সরস্বতী পুজোয় দুগ্গা নাম
সঞ্জয় বসু, ১৯৮৪ আর্কিটেকচার ও প্ল্যানিং
সে অনেক দিন আগের কথা।
তখন মনে গান ছিল। প্রাণে প্রেম ছিল। পেটে ক্ষিদে ছিল। চলনে ছন্দ ছিল।
দাঁতে পোকা ছিল না। হাঁটুতে ব্যাথা ছিল না। রক্তে চাপ ছিল না। চোখে চশমা ছিল না।
খাওয়াদাওয়ার হিসাব হতো খুব। চাওয়া না পাওয়ার হিসাব হতো না একেবারেই।
সেই সময়ের কথা।
সরস্বতী পুজোর কয়েক দিন আগে বন্ধুরা ক্যান্টিনে বসে আলাপ জমিয়েছি, জিলিপি সিঙ্গাড়া সহযোগে। বিদায়ী শীতের আমেজ। তার ওপর নিজেদের বিদায়ী দিন প্রায় আগত। সহপাঠীদের যেন আরো আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয় এই সময়।
কথা হচ্ছিল, সরস্বতী পুজোর দিন কি করা যায়? চল সবাই ঘুরে আসি। হুজুগে লোকজন, এক কথায় অনেকেই রাজি। অনেকে আবার কি? ওই তো এগারোজনের আরকিটেকচার ক্লাস। লোকেরা বলে আর্কি। ঠাট্টা করে বলতাম
– আর কি? একে একে এগারো!
কারো কারো বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয় প্রতি বছর। তারা খসে গেলো। একজন মেয়ে বিদেশিনী। এমনিতে বেড়াতে ভালো বাসলেও সে এলো না। মাসের কোন সময়ে যে মেয়েরা বেড়াতে ভালো বাসবে, কখন বাসবে না, তখন বুঝি নি, এখনও বুঝি না। হয়তবা সে অন্য কারো বাড়ির পুজোয় গিয়ে থাকবে।
যাই, হোক, জনা পাঁচেক সেদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম ডায়মন্ড হারবারের পথে, ধর্মতলায় বাস বদলি করে। চারটে ছেলে, একজন সহপাঠিনী।
পুজোর দিনে পুজো না করে বেড়াতে যাচ্ছি। অপরাধী মন ডানে বাঁয়ে মণ্ডপ খোঁজে। তখনও সরস্বতী এত জনপ্রিয় বারোয়ারী দেবী হয়ে ওঠেন নি।
বাসে যেতে যেতে যে দু একটা পুজোর মণ্ডপ চোখে পড়ল, মাথা ঝুঁকিয়ে তর্জনীটা কপালে আর নাকে বার দুই ঠেকিয়ে প্রণামের দায়িত্ত্ব সারলাম। ভাবখানা এই, যে, ফাইনাল ইয়ার তো প্রায় মেরেই এনেছি, দেবী রাগ করলেও, কলেজের কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পাস করিয়ে দেবে! তবুও, মায়ের মান রক্ষার্থে, নাকে কপালে অঙ্গুলি সঞ্চালন, এই আরকি?!
আর্কির ছেলেমেয়ে, কত আর ভাল হবে?
একজনের বাড়ি জোকার দিকে। ডায়মন্ড হারবার তার খুব চেনা। নৌকো ভাড়া করে নদীতে সফর করার বুদ্ধি সেইই দিলে। বড় নৌকো। চড়ে পড়লাম সকলে। মাঝ নদীতে নিয়ে নৌকো বাইতে লাগলো দুই মাঝি। বুড়ো মাঝি, ছাগল দাড়ি, গোঁফ কামানো, হাল ধরে বসে বিড়ি ফুঁকতে লাগলো।
পরিষ্কার আকাশের নিচে নৌকোর পাটাতনে বসে গল্প করতে করতে বেশ গরম লাগতে লাগলো। আমি এমনিতে শীতের দিনে জল সংরক্ষন করার চেষ্টা করি, স্নান না করে। কিন্তু সেদিন নদীর মাঝে চান করার বাসনাটা ভীষন প্রবল হোলো।
সাঁতার জানতাম না। তবে দুটো বুদবুদ তুলে একেবারে ডুবে যাবার আগে, পনের সেকেন্ড মত একপেট নোংরা জল খেয়ে খাবি খেতে শিখেছিলাম হেদুয়ার পুকুরে। সঙ্গে মা-মা বলে চেঁচাতেও পারতাম হয়ত! যদিও সেটা হেদুয়ার বুক জলে পরখ হয় নি। কেউ বাঁচাতে চাইলে, ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় পেত বোধহয়।
সবাই মানা করলে বটে, কানে নিলাম না। প্রাণের ভয় আমার কোনোকালেই বিশেষ নেই। কোন অর্বাচীনেরই বা থেকে? ‘বেঁচে থেকেই বা কি বেশি করছি?’ মনের ভাবটা এই! তবে, বন্ধুদের মধ্যে আমাকে কে বাঁচাতে পারে, বা আদপে বাঁচাতে চাইতে পারে, সে বিষয়ে আমার একটা সংশয় ছিল বটে। কারন, হাসাহাসির পিছনে রেষারেষির অভাব ছিল না।
বাঁচাতে পারত বটে একজন। সে আমাদের এই সহপাঠিনী। উদার মনের মানুষ। খোলা গঙ্গায় সাঁতার শিখেছে সে। ডাগর ডাগর চোখ! প্রায় হাঁটু অব্দি লম্বা মোটা বেনী! সুঠাম ফর্সা চেহারা।
হালকা ছিটের সাদা পাড় বিহীন ছাপা শাড়িতেই দেখেছি তাকে শুরু থেকে। সময়ে অসময়ে সুমিষ্ট গলায় বড় বড় রবীন্দ্রনাথের কবিতা গড়গড় করে আবৃত্তি করে যায় অবিরত। ক্লাসে মন কম, জানলার বাইরে তাকায় বেশি। দৃষ্টিতে সদাই যেন একটা ‘হারিয়ে গেছি আমি’ ভাব। সরস্বতীর দেবীর সাধিকা মনে হত আমার। আমায় বিশেষ পাত্তা দিত না কোনোকালেই। আমি তো ছার, ভাল ভাল ডিপার্টমেন্টে পড়া লাল্টু ছেলেরাই পাত্তা পেত না তার কাছে! তাই জন্যেই, আমার মনে ক্ষোভ ছিল না।
এ হেন নারী আমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করলেও করতে পারে, ভেবেই গা টা এতো গরম হলো, যে নির্দ্বিধায় নৌকোর হালের কাছে শেকল ধরে জলে নেমে গেলাম, জামা কাপড়টা কায়দা করে খুলে রেখে, জাঙ্গিয়া সম্বল করে। কারো কথা শুনলাম না। তিনি ইচ্ছে করে অন্যদিকে তাকিয়ে কবিতায় আওড়ানোয় মশগুল রইলেন।
কাঁধ অবদি জলে ডুবিয়ে নৌকোর সাথে ভেসে চললাম আমি। জীবনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত!
