সরস সত্যই নমো নমঃ
সুদীপ্ত চক্রবর্তী, ১৯৮২ স্থাপত্যবিদ্যা
অন্য দেবীরা আশ্রয়ের, মা সরস্বতী প্রশ্রয়ের।
এই যে শুভ্রাতিশুভ্রা কমলাসনা চতুর্ভুজা মরালবাহনা ঋচা, বাচি, স্বরাত্মিকা, যাঁর স্তুতি রয়েছে সেই আদি বেদে, যাঁকে আরাধনা করে শুধু হিন্দু নয় বহু জৈন আর বৌদ্ধরাও, তাঁকে আমরা বাঙ্গালীরা কিন্তু পেয়েছি যেন সেই উমা মায়ের মতন করেই, শ্রদ্ধায় কিন্তু আদরে, যেন কাছের মানুষ। অন্য সব দেবদেবীদের পূজায় থাকে এক গম্ভীর নিষ্ঠা, সেসব পূজা থাকে বড়দের হাতে, কিন্তু এই এক আছেন মা সরস্বতী যাঁর পুজো এন্ডিগেন্ডি বালখিল্যদেরও যেন সাধ্যের মধ্যে। সরস্বতী মা সব ভুলচুক মাফ করেন, তিনি বেশ উদার, ঠোঁটে থাকে এক চাপা হাসি যেন, হাতে সদাই বরাভয়। এমনকি শাস্ত্রে যাই বলুক, আমাদের মা সরস্বতী দ্বিভুজা হয়েই দেখা দেন।
সরস বতী বা সরস অতি ছাড়াও, সরস্বতী মায়ের নামের আরেক ব্যাখ্যা হল, নামটির মূলে নাকি আসলে সর অর্থে ‘সার’ এবং ‘স্ব’ অর্থে নিজ। যে দেবতার বরে নিজের সারটি জানা যায়, আত্মবোধ হয়, তিনিই সরস্বতী। বৈদিক কালের প্রাণদা নদী সরস্বতীর তীরেই গড়ে উঠেছিল সভ্যতা, তার বস্তুগত অস্তিত্ব আর বৌদ্ধিক সাংস্কৃতিক বিকাশের ধাত্রী এই নদীই। প্রথমে বলা হল, এই নদীই শুদ্ধকারিণী, ‘শুদ্ধকারী জলরাশি’, তার থেকে এল ‘যা কিছু শুদ্ধ করে’, তারপর এল ‘শুদ্ধকারী বাক্যরাশি’, তার থেকে এল এক ধারণা ‘শুদ্ধকারী জ্ঞান’ আর সবশেষে সেই ধারণা রূপ পরিগ্রহ করল এক দেবীর, তাঁর অঙ্গ শুভ্র, পরিধান শুক্ল, অলঙ্কার সর্ব শুভ্র, চারি হস্তে যথাক্রমে জ্ঞানসার পুস্তক, ধ্যানসার অক্ষমালা, ধৌতকারী পুণ্যসলিল আর সর্বার্থসাধক সৃষ্টিশীলতার উৎসারবিন্দু আনন্দিনী বীণা। তাঁর বাহন শ্বেতশুভ্র মরাল, কখনোবা শ্বেত চিত্রমেখলা অর্থাৎ ময়ূর। বেদে পুরাণে আগমে নিগমে সরস্বতী মাতার নানান উল্লেখ, এমনকি তাঁর দেখা মেলে নানা রূপে কিন্তু একই মূল পরিচয়ে, নানা ধর্মে পৃথিবীর নানা কোণে। আবার দেখি, মায়ের শাস্ত্র বর্ণিত রূপের নিখুঁত রূপায়ন কিন্তু পাওয়া মুশকিল। এমনকি সত্যিকারের সর্বশুক্লা সরস্বতী মূর্তির তো দেখা পাওয়াই ভার। তার মানে হল, কালে কালান্তরে আর স্থানভেদে জ্ঞানভেদে রুচিভেদে সরস্বতীর মূর্তি মানুষ আপন মনের মাধুরী মিশিয়েই গড়েছে পূজেছে। কিন্তু আজকের আলোচনা তাঁর সেই উৎস ইতিহাস কিম্বা আরাধনার চর্চার বিশদ নিয়ে নয়। গম্ভীর গবেষণার কেতায় নয়, আমাদের এই কথাবার্তা শুধু হালকা চালে আমাদের বাংলার উঠোনে সরস্বতী মায়ের আগমন জনিত আনন্দের কিছু সরস ব্রতী আলাপ। আবার তার বেশিটা পদ্যেই প্রকাশ পেতে চলেছে আজ। হয়তোবা অল্প কিছু কথা আক্ষেপেরও।
