান্য উৎসবের মতো সরস্বতী পূজাতেও অংশ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মা সরস্বতীর প্রতি দাদা-দিদি-বৌদিদের শ্রদ্ধা-ভক্তি ও নিষ্ঠা দেখে আমরা অভিভূত হই। বোধন, পূজা ও পুষ্পাঞ্জলি সেরে এক সারিতে বসে প্রসাদ পাওয়া ও দুপুরে প্রসাদী লাঞ্চ। সান্ধ্য সম্মেলনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছোট ছোট বাচ্ছাদের ট্যালেন্ট শো এর পাশাপাশি চলতো বড়দের কবিতা আবৃতি, নৃত্যকলা প্রদর্শন ও শ্রুতিমধুর সংগীতানুষ্ঠান। নিজেদের খুব ভাগ্যবান মনে হত।
একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি, প্রায় প্রতি সরস্বতী পূজার সময় এই ঘটনায় আমরা নিজেদের মধ্যে খুব হাসাহাসি করি। বড়দের প্রোগ্রামে সদ্য বিবাহিত গিন্নিকে একটা গান করার জন্য বলা হয়। উনি একটা জানা সরস্বতীর প্রার্থনা সংগীত বেছে নিয়ে বিশেষ ভাবে প্রাকটিস করেন। কিন্তু উদ্বোধনী সংগীতে মিনাদি ওই বিশেষ গানটা দিয়েই শুরু করেন। সারপ্রাইজড ও কিছুটা নার্ভাস হলেও, অন্য একটা গান দিয়ে সুদক্ষ ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয় সে। বিষ্ণুপুর ঘরানার শিক্ষাপ্রাপ্ত শিল্পীকে আপন করে নেয় ম্যাডিসনের বেঙ্গলি কালচারাল সোসাইটি।
এবারে আসি সান ফ্রান্সিস্কো সিলিকন ভ্যালির সরস্বতী পূজায়। সময়কাল ১৯৯৯ – ২০২২ সাল।
এই পূজা খুবই বৈচিত্রময়। এখানে ঠিক কত সরস্বতী পূজা হয় তা গুনে শেষ করা যায় না। এই ২০২২ সালেই দু-ডজনেরও বেশি বারোয়ারি দূর্গা পূজা হয়েছে। কয়েক হাজার মেম্বারশীপের মেগাপূজা যেমন প্রবাসী, সংস্কৃতি, পশ্চিমী, বেবাসী, প্রথমা, আগমনী প্রভৃতি সংস্থা ছাড়াও আরো অনেক বাঙালি গোষ্ঠী সরস্বতী পূজা করে থাকে। এছাড়াও TCS, CMC, TECHNA , RS SOFTWARE প্রভৃতি কলকাতার কোম্পানির লোকজনও নিজেদের গ্রুপের মধ্যে অনুষ্ঠান করে থাকেন। আর আছে পাড়ার পূজা, ছোট ছোট ফ্রেন্ড সার্কেলের পূজা। সিলিকন ভ্যালিতে বসে মা সরস্বতী তখন বেশ জমাটি আড্ডা বসান। ক্যালিফর্নিয়াতে এসে আমরা কয়েক বছর “প্রবাসীর সরস্বতী পূজা” দেখতে গিয়েছিলাম। পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার আগে থেকেই বিশাল সর্পিল খিঁচুড়ি ভোগের লাইন পড়তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একপেট খিদে নিয়েও ধৈর্য ধরে মায়ের ভোগের জন্য কয়েক শত বাঙালি লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেন। কোথাও কোনরকম বিশৃঙ্খলার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নাই। ঠাকুরের ভোগ হয় খুবই সুস্বাদু! বিকেলের দিকে প্রজেক্টরে পুরানো দিনের উত্তম-সুপ্রিয়া বা উত্তম-সুচিত্রার সাদা কালো সিনেমাও দেখানো হতো।
“বেবাসীর পূজা” আমাদের পাড়ার পূজা। প্রায় একশো পঞ্চাশটা বাঙালি পরিবার বেবাসীর স্থায়ী সদস্য। এই পূজায় একটু কলকাতার তথা বাংলার পূজার পুজো-পুজো গন্ধ পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে সদ্য আসা অনেক অল্প বয়স্ক ফ্যামিলিদেরই প্রাধান্য। বেবাসীর পূজার আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল ছোটদের ট্যালেন্ট শো, মহিলাদের নৃত্যগীতি ও বড়দের নাটক। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন খুদে খুদে আর্টিস্ট মঞ্চ আলোকিত করে। আমার পুত্র অর্ক প্রায় কয়েকবছর বেবাসীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটানা গিটার বাজিয়ে দর্শকদের বাহবা কুড়িয়েছে। ম্যাডিসন শহরের সরস্বতী পূজায় মিনাদি যে গানটি করে গিন্নিকে বিপাকে ফেলেছিলো, এখানেও একটা পাড়ার অনুষ্ঠানে সেই একইরকম ঘটনা ঘটে। যে গান প্রাকটিস করে অনুষ্ঠানে করবে ঠিক করে, কেউ না কেউ আগেই সেটা গেয়ে ফেলে। তাই এবার গান ছেড়ে সরাসরি সরস্বতী বন্দনা, “জয় জয় হে ভগবতী সুর ভারতী…”করে আত্মতৃপ্তি পায় উনি। অডিয়েন্সদের হাত-তালিতে অনুষ্ঠান মুখরিত হয়। যেন সত্য সত্যই অনুভূতি আসে …