ভালই কাটছিল সময়। ভাটার টানে কুলকুল করে ঠান্ডা জলের স্রোত শরীরের চারপাশে বয়ে যেতে, ভারী আনন্দ হচ্ছিল। খরস্রোতা জলে নামার সুযোগ আসেনি আগে। কতক্ষন কেটেছে খেয়াল নেই। জলের মধ্যে থেকে মুখ তুলে দেখলে, বড় নৌকার পাটাতনে বসা সাথীদের কাউকে দেখা যায় না। তারাও আমার ব্যাপারে ভুলে গিয়ে থাকবে।
জলের স্রোতে ঢিলে জাঙ্গিয়াটা জায়গা থেকে সরে গিয়ে বেশ কিছুটা নেমে যাওয়ায়, জলের মধ্যেই এক হাত চালিয়ে সেটাকে স্বস্থানে আনার চেষ্টা করতে লাগলাম। সোজা কাজ নয়। অন্যহাত দিয়ে শেকল ধরা রইল। নয়ত ভেসে যেতাম। ভাবলাম কেউ টের পেল না আমি কি করছি।
হাল ধরে বসা বুড়ো মাঝির চোখ এড়ায়নি ব্যাপারটা। মুখ থেকে বিড়ি সরিয়ে, দাড়ি নাড়িয়ে একটু চিন্তিত হয়ে বললে,
– এ জলে কামট আছে, বুইলেন? টুক করে কেটে নিয়ে যাবে, টেরও পাবেন নি! জেবনটাই ব্রেথা!
প্রথমে বুঝতে না পারলেও, এক মুহুর্ত পরেই মানেটা মগজে ধাক্কা মারল। তাই তড়াক করে জল থেকে উঠে এলাম সেই অবস্থাতেই! কাটা যাবার ব্যাথা একটু হলেও জানে বুড়ো! জীবন গেলে চিন্তা নেই, অঙ্গ গেলে জীবনটাই বৃথা কিনা?
শোরগোল শুনে বন্ধুরা সবাই ঘুরে তাকালো। তিনিও। আমার অবস্থা দেখে বিষম খেয়ে তাঁর কবিতা থেমে গেল মাঝপথে। আমি বুড়ো মাঝির কাঁধের তেলচিটে গামছাটা আচমকা টেনে নিয়ে আব্রু সামলালাম! বন্ধুরা হাসিতে ফেটে পড়ল একসাথে।
নদী সফরের বাকি সময়টা নৌকোর পাটাতনে বসে কামটের দাঁতে অঙ্গ কাটা যাওয়ার চিন্তায় শিউরে শিউরে উঠতে লাগলাম। সেকালে রেলের টিকিট কাটতে গেলে, পুং আর স্ত্রী, এই দুটো লিঙ্গই থাকত, আজকের দিনের মতো তিনটে থাকত না। ব্যাপারটা নিয়ে বেশ একটা ভয়মেশানো অনিশ্চয়তা ছিল সকলের মনে।
সেদিন কলেজে ফেরার পথে আর সরস্বতী দেবীকে ডাকতে পারি নি। জড়সড় হয়ে তাঁর মাকে বার বার স্মরণ করে ধন্যবাদ দিয়ে জপতে লাগলাম, “দুগ্গা, দুগ্গা, দুগ্গা”। বিদ্যা দিয়ে কি হবে, যদি মুখ্য অঙ্গই চলে যায়? ভক্তির পারা একলাফে চড়ে গেল একেবারে তুঙ্গে !
অনেক বছর কেটে গেছে। সেই তেনার সঙ্গে সুদীর্ঘ কাল ঘর করে দুই সন্তানের গর্বিত জনক আমি। ভাগ্যিস সরস্বতী পুজোর সেই দিন দূর্গাদেবী রক্ষা করেছিলেন! নয়ত কোথায় পেতাম তাঁকে, কিকরে জন্মাত অপত্য স্নেহ?!
তাঁর রবীন্দ্র-কবিতার স্রোত থামেনি এখনও। আমার সেই সরস্বতী পুজোর দিনটার কথা আজও মনে পড়ে, তিনি সেদিনের সেই কবিতাটা আউড়ালেই –
“তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা। ”
বিহঙ্গ মানে পাখি, সেটা জানতাম। কামট মানে যে হাঙর, সেটা জেনেছি অনেক পরে।
Add comment