আমাদের শ্যামল সুনীল নরম সরম বাংলায় মা সরস্বতীকে আমরা ঘরের কাছের করে নিয়েছি। তাঁর উগ্রতা নেই, সংহারমূর্তি জানিনি, তাই কি ভয় পাইনি, কালে কালে আমাদের বোধে বুদ্ধিতে আবেগে মায়ের সেই মূল জ্ঞানদাত্রী ভাবনার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রেমদাত্রী রূপ। মা যেন সহাস্য প্রশ্রয়ে যৌবনকে বিকশিত উন্মীলিত ব্রীড়াবনত আবার ক্রীড়ারত দেখতেও ভালোবাসেন। মা যেন শুধু শুকনো জ্ঞানের মাস্টারণী নন, প্রাণরসের দিদিমণিও বটেন। মায়ের বীণা যেন শুধুমাত্র সর্বসংস্কৃতির গভীরনাদী প্রেরণা আর প্রতিভূই নয়, কৈশোর যৌবনের চপল লীলার চটুল নেপথ্যসঙ্গত ও বটেই!
খুব মনে আছে, একেবারে বেশ ছোটো বেলায় যখন হাপ্প্যান্ট বার বার নেবে নেবে যায় আর টেনে টেনে তুলি, লালাঝোলা দুধের গন্ধ ভূতের ভয় কিছুই যায়নি ভালো করে আর টাকাপয়সা কিছুই চিনি না প্রায়, তখনি আমাদের কিলিবিলি কিছু খোকা মিলে এক নাম দেয়া হল ‘বালক সঙ্ঘ’ আর বিছানার চাদর চেয়েচিন্তে এনে চাঁপা, জামরুল, সবেদা আর কলা গাছে চার খুঁট বেঁধে, বাগানে এক সরস্বতী পুজো নামিয়ে ফেললাম, সে কী উত্তেজনা সে কী উৎসাহ! সে পুজো আজ বড় আকার নিয়েছে একটানা হয়ে চলেছে আর আমরাও বুড়োর দলে নাম লিখিয়ে মায়ের থেকেই শেখা প্রশ্রয়ের চোখে শিশুপালের সেসব মাতামাতি উপভোগ করছি। তারপরে এলো সেই সাঙ্ঘাতিক কাল, উঠতি বয়েসের অঙ্কুর উদ্গমের চাপে ফাটোফাটো কৈশোর যৌবন। উঠতি দাড়ি, সদ্য শাড়ি আর গুরুজনেদের নজরদারি, এই তিন নিয়ে সেই রোমাঞ্চকর যুগ।
আমাদের কট্টর বরিশাল্লিয়া চাপা কিন্তু অনতিক্রম্য ঘোর নীতিবাদী পরিবার ছিল। তার উপরে খানদানি রিপিউজি ফেমিলি এপারে আইয়া আবার পায়ের তলে মাডি পাওনের যুদ্ধ তহন সাঙ্ঘাতিক চলতেয়াসে, হেয়ার মইদ্যে বাইল্য প্পেরেম আদি ধরা পরলে নরবলির সাক্ষাৎ সম্ভাবনা আসেলে। তা ছাড়া সেকালে ওই হতগরীব সমাজে কো-এডুকেশন নামক অপূর্ব সুবিধাও প্রাপ্ত আসেলে না। আবার বংশমইজ্জাদা, জাতপাতের আদিখ্যাতা, প্রাণে ধুকুরপুকুর ভয় এমনকি হাতখরচা নামক ফ্যাকড়া আদৌ নাজানা নাশোনা ইত্যাদি নানাবিধ কারণের জড়াপল্টায় ছাগপ্রেম নামক রোগটি আমাদের বংশের শিশুদের অধরাই থেকে যায়। তা বলে সে দ্রব্যের চাষ ত বড় সমাজে বন্ধ থাকে নাই। বসন্তের হাওয়া বড়ই নরম কিন্তু ততোধিক শক্তিশালী, নকীন্দরের নুয়ার বাসর ঘর ভেদেও সে হাজির হয়। সরস্বতী পুজোর মরসুম এলে পালে পালে আধদামড়ার পালে লাগত প্রেমের হাওয়া, হাওয়াই চপ্পলের সেই মালিকেরা নবযুবতীদের দৃষ্টি টানার মিষ্টি আয়োজনে কী যে কাতর ভাবে আতর মেখে নেবে পড়ত তা মনে করে আজ চিলতে হাসি চলে আসে বৃদ্ধ ঠোঁটের মুগ্ধ কোণায়।