“মধুর মধুর ধ্বনি বাজে হৃদয়কমলবনমাঝে॥”
স্বদেশ ও বিদেশের সরস্বতী পূজার তাৎপর্য সব দেশে সব কালে একই। বিদ্যা আহরণ ও বুদ্ধির বিকাশ।। এই পূজার উদ্দেশ্য বিদেশে বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির চর্চা করা, বিদেশে জন্ম ও বড় হওয়া প্রজন্মকে বাংলা ভাষা শেখানো, বাংলা কবিতা, সংগীত, শিল্পকলা সম্পর্কে অবহিত করা। পূজার নৈবেদ্য সব কিছু বিদেশে পাওয়া যায় না। ম্যাডিশনের পূরবী বৌদির কথায় , “নারকেল কুল নাই , গাঁধা ফুল নাই – শুধুই সরস্বতী পূজা !” গাঁধা ফুলের জায়গা নিয়েছে উন্নত প্রজাতির বিভিন্ন রঙের ও গন্ধের ক্যালিফর্নিয়া গোলাপ। নারকেল কুলের পরবির্তে ক্যালোফোর্নিয়ার সুস্বাদু এনভি আপেল। তার সঙ্গে অর্গানিক ব্যানানা, নারকেল নাড়ু , পিস্-পিস্ করে কাটা ক্যালোফোর্নিয়া অরেঞ্জ ও মোহন ভোগের লাড্ডু মায়ের নৈবেদ্য প্রসাদ। ”
বিদ্যা , বুদ্ধি ও মা সরস্বতী
বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আমাদের বিদ্যা প্রদান করেন ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটান। মা বিশালাক্ষ্মী পরা ও অপরা দুই বিদ্যাই দেন। অপরা বিদ্যা হলো বহির্জগতের বিদ্যা, যে বিদ্যার দ্বারা স্থূল জ্ঞান অর্জন করা যায়।পরা বিদ্যা অন্তর্মুখী বিদ্যা, যে বিদ্যা অন্তর জগতের অজ্ঞানতা দূর করে। মন-চিত্ত-অহংকার-বুদ্ধি আলোকিত করে অন্তর্জগতের তামসিকতা নাশ করে। সে বিদ্যাই আসল বিদ্যা যা পরাজ্ঞানের সন্ধান দেয়, নাহলে, শুধুমাত্র জাগতিক জ্ঞান মানুষকে জ্ঞানের উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে পারে না। তাই তো যুগে যুগে মনুষ্যজাতির জাতির প্রার্থনা : “অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মামৃতং গময়।”
শাস্ত্র মতে বুদ্ধির শ্রেণীবিন্যাস চার প্রকার — স্মৃতি , ধৃতি , মেধা ও ধী
শুধু মাত্র “স্মৃতি ও ধৃতি” — বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর শ্বেত ও শুভ্র বাহনের এই দুই ডানায় ভর করে শিক্ষার অতি উচ্চ স্তরে ওঠা যায়। আবার বুদ্ধির আর এক ধাপ “মেধা“ র উৎকর্ষ সাধনের জন্য দেবীর আশীর্বাদ প্রয়োজন। খুব কম ব্যক্তিই বীনাপানীর দুই হস্তের দুই মেধা ধারণ করতে সক্ষম হন। আবার মা যখন নিজের হাতে “জ্ঞানের রাশ ঠেলে দেন“ তখন “ধী” বুদ্ধির আধ্যাত্মিক স্পুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়। তখন মৃন্ময়ী মূর্তিতে চিন্ময়ী বীণাপাণির আবির্ভাব ঘটে।
“ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।।”
“এসো দেবী, এসো এ আলোকে, একবার তোরে হেরি চোখে–“
মায়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা:- আমরা যেন মেধাবী এবং বিদ্বান হতে পারি , শ্রুতিসম্মত তর্কে ও শ্রুতিবিরুদ্ধ মত-খণ্ডনে যেন পারদর্শী হতে পারি। এস , এবার সবাই মিলে মায়ের প্রণাম মন্ত্রে মা সরস্বতীকে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে প্রার্থনা জানাই : “বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।”
Add comment