সব ঠাকুর একদিকে আর দিকে তুমি
তোমার রাজ্য হল যৌবন ভূমি
শীত শীত শিউরায় সকালের হাওয়া
আড় চোখে চায় পেতে কার চোখ চাওয়া।
ল্যাপটপে ইমেল আর মব-এ এসেমেসে
অবোধ আকূতি গুলো কার এসে মেশে
আধো আধো অক্ষরে গদোগদো চ্যাট
প্র্যাকটিস পিচে দেখি প্রেম করে ব্যাট
চুড়িদার জিন্স আর টপ রেখে বাড়ি,
রাস্তায় বেরিয়েছে শাড়ি সারি সারি
স্কুটি জিজ্ঞেস করে নীল সাইকেলে
ওহে চক্কর কেটে কারো মন পেলে
চান করে টান করে বেঁধে নিয়ে চুল
বাসন্তী কতগুলো ফুল যায় স্কুল
মন চলে যায় তার পিছু পিছু হেঁটে
সেই ছোটবেলাকার ইশকুল গেটে
বড় হয়ে ছোট হয়ে গেছি মাগো ভারি
আর কি সে দিনগুলো ফিরে পেতে পারি
তবু যেই আজো শুনি বাগদেবী পুজো
মন বলে, সেই মন একবার খুঁজো………
কৈশোর পারায়ে আসে যৌবন, তার তাড়া আরো বেশী। ভয় কমে, টান বাড়ে, হাতে কিছু পয়সা আসে, চেহারায় স্থিতি, শেখা কিছু গীতি, সাজুগুজু সড়োগড়ো আর সিকনিপড়া ট্যাবা-গালের অবোধ বালিকারাও ততদিনে খরসুন্দরী হয়ে লাবণ্য বিকিরণে সদা তৎপর, তাদের লাস্যে বিভঙ্গে ভ্রূভঙ্গে আসঙ্গের আশা, তীব্র কটাক্ষে বজ্রপাতের জোশ আর সমবেত কলহাস্যে পাড়ে-ভাঙ্গা সাগরঢেউয়ের ফেনিল ফুর্তিময় কলতান। সবেমিলে উপরমালিকের পাতা সে এক জগতজোড়া ফাঁদবিশেষ। হাওয়া শিরশির করছে, ফুল তিরতির করে কাঁপছে, উড়ৈল পেরজাপতি তাতে এসে বসছে, মধু খাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে, শরীরে মনে এক আজব মাতন, কীযেন মহাসম্পদ আছে বুঝতে পারে না আর কী এক মহা ফাঁক রয়েছে ধরতে পারে না। ঠিক সেই সময়টিতেই নেমে আসেন অঘটনঘটনপটিয়সী মা সরস্বতী। তাঁরই বরে প্যান্ডেল বাঁধা হয় ঠাকুর আনা হয় রাত জেগে সাজানো হয় ফুলপাতা জোগাড় করতে হয় অঞ্জলি দিতে হয় আর আহা বাহা সেই সুবাদে অনেক নিয়ম নরম পড়ে সাময়িক, অনেক শাসন ঢিলা পড়ে দিন দুয়েক। সরস্বতী পুজো তো নয় সে যেন নয়া পীরিতের হালখাতা আরকি।
ভোরে উঠে চান থাকে ভোগে থাকে শাঁকালু বাসন্তী শাড়ি দেখে পায়জামা ভাবালু
আনকোরা কতো ছোঁড়া ট্রাই নেয় পীরিতে একটুকু ছোঁয়া লাগে ভিড়ে-ভরা সিঁড়িতে
হাতে হাতে দিতে দিতে বেলপাতা আর ফুল কালো হাতে শিউরায় চম্পক-আঙ্গুল
আধবোঁজা চোখে শোনে আধবোঝা মন্তোর মনে ভাবে, যদি পাই আনকোরা মন তোর
মেলামেশা কাছেঘেঁষা সন্ধ্যেয় ফাংশন কৈশোরে মনজুড়ে মদনের দংশন
এই নিয়ে পুজো, এই বাগ্দেবী-বন্দন এ ঠাকুর খুব ভালো, ভালোবাসে যৌবন
জয় জয় দেবী চরাচর সারে অঞ্জলি দিতে গিয়ে দ্যাখে আড়ে আড়ে
বীণা পুস্তক রঞ্জিত হস্তে সন্ধ্যেবেলায় যদি রাস্তায় আসতে
ভদ্রকাল্যই নমো নিত্যং উফ তাকে দেখে হোলো বিকলং চিত্তং
বেদ বেদাঙ্গ বেদান্ত একটু পাওয়া গেলে একান্ত
বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ বিদ্যাস্থানেই ভয়েব চ
সরস্বতী মহাভাগে একি ও যে মা ভাগে
হয়ে গেল অঞ্জলি এখানে কী করে বলি
নিলো না বাড়ানো গাঁদাফুল ফেলে রেখে বেচারা আকুল
গালে ফেলে কটা টোপাকুল পিঠে ফেলে গোছা খোলাচুল
মেয়েদের দলবল কলকল উচ্ছল চলে গেল নিজেদের নিয়ে মশগুল
সেই শোক সেই সুখ ফিরে ফিরে আসে
আজো বুড়ো দামড়ার খোয়াববিলাসে
বয়েস ছিলো কাঁচা বেঁচেছে বড়ো বাঁচা এমনও কখনো মনে আসে
প্রেমে হাতেখড়ি আর পীরিতের পড়াটা তুমি প্রশ্রয় দাও হাতে হাত ধরাটা
তাই বলি মা সরস্বতী
তুমি খুব ভালো আবার তুমি দুষ্টু অতি
তারো পরে আসে কলেজবেলা। সব লায়েক হয়ে যায় বাবুরা বিবিরা। প্রেমের সেই আদো-আদো গদো-গদো হালছাড়া তালহারা দিশাহীন ভাবটা অনেকটা চলে যায়, পছন্দ-অপছন্দের ছন্দ বদলায়, তবে সেই প্রাক-নোঙ্গর কালেও ছেলেদের সেই ক্যাবলা ভাবটা আর মেয়েদের সেই দলে ছলবলে একা লাজুক ভাবগুলি কাটেনা। আবার সেই মা সরস্বতীর দরবারেই দেখা হয় তাদের।
জয় জয় দেবী চরাচর সারে
যারা জিন্স পরে তারা বাসন্তী ও পারে
আমাদের আইপড আমাদের নেট
কাল মা তোমার কাছে সব মাথা হেঁট
আমাদের টিউশন আমাদের ক্লাস
কাল মা ভেবেছি চুলে গুঁজবো পলাশ
আমাদের বারমুডা পাঙ্ক ছাঁট চুল
জানি কালকের আগে খেতে নেই কুল
হলিউড বলিউড করি জল্পনা
কালকে সকালে উঠে দেবো আলপনা।
আমাদের ফেসবুক আমাদের স্কুটি
কালকে সকালে উঠে খালি পায়ে ছুটি
নেট গেট জয়েন্টে বুঁদ হয়ে আছি
কাল মা বসবো তোমার কাছাকাছি
কাল নেই কোচিঙের ভয়াল ভ্রূকূটি
ভোরে ওঠা উঠি তবে পড়া নেই, ছুটি।
বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে
মোবাইলে রিংটোন করে দেব আস্তে
ধুতি মুশকিল মাগো পায়জামা কুর্তা
মন্ত্র বুঝি না তবু লাগে কি মধুর তা
কোক বার্গার পিজা এইসব কিছুরই
ভক্ত হলেও কাল খাব শুধু খিচুড়ি
আপেলের ফালি আর চাল ডাল মাখা
চাহনি নরম করে চোখে চোখ রাখা
অঞ্জলিতে ফুলপাতা চোখ আসবে বুঁজে হাঁটু মুড়ে
আবহমান বসবে এসে আধুনিকের হৃদয় জুড়ে
ভদ্রকাল্যই নমো নিত্যং সরস্বত্যই নমো নমো
দেবনাগরী পুঁথির পাতায় মিলবে এসে এ ডটকম ও
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমস্তুতে
চিরকালীন আকুলতা বাসন্তী রং আঁচল ছুঁতে
এমনি করে বিদ্যা দেবী পার করে দাও মিলেনিয়াম
ল্যাপটপ সব তোমার পায়ে আমরা সবাই মিলে দিলাম………
এই রকম সব টানাটানি কানাকানি চেষ্টা চরিত্তির হতে হতেই পাখীরা মায়ের নরম চাউনির ছাউনির নীচে পরম আনন্দে জুটি বাঁধে, নীড় বানায়। ধীরে ধীরে আসে নতুন প্রজন্ম। এইবার আমরা কিন্তু দেখাই এক নতুন রূপ। মায়ের মতন স্নেহনরম নয়, আমরা মায়ের কথা ভুলে যাই, যে যে কোনো শিক্ষাতেই আনন্দ হল একমাত্র পন্থা, সৃষ্টিশীলতা শিখতে হবে আনন্দ উল্লাস করে, জোর করে নয়। কিন্তু আমরা জোর করে শিশুদের শেখাই আমাদের রচিত নতুন সরস্বতীস্তোত্রম।
আচমনঃ লক্লক্ হোমাগ্নি উঠছে সন্তান আহুতি দিবি আয়
দেড় বছর বয়েস হলেই স্কুলে স্কুলে ফর্ম পাওয়া যায়
ধ্যানঃ লালনীল বেঞ্চি আছে আছে মিস্ ম্যাজিক-দেবতা
ইংরেজী ধমকে বাচ্চা ভোলে সব হারাবার ব্যথা
অ্যাই অ্যাই থামো থামো জন্ম দিতে উদ্যত দম্পতি
স্কুলের হিসেবে জন্ম চাই, তা নইলে নানাবিধ ক্ষতি
আবাহনঃ বয়েস লুকানো চোথা কোথা পাই বলে দাও গুরু
জন্মেই মৃত্যুর বার্তা মিথ্যা মন্ত্রে আবাহন শুরু
স্কুল থেকে ফেরে চাইল্ড পেরেন্টের কি আহ্লাদ হয়
মাকে বলে সিলি গার্ল বাবাকে বলেছে নটি বয়
বইখাতা ব্যাগছাতা হয়ে ওঠো রঙিন রঙিন
হোকনা ধূসর মন মাসিপিসি রূপকথা হীন
সঙ্কল্পঃ সমুচ্চ সফল হবে বিশারদ সর্ববিদ্যাবতী
মানুষ না হোক হবে সুবিখ্যাত আমার সন্ততি
সুখ দিতে চাই বলে দুঃখ দিই যতো যতো পারি
সহিংস নিষ্ঠুর হাতে শৈশবের সরলতা কাড়ি
শিক্ষা প্রয়োজন নেই করে তুলি ভীষণ পন্ডিত
প্রতিবেশী হেরে যাক তবেই না আমাদের জিত
এবার অঞ্জলি দিনঃ কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি তোমার সাথে আমার আড়ি
ব্ল্যাক শীপেরাই বন্ধু আমার জেনো
পাপা যখন ট্যুওরে যাবে ফ্লাইটে যত ক্যান্ডি পাবে
সেইগুলো আর ফরেন কমিক এনো
দক্ষিণাঃ বিপন্ন অরণ্য কাঁদো মুছে যাক আকাশের নীল
আসুন সহর্ষে দেখি সাফল্যের ভারবাহী শিশুর মিছিল
বহু সাফল্যমন্ডিত মানুষের বাড়ি দেখেছি ছাত্রবন্ধু আর মেডঈজির পাহাড় কিন্তু সাহিত্যের বই একখানিরও প্রবেশ নিষেধ, খপরকাগজটাও রাখা হয়না পাছে সন্তানের সাধনায় বিঘ্ন ঘটে।
সরস্বতী মায়ের মুখখানি কি আমাদের কান্ডকারখানা দেখে কিছুবা ম্লান হয়ে যায়? জানিনা বুঝিনা দেখার আর সময় ও থাকেনা। আমাদের সন্তানেরা তখন এগিয়ে চলেছে আরো আরো উচ্চাশার বোঝা মাথায় নিয়ে আরো আরো উঁচু উঁচু সব লক্ষ্যের পানে।
ওং সরস্বত্যই নমো নিত্যং অন্যের ভালো দেখে বিকলং চিত্তং
ভদ্রকাল্যৈ নমো নমো অন্যের জৌলুষ কমো কমো
সরস্বতী সরস্বতী হয়ে গেল বড়ই ক্ষতি লেখাপড়ার বদলে হায় করে পড়াশোনা
সরস্বতী সরস্বতী নিভে গেল চোখের জ্যোতি পড়াশোনায় পাইনা খেতে হাড় গুলো যায় গোনা
সরস্বতী সরস্বতী মা তুমি দয়ালু অতি দয়া করো সন্তান আমার করবে লেখাপড়া
নিবাস যে তার হবে কোটা তিনটে বছর খাটবে গোটা এই প্রতিজ্ঞা পড়শীর চোখ করব ছানাবড়া
বর দিও মা না হয় যেন মানুষ সন্তান আমার হতেই হবে সফল ধনী মানী এবং অহং দিয়ে গড়া
দূর করেছি বাড়ি থেকে পড়াশোনা এখন থেকে কেবল লেখাপড়া মাগো কেবল লেখাপড়া
যাই হোক আমাদের যে সরস্বতীপুজো শুরু হয়েছিল অবোধকালে চাঁপা গাছে চাদর বেঁধে, আজ এই বৃদ্ধ বয়েসে (আজো অবোধ) প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে নিজ নিবাসে বিনীত আয়োজনে স্বজনসমাগমে সে আরাধনা ধারাবান রয়েছে। যাবার আগে আবার ভাবি মনে মনে, মা সরস্বতীর গরিমা মহিমা তাৎপর্য ঔদার্য । তিনি যে শুধু তথ্যের নন বিদ্যার, বিদ্যার পরে বুদ্ধির, বুদ্ধির পরে জ্ঞানের, জ্ঞানের পরে বোধের, বোধের পরে বোধির, বোধির পরে চেতনার, তারও পরে কোন অবাঙমনসোগোচর বিশ্বচেতনার, সেসব ভাবি। তিনি যে শুধু পেশাদারি কেতাবী বিদ্যার নন, সকল রকম সৃজন, সুভাবনা, কলা, শিল্প সঙ্গীত নাটক নৃত্যগীতবাদ্যের অধিষ্ঠাত্রী, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শুধু বিদ্যা আহরণের নন বিদ্যা দানেরও দেবী, অর্থাৎ শিক্ষকদেরও মা, তাও ভাবি। তিনি শুধু হাতেখড়ি থেকে ডক্টরেটের দেবী নন, তিনি স্নেহের প্রেমের সহানুভূতিরও দেবী। এখন বেলা গেছে আর শেখার কাল নেই তাও ভাবতাম, আবার ভাবলাম সেই মহামানবের কথা, ‘যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি’, তাই রয়ে গেলাম মা সরস্বতীর অযোগ্য অপোগন্ড একলব্য চেলা।
মায়ের পুজো করি ঠাকুরদার শত বছর পুরাতন সনাতন ‘বৃহৎ পুরোহিত দর্পণ ও নিত্যকর্ম পদ্ধতি’ অনুযায়ী, কিন্তু প্রতি বছর কিছু কিছু নতুন নতুন নিবেদন তাতে যোগ করি, যেমন তিব্বতী তন্ত্রের সরস্বতি বন্দনার কয়েক শ্লোক, জাপানী বিদ্যাদেবীর উদ্দেশে কিছু হাইকু, দক্ষিণ ভারতীয় রীতির সরস্বতী মন্ত্র, বাল্মিকী প্রতিভার গান, ভারতচন্দ্রের লেখা সরস্বতী আবাহন, আর নিজের মনের প্রাণের আকুল ডাক তো থাকেই, মা মা আমায় তোমার পাঠশালাতে এখনও ভর্তি নাও মা। আর কী সব সুন্দর সরস্বতীবন্দনা রয়েছে কত প্রতিভাধর ভক্তের লেখা সেসব যুগ যুগ ব্যেপে। অপরূপ সেই সব বন্দনের কিছু বর্ণনা কিছু পূজা কিছু আবাহন কিছু ধ্যান কিছু প্রার্থনা কিছু স্তুতি কিছু স্তোত্র। হ্রীঁ হ্রীঁ হৃদ্যেকবীজে শশিরুচি কমলাকল্পবিস্পষ্টশোভে ইত্যাদি, বা ওঁ যা কুন্দেন্দুতুষারহারধবলা যা শ্বেতপদ্মাসনা ইত্যাদি, যেমন দেবী, তাঁর তেমনি সুন্দর কাব্যকবিত্বময় সব আরাধনা মন্ত্র। আলোচনা করলে দেখা যাবে, দেবীমন্ত্রে একজায়গায় ‘কামরূপিনী’ শব্দটি আছে। তা কি ওই বসন্তের মাতাল হাওয়ায় ভেসে যাওয়া ফুলের পরাগের পরাগমিলনের আর মানবযৌবনের মিলনবাসনার কাম, না কি সে বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান শিল্পের একান্ত কামনা। আবার, সরস্বতীপূজার সুবিখ্যাত মন্ত্র ‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে………এই পর্যন্ত এসেই মনে হয়, এ মায়ের মন্ত্র নয়, এ কোনো মুগ্ধ কবির দেবীদেহ সৌকর্যের বর্ণন মাত্র। সেকালে মানুষের তথা দেবী দেবতাদের শারীরিক সুন্দরতার বিস্তারিত বয়ান কথন ব্যাখ্যান একেবারেই স্বাভাবিক ছিল, নিষ্পাপ মনে করা হত। যাই হোক এই শ্লোকের শেষে ‘দেবী নমস্তে’ আছে বটে। ভক্তিনম্র বন্দনস্তব আর রূপমুগ্ধ সৌষ্ঠবকীর্তনের মধ্যেকার সীমারেখা ছিল বড়ো ঝাপসা। একালেও পড়েছি নীললোহিতের লেখায় কৈশোরকালে অসমাপ্ত সরস্বতীমূর্তিকে আলিঙ্গন করার ঘটনা, সে লেখার সামাজিক অভিঘাতও দেখেছি। এ আলোচনার অন্ত নাইকো, তা অন্ত তো করা দরকার, কবি ভারতচন্দ্রের মাতৃ-আবাহন উল্লেখ করে শেষ করা যাক।
উর দেবী সরস্বতী স্তবে কর অনুমতি বাগীশ্বরী বাক্যবিনোদিনী
শ্বেত বর্ণ শ্বেত বাস শ্বেত বীণা শ্বেত হাস শ্বেতসরসিজনিবাসিনী
বেদ বিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র বেণু বীণা আদি যন্ত্র নৃত্য গীত বাদ্যের ঈশ্বরী
গন্ধর্ব অপ্সরা গন সেবা করে অনুক্ষণ ঋষি মুনি কিন্নর কিন্নরি
আগমের নানা গ্রন্থ আরো যত গুণপন্থ চারিবেদ আঠার পুরাণ
ব্যাস বাল্মীকাদি যত কবি সেবে অবিরত তুমি দেবী প্রকৃতিপ্রধান
ছত্রিশ রাগিনী মেলে ছয় রাগ সদা খেলে অনুরাগ সেসব রাগিনী
সপ্ত স্বর তিন গ্রাম মূর্ছনা একুশ নাম শ্রুতি-কলা সতত সঙ্গিনী
তান মান বাদ্য ভাল নৃত্য গীত ক্রিয়া কাল তোমা হইতে সকল নির্ণয়
যে আছে ভুবন ও তিনে তোমার করুণা বিনে কাহার শকতি কথা কয়
তুমি নাহি চাহ যারে সবে মূর্খ বলে তারে ধিক ধিক তাহার জীবন
তোমার করুণা যারে সবে ধন্য বলে তারে গুণীগণে তাহার গণন
দয়া কর মহামায়া দেহ মোরে পদচ্ছায়া পূর্ণ কর নূতন মঙ্গল
আসরে আসিয়া উর নায়কের আশা পূর দূর করো অজ্ঞান সকল…।
Add comment